পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সরষের মধ্যে ভূত – জিন বদলের কাহিনী

  • 07 November, 2022
  • 1 Comment(s)
  • 1154 view(s)
  • লিখেছেন : অংশুমান দাশ
একদিকে ভারত সরকার বলছেন প্রাকৃতিক কৃষির প্রচারের কথা – সদ্য সদ্য এনেছেন ‘ন্যাশানাল মিশন অন ন্যাচারাল ফার্মিং’ – আবার পাশাপাশি এই জি এম এর বাজনা? জিএম ফসল জৈব কৃষিতে অনৈতিক। যেহেতু আগাছা নাশক দেওয়া হবে, তাই এর সঙ্গে মিশিয়ে চাষ করা যাবেনা কিছুই। গম-সরষে খুবই প্রচলিত মিশ্র ফসল।  এই দ্বিচারিতার উৎসই বা কী আর শেষই বা কোথায়?

শরীরের কোষে জিনের মধ্যে লেখা থাকে আমাদের স্বভাব চরিত্র কেমন হবে তার বর্ণনা। সুতরাং জিনের কিছু অংশে অন্য কিছু লিখে দিতে পারলে, মানে জিনের গঠন বদলে দিলেই আমাদের চেহারা যাবে বদলে। জিনের পরিবর্তন মানেই গেল গেল রব উঠে যাওয়ার ব্যাপারটার ভিত্তি কোথায় তা একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

 

প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ জিন বলে প্রায় কিছু হয়ই না।লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নানা জীবের মিলমিশ হচ্ছেই,তা না হলে এককোষী অণুজীব থেকে আজকের এই জৈব বৈচিত্রে পৌঁছানো সম্ভব হত না। যেমন মনে করা হয় মানুষের জিনের প্রায় ৪০ শতাংশেরই দাবীদার অন্য কেউ। তাহলে কি যে কারোর সঙ্গে যে কেউ মিলে মিশে হাতিমি তৈরি হতে পারে? তা অবিশ্যি পারে না। বেশ কিছু বাধা আছে। কিছু সাযুজ্যের দরকার আছে তবেই জিনের আংশিক গ্রহণ বা বর্জন হয় – তার সব রহস্য এখনও সমাধান হয়নি।তবে দুটো জাতের মধ্যে হলেও দুটো প্রজাতির মধ্যে মিলমিশ বেশ বিরল। তার মধ্যে কেউ থাকে, কেউ হারিয়ে যায়।যারা থাকে তারা কিন্তু নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষতিকর দিক ঝেড়ে ফেলে স্থিতিশীল হয় হাজার বছর ধরে।তাহলে যে বিশুদ্ধই নয়, তার পরিবর্তন নিয়ে আবার এত চিন্তা কিসের?

চিন্তা আছে

 প্রাকৃতিকভাবে জিনের যে বদল হয়, তা মিলন বা পরাগমিলনের মাধ্যমে – এমন কি হাইব্রিড ফসলও।কিন্তু ল্যাবরেটরিতে যে জিন প্রতিস্থাপন হয়, তা জোর করে – একটা অংশ কেটে নিয়ে সেখানে আর একটা অংশ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কৃত্রিম ভাবে।এ ভাবে কিছু চমৎকার উপকার পাওয়া গেছে যেমন ইনসুলিন তৈরি করতে বা হার্টের ওষুধ হেপারিন বানাতে কিন্তু মাথায় রাখতে হবে – তা ল্যাবরেটরিতে। কৃষিক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হচ্ছে মাঠে – উন্মুক্ত প্রকৃতিতে।একটা জিনে একটা কেবলমাত্র অন্য একটা জিনের অংশ ঢুকিয়ে দিলেই তার পরিবর্তন আসবে, এই জায়গায় একটা তাত্বিক গলদ আছে। যে কোনও জীবন কী রকম ভাবে পরিস্ফুট হবে, কী রকম ফসল ফলাবে তা নির্ভর করে তার পারিপার্শ্বিকের উপরেও, প্রতিবেশের উপরেও। এবং সেই ফসলটিও নানাভাবে প্রতিবেশের অন্য উপাদানের উপরে প্রভাব খাটাতে পারে। সুতরাং আন্তঃসম্পর্কের জটিলতাকে এই প্রযুক্তি অস্বীকার করেছে – অস্বীকার করেছে বৈচিত্রকে।মানুষ এবং কেবল মানুষই এই প্রযুক্তির কেন্দ্রে – প্রকৃতি নয়।কৃষিতে জিন প্রযুক্তি জটিলতা থেকে বাঁচার জন্য একধরণের সরলতা ও একমুখীতা দাবী করে – কারণ ল্যাবরেটরির সরল পরিস্থিতিতেই তার জন্ম ও সফলতা – তাই সব তুলো বীজ ভারতবর্ষের বাজার থেকে সরিয়ে দিয়ে এখন কেবল জিন বদলানো তুলো। এর ফলে পছন্দসই চাষের অধিকার একেবারেই হারিয়ে ফেলবেন কৃষকরা। উপরন্তু এই বীজ ফলনে সার ও জলের প্রয়োজনীয়তা বেশি বই কম হবে না। খরচ কি কমবে? একেবারেই না। এই বীজের দামও হবে বেশী।  

