পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জাতীয় সঙ্গীত বদল - বিতর্কের উদ্দেশ্য কি ?

  • 19 December, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2306 view(s)
  • লিখেছেন : মীনাক্ষী ভট্টাচার্য
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত "জন গণ মন অধিনায়ক" গানটি ১৯৫০ সালের ২৪শে জানুয়ারি জাতীয় সংগীত হিসাবে গৃহীত হয়। বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে, রাজেন্দ্র প্রসাদের উপস্থিতিতে কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির প্রতিটি সদস্য সমবেত ভাবে "জন গণ মন" গেয়ে গানটিকে ভারতের জাতীয়সংগীত হিসাবে সিলমোহর দেন। এখন এটা বদলানোর চিন্তাভাবনা চলছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কি?

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত "জন গণ মন অধিনায়ক" গানটি ১৯৫০ সালের ২৪শে জানুয়ারি জাতীয় সংগীত হিসাবে গৃহীত হয়। বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে, রাজেন্দ্র প্রসাদের উপস্থিতিতে কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির প্রতিটি সদস্য সমবেত ভাবে "জন গণ মন" গেয়ে গানটিকে ভারতের জাতীয়সংগীত হিসাবে সিলমোহর দেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ না করা, অনেকক্ষেত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ সবসময়ই জাতীয় সংগীত হিসাবে "জন গণ মন অধিনায়ক"-এর বিরোধিতা করেছে। গানটি রচনার পর থেকেই বিতর্ক হয়েছে, যা আজও পিছু ছাড়েনি। রবি ঠাকুর গানটি রচনা করেন ১৯১১ সালের ১১ই ডিসেম্বর, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ ভারতে আসেন ১২ই ডিসেম্বর, ১৯১১ সালে। অনেকে দাবি করেন, ওই "জন গণ মন" আসলে পঞ্চম জর্জের স্তুতি গান, "অধিনায়ক" বলতে তাঁকেই বুঝিয়েছেন কবিগুরু। অর্থাৎ কবি গুরুর এই সৃষ্টি আসলে ব্রিটিশ বন্দনা, দেশাত্মবোধক গান না- এই অভিযোগ উঠেছে বারবার। কিন্তু এ দাবি বারবার নস্যাৎ করেছেন রবীন্দ্র গবেষকরা। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য, ঐতিহাসিক নিমাই সাধন বোস ও প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক প্রবোধ চন্দ্র সেন আরএসএসের এই দাবিকে যুক্তি ও তথ্য সহযোগে খণ্ডন করেছেন। ১৯৩৯ সালে বন্ধু কালিদাস নাগকে লেখা চিঠিতে স্বয়ং রবি ঠাকুর আর এস এসের এই দাবিকে খণ্ডন করেছেন। সুতরাং এই বিষয়ে আর বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না। ১৯১১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের ২৮তম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে "জন গণ মন" গানটি প্রথমবারের মতো গাওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র "দিল্লী দরবার" বইটিতে ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর পঞ্চম জর্জের আগমনের দিন তাঁকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানাতে কোনো বাংলা গান গাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া গানটিতে "স্নেহময়ী তুমি মাতা" শব্দগুলি আছে, এগুলো কখনই পঞ্চম জর্জকে সম্বোধনের জন্য হতে পারে না। এই সম্পর্কে সমস্ত বিতর্কই তাই অহেতুক ও পরিকল্পিত - তা সহজেই অনুমান করা যায়। "স্নেহময়ী তুমি মাতা" পরিষ্কার ভাবেই বলে দেয় "জন গণ মন" গানটি আসলে দেশ মাতৃকার গান, অর্থাৎ দেশাত্মবোধক গান।

পরবর্তী ক্ষেত্রে বিতর্কটি অন্য ভাবে উপস্থাপন করা হয়। আর এক বাঙালি আইকন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা "বন্দেমাতরম" গানটি

ভারতের জাতীয় গান হিসাবে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু আরএসএসের দাবি, এই গানটিই জাতীয়

সংগীত হওয়ার যোগ্য, "জন গণ মন" না। কারণ "বন্দেমাতরম" গানটি নাকি বেশি দেশাত্মবোধক। এরকমই অদ্ভুত সব যুক্তি খাড়া করা হয়েছে বারবার। কারণ আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদীরা সবসময়ই রবীন্দ্র আদর্শ বিরোধী। রবীন্দ্রনাথের সর্ব ধর্ম সমন্বয়, সহিষ্ণুতা বড় অপ্রিয় সংঘের। তাই তাঁর লেখা "জন গণ মন" গানটিকে যেকোনো মূল্যে ভারতের জাতীয় সংগীত থেকে বাদ দিতে চায় তারা। ভাইয়াজ্জি যোশীর মতো আরএসএস শীর্ষ নেতৃত্বও সরাসরি এই বিতর্কে জড়িয়েছেন। কখনও কখনও গানটির মধ্যে "সিন্ধু" শব্দটিকে নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে, কারণ সিব্ধু বর্তমানে পাকিস্তানে।

