পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কেরল সহ দেশের পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক বিপর্যয় যে পথ বেয়ে

  • 05 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 777 view(s)
  • লিখেছেন : সন্তোষ সেন
হিমাচল, উত্তরাখণ্ড হয়ে কেরল ছাড়িয়ে সিকিম সহ ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে এসবই এখন নিউ নরম্যাল। সব এক্সট্রিমগুলো ঘন ঘন ঘটছে একই সাথে, একই বা ভিন্ন অঞ্চলে। প্রশ্ন উঠছে বড় বাঁধের অযৌক্তিকতা ও বিপর্যয় ক্ষমতা নিয়ে। তিস্তার ওপর একাধিক বাঁধ তৈরি ও নদী দখল করার জন্য তিস্তার গতিপথই বদলে গেছে। সিকিম যাওয়ার পথে বারবার বিপর্যয় নেমে আসছে। কিন্তু কী করণীয়, তা নিয়ে আমরা এতোটুকুও চিন্তিত ?

বিপর্যয়ের ভয়াবহতা:

২৯ জুলাই ভোররাত থেকে তিন দিন ধরে প্রবল বৃষ্টি এবং তার জেরে দু’টি বিশাল মাপের ভূমিধসে কেরলের ওয়েনাড় জেলার বিস্তৃত এলাকা বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী ধসে চাপা পড়ে ৩৩৪ জন নিরীহ গ্রামবাসী মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। দুই শতাধিক মানুষ চাপা পড়ে রয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আহত ও নিখোঁজ বহু। মৃত্যু ও নিখোঁজ মানুষের সঠিক হিসেবে হয়তো কোনদিনই পাওয়া যাবেনা। সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বলছেন –ধসে নেমে আসা টন টন কাদামাটি, পাথর আর গাছপালার স্রোতে ভেসে যাওয়া চারটি গ্রামের যত মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের সকলের দেহ উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব। সন্তান, আত্মীয়- পরিজন হারিয়ে কোনক্রমে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো খাদ্য ও পানীয় জলের সংকটে  ভুগছেন।  ভিটেমাটি, সংস্কৃতি, শিকড় থেকে উচ্ছেদ হওয়া সর্বশান্ত এ মানুষগুলো হয়তো হারিয়ে যাবেন পরিবেশ-উদ্বাস্তুর নীরব মিছিলে।
ভূমিধসে কাদামাটি, পাথরের স্তূপে চাপা পড়েছে জীবিত বা মৃতের বিকৃত শরীর। বীভৎসতার একটা উদাহরণ: ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনা দলা পাকানো একটি মৃতদেহ হাসপাতালের টেবিলে আনলে ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের আর্তি –“আর দেখা যাচ্ছে না, এক্ষুনি ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আসলে এরকম তো আগে কখনো দেখিনি। দেহটার আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না।” এই ভয়ঙ্কর ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সমগ্র ওয়েনাড় জুড়েই। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, স্থানীয় স্কুলে জেনারেটর চালিয়ে অস্থায়ী মর্গের ব্যবস্থা করতে হয়েছে সরকারকে।

একটি ব্রিজ, ৫০টির বেশি দোকান ও একটি গ্রামের সব বাড়িসহ সহ শয়ে শয়ে বাড়ি ভেসে গিয়েছে। ভেল্লারমালার একটি স্কুল ভেসে গিয়েছে। সেখানকার ২২ জন পড়ুয়ার খোঁজ নেই। পশ্চিমঘাট পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামা একের পর এক ভূমিধস বদলে দিয়েছে কাবিনি নদীর জলের রং। গেরিমাটি গোলা সেই জলের মধ্যে পড়েছে টন টন পাথরের চাঁই। অস্বাভাবিক ভারী বর্ষণে টইটম্বুর নদী পাড় ছাপিয়ে বাড়িঘর, চা বাগান, কফির খেত ভাসিয়ে উজাড় করেছে গ্রামের পর গ্রাম। কেরালায় এই প্রাকৃতিক রুদ্ররোষ ২০১৮ এর পরে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম ভয়ঙ্কর বিপর্যয় বলেই স্বীকার করছেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরা। নদীর এই খরস্রোত, ভূমিধস, ভাঙচুরের মেজাজ, কূল ছাপানো সন্ত্রাসের কাছে জনপদ, উন্নয়ন ও সভ্যতার সঙ্গে সংযোগবাহী জাতীয় সড়ক, হোটেল গেস্টহাউস, সবই যে নেহাতই ঠুনকো: আরও একবার তা দেখিয়ে দিল রুষ্ট প্রকৃতি।

আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে আরব সাগরের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় তা ঘন মেঘপুঞ্জ তৈরিতে সহায়ক হচ্ছে। আর ওই মেঘের কারণেই কেরালার একাধিক জায়গায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে আকাশ ভেঙ্গে রেকর্ড বৃষ্টিপাত। ৪৮ ঘন্টায়  ৫৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, তার ফলেই প্রবল ভূমিধস। পুরো পাহাড়টাই যেন হুড়মুড় করে নেমে আসছে মাটিতে, নদীর জলে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির বিরাম থাকবে না উত্তর কেরলের এই ধ্বংস উপত্যকা ওয়েনাড়ে। কেরল জুড়ে মানুষ আশঙ্কা ও আতঙ্কে ভুগছেন।

অধিকাংশ জায়গায় প্রচুর গাছ উপড়ে পড়েছে। মারা গিয়েছে পাখপাখালি সহ অসংখ্য প্রাণ প্রজাতি। জলের স্রোতে ভেসে গিয়েছে গাড়ি। রাস্তায় এতটাই জল জমে গিয়েছে যে, ঘরবাড়ির অনেকাংশই কাদাজলে ডুবে রয়েছে। গ্রাম- শহরের মধ্য দিয়ে তড়িৎ গতিতে বইছে ফুঁসতে থাকা নদী। কাবিনি নদীর মস্ত এক বাঁকে গড়ে উঠেছিল মুন্ডাক্কাই ও চূড়ালমারা গ্রাম। এই গ্রাম দুটি প্রায় মুছে গিয়েছে। প্রায় ৮৬ হাজার বর্গমিটার এলাকা কার্যত নেই হয়ে গেছে। বসতির সব চিহ্ন নিকিয়ে মুছে নিয়ে গেছে নদীর ঘোলা জল। উন্নয়নের মডেল হোটেল, আবাসন ও গেস্টহাউস গুলোর সামনে কোমর সমান, কোথাও বা গলা সমান জল কাদা থৈ থৈ করছে। এই বিপর্যয়ের দায় কার? কেরল প্রবল বৃষ্টিপ্রধান রাজ্য হলেও এবারের ব্যাপক বিপর্যয়ের মূল কারণ অবশ্যই কর্পোরেটের বাজার ও মুনাফা বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবল খিদে আর সব গিলে খাওয়া উন্নয়ন প্রকল্প। এই ক্ষেত্রে ডান ও বামপন্থী সব সরকারকে অনায়াসে একই বন্ধনীতে ফেলা যায়। এই বিপর্যয় মূলত মনুষ্যসৃষ্ট। এই অভিমত প্রকাশ করছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা। ‘ঈশ্বরের নিজের দেশে’ এই বীভৎসতার ছবি ভয় ধরাচ্ছে সকলকে। জলবায়ু পরিবর্তনের জের আছড়ে পড়ছে রাজ্য থেকে দেশ, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। এই আবহে সময় এসেছে কর্পোরেটের স্বার্থে ওদেরই তৈরি করা উন্নয়নের খুড়োর কলের পিছনে অন্ধভাবে ছুটে না চলে প্রাণ প্রকৃতি বিঘ্নকারি তথাকথিত উন্নয়নের নীল নকশাকেই চ্যালেঞ্জ করার। বিজ্ঞানীরা কী বলছেন শোনা যাক এবার।

বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের অভিমত:

