পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

চার ঘণ্টার নোটিশ

  • 09 July, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1579 view(s)
  • লিখেছেন : ধীমান বসাক
একশো দিনের কাজের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়ানো, তার জন্য অর্থবরাদ্দের জন্য চাপ সৃষ্টি, মিউনিসিপাল এলাকায় এরকম প্রকল্প চালু করা, অভিবাসী শ্রমিক সহ কর্মচ্যুত সমস্ত মানুষকে নগদ অর্থ দেওয়া, কারখানার শ্রমিকদের বন্ধের সময়ের মজুরীর দাবী, সারা ভারত জুড়ে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান ও স্বাস্থ্য সহ সামাজিক নিরাপত্তা দাবী করা, নতুন আইন তৈরীর দাবী তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে এলাকা জেলা রাজ্য ভারতজোড়া স্তরে সেই কাজ শুরু হতে পারে।

২৪ মার্চ মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন করানোকে অনেকেই বলছেন পরিকল্পনাহীন বা চটকদার বা দেখনদারি, মোদীর ক্রেডিট নেওয়ার চেষ্টা, ইত্যাদি।

গত কয়েক মাস ধরে ঘটনাপ্রবাহ যারা দেখে চলেছেন, ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে যারা বিচ্ছিন্ন বা ব্যক্তির খামখেয়াল নির্ভর মনে করেন না, যারা আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়েই ইতিহাসের ক্রিয়াশীল শক্তিগুলো কাজ করে চলে বলে মনে করেন, তারা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে একটা অংশ বাধ্য হয়ে আবার কাজের সন্ধানে পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে যাওয়া শুরু করেছেন।

রাজস্থানের একটি সরকারী ক্লিনিকের ডাক্তাররা একটি স্টাডি করেছেন। অভিবাসী শ্রমিকরা যখন নিজেরা প্রথমদিকে ফিরে এসেছেন, তখন তাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার রিপোর্ট এইরকম -- মার্চের শেষ এবং এপ্রিলের প্রথমে এইরকম ফিরে আসা ১১২৯ জনের স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়, সন্দেহভাজন ১৩ জনের কোভিড টেস্ট করানো হয়, একজনেরও টেস্ট পজিটিভ আসেনি।

দেড় মাস আটকে পড়ে থেকে যেসব অভিবাসী শ্রমিকরা মে মাসের প্রথম থেকে ফিরতে শুরু করেন, ঐ কমিউনিটি সেন্টারে পরীক্ষা হওয়া সেইরকম শ্রমিকদের মধ্যে সাতজনকে কোভিড আক্রান্ত বলে পরীক্ষায় পাওয়া যায়। গোটা রাজস্থানের সংখ্যার সাথে তুলনা করে দেখা গেছে, এ ঘটনা সব জায়গাতেই ঘটেছে।

ফলাফল পরিষ্কার। প্রথম ধাপেই এই শ্রমিকদের ফিরতে দিলে তাদের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। দেড় মাস কর্মহীন অর্থহীন সামাজিক নিরাপত্তাহীন শ্রমিকদেরকে শহরগুলোতে আটকে রাখার ফলে তাদের একটা অংশ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এবং রাষ্ট্রের নীতির ফলে সেই অংশটাই শহর থেকে গ্রামে সংক্রমণ নিয়ে আসার বাহকে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছেন অজান্তেই।

