পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লকডাউনের পরে নতুন পৃথিবীঃ সামঞ্জস্য আর সহযোগিতার নতুন সিস্টেম?

  • 29 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1697 view(s)
  • লিখেছেন : অনুপম শরাফ
আমাদের সিদ্ধান্তই বলে দেবে মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ কী, আমরা কি ডাইনোসরদের মত হব, যারা আকারে সুবিশাল ছিল কিন্তু এই গ্রহের জলহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে টিকে থাকার ক্ষমতা তাদের একেবারে ছিল না, নাকি আমরা সেইসব ব্যাকটেরিয়াদের মত হব, যারা অন্যান্য জীবিত প্রাণী বা উদ্ভিদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই টিকে গেছে লক্ষ লক্ষ বছর।

গত সপ্তাহে আমি সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত “ইন্ডিয়া, কোভিড-19 অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথ গভর্নেন্স” শীর্ষক একটি ওয়েবিনারে যোগ দিয়েছিলাম। এই ওয়েবিনারে আলোচনার একটা বিষয় ছিল; আক্রান্তের পরিসংখ্যানের উর্ধ্বমুখী গ্রাফকে ফ্ল্যাট করতে গিয়ে এইটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, এই বিশাল পরিমাণ ভাইরাসে আক্রান্তের চিকিৎসা করার মতন উপযুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থা বা হাসপাতালের পরিমাণ দুনিয়ার কোনও দেশেই নেই; যা আমার নিজস্ব অবজার্বভেশনের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। চিকিৎসা তো পরের কথা, হাসপাতালের সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে প্রোটেক্টিভ সামগ্রীটুকুও পৌঁছে দেবার জন্য এদের যে সময়ের দরকার ছিল, সে সময়ও এরা পায় নি। আরও যেটা জানা গেছে যে কোভিড-19এর প্রকোপে সেইসব দেশগুলোই সবথেকে বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেখানে চিকিৎসাব্যবস্থার বেশির ভাগটাই বেসরকারি হাতে চলে গেছে।

যখন একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে স্বাস্থ্য-পরিষেবার খোঁজ করেন এবং সেই স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে সেই ব্যক্তির সামনে হাজির হন একজন স্বাস্থ্য-“প্রফেশনাল” যাঁর পরিষেবার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বেশি লাভ করা; ঠিক সেই পরিস্থিতির সামনে এসে জনস্বাস্থ্য একটা বিষয় হিসেবে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যায় যখন ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্য পরিষেবার এই বাড়তি খরচার বহর সামাল দিতে “থার্ড-পার্টি” হিসেবে এই সিস্টেমের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা সিস্টেমস্পিক-এ বলে থাকিঃ বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থায় এই তিন ধরণের অ্যাক্টর সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে পরস্পরের কাছে আসে। স্বাস্থ্য-পরিষেবার ব্যবহার করতে চাওয়া ব্যক্তিটির উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য-প্রফেশনালের উদ্দেশ্যের সাথে বা ইনস্যুরেন্স প্রোভাইডারের উদ্দেশ্যের সাথে মেলে না, উদ্দেশ্যগুলি পরস্পরকে সাহায্য করবার বদলে পরস্পরের সাথে একটা মুনাফা-লোকসানের সম্পর্ক তৈরি করে, যাকে সহজ ইংরেজিতে বলে এক্সপ্লয়েটেশন।

পিটার ড্রাকার নামে এক ম্যানেজমেন্ট গুরু, আমেরিকার এক মিশনারি হাসপাতালের জন্য মিশন স্টেটমেন্ট বানিয়েছিলেন, সেইটা আমার এখন মনে পড়ছে। হাসপাতালের ট্রাস্টিরা যখন ড্রাকারকে হাসপাতালের জন্য একটা মিশন ফর্মুলেট করতে বলেন, ড্রাকার তাঁদের কাছ থেকে খানিকটা সময় চেয়ে নেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত এই তিন রকমের অ্যাক্টরের সাথে কথা বলার জন্য। কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের জানান যে নতুন মিশন স্টেটমেন্ট তাঁর তৈরি হয়ে গেছে, এবং তিনি তাঁদের সয়াথে এই নিয়ে কথা বলার জন্য প্রস্তুত।