বর্ষায় পাহাড়ে ভূমিধ্বস খুব চেনা ছবি। কিন্তু উত্তরাখন্ড, হিমাচল সহ ওয়েনাড়ের মতো ভয়াবহ বিপর্যয়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, পাহাড়ে উন্নয়নের যে কর্মকাণ্ড চলছে তাতে এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা তৈরি, বৃক্ষ ছেদন, বনাঞ্চল ধ্বংস, পাহাড়ি নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ঘুরিয়ে বা অবরুদ্ধ করে বিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রণা ভারতবর্ষের পাহাড়ি অঞ্চলকে কম সইতে হচ্ছে না। সিকিম ও আমাদের সাধের উত্তরবঙ্গের অবস্থাও তথৈবচ। ‘ইসরো’ প্রকাশিত ‘ল্যান্ডস্লাইড অ্যাটলাস’র তথ্য অনুযায়ী –কেরালা, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশের মতো ধস-প্রবন এলাকাগুলির মধ্যে পড়ছে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকা ও সিকিমও। এরসাথে আরও কিছু দিক উঠে আসছে। ২০২২-র একটি সমীক্ষার দাবি –১৯৫০-২০১৮ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের এইসব পাহাড়ি অঞ্চলে ৫০-৬২ শতাংশ বনাঞ্চলই উধাও হয়ে গেছে। ওই সমীক্ষার দাবী –১৯৫০ সালের আগে ওয়েনাড়ের ৮৫ শতাংশ ছিল জঙ্গল। কিন্তু ক্রমশ তা ধ্বংস হওয়ায় পাহাড়ের মাটি দিন দিন আলগা হয়েছে। বিশেষ করে, বেশি বৃষ্টিপাতের অঞ্চলে বৃক্ষছেদনের ফলে ধসের আশঙ্কাও বেড়েছে। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির প্রক্রিয়া জারি আছে। কিন্তু এখন তাতে যুক্ত হয়েছে যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার। রাস্তা তৈরি ও নানাবিধ নির্মাণকার্যের জন্য ডিনামাইট দিয়ে  পাহাড় ফাটানো ও যন্ত্র প্রয়োগে পাহাড় কাটার কারণে পাহাড় প্রবল বেগে কেঁপে ওঠে, মাটি আরও আলগা হয়। সবকিছুর মিলিত ফল ধসের সংখ্যা ও তীব্রতা বহুগুনে বেড়ে যাওয়া। অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সোনায় সোহাগার মতো করে হাজির হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন। কোচি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যক্ষ  জানাচ্ছেন –আরব সাগরের তাপমাত্রা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় এইসব ভয়ংকরী  বিপর্যয় আরও প্রকট হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব আরব সাগর ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় কেরালা সহ পশ্চিমঘাট পর্বতমালার স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি ‘ডিপ ক্লাউড সিস্টেম’ তৈরি হওয়ার কারণে অল্প সময়ে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে অতিভারী বৃষ্টি হচ্ছে ও পাহাড়ে ধস নামছে। ২০১৮ সালে কেরালার যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল, সেই সময়ও বৃষ্টিপাতের এই প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গেছে। সিকিমে প্রবল বন্যা ও ভূমিধসের ক্ষেত্রেও এইসব কারণগুলো সমানভাবে দায়ী।

বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণী:

‘পশ্চিমঘাট ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল’ সেই ২০১১ সাল থেকেই ওয়েনাড় সহ অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলকে ‘সংবেদনশীল (fragile)’ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের সতর্কবাণী –পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন তাপবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ ও বড় মাপের উইন্ড এনার্জি প্রকল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক। পাশাপাশি পাহাড়ে ভারি নির্মাণকাজ ও খনন বন্ধ করার দাবিও উঠেছে বারবার। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত কিছু নোটিস কেন্দ্রীয় সরকার জারি করলেও, তা কার্যকরী করার ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা দেখা গেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (IMD)-এর ডিরেক্টর জেনারেল জানিয়েছেন –পূর্বাভাস অনুযায়ী লা-নিনা বা তার মতো একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে আগস্টের শেষ নাগাদ। ফলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর জুড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাভাবিকের থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ অফিসিয়ালি বর্ষা বিদায় নিলেও দুর্ভোগ অপেক্ষা করে থাকবে শারদীয়ার প্রাকলগ্নে।

হিমাচলপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ডে ব্যাপক বিপর্যয়:

কেরলের পরপরই বিপর্যয় উত্তর ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের সাতটি রাজ্যে। হিমাচল প্রদেশের সিমলা, কুলু, মান্ডি থেকে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টির খবর মিলেছে। এরই পাশাপাশি প্রবল বৃষ্টি ও ভূমিধ্বসে আবারও বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ড। রাতভর বৃষ্টিতে বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে মন্দাকিনী, অলকানন্দা, বিপাশা ও পার্বতীর মতো প্রায় সব বড় নদী। চন্ডিগড়-মানালি জাতীয় সড়ক বেশ কিছু জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পার্বতী নদীতে মালানা বাঁধ ভেঙে ভেসে গিয়েছে একাধিক বাড়ি, মন্দির, চাষের খেত। সমস্যায় পড়লেন আপেল চাষীরা। ক্ষতিগ্রস্ত মালানা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মান্ডি-র বেশ কিছু অঞ্চলে প্রচুর বাড়ি, দোকান, রাস্তা, স্কুলঘর কাদাধসে ধুয়ে মুছে গেছে। নিখোঁজ বহু গ্রামবাসী। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার, কংখল, তেহরি, দেরাদুন এবং চামোলির মতো অঞ্চলগুলোর। সব অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, স্কুল বন্ধ কয়েকদিন ধরে। ২২০০ এর বেশি তীর্থযাত্রীকে উদ্ধার করে আপাতত স্থগিত রাখা হল চারধাম যাত্রা। কেদারনাথের পথে এখনও আটকে আছেন ১৩০০ তীর্থযাত্রী।
যে চারধামের জন্য উত্তরাখণ্ডের পাহাড় আজ বিপন্ন, বিপর্যস্ত: সেই চারধাম যাত্রাও প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে ছাড় পাচ্ছে না। একেই বোধহয় বলে প্রকৃতির মার! উত্তরভারতের সাতটি পার্বত্য রাজ্য থেকে ২৪ ঘন্টায় কম করে ৫০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। কেন এইধরনের চরম বিপর্যয় বারবার?

১৯৭০ ও ১৯৭৮ সালে ভাগীরথী ও অলকানন্দার প্রবল বন্যা, ১৯৮৩ সালের কেদারনাথ কাণ্ড, ২০১৩ সালে চামোলি গ্রামসংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক বিপর্যয় ও প্রাণহানি এবং ২০২১’র হিমবাহ গলে গিয়ে ব্যাপক বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২৩ এর শুরুতেই যোশীমঠে প্রকৃতির প্রলয় নাচন এবং এবার আবার কেদার বদ্রী, হিমাচলপ্রদেশ ও কেরলের ভয়াবহ বিপর্যয় বোধহয় শেষবারের মতো অশনি সংকেত। ভূমিকম্প প্রবণ, বয়সে নবীন ও ভঙ্গুর হিমালয় সংলগ্ন এলাকায় এইসব বিভীষিকাময় দুর্যোগগুলো কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এর মূলে মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোই সবচেয়ে বেশি করে দায়ি। হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজে মোড়া সুউচ্চ বনানী, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ সহ তামাম জীববৈচিত্র্য অটুট থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভীষিকা ও ক্ষতিসাধন ক্ষমতা অনেকটা কম হয়। কিন্তু বাস্তবে কী হল? নদীর পাড় বরাবর রাস্তা নির্মাণ, নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ রুদ্ধ করে যেখানে সেখানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ, আর সাথে দোসর ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির বাড়বাড়ন্ত। পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি, নদী ও জমি চুরি করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠল হোটেল-রিসর্ট। নদীর বুকে ও পাহাড়ের কোলে জমা হতে থাকল যতসব অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক নির্মাণের কঠিন বর্জ্য, হল চারধামে যাওয়ার চার লেনের মাখন মসৃণ রাস্তা –রুদ্ধ হল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে –বিগত কয়েক বছরে উত্তরাখণ্ডের কয়েক হাজার প্রাকৃতিক ঝর্না স্রেফ উধাও হয়ে গেছে। এসবই হল সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে ও অদূরদর্শিতার কারণে। অথচ ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প যে পরিবেশ সহ স্থানীয় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করবে, তা বুঝতে পেরেই গ্রামবাসীরা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রতিবাদে মুখরিত হয়েছেন প্রথম থেকেই। আদালতের স্পষ্ট রায় ছিল– “হিমালয়ের একেবারে ভিতরে নদীকে অনেকটা পথ ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ-কেন্দ্র স্থাপন করলে তা হিমালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ ধ্বংস করে বিপর্যয় ডেকে আনবে”। এই রায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নানান পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে নির্মাণ কাজ চলছেই, উন্নয়নের ঢক্কা-নিনাদ বেজেই চলেছে। আসলে কর্পোরেট ও তাদের সেবাদাস সরকারগুলোর একটাই বাণী: যেকোন মূল্যে ছুটিয়ে নিয়ে চলো সব গিলে খাওয়া উন্নয়নের রথ আর পুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির হার। অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ও নগরায়নের মহাযজ্ঞ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ও ভারসাম্যের বিপরীতে কাজ করছে, ফলে এইসব পরিবর্তনগুলোকে প্রত্যাবর্তনীয় চক্রের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আগের অবস্থায় কোনভাবেই আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই হিমালয়ের বিপর্যয়ের সাথে সাথে জীববৈচিত্র্য সহ প্রকৃতির ভারসাম্য সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হওয়ার দিকে নিশ্চিত পায়ে এগিয়ে চলেছে।

ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী:

২০২১ সালের ভূমিধ্বস ও হড়পা বানে ঋষিগঙ্গা ও তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটি সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কর্মরত শ্রমিকরা টানেলে আটকে পড়ে সবাই মারা যান। এর আগে ২০১৩ সালে একইভাবে ১১,০০০ মানুষ বিপর্যস্ত হন, জলের তলায় তলিয়ে যায় বেশ কয়েকটি গ্রাম ও হেক্টরের পর হেক্টর চাষের জমি। এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত পরিবেশ ও বনমন্ত্রকের বিশেষ কমিটির রিপোর্টে আঙ্গুল তোলা হয়েছিল পার্বত্য রাজ্যটিতে অপরিকল্পিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাড়বাড়ন্তের দিকেই। দেরাদুনের ‘পিপলস সায়েন্স ইনস্টিটিউট’র অধিকর্তা রবি চোপড়ার নেতৃত্বে কমিটি যে রিপোর্ট সুপ্রিমকোর্টে ২০১৪ সালে জমা দেয় তাতে স্পষ্ট সুপারিশ ছিল– অলকানন্দা ও ভাগীরথী নদীর অববাহিকায় অন্তত ২৬টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। কারণ এই নির্মাণের ফলে নদীর জলস্তর এবং গতিপথ, ধস আটকানোর বনভূমি, মাটি-পাথরের স্থিতিশীলতা: ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবকিছুই। রিপোর্ট জমা পড়ার পর প্রায় এক যুগ কেটে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং অসংখ্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে ১২০টির কাজ ইতিমধ্যেই শেষ। নদী- বিশেষজ্ঞ কল্যান রুদ্র মনে করছেন –’রান অফ দ্য রিভার মডেলে’ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হলে তা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে অনেক সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিখ্যাত পর্বতারোহী বসন্ত সিংহরায়ের মতে –“নদীবাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পাশাপাশি বনভূমি ধ্বংসও এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারন”। পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক ও হিমালয় বিশারদ প্রয়াত সুন্দরলাল বহুগুণার নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালে উত্তরাখণ্ডের মন্ডল গ্রামে প্রথম শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জঙ্গল রক্ষার দাবিতে চিপকো আন্দোলন। বস্তুত, ১৯৩০ সালেই সুইজারল্যান্ডের কিছু ভূ-বিজ্ঞানী যোশীমঠে যেকোন ধরনের বড় নির্মাণ বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। পাহাড়কে বাঁচাতে বৃহত্তর আন্দোলনে নামেন জি ডি আগরওয়াল, যাঁর আন্দোলনের ফলে ২০১০ সালে ইউপিএ সরকার ৬০০ মেগাওয়াটের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ২০১৮-এ ভাগীরথী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ধর্ণা ও অনশনের সময় সুন্দরলালজীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তারপরই খুব খারাপ পরিস্থিতিতে ওনার মৃত্যু হয়। এরপর, পরিবেশ বিজ্ঞানী রবি চোপড়া, যিনি চারধাম রেল প্রকল্পের মনিটরিং কমিটির একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, ওই কমিটি থেকে ইস্তফা দেন পরিবেশ রক্ষা প্রসঙ্গে তাঁর পরামর্শ সরকার মানছে না বলে। চিপকো আন্দোলনের অন্যতম নেতা, যিনি প্রকৃতিকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন, পাহাড়ের প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি নদীকে হাতের তালুর মতো চেনেন সেই চন্ডীপ্রসাদ ভট্ট তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে হিমালয়ের বুক বিদীর্ণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রবল বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে ‘পহর’ পত্রিকার সম্পাদক, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও ‘হিস্ট্রি অফ চিপকো মুভমেন্ট’ গ্রন্থের প্রণেতা শেখর পাঠকও সরকারকে একই উপদেশ শুনিয়েছেন বারেবারে। কাকস্য পরিবেদন! সরকার ও রাজনীতিবিদরা এসব চেতাবনি কানে তুললে বারবার ভয়াবহ বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে হত না ভারতবাসীকে।