এমনটাই তো হওয়ার ছিল। স্প্যানিশ ফ্লু এসেছিল জাহাজে চেপে, করোনা এসেছে বিমানে চেপে। স্প্যানিশ ফ্লু ১৯১৮-তে ছড়িয়েছিল প্রথমে ভারতের উপকূল জুড়ে, মুম্বাইতে শুরু। করোনা এসেছে বিদেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে, মূলত পশ্চিম ভারতের শহরগুলোতে। করোনা ঠেকানোর উপায় বলা হল লকডাউন, সোশাল ডিসট্যান্সিং। যারা দিন আনি দিন খাই মানুষ, তারা এবং নর্দমা পরিষ্কার, সাফাই, পরিবহন, জল চালু রাখা, বিদ্যুত, স্বাস্থ্যকর্মী, এদের সবাইকেই কাজে বেরোতে হয়েছে। কাজ থেকে ফিরে এরা ঘরে এসেছেন, যেখানে সোশাল ডিসটান্সিং মেনে চলা কার্যত অসম্ভব। একটা দশ বাই দশ ঘরে গাদাগাদি করে ছয় থেকে আটজনের বাস, সরু গলি, অপরিষ্কার নর্দমা, খুব কম টয়লেট, জলের সরবরাহ একেবারেই কম, আলোহাওয়া কম খেলে, খোলা জায়গা নেই, রাস্তাতেই বাজার বসে, এরকম শ্রমজীবী বস্তিগুলোই ক্রমশ হয়ে উঠলো করোনার হটস্পট। অভিবাসী শ্রমিকদের এক বিপুল অংশ এই ধরনের বস্তিতেই থাকেন। মুম্বাই দিল্লী আমেদাবাদ সুরাট পুনে ব্যাঙ্গালোর চেন্নাই ইন্দোর প্রভৃতি শহরগুলোতে। যারা আটকে রইলেন সেই বস্তিতে, অথবা মাঝপথে আটকে গাদাগাদি করে রাখা কোয়ারান্টাইন সেন্টারগুলোতে, তাদের একটা অংশ করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। বেশ কিছু সমীক্ষায় ধরা পড়লো সেই তথ্য, বেশ কিছু লেখাতেও। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটা লেখায় তা স্বীকার করে নিলেন। লকডাউন সোশাল ডিসটান্সিং এসব বাঁচাল বিত্তশালীদের, বিপন্ন করলো বিত্তহীনদের জীবিকা তো বটেই, জীবনকেও।

অর্থাৎ করোনা প্রতিরোধের দিক থেকেও লকডাউন ব্যর্থ। ব্যর্থ শুধু নয়, উলটো ফল পাওয়া গেছে।

ফিরে আসার পর স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদেরকে জুড়ে নেওয়ার কোন বিশেষ উদ্যোগ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার নেয়নি। গ্রামাঞ্চলে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে তাদের সুযোগ মেলেনি বললেই চলে, প্রয়োজনের তুলনায় কাজ কম, আর মিউনিসিপাল এলাকায় এরকম কোন প্রকল্পই নেই। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, বাংলা, আসাম, সব রাজ্যেই কমবেশি একই অভিজ্ঞতা। আমার নিজস্ব কথোপকথনের অভিজ্ঞতা বলছে যে এই ফিরে আসা শ্রমিকরা কেউই অন্তত আগামী মাস তিনেক ফিরে যেতে চাইছিলেন না, কিন্তু বলেছিলেন যে পেটে টান পড়লে তো যেতে বাধ্য হবো। ইতিমধ্যে তাদের কেউ কেউ ফিরে যাবেন বলেই জানাচ্ছেন, পেট চলছে না।

এই সমস্ত ঘটনাকে একসাথে দেখলে কতগুলো সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে। লকডাউন ১) সারা ভারত জুড়ে, ২) একসাথে, ৩) একইরকম, ৪) চারঘণ্টার নোটিশে মানে কোন সময় না দিয়ে, ডাকার অর্থ হল -- এই বিপুল অভিবাসী শ্রমিক যাতে ফিরে না যেতে পারেন, যাতে আগামীতে শ্রমিকের অভাবে পুঁজি এবং পুঁজির মালিকরা পঙ্গু হয়ে না পড়ে, সেটা আটকানো। এখনও যে ফিরে আসা এই বিপুল শ্রমিকবাহিনীর জন্য দেশজোড়া এবং রাজ্যে রাজ্যে কোন বিশেষ পরিকল্পনা নেই, তার কারণও ঐ একই, যাতে শ্রমিকরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়, করোনার কেন্দ্রস্থল ঐ শহরগুলোতেই, পুঁজি এবং তার মালিকদের সুবিধার্থেই।