 

ল্যাবরেটরি থেকে মাঠে এনে ফেললে কী হয় তার উদাহরণ বিটি টেকনোলজির হালত। বিটি মানে ব্যাসিলাস থুরিঞ্জিয়াসিস, এক ধরণের ব্যাক্টেরিয়া, যা পোকা মারার জন্য ব্যবহার করা হয়।তুলো গাছে এবং পরে বেগুন গাছের জিনে এই ব্যাকটেরিয়ার জিন জুড়ে এমন বীজ বানিয়েছেন কিছু বীজ কোম্পানি যাতে এই বীজ থেকে গাছ নিজেই হবে বিষাক্ত।তাই তাকে আর পোকায় খাবে না, আর পোকা মারা বিষ দেওয়ারও দরকার হবে না। আপাত ভাবে শুনতে ভালো হলেও জিন বদলানো খাবারের নানা অস্বাস্থ্যকর প্রভাব যেমন অ্যালার্জি, প্রজনন স্বাস্থ্য, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা শুরু থেকেই সতর্ক করে আসছেন।এই ক্ষতি অনেকসময় হতে পারে এক প্রজাতির জিনের টুকরো অন্য প্রজাতির জিনে প্রতিস্থাপনের সময় নানা অবাঞ্ছনীয় পরিবর্তনের ফলে ফসলে ক্ষতিকারক যৌগ উৎপন্ন হয়ে যাওয়াতে। আবার জিন ফসলের সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকে আসতে পারে কীটনাশক বা আগাছানাশক। যেমন ধরা যাক বিটি তুলোর গল্প।বিটি প্রযুক্তির তুলো গাছ বলওয়ার্ম পোকাকে লক্ষ্য করে তৈরি, বলওয়ার্ম গেল – কিন্তু তার পরিবর্তে এখন বলওয়ার্মের চাপে লুকিয়ে থাকা সাদা মাছি, জাব পোকা তেড়ে ফুঁড়ে প্রধান শত্রু পোকা হয়ে উঠল।বিটি তুলো তাকে আটকানোর জন্য তৈরি নয় – তাই তাকে মারতে শেষমেশ বেড়েই গেল কীটনাশকের প্রয়োগ।সাময়িক ভাবে উপকার হলেও ফলন এখন পড়তির দিকে – খরচও আকাশছোঁয়া।

 

জিএম সর্ষের কাহিনীটি কী? এই সরষে, ধারা মাস্টার্ড হাইব্রিড – ১১ (DMH-11), এক ব্যাক্টেরিয়ার জিনকে সরষেতে ঢুকিয়েই তৈরি। এই প্রযুক্তিতে একদিকে সরষের স্বপরাগায়নকে দমিয়ে রেখে শংকরায়ন করতে বাধ্য করা হয় – অন্যদিকে এমন এক উৎসেচক তৈরি করে এই গাছ, যা কিনা গ্লুফোসিনেট নামের আগাছানাশক সহ্য করতে পারে।তার মানে সরষে ক্ষেতে আগাছা হলে যত খুশি গ্লুফোসিনেট দাও – আগাছা মরবে, কিন্তু সরষে গাছ দাঁড়িয়ে থাকবে দিব্যি।

