পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বই দেখলে যে ভয় পায়

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 205 view(s)
  • লিখেছেন : শুভমন
২৫-এর ৫ই অগাস্ট রাত পোহাতেই ২৫ টি গবেষণা গ্রন্থকে নিষিদ্ধকরণের পরোয়ানা জারি হল তামাম কাশ্মীর জুড়ে। অরুন্ধতী রায়ের আজাদি সম্বলিত সে তালিকায় সিংহভাগই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রাবন্ধিক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক ও অধ্যাপকের লেখা বইয়ের নাম।

 চাপা উত্তেজনা বহাল ছিল বেশ কদিন ধরেই। নজরদারির উড়ানগুলো চক্কর কাটছিল মাথার ওপর। কানাঘুষো ঘুরে বেড়াচ্ছিল কাশ্মীরের আনাচে-কানাচে। বিশেষধারা রদের ষষ্ঠ বর্ষপূর্তিতে এমনটাই ছিল উপত্যকার আবহাওয়া। ছ বছর আগেও অগাস্ট শুরুর হপ্তায় ওয়াদিকে এমনই ঘেরাটোপে মুড়ে ফেলা হয়েছিল রাতারাতি। আবারও কি ভাগ হতে চলেছে তবে জম্মু এবং কাশ্মীর? চাপানউতর চলছিল চারপাশে। কিন্তু না। এবার আর ভাগ নয়, বিয়োগ। ২৫-এর ৫ই অগাস্ট রাত পোহাতেই ২৫ টি গবেষণা গ্রন্থকে নিষিদ্ধকরণের পরোয়ানা জারি হল তামাম কাশ্মীর জুড়ে। অরুন্ধতী রায়ের আজাদি সম্বলিত সে তালিকায় সিংহভাগই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রাবন্ধিক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক ও অধ্যাপকের লেখা বইয়ের নাম। 

 চিলির কবি নিকানোর পাররার একটি কবিতা আছে - "ইউনাইটেড স্টেটস, দি কান্ট্রি, হোয়্যার লিবার্টি ইজ এ স্ট্যাচু"। সেই বিখ্যাত ছত্রের অনুরণনেই মগজে সেদিন দানা বেঁধেছিল একটি ওয়ান-লাইনার - "কাশ্মীর, আজাদি যেখানে নিষিদ্ধ"! 

 অরুন্ধতীর আজাদি যাঁরা পড়েননি এই ফাঁকে তাঁদের জানিয়ে রাখি, আজাদি কিন্তু কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদের ওপর লেখা কোনো সন্ত্রাসপাঠ নয়। ২০১৮ থেকে '২০ সময়কালের এই প্রবন্ধ সংকলনে ভারতের সামগ্রিক সমাজের চেহারা ধরা দেয়। দিল্লি জুড়ে সিএএ - এন আর সি বিরোধী আন্দোলন, তাকে কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যে শাসক-সংঘীর গুন্ডাগর্দি, সেই তুমুল ডামাডোল আর খুনখারাপির মাঝে ভারত সফররত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতকে ৩ বিলিয়ন ডলারের এম এইচ-৬০ হেলিকপ্টার বেচা, ১৯-এর জাতীয় নির্বাচন ও তার অব্যবহিত আগেই পুলওয়ামা বিস্ফোরণ, কোভিড মহামারী, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিক্ষোভ আন্দোলন, বিশেষ ধারা রদের আগে ও পরে কাশ্মীরি সমাজের বাস্তব চিত্র, সারা দেশব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও দলিত নিপীড়ন আর গৈরিকী সন্ত্রাসের ছবি তুলে ধরে অরুন্ধতীর আজাদি। শিরোনামের আজাদি এখানে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বপ্ন নয়, বরং শাসক-সঙ্ঘী-কর্পোরেটের ত্রিফলা উপনিবেশীকরণ থেকে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আবশ্যিকতার বয়ান। লেখিকার ভাষায় ফ্রিডম উইথ রেসপন্সিবিলিটি। 

  তা অরুন্ধতী ছাড়া আর কারা রয়েছেন এই নিষিদ্ধ তালিকায়? রয়েছেন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ডিনার অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ও প্রাক্তন সাংসদ সুগত বসু ও তাঁর ভাই লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স-এর অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুমন্ত্র বসু। যাঁরা একাধারে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের দাদা শরৎ চন্দ্র বসুর নাতি। রয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ জি নূরানি। রয়েছেন নর্দার্ন কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নৃতত্ত্ববিদ আতহার জিয়া, অস্ট্রেলিয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার স্নেডেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ইতিহাসবিদ ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ড, আপোষহীন সাংবাদিক অনুরাধা ভাসিন। রয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য স্যার গুরুদাস ব্যানার্জির উত্তরসূরী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী ভোলা চ্যাটার্জির কন্যা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নৃতত্ত্ববিদ অঙ্গনা চ্যাটার্জি, প্রমুখ। 