ভয়াবহ সিকিম:

উত্তর সিকিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে প্রবল বর্ষণ ও প্লাবনে বিপর্যস্ত। লাচুং ও মঙ্গনের মাঝখানে সাংকালন সেতু ভেঙে পড়ায় পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে পড়ে। দুই হাজারের বেশি পর্যটক সিকিমে আটকে থাকলেন বেশ কিছুদিন। তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, জলঢাকা, মূর্তি সব ফুলেফেঁপে রাস্তা, জনপদ গ্রাস করেছে। সিকিমের তিস্তাবাজার সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত। সিকিমগামী ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক ভেঙেচুরে তিস্তার সাথে একাকার। আরও অনেকগুলো সড়ক পাহাড়ি ধসে বিপর্যস্ত। বারবার করে প্রবল বৃষ্টির কারণে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক সহ একাধিক সড়ক প্রায়শই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ডুয়ার্সের ব্যাপক অঞ্চলও জল থৈ থৈ। ২০২৩-এ সিকিমে গ্ল্যাসিয়ার লেক আউটবার্স্ট ও ভয়াবহ প্লাবনে প্রায় ১৫০০ পাহাড়বাসীর মৃত্যু হয়। সেই আশঙ্কা বুকে চেপে সিকিম সহ উত্তরবঙ্গের মানুষ রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন।

বেশ কিছুদিন ধরে অবিরাম বর্ষণে অসম, ভুটান ও মেঘালয় বিপর্যস্ত। ফের বন্ধ হয়ে পড়ল অসমের পাহাড় লাইন। মেঘালয়ের উপর দিয়ে চলা বদরপুর-জোয়াই জাতীয় সড়কে প্রবল ধস। এই রেলপথ ও সড়ক পথেই বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং দক্ষিণ অসমের। কয়েকদিনের জন্য বাতিল করা হল বেশকিছু দূরপাল্লার ট্রেন। দীর্ঘদিন ধরে তুমুল বৃষ্টির জেরে ব্রহ্মপুত্র ফুঁসছে। অসমের ২৮টি জেলার প্রায় ২৩০০ গ্রাম বন্যাকবলিত। ২৪ লক্ষের বেশি মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে। বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৮৪। কাজিরাঙ্গায় ২২৩টি বন শিবিরের মধ্যে শতাধিক জলমগ্ন। মারা গিয়েছে চারটি হগ ডিয়ার সহ ১৫৮ টি বন্যপ্রাণী। বন্যায় বিপর্যস্ত অসমের পবিতরা অভয়ারণ্য, কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক। বিপাকে একশৃঙ্গ গণ্ডার, হাতি সহ প্রচুর বন্যপ্রাণ। প্রবল বৃষ্টিতে ভূমিধসের জেরে (২৯ জুন) নেপালে মৃত্যু হল নয় জনের। একই দিনে লাদাখের কাছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর শায়ক নদীতে হড়পা বানের জেরে ডুবে গেল সেনাবাহিনীর ৭২টি ট্যাংক। জলে ডুবে মৃত পাঁচ সেনা আধিকারিক।

