পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

খাদের কিনারে ভোটবাজি জমে উঠেছে।

  • 24 March, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 2278 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
আমি নিজে ৩৭ বছর ধরে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে একটা দলে কাজ করে বাম জমানায় টিএমসি-র সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করায় দল ছেড়েছিলাম। কেন না, ওরকম জোটের মধ্যে থেকে সত্যিই আমি কাজ করতে পারতাম না! আমরা বামপন্থীদেরই চাই। সিপিএম-এর রাজনীতির অন্য সমালোচনা যাই থাকুক, যদি নির্বাচনে তারা একটা সৎ, স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন অবস্থান নিয়ে বিজেপি-বিরোধিতায় সদর্থক ভূমিকা পালনে ব্রতী হতেন, আমরা অন্তত নির্বাচনী সময়টুকুতে তাদের সঙ্গেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম।

এত দিনে জমে ওঠারই কথা। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে। কোন জেলায় কোন মহকুমায় কবে ভোট হবে ঘোষণাও হয়ে গেছে। লেখাপড়ার বারোটা বাজিয়ে স্কুল শিক্ষকদের ধরে নিয়ে গিয়ে ইট্‌রেনিং-ও প্রায় শেষ। এখন শুধু ভোট হওয়া বাকি।

আমরা যারা বাম মনস্ক অদল কর্মী সমর্থক, যারা এখন বিজেপি-কে ভোট নয় (NoVoteToBJP) আন্দোলন করছি, তারা কেন বিজেপি-র বদলে কাকে ভোট দেবেন বলতে পারছি না, এই নিয়ে চার দিকে একটা গুঞ্জন উঠেছে। তারই ব্যাখ্যায় আমার এই ব্যক্তিগত নিবেদন।

আমরা কেন সরাসরি বাম সংযুক্ত মোর্চাকে ভোট দিতে বলছি না, সিপিএম মহলের এটা একটা বড় প্রশ্ন। আর যেহেতু আমরা সেটা বলতে পারছি না, তারা ধরেই নিয়েছে, আমরা টিএমসি-র হয়ে প্রচার করছি। সুতরাং প্রথম পর্বের ভোট শুরু হওয়ার মুখে এর একটা উত্তর প্রকাশ্যভাবে দেওয়া দরকার বলে মনে হল।

সমস্যা হচ্ছে ভোট ফর লেফট শিবিরে।

একে তো আব্বাসউদ্দিন সিদ্দিকীর সেকুলার ফ্রন্ট নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে, যার একটারও উত্তর সিপিআই (এম) শিবিরে নেই এবং কেউ দিতে পারছে না। সেকুলার ফ্রন্টের অংশীদারদের প্রায় সকলেরই দুটো করে ভাগ। এক দল তৃণমূলের দিকে, আর একদল বিজেপি-র দিকে। আব্বাস যাদের সঙ্গে ফ্রন্ট বানিয়েছে তারা সকলেই বিজেপি-র শিবিরের লোক। পদ্ম দলের বিভিন্ন সভায় তাদের উপস্থিতি এখন কম বেশি সকলেই জেনে গেছেন। তার নানা ছবিও ঘুরছে সোস্যাল মিডিয়ায়।

অর্থাৎ, আব্বাস উদ্দিনের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভোট ফর লেফট শিবিরে থেকে বিজেপি-র কাজ কিঞ্চিত সহজ করে দেওয়া। মহাভারতীয় শিখণ্ডী কৌশলে।

সিদ্দিকীর নিজের কাজ যে তৃণমূল শিবির থেকে খানিকটা মুসলিম ভোট কেটে এনে বিজেপি-কে পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করা সেটা বুঝতে কারও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডকটরেট হতে হবে না। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকলেই বোঝা যায়। আর মুসলিম জিগির তুলে মুসলিম ভোট কাটার খেলাটা যে সেকুলার কোনো পন্থা নয়, সেও বুঝতে খুব বেশি লেখাপড়া করতে হয় না।

