পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

'উদ্বাস্তু -- কে না?: শতবর্ষে ঋত্বিক'

  • 31 December, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 362 view(s)
  • লিখেছেন : মানস ঘোষ
আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে আমরা অবাক হয়ে দেখছি প্রতিদিন যেন এই দেশ আমাদের কাছে অচেনা ঠেকছে। সুবর্ণরেখায় আমরা দেখেছি একটা গণমাধ্যম যে কিনা প্রতিনিয়ত অশ্লীল খবরের সন্ধানে, মনুষ্যত্বের অবমাননার খোঁজে ছুটছে তাদের পকেট ভরাতে। আমরা দেখছি সেখানে কৌশল্যার মতো সহায় সম্বলহীন মানুষকে রাষ্ট্র টেনে হিঁচড়ে নির্বাচনে নিয়ে যাচ্ছে। ‘রাত কত হলো উত্তর মেলে না’, রবীন্দ্রনাথের শিশু তীর্থ ঋত্বিকের ছবিতে উচ্চারিত হয়, আমাদের সময়কে সে যেন মহাকাব্যিক উচ্চারণে বুঝতে চায়।

২০২৫ সাল সমাপ্ত। আমরা প্রবেশ করছি নতুন বছরে, ২০২৬ সালে। ক্যালেন্ডারের কালপ্রবাহ এগিয়ে চলেছে, আর সারা পৃথিবী জুড়ে দক্ষিণপন্থার উত্থান আমাদের সময়কে পিছিয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষের মুক্তি যদি আমাদের কাছে অগ্রগতির মাপকাঠি হয় তাহলে আমরা পিছোচ্ছি এক অদ্ভুত হিংস্রতা ও হানাহানির দিকে। আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে উগ্র দক্ষিণপন্থা ও নয়া ফ্যাসিবাদ মানব মুক্তির সমস্ত পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের রাজনীতি প্রধানত আবর্তিত হচ্ছে অনুপ্রবেশ বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। এদিক থেকে দেখলে ঋত্বিক ঘটককে শতবর্ষে নতুন করে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে। ঋত্বিকের ছবির আবেগের ভূগোল আজকের পৃথিবীর বাসভূমি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে মানুষের নতুন বাড়ি খোঁজার ভূগোলের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে। গত কয়েকদিনের এদেশের ঘটনাপ্রবাহ যদি দেখা যায়, যদি দেখা যায় প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংকটের দিকে, যদি আমরা দৃকপাত করি প্যালেস্টাইনের দিকে, তাহলে বুঝবো আমাদের প্রকৃত অবস্থা।

আমরা ভেবেছিলাম যারা সুখে-শান্তিতে এ দেশে বসবাস করছে কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের সুখ ও শান্তি নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হবে। ভেবেছিলাম যারা বাইরে থেকে এসেছে তারা উদ্বাস্তু। সংকট যদি ঘনিয়ে আসে তবে তা আসবে তাদের জীবনে। হায় রে মধ্যবিত্ত মরীচিকা! আমাদের দেশে এসআইআর নামে যে নতুন পিশাচের উৎপাত শুরু হয়েছে সেই পিশাচ প্রায় সকলকেই উদ্বাস্তু বানিয়ে ছেড়েছে। আমরা আজ সকলেই নিজদেশে পরবাসী। ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা ছবির একটা কথা মনে পড়ে, ‘উদ্বাস্তু -- কে না’? হয়তো ঋত্বিক প্রাথমিকভাবে দেশভাগ পরবর্তী সমাজের কথাই বলেছিলেন। কিন্তু যা বলেছিলেন, যা উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর ছবিতে তা যেন আজ নতুন আলোকে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। দেশ-মাটি হারানো বাগদি বউ কৌশল্যার এ সমাজে কোন ঠাঁই হয় না। রাষ্ট্র তাকে টেনে নিয়ে যায় দণ্ডকারণ্যে। নির্বাসনে। সেই নির্বাসন আজকের দিনে নাম-কাটা যাওয়া মানুষের ডিটেনশন ক্যাম্প। যারা যুদ্ধ দেখে নাই, দেশভাগ দেখে নাই, মন্বন্তর দেখে নাই, দাঙ্গা দেখে নাই তারা জানে না কি অসহনীয় বেঁচে থাকা প্রতিদিন এদেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবনকে নরকে পরিণত করছে। যারা আখলাকের ক্ষত দেখেনি যারা জুয়েল রানার প্রাণহীন দেহ দেখেনি, যারা দেখেনি দিপু দাসের পোড়া শরীর দেখেনি। যারা খোঁজ রাখেনা ওমর খালিদ বা সোনাম ওয়াংচুক কারাগারের কোন অন্ধকারে দিন গুজরান করছে, তারা ঋত্ত্বিক ঘটকের মূল্য বুঝবে না, তারা বুঝবে না দণ্ডকারণ্যগামী ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া অজানা অনামী অনামী স্টেশনে কৌশল্যার মর্মান্তিক মৃত্যুর মানে।

