পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কার কাছে? কার জাস্টিস?

  • 07 September, 2024
  • 1 Comment(s)
  • 679 view(s)
  • লিখেছেন : মালবিকা মিত্র
তিলোত্তমা ও তার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন এর বিরুদ্ধে যে জাস্টিসের দাবি তা বাস্তবিক কতটা আদায় করা সম্ভব হবে আমার জানা নেই। কিন্তু তিলোত্তমা একটি সামাজিক গণজাগরণের নাম হতে পারে। সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জাস্টিস একটা দাবি হতে পারে। সেই সামাজিক আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে তিলোত্তমার জাস্টিস নিহিত।


অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, সংগীতের স্বর উচ্চ গ্রামে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না। ধীরে ধীরে উচ্চ গ্রামে পৌঁছায় এবং তা কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়, আবার ধীরে ধীরে তা খাদে নেমে আসে। সংগীতের অধিকাংশটা চলে মধ্যম স্বরে। আবার গভীর খাদেও স্বরকে স্থায়ী করা যায় না। কথাগুলো অ্যারিস্টটল বলেছিলেন রাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে, রাজনীতি প্রসঙ্গে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কোন বিশেষ সময় বিশেষ মুহূর্তে গভীর খাতে প্রবাহিত হয়, আবার কখনোবা উচ্চ গ্রামে প্রবাহিত হয়। কিন্তু মূলত অধিকাংশ সময় সে প্রবাহিত হয় মধ্যম বা মডারেট লাইনে। সেই , ভগবান বুদ্ধ কথিত মজঝিম পন্থা।

এটা হল সংগঠিত রাজনৈতিক ক্রিয়া সম্পর্কে মন্তব্য। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত কোন উত্থান বা প্রতিবাদ হঠাৎই উচ্চ গ্রামে পৌঁছায়, ধীরে ধীরে নয়। আর অনিবার্য নিয়ম হিসেবেই তা অতি দ্রুত খাদে নেমে আসে। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে মধ্যম স্বর খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্ষমতা লিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলি এই সুযোগটারই অপেক্ষায় থাকে। তারা এই সময় স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভকে উচ্চ গ্রামে অব্যাহত রাখতে মরীয়া ভাবে সচেষ্ট হয় ও সেই আন্দোলনকে ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে রূপ দেয়। আপন উদ্দেশ্য সাধনে অগ্রসর হয়। অন্যথায় স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হল ফস করে জ্বলে ওঠা ও দপ করে নিভে যাওয়া। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৯ই আগস্ট আর জি করের ঘটনা আর ১৪ ই আগস্ট রাত্রে মেয়েদের রাত দখল করার আহ্বান -- এর মাঝে গণপরিসরে আমরা বিশেষ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখিনি। এমন কি এখানে সেখানে কোন ছোটখাটো সভা - সমিতিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে হতে দেখিনি। কিছু এ আই ডি এস ও র পতাকা, কিছু ডি ওয়াই এফ আই পতাকা, আর বিজেপি নেতা অমিত মালব্যের ট্যুইট এবং সজল ঘোষের উপস্থিতি। এই রাজনীতির বাইরে গণকন্ঠ বিশেষ শোনা যায়নি। অবশ্যই পড়ুয়াদের প্রতিবাদ প্রথম দিন থেকেই লাগাতার বজায় ছিল। কিন্তু ১৪ তারিখের রাতের প্রতিবাদটির আগে কোনো ধারাবাহিক উত্তরণ পর্ব ছিলনা, অবতরণপর্বও ছিল না। যা ঘটেছে সেই দিন রাতেই। যা ঘটেছিল সেই রাতে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য, অভূতপূর্ব । সমগ্র রাজ্যে অংশগ্রহণের মোট সংখ্যা ৩০-৪০ লক্ষও হতে পারে। ওই রাতের অংশগ্রহণ দেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠী এরপর সক্রিয় হয়ে ওঠে, "রাত দখল" কে "দখল" করার জন্য।