প্রথমে তিনি ট্রাস্টির সদস্যদের জিজ্ঞেস করেন যে, তাঁদের মতে তাঁদের মিশন কী হওয়া উচিত। নানা রকমের জবাব আসে। “আমরা সবচেয়ে বড় হাসপাতাল হব”, “আমরা এই দেশে বা এই রাজ্যের এক নম্বর হাসপাতাল হব”, “আমাদের স্বাস্থ্য-সুবিধে হবে স্টেট অফ দ্য আর্ট”, “আমাদের সাথে থাকবেন দেশের সেরা ডাক্তারেরা”, “আমরা ফাইভ-স্টার সার্ভিস দেব”, “আমরা ক্যাশলেস সুবিধে দেব”, এ রকম আরও নানা রকমের আইডিয়া আসে মিশন হিসেবে।

সবার বলা হয়ে গেলে, পিটার ড্রাকার তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, এই হাসপাতাল কাদের সার্ভিস দেয়। সবাই চুপ করে রইলেন।

ড্রাকার বলে চললেন, “পরিষেবা-চাওয়া ব্যক্তিটির একমাত্র যে চাহিদা আপনারা পূরণ করতে পারেন তা হল, তাঁর পরিষেবা পাবার নিশ্চয়তা।”

ড্রাকারের এই আলোচনার মূল লক্ষ্য ছিল হাসপাতাল আর স্বাস্থ্য-পরিষেবা চাওয়া ব্যক্তিটির মধ্যেকার সম্পর্ক তৈরি হবার এক কমন উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা। যাকে মিশন বলা যেতে পারে। কমন উদ্দেশ্য নিয়ে এই মিশন স্থাপিত করে তিনি একটি পারস্পরিক সাহায্যের সিস্টেম তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা বাজার-চলতি মুনাফা লোকসানের “এক্সপ্লয়েটিভ” সিস্টেমের মত হবে না।

আমাদের হেলথ সিস্টেম কোনও কমন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে না। বেসরকারি হাসপাতাল, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, মেডিক্যাল সাপ্লায়ার, ফার্মাসিউটিকাল – এরা সবাই ব্যবসা করে যে যার নিজের উদ্দেশ্য মত, কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবার সামনে এসে দাঁড়ানো সেই ব্যক্তিটিকে কেউই সেই পরিষেবার নিশ্চয়তাটা দিতে পারে না। সেইটা কারুর উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে না। উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যে কনফ্লিক্ট তৈরি হয়। সেই কনফ্লিক্ট বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবা চাওয়া ব্যক্তিটির কাছে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাছে।

কোভিড আক্রান্তের গ্রাফের কার্ভ ফ্ল্যাট করার চেষ্টা করতে গিয়ে এইটা সবার সামনে এসে গেছে যে ব্যাঙের ছাতার মত একের পর এক প্রাইভেট হাসপাতাল, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, মেডিক্যাল সাপ্লায়ার, ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি গজিয়ে ওঠার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে আমাদের সরকার ব্যর্থ, সম্পূর্ণ ব্যর্থ। একটি পরিপূর্ণ, সমর্থ পাবলিক হেলথ সিস্টেম গড়ে ওঠার রাস্তা থেকে বহুদূরে সরে গেছি আমরা। এই ব্যর্থতা সবার সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবার পরে আমরা এখন বুঝছি জনস্বার্থে কেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমন উদ্দেশ্যগুলো আমাদের সকলের বোঝা, জানা এবং রক্ষা করা দরকার।

সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন সিস্টেমের মধ্যে কাজ করে চলা অ্যাক্টরদের কাজের উদ্দেশ্যর মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলাই সরকারী সিস্টেমের কাজ। সরকার ঠিকভাবে সেই কাজটা করলেই তার আওতায় কাজ করা সমস্ত সিস্টেমের সামঞ্জস্য, সম্মান, স্বাধীনতা আর সমতা বজায় রাখতে পারে। সরকারী সিস্টেম যখন এই কমন উদ্দেশ্য বা পারপাসের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন বেসরকারি মুনাফালোভী সংস্থারা তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সিস্টেমে প্রবেশ করে, ফলে সামঞ্জস্যের পুরো গল্পটাই মাঠে মারা যায়। নষ্ট হয়ে যায় সিস্টেমে কাজ করে চলা অ্যাক্টরগুলির সামঞ্জস্য, সম্মান, স্বাধীনতা, সমতার প্রচেষ্টা।

আর যে গভর্নেন্স, সরকারী সিস্টেম এইসব বেসরকারি মুনাফালোভী অ্যাক্টরদের স্বার্থ রক্ষা করতে নিজে উদ্যোগী হয়, তাদের হাত ধরে সমাজের বিভিন্ন সিস্টেমের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করে, সেই গভর্নেন্স জনতার সেবা করার অধিকার হারায়।

সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ২৭০ কোটি শ্রমজীবি মানুষ সম্পূর্ণ বা আংশিক লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়েছেন বা হারাতে চলেছেন। সংখ্যাটা পৃথিবীর মোট ওয়ার্কফোর্সের একাশি শতাংশ।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ১২৫ কোটি চাকুরে, যা পৃথিবীর মোট ওয়ার্কফোর্সের ৩৮ শতাংশ এমন ধরণের চাকরিতে নিযুক্ত আছেন, যা এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর পতনের মুখে দাঁড়িয়ে, তাদের চাকরি চলে গেছে বা চলে যেতে বসেছে। অর্থব্যবস্থার সাথে সরাসরি যুক্ত বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবসা আজ অভাবনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যার জন্য তারা কর্মচারীদের বেতন দেওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের ব্যবসা চালু রাখবার অবস্থায় আর নেই।

দুনিয়ার বিভিন্ন স্টক মার্কেটে এখনও অবধি কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের নিবেশ, স্রেফ উবে গেছে। মানে টাকার গতি, যাকে বলে মানি ফ্লো আর লিকুইডিটি, সেটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই অনেক ইন্ডাস্ট্রি তাদের দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। তারা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেতে চলেছে।

বেশির ভাগ বাজারমুখী সাপ্লাই চেন সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। সারা দুনিয়ায় যারা এতদিন আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ করত, আজ তারা তার কোনও নিশ্চয়তা দেবার মত অবস্থায় নেই। অতিপ্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সার্ভিস বা জীবনদায়ী ওষুধও আর আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। ওষুধ, জল, সাফাই – কোনওকিছু আজ চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারী ব্যবস্থা, দেশের বিভিন্ন সিস্টেমের মধ্যে একটি সুসমঞ্জস কমন উদ্দেশ্য প্রণয়ন বা সাধন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ, সেটা এই অবস্থা আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

শুধু মার্কেট সিস্টেম নয়, সরকারি সিস্টেমও একসাথে ভেঙে পড়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার পর যদি সভ্যতা টিকে থাকে, তা হলে হয় তো একদিন আমাদের নতুন করে গভর্নেন্সকে আবিষ্কার করতে হবে, যা আমাদের সবার কমন উদ্দেশ্য সাধনের কাজে লাগবে, কারুর ব্যক্তিগত মুনাফার কাজে নয়।

বেশির ভাগ সরকার সেই উদ্দেশ্য সাধনের আজ চেষ্টা না করে, তাদের নিজস্ব ফান্ড থেকে মার্কেটে টাকা ঢেলে “নর্ম্যালসি” আনার চেষ্টা করে চলেছে।

আপনার, আমার মধ্যে সেই জোর কিন্তু আছে, যার বশে আমরা এই মুনাফালোভী সিস্টেমকে পরিত্যাগ করে কমন উদ্দেশ্য সাধনের সিস্টেমকে সাদরে গ্রহণ করতে পারি। সেই জোর দেখানোর এইটাই সময়, কোভিড-19 আজ বিশ্বে মানবসভ্যতার কাছে সেই একটিমাত্র জোর দেখানোর সুযোগ সামনে এনে দিয়েছে।

সেই সুযোগ, যা মানবসভ্যতাকে নতুন ভাবে ভাবতে শেখাবে আমরা ব্যক্তিগত লাভ বা পরজীবিত্বের আদর্শে বাঁচি না, আমরা বাঁচি সমষ্টি হিসেবে একে অন্যের জন্য, একে অন্যের হাত ধরে, সামঞ্জস্যের সিস্টেম গড়ে তুলে। আমরা আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে দাঁড়িয়ে একদিন ইতিহাসে আমাদের সময়ের কথা লেখা হবে, লেখা থাকবে, আমরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিলাম, না কি পারি নি। ইতিহাস সেদিন সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সত্যিই হোমো সেপিয়েন্স নামের যোগ্য কিনা, যার মানে “বুদ্ধিমান প্রাণী”, দ্য ওয়াইজ ওয়ান।

আমাদের সিদ্ধান্তই বলে দেবে মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ কী, আমরা কি ডাইনোসরদের মত হব, যারা আকারে সুবিশাল ছিল কিন্তু এই গ্রহের জলহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে টিকে থাকার ক্ষমতা তাদের একেবারে ছিল না, নাকি আমরা সেইসব ব্যাকটেরিয়াদের মত হব, যারা অন্যান্য জীবিত প্রাণী বা উদ্ভিদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই টিকে গেছে লক্ষ লক্ষ বছর।

অনুবাদ - শমীক মুখোপাধ্যায়

0 Comments

Post Comment