সাম্প্রতিক কালে বিজেপি সাংসদ, বিতর্কিত নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী এই বিতর্ককে নতুন ভাবে খুঁচিয়ে দিয়েছেন। তিনি ভারতের জাতীয়

সংগীতকে পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়েছেন। তিনি দাবি তুলেছেন "জন গণ মন" র পরিবর্তনে সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের গানটিকে ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হোক। বাংলা ও বাঙালি তথা ভারতের দুই নক্ষত্রের মধ্যে লড়াই লাগিয়ে বাঙালিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চলছে। "নেতাজী"কে হাইজ্যাক করার চেষ্টা গত কয়েকবছর ধরেই চালাচ্ছে বিজেপি। প্রসঙ্গত, সুভাষ চন্দ্র বসু সব সময়ই হিন্দু মহাসভা বা আরএসএসের বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু নেহেরুকে বিরোধিতা করতে সবসময়ই সুভাষচন্দ্র বসুকে ঢাল করে ভোট অস্ত্রে শান দেয় আরএসএস-বিজেপি।

বাঙালির প্রাণের ঠাকুর রবি ঠাকুরের লেখা "জন গণ মন" পরিবর্তনের দাবি করলেন বিজেপি সাংসদ, এ জিনিস বড়ই ক্ষোভের, কষ্টের৷ রবীন্দ্রপ্রেমী, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকল মানুষ সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন, প্রতিবাদ করলেন। বাঙালি হিসাবে প্রতিবাদে মুখর হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আবেগ অনেক সময় আমাদের ভুল পথে চালিত করে, আমাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়াগুলোকে গুলিয়ে দেয়। আর একটা দিক তলিয়ে ভাবা জরুরী।

তাই এবার আবেগ থেকে নিজেকে বের করে কয়েকটা সহজ কথা বোঝা জরুরি। সুব্রহ্মণ্যম স্বামী কখন এই জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি তুললেন? সময়টা খেয়াল করুন। বাংলার বিধানসভা নির্বাচন দুয়ারে, একটা রাজনৈতিক দল তার গায়ে লাগা "বহিরাগত", "বাঙালি বিরোধী" তকমা ঝাড়তে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আগামী ২০ তারিখ বিশ্বভারতী আসছেন রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সম্ভবত সমাবর্তনে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখবেন পদাধিকার বলে বিশ্বভারতীর আচার্য তথা রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যেই তাঁর মধ্যে রবীন্দ্র প্রেমী, বাঙালি প্রেমী সাজার মিথ্যে চেষ্টা দেখছি, দাড়িও রেখেছেন রবি ঠাকুরের ধাঁচে।

সুব্রহ্মণ্যম স্বামী বাঙালির মধ্যে উৎকন্ঠা, ক্ষোভের জন্ম দিলেন। এবার সেই ক্ষতে মলম লাগাবেন মোদী-শাহ। বার্তা দেবেন, "জন গণ মন" পরিবর্তন করা হবে না, তারা রবীন্দ্র প্রেমী। সঙ্গে সঙ্গে মোদি হয়ে উঠবেন বাঙালির মসিহা। সংবাদমাধ্যম তারস্বরে ঢাকঢোল পেটাবে, মোদিকে রবীন্দ্র প্রেমী, বাঙালির বন্ধু হিসাবে দেখানো হবে। অর্থাৎ "সর্প হইয়া দংশাও, ওঝা হইয়া ঝাড়ো"। মনে হবে যেন, মোদি রবি ঠাকুরকে এই যাত্রায় রক্ষা করলেন, তিনি বাঙালির ত্রাতা।

অদ্ভুত, রবি ঠাকুর ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তাঁর সৃষ্টি অমর, " জন গণ মন" ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ছিল, কোনো সমস্যাই ছিল না। তার দলের নেতা সেটা নিয়ে কথা বললেন, পরিবর্তনের দাবি তুললেন। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাঙালির কাছে হিরো হয়ে যাবে কেউ কেউ। এই সহজ রাজনৈতিক চাল বোঝা জরুরী। আমাদের এই ফাঁদে পা দিলে চলবে না। আমরা জানি, কাদের আদর্শ সম্পূর্ণ রূপে রবি ঠাকুরের আদর্শ বিরোধী, আমরা জানি কারা রবি ঠাকুরের শত্রু। আমরা জানি কারা NCERT সিলেবাস থেকে রবি ঠাকুরের নাম বাদ দিয়েছে, আমরা জানি ত্রিপুরাতে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি কারা ভেঙেছে, আমরা জানি পাটনায় রবীন্দ্র চকের নাম বদলে "অটল চক" কারা করেছে। তারা একদিকে প্রতি সেকেন্ডে রবি ঠাকুরকে মুছে ফেলতে চেষ্টা চালাচ্ছে, অন্যদিকে ভোটের আগে রবি ঠাকুরকে বেচছে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না৷

আমাদের সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। এই বিষয়েটি এবার একটু গভীরে বিশ্লেষণ করে দেখার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করি।

লেখক ঃ গবেষক, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

0 Comments

Post Comment