সিপিআইএম দীর্ঘ ১২-১৩ বছর হল ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে। আরো উল্লেখযোগ্য যে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এভাবে ক্ষমতাহীন অবস্থা, ঠিক যেন ডাঙ্গায় তোলা মাছ। তাদের কাছে এক্ষুনি রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় আসাটা অস্তিত্বের প্রশ্ন। একই অবস্থা বিজেপি ও বিশেষভাবে কাঁথির অধিকারী পরিবারের। পশ্চিম ও উত্তর ভারতে বলা চলে বিজেপির জনপ্রিয়তা এখন ক্রমশ তলানিতে। বিগত নির্বাচনে সেটা প্রমাণ হয়েছে। বলা ভালো বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। আসাম উড়িষ্যা ও বিহারের সাপোর্ট না পেলে ক্ষমতাবৃত্তের বহু দূরেই তাকে থামতে হতো। সেই কারণে বিজেপির পাখির চোখ এখন বাংলা। যে কোন মূল্যে বাংলার ক্ষমতায় আসতে হবে ও তার জন্য চাই এই রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অবসান। রাজ্যপালদের দিল্লিতে ডেকে মগজ ধোলাই থেকে শুরু করে, মেদিনীপুরে নির্বাচনী পর্যালোচনা সভায়, সর্বত্র এ রাজ্যে যেকোনো মূল্যে একটি অশান্তি জারি রাখার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট বলেছেন, রাজ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি করব, যাতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যপালের রিপোর্টের ভিত্তিতে এখানে ৩৫৫ ধারা জারি করে। সেটা কিভাবে করতে হবে আমার জানা আছে। ফলতঃ আর জি কর ইস্যুটা বিজেপি ও শুভেন্দুর কাছে একটা ফুল টস বল। ভাবছে এবার নাহলে নেভার। আর শুভেন্দুর কাছেও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার এটাই শেষ সুযোগ। সন্দেশখালি চোপড়া আড়িয়াদহ সর্বত্র চললো খোঁজ। মেলায় হারিয়ে যাওয়া শিশু খুঁজতে থাকে তার মামাকে, কালো লম্বা। আর ভুল করে একে তাকে হাত ধরে। "যারেই দেখি উঁচা কালা, তারেই ভাবি বাবার শালা"। এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাতে এসে গেল আরজি কর কান্ড।  

তার মানে দাঁড়ালো, আরজি করে একটি চরম মর্মান্তিক ঘটনা ও খুন, তার প্রতিবাদে ১৪ই আগস্ট সারারাত ব্যাপী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গণ উত্থান। কিন্তু তারপর থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতালোভী, সরকার দখলের জন্য তৃষ্ণার্ত মরিয়া রাজনৈতিক দলগুলি, এই স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণকে দখল করতে এগিয়ে এলো। যা ছিল "উই ওয়ান্ট জাস্টিস" তা পাল্টে গিয়ে হল "দফা এক দাবি এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ"। এই সমস্ত চর্বিত চর্বন কাহিনী সকলের জানা আছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, যে দলহীন গণজাগরণ সেদিন ঘটলো, তাকে একটা মধ্যম স্বরে এনে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেওয়া, সেটা ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলো করবে না। তারা চাইবে আন্দোলনের স্বরকে উচ্চ গ্রামে বেঁধে রাখতে। সরকার কে বেকায়দায় ফেলতে। তাকে দীর্ঘস্থায়ী করা তাদের লক্ষ্য নয়। তাহলে এ কাজটা করবে কে ১৪ ই আগস্ট রাত্রের গণকণ্ঠ থেকে তো সরকার দখলের স্লোগান উচ্চারিত হয়নি। তেমন অভিলাষ কেউ পোষণ করেননি। ক্ষমতাবৃত্তের বাইরের এই রাজনীতিটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ভীষণ জরুরি। যেখানে ন্যায় অন্যায় ফারাক আছে স্পষ্ট। যেখানে রাজা তোর কাপড় কোথায় বলার সৎ সাহস আছে। এই কথা সরকার বাঁচাতে মরীয়া পক্ষ অথবা সরকার ফেলার আগ্রহী সরকারি বাম সিপিএম বা চরম ডান বিজেপি, কেউ বলতে পারবে না। কারণ সাথে সাথে কেরলের প্রশ্ন বা উত্তরপ্রদেশ মনিপুরের প্রশ্ন, হরিয়ানার প্রশ্ন, এসে পড়বে। তাই ক্ষমতাবৃত্তের বাইরের স্বরগুলো খুবই মূল্যবান।

