‘হীরক রাজার দেশে’ বাঙালি দেখেছিল, রাজার আদেশে পড়ুয়াদের পাঠশালার ঝাঁপ একদিকে বন্ধ হলে অন্যদিকে খুলে যায় মগজ ধোলাইয়ের পাঠশালা। এদেশেও অতিমারির দাপটে সরকারি ঘোষণায় পাঠশালার তালা বন্ধ হয়েছে। আঠারো মাসে বছরের সরকারি ক্যালেন্ডারে লকডাউন থেকে আনলকের পথে সমাজের সার্বিক যাত্রা শুরু হলেও, বন্ধ রয়েছে স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের সূচী। একথা ঠিক যে করোনা সংক্রমণ ঘণ্টা দিন মাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে বছর জুড়ে। সন্দেহ নেই যে এমন অতিমারিতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কাজ। আশু সংক্রমণের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সমাজকে তালাবন্ধ রেখে মানুষ প্রাণে বাঁচলেও বাঁচানো যায়নি মানুষের কাজের উপায় আর শিক্ষার সুযোগ । ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে অফিস আদালত, কল কারখানা, চাষ বাস চালু হয়েছে কখনও কর্মীর সীমা বেঁধে,কখনও কাজের সময়ের সীমা বেঁধে । চালু হয়েছে বাস, ট্রাম, অটো, মেট্রো। চলেছে দেশ জুড়ে বিধানসভা থেকে পঞ্চায়েতের ভোট। কিন্তু এতো কিছুর পরও নাকি সংক্রমণ ভয়ে স্কুল কলেজের গেটে ঝুলছে তালা।
আর এই প্রেক্ষিতেই সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন উঠে আসছে যে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সাথে কি সংক্রমণ প্রসারের কোন নতুন জৈবিক সম্পর্ক রয়েছে? নাকি সংক্রমণ ভীতির আড়ালে সরকারি স্তরে কাজ করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রবল অনীহা ! যত দিন যাচ্ছে তত, এমন অনীহার পেছনে বিবিধ রাজনৈতিক কার্যকারণ সম্পর্ক উঠে আসছে। যার একটি কারণ এই সংক্রমণ ভয়কে ঢাল বানিয়ে অন লাইন শিক্ষা ব্যাবস্থাকে বিকল্প ভাবনা হিসাবে তুলে ধরা। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ এর ফর্মুলায় শিক্ষার বেসরকারিকরণের চেষ্টাকে আরও বেশি কার্যকরী হিসাবে প্রমাণের ছাপ দেখা যাচ্ছে এমন সরকারি রাজনৈতিক কৌশলে । এরফলে একদিকে দেশের কিংবা রাজ্যের সরকার যারা শিক্ষায় রাষ্ট্রের দায় ঝেড়ে ফেলে নতুন শিক্ষা নীতি মেনে শিক্ষা প্রসারের দায়িত্ব বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চাইছে তাদেরও পোয়া বারো । ফলে স্কুল বা কলেজের গেটে তালা ঝুলিয়ে সাবেকি শিক্ষার পথ অবরুদ্ধ হলেও খুলেছে এই প্রযুক্তি নির্ভর পঠন পাঠনের বিকল্প পথ, শিক্ষাকে সম্পন্ন শ্রেণীর কাছে পৌঁছে দিতে । ফলে এমন পুঁজি এবং প্রযুক্তি নির্ভর পঠন পাঠন এদেশের সমাজে যে প্রান্তিক অংশের পড়ুয়ারা ব্রাত্য হবে সে নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই । ফলে স্কুল কলেজ খোলা নিয়ে সরকারি নীরবতা যে প্রত্যক্ষ ভাবে অন লাইন শিক্ষা প্রসারে সরকারি সক্রিয়তা সেটাও এখন স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন । ফলে অতিমারির এমন ঘোলা জলে এখন বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থাগুলি ‘অ্যাপ’ নির্ভর পঠনপাঠনের বাজারে গত এক বছরে কোটি কোটি টাকা লাভের মুখ দেখেছে ।
স্কুল কলেজ খোলা নিয়ে সরকারি স্তরে নীরবতার আরও একটি বড় কারণ শিক্ষা সম্পর্কে সরকারি ব্যবস্থার উদাসীনতা এবং সম্যক উপলব্ধির অভাব। স্কুল কলেজ খুলে গেলে লাগামছাড়া সংক্রমণ বৃদ্ধির যুক্তি বিচিত্র এবং অতি দুর্বল । বাদুড় ঝোলা স্পেশাল ট্রেন, মিনি বাস অটোয় চেপে পরিবারের বড়রা যখন জীবিকার প্রয়োজনে প্রবল সংক্রমণ সম্ভাবনা নিয়ে বাড়ির বাইরে পা রেখে দিনান্তে বাড়ি ফিরছে , তখন সেই বাড়ির খুদে পড়ুয়ারা কি সেই সংক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে? এমনকি স্কুল কলেজের ক্লাস ঘরের জন ঘনত্বের চেয়ে বেশি পাড়ার মাছের বাজার কিংবা শপিং মলে প্রবেশ অবাধ যদি হয় তবে কোন বাধায় স্কুল কলেজের দরজা বন্ধ থাকবে? সংক্রমণ পরিস্থিতির বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে যেমন পরীক্ষামূলক ভাবে ধাপে ধাপে দোকান, বাজার, অফিস কাছারি, কল কারখানা খোলা হয়েছে ঠিক একই কায়দায় কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না ? সপ্তাহে প্রতিদিন না হলেও দিন ভাগ করে করে আংশিক ক্লাস চালু কেন করা যাবে না? বিশেষত স্কুলে যেখানে মুলত আশপাশের এলাকার পড়ুয়ারাই ভর্তি হয়, সেক্ষেত্রে লোকাল ট্রেন চালু না হলেও স্কুলে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস অবিলম্বে চালু করা যায় । একইভাবে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের ক্লাস স্বচ্ছন্দে চালু করা যায়। এমন ক্লাসে সশরীরে উপস্থিত হতে না পারা পড়ুয়াদের কে সেই ক্লাসের ‘ অন লাইন’ লিঙ্ক দিয়ে সাময়িক ভাবে যুক্ত রাখার উপায় ভাবতে হবে। সীমিত সংখ্যক ক্লাসের পড়ুয়াদের নিয়ে এভাবে ক্লাস চালু করলে সেই স্কুল বা কলেজের ৫০% ধারন ক্ষমতা ব্যাবহার করে করোনার স্বাস্থ্য বিধি মেনে ক্লাস চালু সম্ভব। এর জন্য দরকার সরকারি স্তরে সাহস এবং সদিচ্ছা । অন্যথায় করোনার সংক্রমণ কবে শূন্যে নেমে আসবে সেই অঙ্ক কষে স্কুল কলেজ খোলার ভাবনা মুর্খামির নামান্তর মাত্র । সংক্রমণ পরিস্থিতির বাড়া কমার সাথে সঙ্গতি রেখেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা এবং বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।
সাবেকি ব্যবস্থায় পঠন পাঠনে সবচেয়ে মুল্যবান উপাদান হল স্কুল কলেজে যৌথ পাঠের শিক্ষার পরিবেশ যেটা এদেশের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় প্রজন্মের ‘মিড ডে মিল’ খাওয়া পড়ুয়াদের জীবনে অত্যন্ত জরুরি। এমনকি উচ্চ শিক্ষায় প্রান্তিক অংশের পড়ুয়াদের জীবনে শিক্ষার আদর্শ পরিবেশ তাদের বাসস্থানে খুঁজে পাওয়া বিরল । যদি তর্কের খাতিরে পড়ুয়াদের হাতে ডেটা কিংবা সেল ফোন কিংবা দুর্বল টেলি যোগাযোগ পরিকাঠামোর কথা বাদ দিলেও শিক্ষার এই পরিবেশের অভাব পড়ুয়াদের জীবনে ডেকে এনেছে অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা। এদেশে ঘরে বসে শিক্ষা লাভের সবচেয়ে বড় অন্তরায় পড়ুয়াদের বাসস্থানের বাস্তব চিত্র। এদেশের ৬৯তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশিত দেশের শহরে ৬০ শতাংশ মানুষের গড়ে মাথা পিছু বাসস্থানের মাপ ৭২ স্কোয়ার ফিট যা এদেশের জেল বন্দিদের প্রাপ্য মাথা পিছু ৯৬ স্কোয়ার ফিট এর তুলনায়ও কম আর শহরের ভাড়ার বাড়ি বা বস্তিতে বাস করা মানুষজনের জন্য বরাদ্দ এই বাসস্থান মাত্র ৪৮স্কোয়ার ফিট। দেশের শহরাঞ্চলে ৩৫শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৪৫ শতাংশ মানুষ কেবলমাত্র একটা ঘরে তাঁদের পরিবারের তিন বা তার চেয়েও বেশি সদস্য নিয়ে বসবাস করেন । ফলে সহজেই অনুমেয় এদেশে ‘learn from home‘ কিংবা ‘work from home‘ উভয়ই অত্যন্ত কঠিন । পরিশেষে স্কুল কলেজ না খোলায় বিপর্যস্ত হয়েছে পড়ুয়াদের মূল্যায়ন এবং পরীক্ষা ব্যাবস্থা। পরীক্ষার বিকল্প ফর্মুলায় তৈরি হচ্ছে বিচিত্র ফলাফলে এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় সত্তর জন পড়ুয়া একত্রে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। মোদ্দা কথায় তালাবন্ধ স্কুল কলেজে ঘটে চলেছে শিক্ষার অবমূল্যায়ন। পরিশেষে সরকারের মনে রাখতে হবে যে আমাদের মত গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষা শুধু সুযোগ নয় বরং শিক্ষা মানুষের অধিকার । ফলে এমন অধিকার অরক্ষিত নয় বরং সেটিকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই । তাই পানশালা খোলার আগে পাঠশালা খোলার দায় সরকারেরই । এটাই হল সময়ের দাবী ।