আর্জেন্টিনা হেরে গেল। হেরে যাওয়া নতুন না। তবে প্রতিবার হারের পরের অনুভূতিগুলো পালটে পালটে যায়। 'একটুর জন্য কতকিছু হয়নি, ক্ষয়ে যাওয়া আশা তবু পুরোটা ফুরোয়নি...'- ঐ যে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া আশা, কী সম্মোহন, গতকাল দেখলাম আড়াইটের সময় বাড়ির নিচ দিয়ে স্কুল ফেরত ছেলের জটলা, স্কুল ছুটি চারটেয়, তবু, আর্জেন্টিনার খেলা, মেসির খেলা, এইটুকুর টানেই দলে দলে ছেলে ঘরে ফিরছে!
নতুন শতকের প্রথম দশক। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। পেকেরম্যানের আর্জেন্টিনা। ম্যাক্সি-মাসচেরানো-রিকেলমে-ক্যাম্বিয়াসো। সামনে স্যাভিওলা-ক্রেসপো। এই একটা দলের পোস্টারে অন্যরকম লাগত কার্লোস তেভেজকে। আমাদের পাড়ার দেয়ালে, কে যেন তেভেজের চুলে কালি দিয়ে রঙ করে দিয়েছিল। গলায় দিয়ে গেছিল গাঁদার মালা। এই দেয়ালটার পাশ দিয়ে আমার বিকেলের অঙ্কক্লাস, এই সময়টায় ঝটিকা বিশ্বকাপ এলে অচেনা খেলোয়াড়ের ভিড়ে, পাড়ার বিলে-বিষ্টুদাদাদের মাতব্বরির ভিড়ে, এক আধটা ম্যাচ দেখা হয়েই যেত টিভিতে। ছাব্বিশ টাচের একটা গোল নিয়ে সেবার মাতামাতি হল খুব। মনে পড়ে সূর্যদাকে, রিকেলমে কাপ জিতলে এ পাড়ার সবাইকে নিজের গুমটিতে ফ্রি তে বিস্কুট খাওয়াবে বলেছিল। আমার হোঁচট খেয়ে হাঁটু ছড়ে যাওয়ার যন্ত্রণার মতো এসেছিল আবানদাঞ্জিয়ারির চোট। জার্মানি জিতে গেল। ঐ যেন প্রথম, হয়ত বুঝিনি, পরে বুঝেছি, তবু ঐ প্রথম- জেতা সহজ কাজ না। ভালবাসা সহজ। বোকারা এভাবে ভালবাসে। সেইসব পাড়াটারা আজ আর নেই। হাওড়া শহরের জ্যামিতি বদলে দিয়েছে হাইরাইজ বিল্ডিং-রা, আমাদের ভাড়া করে আনা টিভিগুলো কবেই চলে গেছে বেপাড়ায়, স্টোররুমে। তারপর কত কী যে হয়ে গেল! মারাদোনা যেবার কোচ, আমরা বন্ধুরা স্কুলে বেঞ্চ বাজিয়ে গাইতাম-
'মাঠের মাঝে আর্জেন্টিনা
মনের মাঝে মেসি
বুকের মাঝে মারাদোনা
তাতেই মোরা খুশি...'
হয়নি। কোনওবারই হয়নি। আবানদাঞ্জিয়ারি কখনও চোট পেয়ে যান, কখনও শেষ মুহূর্তে মারিও গোটজে ভেঙে দিয়ে যান সবকিছু, আবার কোনওমতে গুছিয়ে নেমে পড়ো। বাবাদের কাছে শুনতাম, মারাদোনার নব্বই-এর কান্নার পর আর্জেন্টিনার সমর্থকরা শক্ত হয়ে গেছে। ঐ কান্না যেন আশ্চর্য পেনকিলার যা দশকের পর দশক কষ্ট ভোলাতে পারে। ঐ ব্যথার মাঝেও হেঁটে চলাই চিরন্তন।
মারাদোনা থাকলে আজ গ্যালারি থেকে মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে দিতেন আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা ফিফাকে। ঐ যে, আর্জেন্টিনার ছেলেরা ছকভাঙা! চে-ফিদেল-মারাদোনা...
ভায়াকম মিডিয়ার বদান্যতায় ম্যাচের আগে না না গল্প দেখায় প্রি-ম্যাচ শো তে। আজ দেখাচ্ছিল, এই রাজ্যের এক চা দোকানির গল্প। দোকানের রঙ নীল সাদা। মেসি-মারাদোনা-বাতি-তেভেজের ছবি ঘরজুড়ে। বলছেন, মেসির জন্মদিনে বাচ্চাদের আমরা নতুন জামা দিই, একটা স্কুল করেছি অনেকে মিলে টাকা জমিয়ে, মেসির যত বছরের জন্মদিন হয়, তত পাউন্ডের কেক আনি। সব বাচ্চাদের নিয়ে কেক কাটা হয়, খাওয়াদাওয়া। ভালবাসা নাকি বিপ্লব, কী? জানি না!
আর্জেন্টিনা জিতলে ভাল লাগে। আর্জেন্টিনা হারলে ভালবাসা বেড়ে যায়। কী আজব সমীকরণ, আমি বুঝলাম না ব্যাপার! ফুটবল টেকনিক্যালিটিসের বাইরে গিয়েও ভালবাসার একটা নিজস্ব পৃথিবী আছে। সেখানে ছত্রিশ বছর, আঠাশ বছরের টিটকিরি নেই। স্বতন্ত্র ভাবে বেঁচে নিতে চাওয়া একটা দেশ আছে। ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি নিজের মধ্যে গড়ে নেয়া ধারণারা আছে। যেখানে ঝুপ করে লুকিয়ে পড়া যায়। চাইলেই...