পড়ুয়াদের আন্দোলনেও কিছু পরোক্ষ রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলেও, আমি বিশ্বাস করি পড়ুয়াদের আন্দোলন প্রধানত দলীয় রাজনীতি বর্জিত। তাদের লড়াইয়ের সাথে সরকার পরিবর্তনের দাবি যুক্ত নেই। পড়ুয়া দের জমায়েত গুলো "উই ওয়ান্ট জাস্টিস" যে মেজাজ ও অংশগ্রহণ মেডিকেল কলেজ গুলোতে প্রদর্শন করেছিল, খুব স্বাভাবিক ভাবেই অতো উচ্চ গ্রামে স্বর দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। পূর্ণ সমর্থন থাকলেও সক্রিয়তা কম। তাছাড়া, তদন্তের ভার সিবিআই এর হাতে ন্যস্ত হওয়ার ফলে, দাবি জানানোর কেন্দ্রটিও একটু রিমোট, দূরবর্তী হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট আরও দূরে। যে কোন অরাজনৈতিক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে এমনটাই স্বাভাবিক ভাবে ঘটে। পড়ুয়া ও হাউস স্টাফদের প্রধান দাবি উই ওয়ান্ট জাস্টিস। এই দাবিটা স্পষ্ট, ধর্ষিতা ও খুন হওয়া সহপাঠীর মৃত্যুর যথাযথ তদন্ত, দোষীকে চিহ্নিত করা ও তাকে চরম শাস্তি দেওয়া। কিন্তু "আসছে বছর আবার হবে" বলে, এখানেই তো  আন্দোলন শেষ হতে পারে না। তাই এরপরেই যুক্ত হয়েছে তাদের কর্মস্থলের বেশ কিছু নিরাপত্তার প্রশ্ন ও প্রশাসনিক ত্রুটি-বিচ্যুতির সংস্কারের প্রশ্ন। কিছুটা হলেও, সমস্যার আশু সমাধান।

এখানে এসে যদি আন্দোলন থেমে যায় তাহলে এই আন্দোলন ও তার সমর্থনে ১৪ ই আগস্ট এর রাত দখল আন্দোলনে সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে যায়। প্রয়োজন চলমান এই আন্দোলনকে হাসপাতালে রোগীর সুরক্ষা, পেশেন্ট পার্টির সুরক্ষা, পুরুষ ডাক্তার - নার্সের সুরক্ষা, আউটডোরে যথাযথ চিকিৎসার স্বার্থে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো, এক কথায় সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার সাধন। এরপর নাগরিক সমাজ এই আন্দোলনকে সমাজের অন্যান্য স্তরে, রেল যাত্রী সুরক্ষা, বিদ্যালয়ে ছাত্র সুরক্ষা, শিক্ষকের সমস্যাবলী, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পৌর ব্যবস্থা সর্বত্র আন্দোলনের এই ধারাকে বইয়ে দিতে হবে। যে সামাজিক মনিটরিংটা একদম অবলুপ্ত হয়েছে সেটাকে কিছুটা হলেও সমাজের ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ তিলোত্তমার ঘটনাটি তিলোত্তমায় শেষ হলে তাহলে ভবিষ্যতে আরো অনেক তিলোত্তমা ঘটার অবকাশ থাকে। কারণ প্রতিদিন এমনটা ঘটে চলেছে। নির্ভয়ার ঘটনার পরেও কামদুনি ঘটেছে। কামদুনির পরেও আরজি কর ঘটলো। একটা সামাজিক নজরদারি, বলা ভালো সচেতন তদারকির জন্ম দিক এই দলহীন আন্দোলন। তবেই ১৪ ই আগস্ট এর রাত্রি যথার্থতা পাবে। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ বা শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষমতালাভ এসব কোন কিছুই সেই রাতের লক্ষ্য ছিল না। বরং একটা সামাজিক উত্থান ও জাগরণ ঘটাতে পারলেই তিলোত্তমার প্রতি ন্যায় বিচার করা হবে।