এই উপরের চার লাইনের প্রযুক্তিতেই লুকিয়ে যত আশঙ্কা। আগাছা মারতে মাত্রা ছাড়া আগাছা নাশক দেওয়া হবে না এবং সেই আগাছানাশক আমাদের খাবারের থালা অবধি হানা দেবে না তার কী গ্যারান্টি? আর কী সেই আগাছানাশক? গ্লুফোসিনেট – অটিজমের সূত্রপাতে এর জুড়ি মেলা ভার। আগাছানাশক হজম করে যখন আরও শক্তিশালী আগাছা আসবে – তখন কি আরও গ্লুফোসিনেট? আমরা বাঙালীরা সরষে শাক খাই, সরষে ফুলও খাই – এর পর তো চোখে সরষে ফুল দেখতেও হবে। শুধু কি আমার শরীরে? কী হবে সরষে ক্ষেতে বিটলদের, মৌমাছিদের? পিঁপড়ে, ফড়িং, মাকড়সা, প্রজাপতির শরীরে? কী হবে মধুর ক্ষেত্রে? সরষের মধু তো এখনও অবধি সব থেকে বেশি প্রচলিত মধু। সরষে পরিবারে থাকা আরও অন্য ফসল ও জংলী গাছের সঙ্গে পরাগমিলনের সম্ভাবনাও তো প্রচুর। সেক্ষেত্রে স্বপরাগায়ন আটকানোর জন্য যেভাবে পুরুষত্বের বন্ধ্যাত্ব আনা হয়েছে DMH-11 তে, তাও তো ছড়িয়ে যেতে পারে – সুতরাং পুরুষ ফুল অথবা পরাগ বন্ধ্যা হলে উৎপাদন কমে যাওয়ার ঝুঁকিও তো বাড়বে। তখন? এই সবের কোনও উত্তর নেই – কোনও পরীক্ষা হয়নি।

 

একদিকে ভারত সরকার বলছেন প্রাকৃতিক কৃষির প্রচারের কথা – সদ্য সদ্য এনেছেন ‘ন্যাশানাল মিশন অন ন্যাচারাল ফার্মিং’ – আবার পাশাপাশি এই জি এম এর বাজনা? জিএম ফসল জৈব কৃষিতে অনৈতিক। যেহেতু আগাছা নাশক দেওয়া হবে, তাই এর সঙ্গে মিশিয়ে চাষ করা যাবেনা কিছুই। গম-সরষে খুবই প্রচলিত মিশ্র ফসল।  এই দ্বিচারিতার উৎসই বা কী আর শেষই বা কোথায়?

এই সমস্ত তর্ক উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এক যুক্তিতে - DMH-11 তে নাকি উৎপাদন বাড়বে ৩০%। এই ‘৩০%’ হিসাবে কীভাবে পৌঁছলেন বিজ্ঞানীরা। একটাই উত্তর – ধামাচাপা দিয়ে।

 

DMH-11 চার বছরে ১৮ টা জায়গায় ট্রায়াল করা হয়েছে। কিন্তু তথ্য হিসাবে পেশ করা হয়েছে বেছে বেছে তিন বছরের ৮টি জায়গার ফলাফল। সেই মত দেখলেও DMH-11, ক্রান্তি জাতের থেকে থেকে ৯% এবং DMH-1 জাতের থেকে ১.৫% বেশি উৎপাদনশীল, এবং গড় উৎপাদন ২৬২৬ কেজি/হেক্টর । সব ট্রায়াল ধরলে এর গড় উৎপাদন আসলে ২০২৯ কেজি/হেক্টর। RH 749, DRMRIJ 31, NRCDR 2, DMH-1, NRCHB 506, Coral 437 – বাজারে পাওয়া এই সমস্ত সরষের উৎপাদন ক্ষমতা ২০২৯ কেজি/হেক্টর-এর থেকে বেশি। যেখানে ১০০০টি বীজের ওজন DMH-11-র ক্ষেত্রে ৩.৩ গ্রাম, সেখানে RH 749-এর ৬.৯ গ্রাম, NRCDR-2 এর 4.9 গ্রাম।     

