সাবির হরিয়ানাতে যে কাজ করতেন তাকে আমরা এখানে বলে থাকি কাগজ কুড়ানির কাজ। আসলে নানা ধরণের আবর্জনা তিনি সংগ্রহের কাজ করতেন। এতক্ষণে অনেকেই জানেন যে সাবিরকে আবর্জনা দেবার নাম করে কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং দুজন নাবালক, ডেকে নিয়ে যায়। সঙ্গে অসমের এক বাসিন্দা আছিরুদ্দিনকেও। অভিযোগ করা হয় তাঁরা গরুর মাংস খেয়েছেন। তাঁদের ওখানে লাঠি ইত্যাদি দিয়ে মারা হয়। তারপরে স্থানীয়রা আপত্তি করলে, অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে আবার মারা হয়। সাবির মৃত, আছিরুদ্দিনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঘটনাটি, তথ্য অনুসারে, ২৭শে অগাস্টের।
শুধু গরুর মাংস খাওয়াই কি এর কারণ? সাবিরের বাবা বলছেন তাঁরা ওখানে গরুর মাংস খান না। ২০১৫-তে হরিয়ানার বিজেপি সরকার আইন পাশ করে যে গরু চোরাচালান, গোহত্যা নিষিদ্ধ, গোমাংস খাওয়াও। এমনকি চামড়া চালান করলেও সমস্যা আছে। মনে পড়ছে আম্বেদকরের সঙ্গে হওয়া ১৯৪৮-এ কিছু সাংসদের বিতর্কের কথা। সেই সাংসদেরা সারা দেশে গোরক্ষার আইন চেয়েছিল। আম্বেদকর রাজি হননি, কারণ তাতে এদেশের মুসলমান শুধু নয়, শূদ্র এবং দলিতরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দলিতদের একাংশ মৃত গরুর বা গবাদিপশুর চামড়া নিয়ে কাজ করে। শেষমেশ, একে রাজ্যের ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপালের অধীন করে দিয়ে সমঝোতা করতে হয়েছিল। গরু-বাছুর হত্যা বন্ধ করারও বিষয় রাজ্যের অধিকারে জুড়ে গেছিল। এই লাইনেই হরিয়ানা সরকার আইন বানিয়েছে।
কথা হচ্ছে নিষিদ্ধ মাংস খেয়েছে বলেই কি এই আক্রমণ? সন্দেহেই? নাকি আরো কিছু থাকতে পারে এর নেপথ্যে? 'ক্যারাভ্যান' ২০১৬-র ১লা সেপ্টেম্বর একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ঈশান মার্ভেলের। সেখানে লেখা হয়েছিল গোরক্ষা আন্দোলনের ইতিহাস ইত্যাদিও। আমার লেখার বিষয় তা নয়, বিষয় বরং হরিয়ানাতে গোরক্ষক বাহিনী কেমন করে গড়ে উঠেছে তার সামান্য কথন।
বাহিনী, অম্তত হরিয়ানাতে, নামে মাত্র ছিল। ২০১৪-তে আসা খাট্টারের বিজেপি সরকারের আমলে তারা সক্রিয় হয়। তারা রাতবিরেতে রাস্তায় টহল দিত, গাড়ি সার্চ করত, প্রয়োজনে মারধোর থেকে তাড়া করা, ট্রাকের মাথা থেকে সন্দেহভাজনদের ফেলে দেওয়া, সবই করত। এবং পুলিশ সেখানে সঙ্গী হিসেবে ঘটনার আগে বা পরে উপস্থিত হত। ক্যারাভ্যানের তদন্ত তাই বলছে।
কারা এই গোরক্ষা দলের সদস্য? জমি আছে, খানিক অবস্থাসম্পন্ন অথবা অবস্থা ভাল করার জন্য দলে যুক্ত হয়ে নেতার ড্রাইভার থেকে বডিগার্ড হয়ে যাওয়া প্রাপ্তবয়স্ক এবং নাবালকেরা। পড়াশোনা নেই, চাকরীও নেই, শ্রমিক-কৃষকের জীবনও এরা যাপন করবে না, তাহলে করবেটা কি? গোরক্ষা। গোরক্ষা? সেকথায় পরে আসছি। আগে বলি সংগঠন চলে কেমন করে!