এই অবধিও ঠিক ছিল। অঙ্কের স্টেপ বাই স্টেপ দিব্যি মিলে যাচ্ছিল। সমস্যা দেখা দিয়েছে দুই জায়গায়।

এক নং সমস্যা হল, সিদ্দিকীর ফ্রন্টও প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। যাদের সাহায্য করার জন্য তাঁর নির্বাচনে ঝাঁপ, সেই বিজেপি-র মতোই। বিজেপি-র সমস্যা তবু বোঝা যায়। তার নিজের লোক খুব একটা নেই। কেনাকাটা করে অন্যান্য দল থেকে যা ভাঙিয়ে আনতে পেরেছে, তাই তার মূলধন। তার মধ্যে আবার দলের মধ্যে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বাসি পদ্ম ও তাজা পদ্মদের মধ্যে প্রচণ্ড হাতাহাতি চলছে। প্রার্থী পদ না পেলে যে কেন লোকে পার্টি অফিস ভাঙচুর করে, আমার জানা নেই। পার্টি অফিস তো আর কাউকে প্রার্থী করে না, কাউকে কখনও বঞ্চিত করেছে বলেও শুনিনি। সিদ্দিকীর ফ্রন্টে ভাঙচুর নেই, কেন না, তার দলের কাউকেই কিনে আনা হয়নি। কিন্তু প্রার্থী কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, কেন না, এই গরমে প্রার্থী হয়ে কেউই নিশ্চিত হারের ঝুঁকি নিতে চাইছে না।

কংগ্রেসের ভোট যে তারা খুব বেশি পাবে না, সেই ব্যাপারে তারা নিশ্চিত—সে মান্নান সাহেব যতই তাদের পিঠ চাপড়ান। সিপিএম-এর ভোট এমনিতেই কমতির দিকে। তার মধ্যে তারা এখন বিজেপি-র থেকে সমর্থন পাওয়ার ফলে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম বুলডোজার প্রকল্পকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা শুরু করছে। সামান্য সাধারণ বুদ্ধি থাকলেই বুঝতে পারার কথা, টাটা সালেম কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করতে যতটা নগ্নভাবে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, গণহত্যা ধর্ষণ কোনো অপরাধেই পিছপা হয়নি, সেই কর্মসূচিতে আজকের দিনে জনসমর্থন পাওয়া আর হাতির পাঁচপা দেখা সমতুল্য। অপরাধ স্বীকার না করলে, নতুন মুখ নামিয়েও সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অন্য দিকে, ভায়া মিডিয়া বিজেপি-র সঙ্গে হাইফেনে যুক্ত থাকার প্যাঁচ কষতে গিয়ে তাতে আরও ধস নেমে যেতে পারে। তার সঙ্গে বিজেপি-র যে কটা ভোট সেইটুকুর ভরসাতে নৌকা ভাসাতে অনেকেই সাহস পাচ্ছে না।

