জাতশুমারি, জাত, ধর্ম, এবং জনজাতিভিত্তিক শুমারি যে কত কার্যকরী এবং প্রয়োজনীয় তা এখন এতটাই স্পষ্ট যে বিষয় বিতর্কটাই মুহূর্তে বদলে গেলো। কেন্দ্রের উচ্চবর্গীয় সাবর্ণ/সবর্ণ প্রশ্রয়দায়ী সরকার কেন যে এর বিরোধিতা করছিলো তা একেবারে স্পষ্ট। সরকার কেন্দ্রে আসার পর তারা একটিও জনশুমারি করে নি। তার আগের জনশুমারিতে যাবতীয় তথ্য একটা পরিবার থেকে তোলা হতো, নথিবদ্ধ হতো এবং প্রয়োজন মতো তা বিভিন্ন প্রশ্নে এবং বিতর্কে ব্যৱহৃত হতো। ২০০১ এবং ২০১১ তে শিক্ষকদের দিয়ে শুমারি করা হয়েছিল, তাঁদের তথ্য সংগ্রহ অনেকখানিই কার্যকরী হয়েছিল। বিজেপি সরকারের আমলে সব বন্ধ করা হলো, অদ্ভুত সব কারণ দেখিয়ে। বিহার সরকার এক বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে একটা রিপোর্ট বানালেন, তাতে চমকপ্রদ সব তথ্য উঠে এলো। প্রথমত: প্রমাণিত হলো মুসলমান এবং হিন্দুদের আনুপাতিক সংখ্যা এবং "বৃদ্ধির হার" একেবারে ১ শতাংশও বাড়ে বা কমে নি। মুসলমানরা অনেক বেশি বিবাহ করে আর বেশি সন্তানের জন্ম দেয় তা ভুল প্রমাণিত হলো। প্রচুর পরিমানে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী মুসলমানদের প্রবেশ আর অভিবাসন বেড়ে গেছে পার্শবর্তী দেশগুলো থেকে, তাও ভুল প্রমাণিত হলো. আদিবাসী এবং জনজাতি, যাদের তফসিলী উপজাতি বলা হয় তাদের সংখ্যা বেড়ে গেছে মায়ানমার, নেপাল, ভুটান থেকে বা চীন থেকে অরুণাচল এর পথ দিয়ে বা লাদাখ ধরে দেশেই বেড়ে গেছে বা বড়ো শহরগুলোতে তার সমগ্র দেশের প্রেক্ষিতে তার কোনো প্রমাণ মেলে নি (মিলবে কি করে, গণনাই তো হয় নি, অথচ নিরন্তর বলে যাওয়া হলো, আইনসভাগুলোতে বিবৃতি পর্যন্ত দেওয়া হয়ে গেলো) বিহারে তো তার প্রভাব পড়ার কথাই নয়, অথচ নেপাল, ভুটান থেকে নাকি প্রচুর মানুষ ঢুকে চলেছে বলে উচ্চস্বরে আওয়াজ তোলা চলছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এক উল্টো সংরক্ষণ হয়ে চলেছে, ভারী মাত্রায় কিন্তু প্রচার আর সম্প্রচারের ঢক্কানিনাদ সুর ছড়িয়েই চলেছে ক্রমবর্ধমান ত্বরণ গতিতে যে "সর্বসাধারণের" জন্যে "মুক্ত" সুযোগগুলোকে ক্রমশ সংকুচিত করা হচ্ছে, দেখা গেলো ঠিক উল্টোটা। রাহুল গান্ধী দেখালেন যে দেশ চালায় যে ৯০ জন অমাত্য আমলা এবং সামরিক উচ্চকোটি প্রশাসকরা তাদের মধ্যে নাকি মাত্র ৩ জন পিছিয়ে থাকা বর্গভুক্ত, এদের মধ্যে আবার "অবনত বর্গ" এবং আর্থিক ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ একজনও নেই। এই অংশটা আরো বেশি করে নিশ্চিত করা হয়, চাকরির সময়ে ইন্টারভিউতে যখন সরাসরি প্রশ্ন করা হয় যে পরিবারে কেউ আমলা বা পুলিশ বা সামরিক বাহিনী "সরকারি সেবামূলক চাকরিতে যুক্ত ছিলেন বা আছেন কিনা ? অর্থাৎ সেই মুহূর্ত থেকেই এক oligarchy বা গোষ্ঠীআধিপত্যের শর্ত কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়ে যায়, অর্থাৎ ছকভাঙার সমস্ত সম্ভাবনাকে রুখে দেওয়া হয়। বিহারের হিসেবে অনুযায়ী মাত্র ৩.