দেশে এবং সমাজে ডিজিটাল অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এক নয়া বিপদ তৈরি হয়েছে মিথ্যে খবর আর ছবি সম্প্রচারে। কোনো ব্যক্তি বা দলের ইমেজ গড়তে বা ভাঙতে মিডিয়ায় মুহূর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এমনকি ভোটের হিসেবে নির্বাচন জিততে শান্ত মহল্লাগুলোয় হিংসা ছড়ানো হচ্ছে। একের পর এক গুজব তৈরি করে ইদানীংকালে ছোট ছোট সংঘর্ষ ও দাঙ্গা লেগেছে শুধু মিথ্যে খবর প্রচারের জন্য। ফেক নিউজ নিয়ে দেশে এতটাই বিপদ যে নীরবে সমাজের বাঁধনটা ছিন্ন করে দিচ্ছে হিন্দু মৌলবাদী শক্তিরা। বিষয়টা নিয়ে সাধারণ মানুষ অতটা ওয়াকিবহাল নয় বলেই খুব সহজে তাদের সরল বিশ্বাসকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী শক্তি এখন মিডিয়াতেও যথেচ্ছ ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে।
প্রতিদিন যার যা খুশি লিখছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে, রাজনীতি চলছে নিয়ম করে টুইটারে। টিভি বা মুদ্রিত কাগজের খবর নিয়ে বরং অভিযোগ কম, তবুও সেখানেও দেখা যাচ্ছে ভুয়ো খবরের রমরমা। কোনটা ঠিক আর কোনটা মিথ্যে, মনগড়া এবং বিকৃত তথ্য দিয়ে তৈরি, সেটা বোঝা দায়। টাকা যাঁর যত, তাঁর হয়ে প্রচার তত। গোটা মিডিয়া এখন ব্যবসা মঞ্চ। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তার দাম চুকোতে হয়। পাঠক দেন নগণ্য মূল্য, কিন্তু মূল্য দিতে হয় তার ঢের গুণ, না জেনে এবং তাঁরা বোঝেন না যে তাঁরা জানেন না প্রতিদিন কী পরিমাণ মিথ্যে তথ্য তাঁরা গিলছেন। গেলানো হচ্ছে, তাই গিলছেন। কেউ সকালের কাগজে কেউ সন্ধ্যার টিভির আলোচনার মজলিশে। কাগজের সাংবাদিক , দূরদর্শনের সঞ্চালক একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে নির্মাণ করে চলেছেন প্রতিবেদন। পাঠক কিংবা দর্শককে তিনি গেলাবেন সেই সব ভুয়ো তথ্য।
মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব মানুষের জানা হয়ে গেছে। কিন্তু যেটুকু 'খবর' তাতেও ভেজাল কতটুকু, সেটা বোঝা অসম্ভব সাধারণ পাঠকের কাছে। তাছাড়া খবর বলতে এখন আর বোঝায় না সেই চিরাচরিত 'সংবাদ', এখন খবরের ভূমিকা নিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামের মেসেজ, ফেসবুক পোস্ট, টুইটারের টুইট। জনমানসে প্রভাব ফেলতে সর্বক্ষণ বানানো চলছে হাজার হাজার ফেক নিউজ। এর জন্য খুলে গেছে দিকে দিকে কল সেন্টার। মাস কাবারি চুক্তিতে নিজের ঘরে বসে বিভিন্ন দলের হয়ে কাজ করছে শত শত বেকার যুবক যুবতী। এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে জনমনের প্রবণতা বুঝতে রীতিমতো সমীক্ষা করে প্রবণতা বুঝে নেওয়া চলছে এবং তারপর তার পক্ষে বা বিপক্ষে তৈরি হচ্ছে ফেক নিউজ। যা আদৌ হয় নি বা হয় না তাকে নিয়ে ছবি বানিয়ে সরল মনে বিষ ঢালতে তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন। উদ্দেশ্য ভোটের হিসেব বদলে ফেলা, নির্বাচন এলেই তাই বিষাক্ত হচ্ছে এই সমাজ। এর শেষ কোথায়?