দু নম্বর মজার ঘটনা হল, আব্বাস সিদ্দিকী অনেক হইহল্লা করে সেকুলার ফ্রন্ট বানানোর এবং ঘোষণার পর দেখা গেল, তার অমুসলিম শরিকদের প্রায় সকলেই (আগে যারা তৃণমূলের শিবিরে ছিল) বিজেপি-র সমর্থক। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সংযুক্ত মোর্চার নামে এই একটি ফ্রন্ট খোলার দ্বারা সিপিএম এক ঢিলে চার পাঁচটা পাখি মেরে নিতে চাইছে। যথা: ১) সিদ্দিকীর মুসলিম প্রার্থীরা যদি তৃণমূলের কিছুটা মুসলিম ভোটও কাটতে পারে, তাতে বিজেপি-র লাভ হবে; বিহারে ওয়েইসি-র মিম যেমন অনেক আসনে বিজেপি-র সুবিধা করে দিয়েছে, এখানে সিদ্দিকীর মঞ্চ সেই একই কাজ করে দেবে অভিধান থেকে ভিন্ন কিছু শব্দমালা ব্যবহার করে। ২) সেই লাভের জন্য কেউ সরাসরি সিপিএম-এর দিকে আঙুল তুলতে পারবে না, কেন না, কোনো ইউআরএল নেই। ৩) অর্থাৎ, বামেদের ভোট খানিক ধরে রেখেই সিদ্দিকীর মাধ্যমে বিজেপি-কে দুদিক থেকে সুবিধা করে দেওয়া এই ফ্রন্ট গঠন ও তার সঙ্গে বামেদের আঁতাতের লক্ষ্য। সিপিএম আর বিজেপি-র মধ্যে সিদ্দিকীর শরিকরা বাফার বা সেতু হিসাবে কাজ করতে থাকবে। বাইরে শ্লোগান টোগান যাই হোক, পদ্ম আর কাস্তে দুই পক্ষ সাজঘরে বসে বোঝাপড়া চালিয়ে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ৪) কংগ্রেসের সাহায্যে অন্যান্য বেশ কয়েকটা রাজ্যে ভোটীয় সামর্থ্য বৃদ্ধির মতোই সিদ্দিকীর মুসলিম সংগঠনের মাধ্যমে (অবশ্যই একটা বাফার সংগঠন তৈরি করে) সারা ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা ঢোকার পথ সুগম হবে। ৫) নির্বাচনে যদি দু একটা আসনও বাড়ে, দলের এই সর্বনেশে কৌশল মান্যতা পেয়ে যাবে।

এদিকে এখন আবার শোনা যাচ্ছে সেই সেকুলার ফ্রন্টের নামে সিদ্দিকীর নয়া জোট ভোটে লড়ছে না। ফ্রন্ট শিকেয় তুলে দিয়ে সেকুলার ট্যাগ বিছানার তোষকের নীচে সযত্নে লুকিয়ে রেখে তারা এখন নেমেছে বিহারের কী এক মজলিশ নামের সংগঠনের পতাকা হাতে। যার মুসলিম পরিচিতি সত্তা নিয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। এটা যদি সত্য হয় তাহলে, খেমটা নাচের সময় ঘোমটার অব্যবহার সম্পর্কে একটা যে প্রবচন আছে বাংলাতে, তার যথার্থ প্রয়োগ দেখার সুযোগ হয়ত মিলে যেতে পারে আমাদের। সমস্যা হয়ে যাবে তাঁদের যাঁরা কটা দিন ধরে সেকুলার ফ্রন্টের সেকুলারি মাহাত্ম্য বুঝতে ও বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।

লক্ষণীয়, তৃণমূলের অপশাসনের কয়েকটি অনস্পষ্ট মৌল রাজনৈতিক মুদ্দার বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজ সিপিএম মোর্চা তুলছে না। যেমন, বহু বছর ধরে বিনা বিচারে অসংখ্য লোককে (মহিলা সহ) জেলে কয়েদ করে রাখা। না হচ্ছে বিচার, না দিচ্ছে জামিন। এর মধ্যে বেশ কিছু রাজনৈতিক বন্দিও আছে। জেলগুলিতে বন্দিদের সঙ্গে নানা রকম অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। জেল কোড মানা হচ্ছে না। বিনা চিকিৎসায় একাধিক বন্দি মারা গেছে। বন্দিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের নিয়মে নানা ভাবে জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে। করোনার সময় জেলগুলিতে বিক্ষোভ দেখানোর অপরাধে পুলিশ ওয়ার্ডে ঢুকে ব্যাপক মারধোর করেছে এবং দমদম সেন্ট্রাল জেলে পুলিশের গুলিতে অন্তত পাঁচজন কয়েদি মারা গেছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের সপক্ষে এই সব সমস্যা ও দাবি নিয়ে আওয়াজ তুললে তা একই সঙ্গে বিজেপি-র দিকেও তাক করা যেত। সেই রাস্তায় সিপিএম যাচ্ছে না। কেন, তা বুঝে নেওয়া দরকার।