৬ শতাংশ ব্রাহ্মণ ৮০ শতাংশ পদ দখল করে থাকে। ১৫ শতাংশ সবর্ণ বা সাবর্ণ মানুষ ৮৫ শতাংশ পদ দখল করে আছে। অথচ ৮৫ শতাংশ পশ্চাদপদ মানুষ সরকারি চাকরির ভাগিদারী পাওয়া উচিৎ। এমন কি সরকারি চাকরির নিচের দিকের কাজগুলোও কিন্তু সবর্ণরা ছিনিয়ে নেয়। কারণ সরকারি চাকরির লোভনীয় দিক হলো পেনশন এবং অবসরকালীন অন্যান্য সুযোগসুবিধা (অবশ্য সরকার এখন সামরিক বাহিনী থেকে সমস্ত প্রশাসনিক পদ গুলোতেও "পরামর্শদাতা" নিয়োগ করবে বলে মুগুর ভাঁজছে , ঠিক একেবারে মার্কিনি কায়দায়) অর্থাৎ একবার যদি পেনশন, গ্রাচুইটি এবং deferred wage কে সরিয়ে রাখা যায়, তাহলে বীমার যাবতীয় দায়িত্ব কর্মচারীর হবে, সরকারের কোনো দায় থাকবে না। এই অর্থনৈতিক প্রতিশ্রূতি খেলাপ সবার জন্যেই হবে, কিন্তু যে দেশে পশ্চাদপদ বর্গের কোনো সঞ্চয়ই নেই সে দেশে তো অবনত বর্গের আর্থিক উন্নতির কোনো সম্ভাবনাই নির্মূল হয়ে গেলো।
বিহারে "পিছিয়ে থাকা বর্গের "সংখ্যা প্রচুর , প্রায় ৫০ শতাংশ , এই সংখ্যাটা কিন্তু তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং "অতি পশ্চাদপদ অংশের বাইরে, যাদের সংখ্যা যোগ করলে ৮৫ শতাংশ হয়. তাদের খুব সুনিপুন ভাবে সরিয়ে রাখা হয়েছিল এতো দিন, কেউ বুঝতেই পারে নি, কারণ সংখ্যার হিসেব ছিল না। বিহারে এই আপেক্ষিক পিছিয়ে থাকা মানুষজনের ভোটে অনেকদিন ধরেই এই জাত ও জাতিগোষ্ঠীগুলো ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় অন্ততঃ একটা দাবি একেবারে নির্বাচনী দাবিদাওয়ার কেন্দ্রীয় অক্ষ স্তম্ভে এসে প্রভাসিত হলো। অর্থাৎ সমাজে সংখ্যার ভিত্তিতে চাকরি এবং সুযোগ সুবিধা এবং প্রতিনিধিদের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। স্বাধীন ভারতে কাঁসিরাম উত্তরপ্রদেশে এই দাবি তুলে পাশা উল্টে দিয়েছিলেন। মন্ডল কমিশন করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং মহাশয় একেবারে কেন্দ্রের ক্ষমতা চেনাতে পেরেছিলেন খুব অল্প সময়ের জন্যে, অথচ আমলা অমাত্যকূলে ব্রাহ্মণদের নিরঙ্কুশ এবং একচ্ছত্র আধিপত্যে এই ব্যবস্থা বেশি দিন টেঁকানোই গেলো না। এই প্রথা প্রথম শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ আমলে কলকাতা এবং ঐক্যবদ্ধ বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাস তাঁর প্রণীত "বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) এর মাধ্যমে, সেটাও ব্রিটিশের চক্রান্তে টেঁকানো যায় নি। আজ এই দাবি একেবারে সামনে এসে হাজির হয়েছে আবার, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আর্থিক দাবিদাওয়ার সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের দাবিগুলো সামনে আসতে। ভারতে দলিত আন্দোলনের মাধ্যমে দলিত অধিকার , এখন নথিবদ্ধ হওয়াতে এক বিশেষ ঐতিহাসিকতা (historicality) বা লিখিত ইতিহাস ও সমাজ অধ্যয়নে ঢুকে পড়ার ফলে। ব্রিটিশ আমলে বা আটের দশকের আগে প্রয়োজনীয় তথ্যই ছিল না যাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেত। জাতশুমারি এই হাতিয়ার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