 এমন সমস্ত স্কলারদের ২৫ টি গবেষণা গ্রন্থকে রাতারাতি নিষিদ্ধর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হল। ছানবিন করা হল শ্রীনগরের যাবতীয় বইয়ের দোকানে। কেড়ে নেওয়া হল গ্রন্থগুলির সমস্ত প্রকাশিত কপি। অভিযোগ কী? বইগুলোয় নাকি সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এসব পড়লে নাকি কাশ্মীরের যুব সম্প্রদায় উচ্ছন্নে যাবে, উদ্বুদ্ধ হবে আতঙ্কবাদে। এবং এখানে নাকি ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। বাস্তব যদিও ঠিক উল্টো কথাই বলে। কারণ এ সমস্ত বইয়ের অধিকাংশতেই শান্তির পথে আলোচনার রাস্তায় কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের দিশা দেখানো হয়েছে। সুগত বসু ও আয়েশা জালাল সম্পাদিত নিষিদ্ধ পুস্তক কাশ্মীর অ্যান্ড দ্য ফিউচার অফ সাউথ এশিয়া-তে একটি গোটা অধ্যায় রয়েছে হিলিং দ্য উন্ড (আঘাতের শুশ্রুষা) নামে। এ জি নূরানীর দ্য কাশ্মীর ডিস্পিউট প্রথম খন্ড শেষ হচ্ছে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের ভাবনার অনুষঙ্গ দিয়ে। 

 আর ইতিহাস বিকৃতি? ইতিহাসের নথির গ্রহণযোগ্যতার দিকটি কী কী বিষয়ের উপর নির্ভর করে? করে অনেকগুলি বিষয়ের ওপর। যেমন গবেষণায় প্রযুক্ত তথ্যানুসন্ধানের পদ্ধতিগুলি কতটা বিজ্ঞানসম্মত। কতটা ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়েছে। পূর্বে গৃহীত তথ্যের কী কী রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী মানুষের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় কোন কোন দিক উঠে এসেছে। ঘটনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ। ঘটনার বাস্তবতা পরিদর্শন বা গ্রাউন্ড রিয়ালিটি চেক। দীর্ঘ গবেষণার মধ্য দিয়ে লেখক যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ইতিহাস বিচারের মাপকাঠিতে তা কতটা যুক্তিযুক্ত? প্রকাশনা সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা বা ক্রেডিবিলিটি। এমনকি লেখকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাঁর পূর্বকৃত অন্যান্য গবেষণার স্বীকৃতি। বিভিন্ন ইতিহাসবিদের মধ্যেও অনেক সময় মতপার্থক্য থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপকতর গবেষণার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘচর্চার ফসল স্বরূপ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যেতে পারে। এখন এই বইগুলির প্রকাশক কারা? পৃথিবীর শিক্ষিত মহলে কী তাদের গ্রহণযোগ্যতা? এ বইগুলির প্রকাশনা সংস্থা হল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন প্রেস, হার্পার কলিন্স, লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স-এর গবেষণা পত্র প্রভৃতি। না, হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বই এই তালিকায় নেই। 

একটা ব্যাপার এখানে খেয়াল করা জরুরি। সম্প্রতি একটা গৈরিক হাওয়া উঠেছে যে এতদিন যে ইতিহাস আমরা পড়ে এসেছি তা অধিকাংশই বিকৃত। প্রচলিত ইতিহাস নাকি বামপন্থীদের দ্বারা রচিত। আর সংঘীরা কেবল হাওয়া তুলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, বিকল্প ইতিহাসের ভুরি ভুরি বইও তারা এনে ফেলেছে বাজারে। ফলে প্রচলিত ইতিহাসের পাশাপাশি সমান্তরাল ইতিহাস ব্যাখ্যার একটি পাল্টা যুক্তির স্তর গড়ে তুলছে তারা। স্বভাবতই সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। কোন ইতিহাসটি গ্রহণযোগ্য, বুঝে ওঠার আগেই তাদের মগজ ধোলাই হয়ে যাচ্ছে। যদিও হুজুগে হৈ হৈ করে ওঠার আগে গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে মানুষের ছেঁকে নেওয়া জরুরি যে কোন ইতিহাসটি প্রকৃত গ্রহণীয়। দেখে নেওয়া দরকার সংঘী বর্ণিত ইতিহাস লিখছে কারা? কী তাদের ক্রেডিবিলিটি? সেক্ষেত্রে চিন্তাশীল মানুষের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার দাবি থেকে যায়। 