কিন্তু তার জন্য চাই রাজনৈতিক ক্ষমতার লক্ষ্য বর্জিত কিছু দলহীন রাজনৈতিক কর্মকান্ড। সরকারি বাম ব্যাতীত যে সমস্ত বাম শক্তি আছে, যারা ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর নয়, বহু সংখ্যক সামাজিক পরিবেশবাদী, এনজিও আছে, নারী সংগঠন আছে, যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার লক্ষ্য থেকে বহু দূরে, নিরলস কাজ করে চলেছে। এই শক্তিগুলোকে যদি মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া ও হাউস স্টাফরা কাছে টানতে পারে তাহলে একটি দীর্ঘস্থায়ী ধারাবাহিক আন্দোলনের জন্ম দেওয়া সম্ভব।

আমি ধরে নিচ্ছি আন্দোলনকারী ছাত্রদের পিছনে কোন রাজনৈতিক  মদত বা উস্কানি নেই। সেক্ষেত্রে প্রতিবাদী আন্দোলনরত ছাত্রদেরও আত্মবিশ্লেষণে বসতে হবে। যে আমাদের সর্বোচ্চ দাবীগুলি কি এবং ন্যূনতম দাবি কোনটি। কারণ একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ দাবীগুলি আদায় হয়ে যাবে এমন ভাবনা পোষণ করা উচিত নয়। বরং সর্বোচ্চ দাবী নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। মীমাংসা হবে একটি মধ্যবর্তী স্তরে। জানিয়ে দিতে হবে, ছেলে ভুলানো, মন ভুলানো, কথার কথা দিলে হবে না। গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলির ফলো আপ করতে হবে। নিয়মিত ১০-১৫ দিন অন্তর বসা হবে। হাসপাতালে কর্ম বিরতি রিলে পদ্ধতিতে চালু থাকবে। কিছু পড়ুয়া যখন কর্ম বিরতি চালাবে অন্যেরা কাজে যোগদান করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমিক রোস্টার পড়ুয়া ডাক্তাররা নিজেরাই তৈরি করে নেবে। কারণ তারাও রোগী দেখতে সমান ভাবে আগ্রহী। অধিকাংশ নিরক্ষর এর দেশে টেলিমেডিসিন দিয়ে রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার ভাবনাটি আমার মনে হয়েছে খুব যুক্তিপূর্ণ নয়। সেই পরিষেবা রোগীদের ক্ষেত্রে যথাযথ পৌঁছাবে না। তবে পড়ুয়াদের আন্দোলনের পেছনে যদি স্পষ্ট ভাবে কোন রাজনৈতিক মদত ও উস্কানি কাজ করে এবং কর্ম বিরতি যে কোন মূল্যে চালিয়ে যাওয়ার চাপ বা নির্দেশিকা থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে আমার এই প্রস্তাব বর্জন করা যেতেই পারে।

মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এই পর্বটি শুরু হলেই, সামাজিক স্তরেও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণকে পুঁজি করে, মেডিকেল কলেজের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই তদারকি ও নজরদারি চালাবে। ক্ষমতা বর্জিত রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলি সক্রিয় হয়ে উঠবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এটা কিভাবে হবে?