 

সরষেকে শ্রী পদ্ধতিতে চাষ করলে, অর্থাৎ তার শিকড়কে ঠিকঠাক নিজের মত ছড়াতে দিলে সরষের উৎপাদন অনেক বাড়ানো যায়। মধ্যপ্রদেশ কৃষি দপ্তরের করা ২০১২-১৩ সালের ট্রায়ালে  উৎপাদন হয়েছে ৪৬৯৩ কেজি। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, সরষের মধ্যে ভূত ঢোকাতে এত কেন সক্রিয় বিজ্ঞানীরা? আগাছানাশকের বিক্রি বাড়াতে, না বীজের বাজারের দখল নিতে?

 

উৎপাদন বাড়বে – এই যুক্তি ছাড়াও বিজ্ঞানীরা বলছেন এতে নাকি তেল আমদানীর পরিমাণ কমবে। আমাদের মোট তেল খরচের ১৪% মাত্র সরষের তেল, মোট তেলবীজ উৎপাদনের ২৩.৬% মাত্র সরষে। বাকি সব পাম, সয়াবীন, নারকেল তেল আরা অন্যান্য তেল। আমরা কি রাতারাতি আমাদের তেল খাওয়ার অভ্যাস বদলে ফেলে সবাই সরষের তেল খেতে থাকব? এই ভ্রান্ত যুক্তি আমরা এখনও মেনে নিচ্ছি?  

 

এতদিন ঠেকিয়ে রাখার পর, ১৮ই অক্টোবর ২০২২ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রুভ্যাল কমিটি এই সরষেকে ছাড়পত্র দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও বন মন্ত্রক ২৫শে অক্টোবর খোলা মাঠে ট্রায়ালের অনুমোদন দেয়। ৫টি রাজ্যে মোট দশ কেজি বীজ এখানে সেখানে ট্রায়াল হবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজ, এই প্রতিবেদন যখন লিখছি – সুপ্রিম কোর্ট দেশ জুড়ে হওয়া আন্দোলনের ভিত্তিতে, উপরে লেখা সমস্ত বক্তব্য খুঁটিয়ে দেখে – এই সরষের ট্রায়ালের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছেন। পরবর্তী শুনানি ১০ই নভেম্বর।

 

ততদিন দম নিতে নিতে ভাবতে থাকুন - আপনার রায় কী বলে?

তথ্যসূত্র ঃ http://indiagminfo.org/gm-mustard-expertspeak/

 

 

1 Comments

sankar ray

15 November, 2022

মুশকিল হল সিপি আই(এম) নেতৃত্বাধীন সারা ভারত কিষাণ সভা ভারত সরকারের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রুভ্যাল (অ্যাপ্রুভ্যাল নয়, অ্যাপ্রেইজাল) কমিটির এই DMH-11 সরষেকে ছাড়পত্র দেওয়াকে স্বাগত জ্ঞাপন করেছে। এ আই কে এস-এর দুই প্রধান নেতা হান্নান মোল্লা (সদ্য-অবসৃতপার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য) ও অশোক ধাওয়ালে (পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য) এক যৌথ বিবৃতিতে তা প্রত্যয়িত করেছে। এখনো কেন অন্য বাম পন্থী দলের কৃষক সংগঠনের নেতারা নীরব হয়ে এ আই কে এস-এর এই গদ্দারিকে এখনো পরোক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে। ইতিহাসের এমন পরিহাস যে তৃণমুল কংগ্রেসও আর এস এস-চালিত স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ প্রতিবাদ জানিয়েছে এই ছাড়পত্র দানের বিরুদ্ধে।

Post Comment