 সবদিক বিবেচনা করে তাহলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনোই যাচ্ছে যে ইতিমধ্যেই বিদগ্ধ মহলে সমাদৃত আলোচ্য এই ২৫টি বইতে সন্ত্রাসবাদে উস্কানির কোনো উপাদান নেই। এবং বিকৃত তো নয়ই, বরং এখানে যথাযথ ইতিহাস লিপিভুক্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে নিষেধ কেন? ইতিহাসকে নিষেধ তখনই করা হয়ে থাকে, সে ইতিহাস যখন নিষেধকারীর কাছে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর নিষেধকারীর কাছে তা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কখন? যখন অতীত তার নিজের কাছেই গ্রহণীয় হয় না। অর্থাৎ তার অবচেতন যখন বিলক্ষণ জানে যে যা সংঘটিত করা হয়েছিল, তা উচিত কার্য হয়নি। এমতাবস্থায় শাসক চায় গ্রন্থাগার থেকে প্রকৃত ইতিহাস মুছে দিয়ে আপামর প্রজাদের চোখে নিজের পছন্দসই চশমা পরিয়ে দিতে। কেন চায় পছন্দসই চশমা পরিয়ে দিতে? চায়, কেননা যে অতীত শাসকের নিজের কাছেই গ্রহণীয় নয়, তার নিজের মনেই যে অতীত প্রশ্ন জাগায়, সে তো ভুক্তভোগী প্রজাদের মগজে প্রশ্ন তুলবেই। আর ফ্যাসিস্ট আর যাই চাক না কেন, প্রশ্নকে একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না। কাজেই কেবল রাজপথে কারফিউ নামিয়েই সে আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না, প্রজাদের মগজে কারফিউ জারি করতে চায়। 

 এই চশমার পরিসর কিন্তু কাশ্মীরের কাঁটাতারেই সীমাবদ্ধ নয়। কারণ শাসকের দুশ্চিন্তা যে সর্বত্রগামী। তাই সাম্রাজ্য জুড়েই সে চশমা বেচতে থাকে। স্বীকৃত ইতিহাসকে দেশের পাঠ্যসূচি থেকে ছেঁটে ফেলা হয়। চক্ষুশূল মোঘলদের ইতিহাসকে সে আর এনসিইআরটি সিলেবাসে ঠাঁই দেয় না। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও নিয়ে আসে সঙ্ঘী বিবরণ। বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি থেকেও সে মুছে ফেলে ডারউইন, পর্যায় সারণি, প্রভৃতিকে। বিজ্ঞানেও তার অনীহা কেন? কারণ বিজ্ঞানও যে প্রশ্ন করতে শেখায়। পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও ঢুকে পড়ে চশমার প্রচার। বিকৃত ইতিহাসের বাজার জমাতে থাকে সে বলিউডি ছায়াছবির পসরায়। বিরুদ্ধ স্বরের ওপর নির্বিচারে চলতে থাকে সেন্সর বোর্ডের কাঁচি। 

 বইতে এই বিধি নিষেধ কি মঙ্গল গ্রহ থেকে আমদানিকৃত? আকাশ থেকে পড়ল হঠাৎ করে? মোটেই নয়। বই নিষিদ্ধকরণে সিদ্ধহস্ত ছিল স্বয়ং হিটলার। তার বদান্যতায় নিষিদ্ধ হয়েছিল মার্কস, এঙ্গেলস, ফ্রয়েড, ব্রেশ্ট, আইনস্টাইনের গ্রন্থাবলি। মুসোলিনির হাতে বন্ধ হয়েছিল হেমিংওয়ে, রেমার্কের কাজ। গত শতাব্দীর গোড়ায় ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশরাজ নিষিদ্ধ করেছিল মহাত্মা গান্ধীর বই ইন্ডিয়ান হোম রুল। তাতে অবশ্য ইতিহাসের স্বরকে রোখা যায়নি। রোখা যায়নি বিরুদ্ধতার বহমানতাকে। সময়ের কাছে হার মানতে হয়েছে খোদ শাসককেই। আসলে যুগে যুগে দেশে দেশে সারস্বত চর্চায় ফ্যাসিস্ট শাসকের ভয় পাওয়াটাও একটা ইতিহাস। আর ভয় পাবে নাই বা কেন? সৎ সাহিত্য যে ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। আর অপরাধী প্রমাণ রাখতে চায় না।

0 Comments

Post Comment