গবেষক দেবল দেবের একটি ব্যক্তিগত মেসেজ এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। "Communist Party of the US-এর আমন্ত্রণে আমি  ecological economics এবং politics of biodiversity conservation বিষয়ে কয়েকবার বক্তৃতা দিয়েছিলাম বার্কলে শহরে। সেসব আলোচনায় মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টি আর নিকারাগুয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কিছু কর্মীও ছিলেন। ২০০১ এবং ২০০৯-এর অনেকটা সময় ধরে (আমার দুটি ফেলোশিপে থাকাকালীন) এঁদের সঙ্গে প্রভূত আলোচনা করে দেখেছি, এই কমিউনিস্টরা প্রচুর পড়াশোনা করেন, পাশাপাশি নারীমুক্তি, পরিবেশ রক্ষা, অশ্বেতাঙ্গ নাগরিক অধিকার রক্ষা, এবং গরিব ছাত্রদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ইরাক যুদ্ধের চরম বিরোধিতার পাশাপাশি পারমাণবিক চুল্লীর বিরোধিতায় এঁরা সমান যুক্তিপূর্ণ ও সক্রিয়। প্রতি ক্ষেত্রে আমি মনে মনে ভারত আর বাংলাদেশের বাম পার্টিগুলোর সঙ্গে নিষ্ফল তুলনা করতাম।" এই হলো ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে থাকা বাম। ঠিক এই কারণে আমি সরকারি বাম বা কমিউনিস্ট ক্ষমতা লিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলি বাদ দিয়ে ক্ষমতাবৃত্তের বাইরের রাজনৈতিক শক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করছি।
 
এবার আসুন প্রাসঙ্গিক আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করি। মহেশ ও সরিতার গল্প বলা যাক। গল্প নতুন কিছু নয়, অনেকেরই জানা, পুরনো। বিহার ঝাড়খণ্ডে কিছু নদী যেগুলি বৃষ্টির জলপুষ্ট।  শোন নদী, চম্পা, গন্ডক, এরা বৃষ্টির জল পুষ্ট। বর্ষা হলে এরা বিহারকে প্লাবিত করে। আবার বর্ষা শেষ হলে এতদঞ্চলে শুষ্ক খরার প্রাবল্য। মহেশ ও সরিতা প্রাচীন ইতিহাস চর্চা করে দেখেছেন, প্রাচীনকালে এই সমস্ত অঞ্চলে বন্যার প্রাবল্য ছিল না। ব্রিটিশ আমলেই এই অঞ্চলে খরা ও বন্যার উপদ্রব এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ রাজ্যের বাইরে জন মজুরের কাজ করতে যায়। অথচ আগে তারা যেত না। তারা দেখলো বন্যা প্রবণ ওই নদীগুলি থেকে অজস্র খাল কেটে নিয়ে দূরবর্তী গ্রামগুলিতে জলাধার সৃষ্টি করে সেখানে জল সঞ্চয় করত। এভাবে খাল ও শাখা খাল কেটে ওই অঞ্চলে জালের মতো বিস্তার করেছিল ক্যানেল। অসংখ্য খাল এবং জলাধার। বর্ষায় যখন জলের আধিক্য ওই খাল দিয়ে বাড়তি জল গিয়ে ভরে ফেলত জলাধার। এর ফলে গ্রামে বানভাসি সমস্যা সামলে দেওয়া যেত। তারপর বর্ষা মিটে গেলেই এই ধরে রাখা জল ব্যবহার করে প্রাত্যহিক কাজ কৃষি কাজ সবই চলত। খরা সমস্যা এর ফলে মোকাবিলা করা সহজ হতো। এই খাল ও জলাধার গুলিকে বলা হত আহর এবং পইন। চল্লিশ টি গ্রাম কে একত্রিত করে, সেই গ্রামের মানুষদের স্বেচ্ছা শ্রমে, কাটা হয়েছিল মোট প্রায় ২০০ কিলোমিটার খাল। এর সাথে খনন হয়েছিল অসংখ্য বড় বড় জলাধার। যে অঞ্চলে কর্মসংস্থান হতো না, ছিল খরা প্রবন। মানুষ চলে যেতো অন্যত্র জন মজুরী করতে। সেই গ্রামের মানুষ এবার গ্রামেই চাষবাস করে। এমন চল্লিশ টা গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল শব্দোগাঁও। সরিতা ও মহেশের এই কর্মযজ্ঞে  বাইরে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে শামিল হয়েছিলেন, সিপিআই এমএল (লিবারেশন) এর বিহার প্রাদেশিক কমিটি। এটা কোন ভোটের আসন সমঝোতা নয়, বিহারে বিধানসভায় জয়লাভের উদ্দেশ্য নয়, সম্পূর্ণ একটি সামাজিক অর্থনৈতিক আন্দোলন। প্রকৃত অর্থে গান্ধিজীর আদর্শে আঞ্চলিক শাসন ও পঞ্চায়েতি রাজ।