মনুর আমল থেকেই সবচেয়ে পরস্বাপহারি ব্রাহ্মণকুল সমস্ত সুযোগ কে কুক্ষিগত করে ফেলে, এমনকি যুদ্ধ পরিচালকদের পদগুলো পর্যন্ত। ব্রাহ্মনরাই সেখানে যুদ্ধের স্টাটেজিস্ট ছিল। পুরোহিতরা এখন থেকে সবই প্রায় করতো। বাণিজ্যের পরিচালনায় কৌটিল্য থেকে ব্রাহ্মণরা করতে লাগলো, শুধু সামনের মুখ গুলোতে ছিল না, কারণ সেটা করলে তো দায়িত্ব নিয়ে নিতে হয়, জবাবদিহিও করতে হতো। সেই দায় ব্রাহ্মণরা নিলো না, এই শুরু হলো মনু সম্পাদিত ব্রাহ্মণ্যবাদ। আর ওদিক থেকে শুরু হলো মহাভারতের পরম্পরা। কৃষ্ণ যাদব হয়েও বললো যে সে নাকি শান্ডিল্য ব্রাহ্মণ আর সে দায়িত্ব নিয়ে নিলো নিজের যাদব বংশের ধ্বংসের, এর আগে তো পরশুরামরা ছিলেন যাঁরা বিশ্বকে নিঃক্ষত্রিয় করার শপথ নিলেন, বিশ্বামিত্র ছাড়পত্র পেলেন সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার, অন্য সবর্ণদের ধ্বংস করার প্রকল্পকে সাকার করার প্রতিশ্রূতিতে। ব্রাহ্মণরা জমিদারিত্ব উপঢৌকন হিসেবে পেতে থাকলেন , তাকে আইনি আর ধর্মীয় মোহর লাগিয়ে একেবারে আইনানুগ করে তুলে।
জাতশুমারি চোখের সামনে এমন তথ্য হাজির করল যে তাকে চেপে রেখে তস্করী করা আর যাচ্ছে না। খুবই স্বাবাভিক ভাবেই আনুপাতিক সংখ্যাভিত্তিতে কর্মসংরক্ষণ কে প্রণয়ন করতেই হবে। আর তার ভিত্তিতেই এবার নির্বাচন করতে হবে, না করলেই অভ্যুথানের সমূহ সম্ভাবনা। অনেকেই বলছেন যে ধর্মীয় বিভাজনের বিষাক্ত হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে জাত বিভাজনের প্রকল্প আনছে INDIA জোট। বিজেপি গুলিয়ে দিতে চাইছে সেই বাস্তবতা যার মাধ্যমে সংরক্ষণ প্রথম থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদ চালু রেখেছে এই দেশে সাবর্ণরা তাদের উল্টো-সংরক্ষণের মাধ্যমে।
আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে কাজের সুযোগের কথা,কাঁসিরাম বলেছিলেন, "সংখ্যাগত ভিত্তিতে হিস্সাদারী বহাল করতে হবে "जिसको जितना संख्याभारि उसको उतनाही हिस्सेदारी" এটাই ছিল চিত্তরঞ্জনের বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) এর ফর্মুলা। সামাজিক ন্যায় এর দাবি আজ আর্থিক সমানাধিকারের দাবির সঙ্গে ধীরে ধীরে একবিন্দুগামী হতে চলেছে। এটাই তো সামাজিক বিপ্লব ! যার ঘনীভূত রূপটাই হবে রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল। মিশ্র সমাজে "আনুপাতিক হারে সুযোগ" হচ্ছে সামাজিক ন্যায়ের লড়াইয়ের মূল কর্মপ্রকরণ। দরকার ছিল তথ্যের, প্রয়োজন ছিল ঐতিহাসিকতা বা লিখিত বয়ান, এবারে পাওয়া গেলো। এবার প্রয়োজন সারা ভারতে এই প্রকরনে বাস্তবায়ন। হতে পারে একমাত্র ফ্যাসিবাদের বিতাড়নএর মধ্যে দিয়ে। এই মুহূর্তে সামাজিক ন্যায়ের আর আর্থিক সমানতার প্রধান শত্রু কেন্দ্রের সরকারকে সার্বিক ধ্বংসসাধন।
এই লেখকের এই বিষয়ে আগের লেখা পড়ুন