আসলে ঋত্বিকের ছবি আমাদের ক্ষতে প্রলেপ দেয় না, বরং তাকে লাল রক্তের রঙে আমাদের চোখের সামনে উন্মুক্ত করেন। পাবলো নেরুদার ভাষায় the word was born in the blood। খবরের কাগজের অফিসে টেলিপ্রম্পটারে একটা মেসেজ আসে। ‘নাথুরাম বিনায়ক গডসে কিল্ড মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী’। আমরা সাধারণত গান্ধী হত্যার ঘটনাকে উচ্চারণ করি -- গান্ধী কিল্ড বাই গডসে -- ধরনের বাক্যে। যে বাক্যে গান্ধী থাকেন ব্যাকরণগতভাবে সাবজেক্ট বা বিষয়ী। ঋত্বিকের ছবিতে এই রকম প্যাসিভ ভয়েসে কথাটা উচ্চারিত হয় না। একটিভ বয়সে নাথুরাম বিনায়ক গডসে হয়ে ওঠে সাবজেক্ট বা বিষয়ী। ঋত্বিক আমাদের ক্ষতকে প্রলেপ দিয়ে স্বাভাবিকতার ভান করেন না। বোধহয় তিনি বুঝেছিলেন একদিন এই গান্ধীর দেশ হয়ে উঠবে নাথুরাম গডসের দেশ। সুবর্ণরেখায় উচ্চারিত এই কথাগুলি আমাদের এমন এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয় যেখানে প্রিয় মাতৃভূমি হয়ে উঠবে পৈশাচিক নৃত্যের নাট মঞ্চ। কারণ তার পরেই আমরা শুনি দুটিগুলির শব্দ। দেখি খবরের কাগজে সেই হত্যার বার্তা পড়ে হরপ্রসাদের হতাশা, ‘আমরা ঠকে গেছি’!

আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে আমরা অবাক হয়ে দেখছি প্রতিদিন যেন এই দেশ আমাদের কাছে অচেনা ঠেকছে। সুবর্ণরেখায় আমরা দেখেছি একটা গণমাধ্যম যে কিনা প্রতিনিয়ত অশ্লীল খবরের সন্ধানে, মনুষ্যত্বের অবমাননার খোঁজে ছুটছে তাদের পকেট ভরাতে। আমরা দেখছি সেখানে কৌশল্যার মতো সহায় সম্বলহীন মানুষকে রাষ্ট্র টেনে হিঁচড়ে নির্বাচনে নিয়ে যাচ্ছে। ‘রাত কত হলো উত্তর মেলে না’, রবীন্দ্রনাথের শিশু তীর্থ ঋত্বিকের ছবিতে উচ্চারিত হয়, আমাদের সময়কে সে যেন মহাকাব্যিক উচ্চারণে বুঝতে চায়। 

“পাহাড়তলিতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো;

স্তূপে স্তূপে মেঘ আকাশের বুক চেপে ধরেছে;

পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমা গুহায় গর্তে সংলগ্ন,

মনে হয় নিশীথরাত্রের ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ;

দিগন্তে একটা আগ্নেয় উগ্রতা

ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে আর নেভে—”


তবু ঋত্বিক হতাশার শিল্পী নয়। সুবর্ণরেখা বলে ‘এ রাত্রিরও শেষ আছে’। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রার পথ আছে। ঋত্বিক আমাদের দুটো পথই দেখান, আমরা আরো অন্ধ-তমিস্রার দিকে ছুটে যাব, নাকি আলোর সন্ধানে পথ হাটবো। আমরা আর কবে বুঝবো জল জঙ্গল প্রভাত সূর্যের আলো আমাদের সকলের, এ আমাদের সর্বজনীন অধিকার। আমরা কি এমন দেশ পাব যেখানে কেউ বে-নাগরিক হয় না! জানি, উত্তর মিলবে না। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক আমাদের সেই স্বপ্নটা দেখিয়েছেন। তিনি দিকনির্দেশ করেছেন, সেটাই শিল্পীর কাজ।  আমাদের কাজ সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা।

0 Comments

Post Comment