সিপিএম মোর্চা টিএমসি-র বিরুদ্ধে যে মুদ্দাগুলোকে বেছে নিয়েছে, সারদা, নারদ, ইত্যাদি, বাস্তবে যা এখন বিজেপি-র ভয় দেখিয়ে কেনাকাটি করার অস্ত্র। সারদা লুটের চাইতে অনেক বড়, বহুগুণ বেশি চুরির সঙ্গে কংগ্রেস বা লালু যাদব জড়িত, যারা আবার সিপিএম-এর বেশ ঘনিষ্ঠ ভোট-শরিক। আর বিজেপি-র ব্যাপম বা রাফায়েল দুর্নীতির মাত্রা এই সবের চাইতে অনেক বেশি। ফলে বড় চুরি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই না করে সে হইচই করছে যে তাকে রাজ্যপাট থেকে সরিয়েছে শুধু তার বিরুদ্ধে। দশ বছরে আড়াইশ সিপিএম কর্মী খুনের জন্য টিএমসি-র বিরোধিতা করে তারা হাত ধরেছে সেই দলের, যাদের হাতে পাঁচ বছরে (১৯৭২-৭৭) নাকি ১১২০ জন কর্মী খুন হয়েছিল। সংখ্যাগুলি যদি ফেকু না হয়, তথ্যগুলি বিস্ময়কর! ২৮ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেডের জনসভায় যে বিজেপি-র জনবিরোধী আইনগুলির (শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শ্রম কোড বিল, কৃষকদের বিরুদ্ধে ফার্ম বিল, এবং জনগণের বিরুদ্ধে এনার্সির আওয়াজ) বিরুদ্ধে প্রায় আওয়াজই তোলা হল না—এটা নিশ্চয়ই বয়স্ক নেতাদের স্রেফ ভুলে যাওয়া নয়। দিকে দিকে (যার ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য) এও একটা বার্তা।

আমরা যারা বাম মনস্ক অদল কর্মী সমর্থক, যারা এখন বিজেপি-কে ভোট নয় আন্দোলন করছি, তারা কেন বিজেপি-র বদলে কাকে ভোট দেবেন বলতে পারছি না, এই হচ্ছে তাদের সমস্যা। আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই টিএমসি-কে ভোট দিতে বলতে পারি না। আমি নিজে ৩৭ বছর ধরে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে একটা দলে কাজ করে বাম জমানায় টিএমসি-র সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করায় দল ছেড়েছিলাম। কেন না, ওরকম জোটের মধ্যে থেকে সত্যিই আমি কাজ করতে পারতাম না! আমরা বামপন্থীদেরই চাই। সিপিএম-এর রাজনীতির অন্য সমালোচনা যাই থাকুক, যদি নির্বাচনে তারা একটা সৎ, স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন অবস্থান নিয়ে বিজেপি-বিরোধিতায় সদর্থক ভূমিকা পালনে ব্রতী হতেন, আমরা অন্তত নির্বাচনী সময়টুকুতে তাদের সঙ্গেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম।

কিন্তু ইন্দিরা কংগ্রেস আর আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে তাদের তিস্তা-সেতু দেখিয়ে দিল, স্রেফ ক্ষমতা হারানোর ট্রমা আর তার প্রতিশোধ স্পৃহা আজ সিপিআই (এম)-কে বামপন্থা থেকে এক অতল খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। আজ তার ভোট-কৌশল বিজেপি-কে পরাস্ত করার জন্য নয়, বিজেপি-র দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা আড়াল করার জন্য নিয়োজিত।।

0 Comments

Post Comment