অভিবাসী শ্রমিকদের কথা মাথায় না রেখে নয়, মাথায় রেখেই, তাদেরকে কাজের জায়গায় আটকে রাখাই ছিল চারঘণ্টার নোটিশে লকডাউন ডাকার উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য আরও পরিষ্কার হয় যখন দেখা যায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথমকার ঘোষণা ছিল, কাজ বন্ধ হলেও শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করা যাবে না। মে মাসে এসে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই সেটা তুলে নেয়। এখন সুপ্রীম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলেছে ঐ সার্কুলার নিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার দরকার নেই, ওর উদ্দেশ্য ফুরিয়ে গিয়েছে।

পুঁজি, পুঁজির মালিক এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি সরকারগুলো যেটা ভাবতে পারেনি, সেটা হল, বিমান ট্রেন বাস গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিলেও যে এই শ্রমিকের দল তা মানবেন না। স্রেফ গতর খাটিয়ে, ঘরে ফেরার ইচ্ছেয়, তারা এক নতুন মহাকাব্যের জন্ম দেবেন ভারত জুড়ে। যা ইতিহাসে দেশভাগ বা চীনের লং মার্চের মতো অভিঘাত তৈরী করবে। অসচেতন হলেও পুঁজির বিরুদ্ধে এ ছিল শ্রমিকের বিদ্রোহ। ইতিহাস কতগুলো ব্যক্তির খামখেয়ালীপনা নয়।

এই বিদ্রোহ সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বও আঁচ করতে পারেননি। তার একটা কারণ যেমন করোনা প্রতিরোধে লকডাউনের সরকারী ব্যাখ্যাকে মেনে নেওয়া, আরেকটা কারণ এই অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য লাগাতার সিস্টেম্যাটিক নির্দিষ্ট দাবীদাওয়া তুলে ধরার ক্ষেত্রে, সংগঠিত ক্ষেত্রের তুলনায়, অবহেলা। মনে রাখা দরকার এই অভিবাসী শ্রমিকরা প্রায় পুরোটাই দলিত আদিবাসী ধর্মীয় সংখ্যালঘু অংশের থেকে আসা।
এই মুহুর্তে বিচ্ছিন্নভাবে ট্রেড ইউনিয়নগুলো অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য এলাকাগতভাবে কিছু দাবী তুলে ধরছেন বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ঝাড়খন্ডের সরকার একটা পদক্ষেপ নিয়েছে, যে সমস্ত শ্রমিকরা ঠিকা কাজ করতে কেন্দ্রীয় বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন, বিআরও, যারা সীমান্তে রাস্তা তৈরী করে, সেখানে ঝাড়খণ্ড থেকে যায়, তাদেরকে কাজে লাগাতে গেলে ঠিকেদার নয়, প্রথমে রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে। এরকম আরও দাবী সামনে আসা দরকার।

একশো দিনের কাজের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়ানো, তার জন্য অর্থবরাদ্দের জন্য চাপ সৃষ্টি, মিউনিসিপাল এলাকায় এরকম প্রকল্প চালু করা, অভিবাসী শ্রমিক সহ কর্মচ্যুত সমস্ত মানুষকে নগদ অর্থ দেওয়া, কারখানার শ্রমিকদের বন্ধের সময়ের মজুরীর দাবী, সারা ভারত জুড়ে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান ও স্বাস্থ্য সহ সামাজিক নিরাপত্তা দাবী করা, নতুন আইন তৈরীর দাবী তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে এলাকা জেলা রাজ্য ভারতজোড়া স্তরে সেই কাজ শুরু হতে পারে।

তথ্য সুত্র ঃ https://science.thewire.in/health/covid-19-income-inequality-urban-overcrowding-access-to-health-services/

https://indianexpress.com/article/opinion/columns/coronavirus-lockdown-india-covid-19-cases-deaths-6494930/

https://www.google.com/amp/s/www.brookings.edu/blog/up-front/2020/04/16/are-slums-more-vulnerable-to-the-covid-19-pandemic-evidence-from-mumbai/amp/

https://scroll.in/article/966123/forcing-migrants-to-stay-back-in-cities-during-lockdown-worsened-spread-of-coronavirus-study-shows

0 Comments

Post Comment