দেখি, দু’জন শ্রমিক মাঠের আলপথ ধরে বাড়ি ফিরছে। ভিন রাজ্য থেকে ফিরে ওদেরকে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে নিভৃতবাসে থাকতে হয়েছিল। আরও ক’জন শ্রমিক মিলে একসঙ্গে ছিল। গ্রামের রাস্তা ছেড়ে আলপথ ধরে বাড়ি ফেরার কারণ নিভৃতবাসের অস্বস্তি ছাড়া আর কিছু হওয়ার কথা নয়। নিভৃতবাসে থাকার প্রথম তিন দিন স্কুলের সামনে সকাল-বিকেল মানুষজন জড়ো হয়ে ওদের সম্পর্কে খোসগল্প করত। করুণা-টিপ্পনির মিশেলে তৈরি সে গল্পকথা। প্রথম দিন স্কুলে নিভৃতবাস কেন্দ্র করা নিয়ে আশপাশের পরিবারগুলো থেকে আপত্তিও উঠেছিল। লকডাউনের শুরু থেকে শুরু হওয়া ওদের বিড়ম্বনা বয়ে বেড়াতে হ’ল বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত।
অভিবাসী শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে গিয়েছিল আশায় বুক বেঁধে। কেউ গিয়েছিল ছন্নছাড়া পরিবারের দায়ভার মাথায় নিয়ে, কেউ গ্রামে ভালো রোজগারের সুযোগ না থাকায়, কেউ কাজ হারিয়ে। সেখানে কাজ বেশি, মজুরিও বেশি। খাটুনিও কম নয়। বাড়তি খাটুনিতে আক্ষেপ ছিল না কারো। খেয়েপরে টাকাকড়ি জমা হচ্ছিল ভালোই। পরিবার-পরিজন ঘিরে নিজেদের মতো করে স্বপ্ন দেখতে বাধা ছিল না।
অভিবাসে কর্মক্ষেত্র ঘিরে ওদের আশা পল্লবিত হ’ত। অনেকের কখনো আশাভঙ্গও হ’ত কাজ, কাজের পরিবেশ কিম্বা মজুরি নিয়ে টানাপোড়েনে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে যেত আর একটু ভালোর আশায়। আশার আলো-আঁধারিতে স্বপ্নগুলো বিচিত্র বিভঙ্গে সেজে উঠেছিল। পরিযায়ী শ্রমিক তকমার মতো অমোঘ নিয়মে ওদের আশা-স্বপ্নগুলোও যেন পরিযায়ী। এর মধ্যেই ওরা বাঁচার রসদ খুঁজে নিয়েছিল – ওদের চিন্তাধারার মানানসই মানুষের মতো বাঁচা।
অতিমারির অছিলায় সরকারি-অসরকারি কর্মকর্তাদের যে অতি-আচার নামিয়ে আনা হ’ল ওদের জীবনে, তার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? এপ্রশ্নের উত্তর মিলবে না, ওরা জেনে গেছে। আর এখান থেকে ওরা ভয় পায় নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। লকডাউনের জের কতদিন চলবে, জানা নেই। ওদের পুরনো কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়া কি সহজ হবে? লকডাউনের জেরে ব্যবসাপত্র সবকিছুতে মন্দা নেমে এসেছে। সরকার টাকা ঢালবে না; কোম্পানি-প্রমোটাররা কাজ পাবে না। ট্যাঁকের বলে কত আর কাজ হবে? সোনা, ইমিটেশন, বয়নশিল্প, কারপেন্টারি, এমন সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ এখনই বেসামাল। কত আর কাজ হবে? ভাবনাগুলো ওদের মনে ঘুরপাক খায়। প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে না। উত্তর মিলবে, সেই আশাটুকুও জাগে না। নিয়তির শরণ নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে শুধু চেয়ে থাকা।
কেন্দ্র সরকারের তামাশা-ঠাসা কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজে ছিটেফোঁটা যা’ই কাজের হোক, অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য তাতে মুশকিল-আসানের নামমাত্র নেই । প্রায় তিন মাস ধরে ওরা কর্মহীন। ঘরে ফেরার বিড়ম্বনায় বহু শ্রমিকের বেশ কিছু টাকা জলাঞ্জলি গেছে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অনেকেই বলছেন, শ্রমজীবী মানুষদের হাতে উপযুক্ত পরিমাণে নগদ টাকা দেওয়া প্রয়োজন। সে নিয়ে কেন্দ্র সরকারের কোনো হেলদোল নেই। রাজ্য সরকারের অবস্থা তথৈবচ। অভিবাসী শ্রমিকদের উদ্দেশে তার যত করুণাধারা, ‘স্নেহের পরশ’-এই সব নিঃশেষিত। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে ন্যূনতম এক হাজার টাকা করে রাজ্য সরকারের অনুদান, যার সুযোগ লকডাউনের আগে থেকেই রাজ্যে থেকে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকরাও পেতে পারত, রাতারাতি পাল্টে নেওয়া নিয়মের গেরো আর নেট-ব্যবস্থার চালাকিতে সর্বসাকুল্যে কয়েক হাজার জন মাত্র পাবে। এই যখন অবস্থা, তখন অভিবাসী শ্রমিকরা আর কীসে ভরসা করবে?
কেন্দ্র-রাজ্য সরকারি ভাষ্যে জানা যাচ্ছে, কর্মনিশ্চয়তা আইন মনরেগায় অভিবাসী শ্রমিকদের মুশকিল আসান হবে। মনরেগায় চল্লিশ হাজার কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু প্রায় এগারো কোটি শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ যথেষ্ট নয় এবং তামাশাটা এই যে, এই খাতে যত বরাদ্দ হয়, তার অর্ধকেরও কম খরচ করা হয়। এদিকে রাজ্যে মনরেগা নিয়ে চিরাচরিত নৈরাজ্য শুরু হয়ে গেছে। বহু শ্রমিকের ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে যাওয়া জবকার্ড চালু করা হচ্ছে না। চালু সব জবকার্ডের একটা অংশকে বাছাই করে কাজ দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাকিদের পরে কাজ দেবে। মনরেগায় যে কাজ দিয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, তা কিন্তু মামুলি ব্যাপার । কেননা ওরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে এর চেয়ে তিন গুণ বেশি কাজ ও তিন-চার গুণ বেশি মজুরি পেয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে লকডাউনজনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় মনরেগা বড় ভূমিকা নিতে পারে, যদি শ্রমদিবস দু’শো দিনে তোলা হয় ও মজুরি পে কমিশন নির্ধারিত অদক্ষ শ্রমিকের মানদণ্ড অনুযায়ী বাড়ানো হয়। সেখানে অভিবাসী শ্রমিকরা কিছুটা অন্তত উপকৃত হবে।
রাজ্যে অধিকাংশ গ্রামপঞ্চায়েতই আইএসজিপিপি ক্যাটেগরির। এসব পঞ্চায়েতগুলো উন্নয়ন-খাতে বছরে দুই কোটি বা তারও বেশি টাকা পায়। আমলাতান্ত্রিক অনীহা ও কর্মকর্তাদের অপেশাদারিত্বের কারণে ঐ অর্থের অর্ধেকের বেশি খরচ হয় না। আজ এই সঙ্কটের দিনে অন্তত এই হীনদশা ঘুচুক। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নেমে আসুক আরও বেশি বেশি শ্রমদিবস সৃষ্টি করতে। অভিবাসী শ্রমিকরা কাজ পাক।