গুজরাটে বিপুল অর্থ সরকার দেয় এই সব সংগঠনকে, হরিয়ানাতেও বিপুল না হলেও ভাল অঙ্কই আসে সরকারের থেকে। বাকী বেসরকারী দান। পাঞ্জাব থেকে গোয়া সর্বত্র এরা আছে এবং হরিয়ানার সংগঠন সবচেয়ে বড়। নেটওয়ার্ক এদের সমাজের সব স্তরে ছড়িয়েছে।
ক্যারাভ্যানের রিপোর্ট বলছে প্রত্যেক বছর এরা দশ থেকে পনেরো লাখ টাকা পায় দানে। আর পায় নানা ধরণের গাড়ি, যা নিয়ে রাত্রে এরা টহল দিতে বেরোয়। গাড়ির তেল এবং মেরামতি খরচ প্রতিমাসে ৩০,০০০টাকা। সেই সময়েই ৬০/৭০টা বন্দুকের লাইসেন্স তাদের ছিল, হকিস্টিক থেকে দা ইত্যাদির সঙ্গে। এখন নিশ্চয়ই আরো অস্ত্র বেড়েছে। গাড়ির সংখ্যা ছিল তখন ৬০টা প্রায়। স্রেফ ঐক'টা গাড়ির খরচ দাঁড়াচ্ছে তাহলে ১৮,০০,০০০ টাকা। তাহলে ২০১৪ এবং ১৫-তেও গড় গাড়ি ৬০টা ধরে ১৮০টা গাড়ি। আর তার খরচ ৫৪ লাখ টাকা। এখন নিশ্চয়ই এই অঙ্কটা কোটি ছাড়িয়ে অনেকদূর গিয়েছে।
এর সঙ্গে মেশান এরা যে সব গোশালা বানিয়েছে সেখানে গরুদের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ। খাবার থেকে ডাক্তার সব। ৪২৮টা গোশালায় সাড়ে তিনলাখের কাছে গরু তখনই। খাবার থেকে ডাক্তার সবের হিসেব কষেছেন ক্যারাভ্যানের সাংবাদিক ঐ গোরক্ষা দলের মাথাদের থেকেই তথ্য নিয়ে। দেখা যাচ্ছে তা ১০০০কোটি টাকা। বিপুল বিপুল টাকা। এবং দলের মাথারা ঠিকমত হিসেবও দিতে পারেননি।
এর থেকে বোঝা যায় কি যে এটা একটা একেবারে আলাদা ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠেছে? কোটি কোটি টাকার বন্দোবস্ত একে কেমন করে আরো মহার্ঘ্য করে তুলেছে? এখানেই লিখে রাখি আরেকরকম উপার্জনের কথা। হিন্দুস্তান টাইমস, ২০২৩-এর ১০-ই মে, হরিয়ানারই ভিওয়ানিতে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরে একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে উঠে এসেছে কুখ্যাত মনু মানেসরের কথা, যে এমনই গৌরক্ষা দলের স্বঘোষিত নেতা, বজরঙ্গ দল সদস্য। তারা, রাতের পর রাত, হরিয়ানার নানা অঞ্চলে গাড়ি থামায় ইচ্ছামত, সার্চ করে, তাড়া করে কোনো গাড়ি না থামলে এবং প্রয়োজনে গুলিও চালায়। হরিয়ানা পুলিশ সব জানলেও চুপ থাকে বলেই অভিযোগ।
সেই মনু মানেসরের অজস্র কুকীর্তির মধ্যে একটির তদন্ত করছিলেন সাংবাদিক লীনা ধনকর এবং দীপঙ্কর ঘোষ। ওয়ারিশ, নাফিস এবং সৌকীন, তিনজন একটি পুরোনো গাড়ি কিনতে গেছিলেন ভিওয়াড়িতে। ফেরার সময় ভোর সাড়ে পাঁচটায় খোড়ি গ্রামের কাছে পৌঁছোলে মনুর নেতৃত্বে বজরঙ্গ দলের ক'জন তাঁদের গাড়িতে মাহিন্দ্রা বোলেরো গাড়ি দিয়ে ধাক্কা মারে। গাড়ি বিধ্বস্ত করে দেয়। অভিযোগ করে ওয়ারিশরা গো-পাচারকারী বলে। সেই সময় মনুদেরই করা ভিডিওতে ইউ টিউবে দেখা গেছিল তারা বিধ্বস্ত গাড়ি থেকে ওয়ারিশদের টেনে বার করছে। গাড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে পাশে রাইফেল নিয়ে দাঁড়াচ্ছে মনুর লোকেরা। জেনারেল ডায়ারিতে বলা হচ্ছে, পুলিশকে তারাই খবর দিয়ে আনে। আনার পরে পুলিশের সামনেই ওয়ারিশদের জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে মারতে। ব্যাপক অত্যাচারের পরে তারা তাউরি থানার হাতে অবশেষে ওয়ারিশদের তুলে দেয়।