পরিশেষে:

হিমাচল, উত্তরাখণ্ড হয়ে কেরল ছাড়িয়ে সিকিম সহ ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে এসবই এখন নিউ নরম্যাল। সব এক্সট্রিমগুলো ঘন ঘন ঘটছে একই সাথে, একই বা ভিন্ন অঞ্চলে। প্রশ্ন উঠছে বড় বাঁধের অযৌক্তিকতা ও বিপর্যয় ক্ষমতা নিয়ে। তিস্তার ওপর একাধিক বাঁধ তৈরি ও নদী দখল করার জন্য তিস্তার গতিপথই বদলে গেছে। সিকিম যাওয়ার পথে বারবার বিপর্যয় নেমে আসছে। গতবছরের ভয়াবহ বিপর্যয় ও এবারের ধারাবাহিক বর্ষণে অবস্থা ভয়ানক হয়ে উঠেছে। নদী বাঁধের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের নৈসর্গিক প্রকৃতি ও মানুষের যাপনে শেষ পেরেক পুঁততে চলেছে সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত তিস্তার ওপর দিয়ে নির্মীয়মান রেলপথ। প্রশ্ন অনেক: বর্ষার সময় নদীর জলস্ফীতির কথা সকলেই জানেন। তাহলে নদীর দুই পাড় ঘেঁষে দোকান, মল, সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল, আবাসন, কলেজ আর দেবমন্দির হয় কী করে? পাহাড় ফাটিয়ে ভারী নির্মাণকাজ ও তার সমস্ত বর্জ্য নদীতে মিশে নদীর স্বাভাবিক বহমানতাকেই বিপন্ন করছে।

প্রশ্নগুলো সোজা হলেও উত্তর বেশ জটিল। প্রশ্ন উঠছে ভরা-বাদল জুন মাসে এত এত পর্যটককে সিকিমে যাওয়ার পারমিট দেওয়া হল কেন? মানুষের জীবন যায় যাক, তবুও চাই ব্যবসা: এই ধ্যানজ্ঞান নিয়ে চললে যা হবার, ঠিক তাই ঘটল। প্রশ্ন উঠছে বামপন্থী দলগুলোর চিন্তাভাবনার দৈন্যতা সম্পর্কেও। ফিন্যান্স পুঁজির যুগে পুঁজির সংকট কাটাতে, মুনাফার বৃদ্ধির অন্ধগতি বজায় রাখতে সব ভার গিয়ে পড়ছে প্রকৃতির ঘাড়ে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ায় পাশাপাশি বিপর্যস্ত হচ্ছে তামাম জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র। বাড়ছে বিপাকীয় ফাটল। তাই আজকের দিনের
প্রকৃতি পরিবেশ আন্দোলন বাস্তবত কর্পোরেটের অবাধ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এই সহজ সরল অথচ গভীর সত্যটি বোধগম্য হচ্ছে না বামপন্থী দলগুলোর কাছে। এই সহজ সরল বিষয়টি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হবে বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের, অধিকার আন্দোলন সহ সমস্ত সামাজিক আন্দোলনের সাথীদেরও। গড়ে তুলতে হবে মুক্তচিন্তার এক বৃহৎ পরিসর। সমস্ত সংগঠনের ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিই পারে মানবসভ্যতা সহ সমগ্র প্রাণ প্রজাতিকে ঘন অমানিশার অতল গহ্বর থেকে তুলে এনে এই নীল গ্রহে আরও কিছুদিন স্থিতু রাখতে। অন্য আর কোন পথ তো দেখা যাচ্ছে না।

0 Comments

Post Comment