সরকার নিজেই এগিয়ে এসেছে দেশবাসী ও সমাজকে এই বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত করতে। সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করতে আইনের পরিবর্তন আনছে। কিন্তু তাতে রয়েছে মিডিয়ার স্বাধীনতা হারানোর আশঙ্কা। গণমাধ্যমকে দূষণ মুক্ত করতে এই প্রেক্ষিতে জোট বেঁধেছে ১৪ টি মিডিয়া সংগঠন। তাঁদের তৈরি সংগঠনে ক্রমশ সদস্য বাড়ছে কারণ সকল প্রকৃত মিডিয়াকে এখন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তারা যে ফেক নিউজ ব্যবহার করছেন না, সেটা তার পাঠক বা দর্শককে প্রমাণ সহ বোঝানোর মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই তীব্র সংকটাপন্ন যে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার মতো সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে প্রতিদিন পাতায় বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে যে তারা ভেরিফাইড নিউজ দিচ্ছেন। এই ভেরিফায়েড নিউজের তকমা আবার মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিকে আরো বেশি কর্পোরেটাইজেশানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে। গয়নায় হলমার্ক দেওয়ার মতো করেই এবার খবর ছাপবার আগে একটা ভেরিফায়েড সাইন দিতে না হয়, নইলে পাঠক বুঝবে কী করে কোনটা বানানো মিথ্যের খবর আর কোনটা সত্য?
গোড়ার প্রশ্ন এখানেই। সত্য কোনটা সেটা বলবে কে? সরকার বলেছিল তারা পিআইবিকে দিয়ে ফ্যাক্ট চেক করবে। গোল বাঁধলো সরকারের এই কথাতেই। সরকারের অভিসন্ধি নিয়ে সন্দিগ্ধ নানা মহল আশঙ্কা প্রকাশ করল যে এতে সরকারের অপছন্দের খবরে কোপ পড়বে। আশঙ্কার কারণ সরকার নিজেই। ভুয়ো খবর ধরার উদ্দেশ্যে তৈরি অল্ট নিউজকে প্রায় বন্ধ করার চেষ্টায় ছিল সরকার। তাদের অন্যতম মুখ মহম্মদ জুবেইরকে জেল খানায় পচিয়ে মারার পরিকল্পনা করে কেন্দ্র। শেষে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে মুক্তি পান তিনি।। খবরের সত্য মিথ্যে যাচাইয়ে যার অসাধারণ ভূমিকা তাকেই এভাবে হেনস্থা করেছিল সরকার।এরপর আর কোন যুক্তিতে বিশ্বাস রাখবে লোকে কেন্দ্রের উপর? ফেক নিউজ নিয়ন্ত্রণের নামে সরকার প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোকে দিয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছে এবং যেভাবে তথ্য প্রযুক্তি আইন সংশোধন করেছে ( দেখুন, সংশোধিত রুল , এবং IT (Intermediary Guidelines and Digital Media Ethics Code) বিশ্লেষণ করে Editors Guild তো স্পষ্টই বলে “basically serves to make it easier to muzzle the free press, and will give sweeping powers to the PIB ... to force online intermediaries to take down content that the government may find problematic.”এক অর্থে এটা সোশ্যাল মিডিয়া সেন্সরশিপ, বলছেন অনেকেই।
তাহলে উপায়? সরকারের বদলে একটা নিরপেক্ষ স্বশাসিত সংস্থার পরিচালনাধীন একটি টিম কাজ করবে যার মধ্যে থাকবে সরকার পক্ষের প্রতিনিধি এবং একই সঙ্গে এডিটরস গিল্ড, বিভিন্ন মিডিয়া হাউস ও এজেন্সি প্রতিনিধিরা। সেটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ এমনটা জানিয়েছে বেসরকারি মিডিয়া সংগঠনগুলি। ফেক নিউজ এখন এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। এর প্রকোপ বন্ধে অস্ট্রেলিয়া কানাডাতে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ টাস্ক ফোর্স। ফ্রান্স এবং জার্মানিতে আনা হয়েছে কড়া আইন। এদেশে এর দুটো পথের কোনোটাই নেওয়া হয় নি, কারণ? সরকার চায় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। আসল কথা ক্ষমতার রাজনীতি। বিরোধী কণ্ঠ দমনের রাজনীতি। শুধু এটুকু নয়, নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন চলাকালীন জনমনে প্রভাব ফেলতে মিডিয়াকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে চায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী, তাই বিরোধী সমালোচনা থামাতে এবং নিজের পক্ষে মিথ্যে তথ্য দিয়ে রঙিন আশা জাগাতে তারা ফেক নিউজ বিচারে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চায়। সরকার চালাতে এসে ক্ষমতাসীন দল নিজেই একজন ফেক নিউজের অংশ হয়ে গেছে। ওঝা যদি নিজেই ভূতে আক্রান্ত হয় তাহলে ভুত তাড়াবে কে?