আসলে তিলোত্তমা ও তার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন এর বিরুদ্ধে যে জাস্টিসের দাবি তা বাস্তবিক কতটা আদায় করা সম্ভব হবে আমার জানা নেই। কিন্তু তিলোত্তমা একটি সামাজিক গণজাগরণের নাম হতে পারে। সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জাস্টিস একটা দাবি হতে পারে। সেই সামাজিক আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে তিলোত্তমার জাস্টিস নিহিত। আমি এ সবই বলেছি আন্দোলনের পেছনে কারো মদত নেই, দূরভিসন্ধি নেই, ধরে নিয়ে বলছি। আর যদি সত্যিই এই আন্দোলনের পেছনে ক্ষমতালোভি রাজনৈতিক দলগুলির ইতিমধ্যেই হস্তক্ষেপ ঘটে থাকে, তাহলে আমি আমার সমস্ত প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়ে একটা কথাই বলবো, বন্ধ থাক হাসপাতাল, আউটডোর, এমার্জেন্সি। মরে মরুক যত হাড় হাভাতে রোগী, জমে জমুক মৃত মানুষের শবের পাহাড়। বেড়ে চলুক ডাক্তার পড়ুয়াদের দাবির দফা, যাতে কখনোই সমাধান সূত্র না বেরোয়। সরাসরি রাস্তায় নামো, গন কণ্ঠ নয়, রাজনৈতিক দলের কন্ঠে কন্ঠ মেলাও, দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।

খোলামেলা অল আউট মাঠে নামো। কোন অবগুন্ঠনের আড়াল নয়। এই লেখা যখন লিখছি তখন, এই বাংলার বাসন্তীর যুবক সাবির মল্লিক (২২), গো মাংস রাখার অপরাধের সন্দেহে হরিয়ানায় গোরক্ষক বাহিনীর হাতে খুন হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিন, জাস্টিস চাইবেন কিনা।

1 Comments

ইন্দ্রানী

07 September, 2024

ঠিক এই জায়গাটাই আমি বলতে চাইছি। আন্দোলনে একটা মানবিক মুখ স্বতন্ত্রভাবে তৈরি হচ্ছে । যেটা লালবাজারে পুলিশ কর্মীদের সাথে জুনিয়র ডাক্তার দের সামান্যতম অশ্রদ্ধা-অশোভন আচরণে পর্যবসিত হয়নি। আবার পুলিশ আন্দোলনকারীদের জল এনে দিচ্ছে। মুখোমুখি দুজনেই রাত জাগছে। এটা ভালো দিক। এখন শুধু ডাক্তারদের একটি অংশ যদি পালা করে রোগী পরিষেবা চালু করে তাহলে আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেওয়া সম্ভব।

Post Comment