পরে কিন্তু পুলিশের তরফে ওয়ারিশের পরিবারকে জানানো হয় যে ওয়ারিশ পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। বাকীরা আহত। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কথা বলে হরিয়ানার নূহ-এর এসপি বরুণ সিংলা বলেছিলেন, দুর্ঘটনায় পাওয়া আভ্যন্তরীণ আঘাতেই ওয়ারিশ মারা গিয়েছেন। তাহলে ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছিল সেগুলো কী ছিল? অন্তত তখন পুলিশ বা প্রশাসন তার উত্তর দেয়নি, বরং দুর্ঘটনা বলেই চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। অনেক পরে মনু মানেসর বা মোহিত যাদবকে হরিয়ানার পুলিশ ধরে সোশ্যাল মিডিয়াতে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক পোস্টের জন্য। ভিওয়ানিতে দু'জন মুসলমানকে অপহরণ করা এবং জীবন্ত জ্বালিয়ে মারার অভিযোগ ছিল রাজস্থানে, তারা তাকে পরে গ্রেপ্তার করে।
কিন্তু আমাদের এই সব ছাড়িয়েও আরো অন্য দিকে নজর দিতে হবে। হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল যে মনুরা একটা তোলা তোলার র্যাকেট চালাতো। একজন আইনজীবী তাহির হোসেইন রুপারিয়া জানিয়েছিলেন সপ্তাহে অন্তত এমন তিনটি কেস তাঁর কাছে আসে, যেখানে মুসলমানদের গোরু পাচার থেকে মাংস খাওয়া ইত্যাদি অভিযোগে মনুরা অভিযুক্ত করে প্রথমে। এফআইআর হয়। তারপরে তাঁর কাজ হল, এই তথাকথিত গৌরক্ষকদের সঙ্গে একটা সমঝোতাতে আসা। একেকটা কেসে চার থেকে দশ লাখ টাকা, অভিযুক্ত মুসলমানদের দিতে হয় এই গৌরক্ষকদের, এফআইআর থেকে নাম সরাবার জন্য। অর্থাৎ, এও এক তোলা তোলার বিপুল ইন্ডাস্ট্রি।
এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ হচ্ছে দেখাতে হলে, একে আরো বাড়িয়ে তুলে আরো টাকা কামাতে হলে, কয়েকটা গণপিটুনি কি খুব বেশী কিছু? হরিয়ানা ভোটের মুখে যাচ্ছে আর ক'দিনেই। শাসকদল দশ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। কাজেই ক্ষমতাবিরোধীতা, দলের মধ্যে অন্তর্কলহ, এগুলোতো আছেই, আরো কিছু জ্বলন্ত ইস্যু আছে এখানে। অগ্নিবীর প্রকল্প নিয়ে ক্ষোভ, কুস্তিগীর এবং কৃষকদের সঙ্গে করা আচরণ নিয়ে ক্ষোভ। কোনো উন্নয়ন না হওয়ার ক্ষোভ। দলিত এবং জাটদের ক্ষোভ। এমন অনেক আছে। গত লোকসভাতেই দশটার মধ্যে পাঁচটায় হেরেছে তারা। এবারে?
সমালোচকেরা বলেন সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি-র গুজরাট মডেল দেখায় ধাপে ধাপে দলিত, মুসলমানদের সঙ্গে দাঙ্গা করে করে তাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার পদ্ধতি। বলে সেই ত্রাসকে কাজে লাগিয়ে দলিত এবং মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখানোর পদ্ধতির কথা। দলিতরা ভয়ে নিজেদের বর্ণহিন্দুদের অনুগত করে নেয়, ভোট দেয়। মুসলমানেরাও, একই ভয়ে ভোট দেয়। ২০১৪-তে হরিয়ানাতে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি, ক্ষমতা রাখার জন্য তারা তাদের পুরোনো মডেলকেই অনুসরণ করছে না কি?
সাবির মালিককে হত্যা করেই বিজেপি-র লেলিয়ে দেওয়া গৌরক্ষকরা যে থামেনি তা আরিয়ান মিশ্রকে খুন করার মধ্যে দিয়েই বোঝা যাচ্ছে। এইবারে তারা ভুল করে একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ ছাত্রকে মেরে ফেলেছে। তাই নিয়ে মূলধারার মিডিয়াতে কিছু কথা হচ্ছে এখন, ব্যুমেরাং হয়ে গেছে বলে। সাবিরের মৃত্যু বা আছিরুদ্দিনের আঘাত নিয়ে কথা এত হত না, হচ্ছিল না। এতদিন ধরে হরিয়ানা বা অন্যত্র, যে সব জায়গায় বিজেপি ক্ষমতায় আছে, এই সব কাণ্ড করেই চলেছে। এই গৌরক্ষক বাহিনীদের মতন নানা ধরণের অতি-আইনি সংগঠন বানিয়ে কখনো হত্যা, কখনো দাঙ্গার প্ররোচনা দিচ্ছে, ঘটাচ্ছে।
কিন্তু কে কী খাবে, কী পরবে, তা ঠিক করে দেবার এরা কারা? কেনই বা এমন আইন হবে দেশের নানা রাজ্যে যেখানে দলিত, শূদ্র, মুসলমান নিপীড়িত হয়? এইসব আইন বাতিল করার আওয়াজ তোলার সময় কবে হবে? আজ যখন পশ্চিমবঙ্গে আমরা এক ভয়ঙ্কর ধর্ষণ, খুন এবং দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হয়েছি, পথে নেমেছি, আজ কেন আমরা সাবিরের জন্যও বিচার চাইব না?