পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভ্যাকসিন এসে গেছে: আমরা কি নিশ্চিত?

  • 12 January, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1850 view(s)
  • লিখেছেন : পার্থপ্রতিম মৈত্র
মানুষ আপাতত এটুকু জেনেই খুশী, যে কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ব, বিশেষত ভারতবর্ষ কোভিদ-১৯ মুক্ত হবে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং ফুলপ্রুফ হওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ, কারণ মানুষের শরীরের ওপর এর প্রয়োগের ঝুঁকি রয়েছে। সে প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই দেশের বাজারে আসছে টিকা। আমরা নিরাপদ তো?

অবশেষে উৎকণ্ঠার অবসান। অথবা নতুন উৎকণ্ঠার শুরু।

ভ্যাকসিন এসে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন বায়োফার্মাসিউটিকাল কোম্পানীকে বিভিন্ন ধরণের ভ্যাকসিন সাপ্লাই করার বরাত দিচ্ছেন। এ বাজারে এগিয়ে রয়েছে ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্ণা, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চিনের সিনোভ্যাক এবং সিনোফার্মা, রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ ইত্যাদি। ভারতবর্ষেও বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে (কমিটিতে কোন কোন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাঁদের তালিকা অবশ্য চেষ্টা করেও জানতে পারিনি) অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের অনুমতি পেয়ে গেছে (ফাইজার এখনও পায়নি)। ব্রিটেনে উল্টোটা। ফাইজার প্রথম অনুমোদন পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড জন্মভূমি ইংল্যাণ্ডে ছাড়পত্র পেয়েছে। আর ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল রিপোর্ট কোনও সায়েন্টিফিক জার্ণালে প্রকাশিত না হওয়া সত্বেও অনুমোদন পেয়ে যাওয়ায় বৈজ্ঞানিকেরা ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। এদিকে হু ফাইজারের ভ্যাকসিনকে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া মাত্র ফ্লাডগেট খুলে গেছে। চিন, আমেরিকা আর রাশিয়া বিভিন্ন দেশের বাজার দখল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এ লড়াইয়ে এগিয়ে চিন। কোভিদ নিয়ন্ত্রণে তাদের সাফল্য, বিশ্ববাজারে তাদের আধিপত্য আর তাদের ভ্যাকসিনের প্রতিটি ফেজে প্রয়োগ স্বচ্ছতা তাদের প্রতিযোগিতার বাজারে এগিয়ে রেখেছে।

মনে রাখতে হবে যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং ফুলপ্রুফ হওয়া একটি দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ বিষয়, কারণ মানুষের শরীরের ওপর এর প্রয়োগের ঝুঁকি রয়েছে। এর আগে সবচাইতে দ্রুত অনুমোদন পাওয়া গিয়েছিল ১৯৬০ সালে মাম্পস ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে, যা সাড়ে চার বছর সময় লেগেছিল ডেভেলপ করতে। আমরা এই মুহূর্তে যে অনুমোদনের কথা বলছি তা আসলে এমার্জেন্সি ইউজ অথোরাইজেশন (ইইউএ)। কিন্তু তারও কতগুলি মানদণ্ড থাকে, যেখানে দেখা হয় অন্তত ৫০% কার্যকারিতা আছে কিনা। যেমন যাঁরা জরুরি প্রয়োগ অনুমোদন করেছেন তাঁদের নিশ্চিত হতে হয় যে সম্ভাব্য উপকারিতা সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকির থেকে বেশি। তিন ফেজের ট্রায়ালের ক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণাদি সহ দেখাতে হয় উৎপাদিত ভ্যাকসিন বিপণ্মুক্ত। এটা নিশ্চিত করতে হয় তিন হাজারেরও বেশি ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীর উপর প্রয়োগের ভিত্তিতে। লক্ষ্য রাখতে হয়, পরবর্তী পর্যায়েও তাদের উপর কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না। এক মাস ধরে পর্যায়ক্রমে লক্ষ্য রাখার পরেই অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞ এবং অ্যাক্টিভিস্টরা বলে আসছেন যে ভারতবর্ষের ড্রাগ রেগুলেশনের এই ক্ষমতা নেই যে তারা ইইউএ জারি করতে পারে এবং এই অনুমোদনের কোন পরিষ্কার সংজ্ঞা ও সংগতিপূর্ণ কোন নিয়মাবলী নেই। তবুও তারা জরুরি ভিত্তিতে অথবা সীমাবদ্ধ জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে এই ভ্যাকসিনগুলি অনুমোদন পেয়েছে, সে বিষয়ে একটু অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে যে প্রায় সব ক্ষেত্রেই যে মেডিকেল রিসার্চ কোম্পানি এই ভ্যাকসিন তৈরি করতে অগ্রণী হয়েছে, তাদেরই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রিপোর্টের ভিত্তিতে (যা কিনা খুব দ্রুত, অল্প সময়ে, তাড়াহুড়োর মধ্যে, এবং স্বাভাবিক ভাবেই অপর্যাপ্ত অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তৈরী) এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই ধরণের পরিস্থিতিতে একটা বিশাল সংখ্যক জনগণকে, যাদের উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে, তাদের এই সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি। বিভিন্ন দেশের সরকার এই বিষয়ে যুক্তি দিয়েছে, সারা পৃথিবীর মানুষ মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছিল কবে ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে এবং মানব সভ্যতা রক্ষা পাবে। সেই অসহায় মানুষের জন্যই দ্রুত জরুরিকালীন তৎপরতায় ভ্যাকসিনের আবিষ্কার, বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষা এবং প্রয়োগ। একজন সরকারি উচ্চপদস্থ সিনিয়র অফিশিয়াল এর আগে বলেছিলেন, ভ্যাকসিন উৎপাদক যেসব কোম্পানি অন্যত্র ট্রায়াল হয়েছে তার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন লঞ্চ করার অ্যাপ্রুভাল চাইবে, তাদেরকে লোকাল এরিয়াতে ট্রায়াল করে দেখাতে হবে যে এই ভ্যাকসিন সেই অঞ্চলের মানুষের উপরে কার্যকরী এবং বিপন্মুক্ত। তবেই তারা অনুমোদন পেতে পারে।

তবে মানুষ আপাতত এটুকু জেনেই খুশী, যে কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ব, বিশেষত ভারতবর্ষ কোভিদ-১৯ মুক্ত হবে। ঘাড়ের ওপর সারাক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলবে না করোনা ভাইরাস। জনজীবন স্বাভাবিক হবে, কলকারখানা খুলবে, অফিস কাছারিতে কাজ শুরু হবে, হাসপাতালগুলিতে কোভিদ ছাড়াই অন্য রোগের চিকিৎসা শুরু হবে। ভ্যাকসিন যখন আবিষ্কৃত হয়ে গেছে তখন ধরে নেওয়া যায় অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে, রাজনীতি স্বাভাবিক হবে, স্বাভাবিক হবে জনজীবন। আকাশ থেকে জিনিসের দাম নেমে আসবে মাটির পৃথিবীতে, স্কুল কলেজ খুলবে, ছেলেমেয়েরা গৃহবন্দি হয়ে থাকার বদলে, খেলবে, হাসবে, ভালবাসবে। মুক্ত পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নেবে। সর্বক্ষণ আর স্যানিটাইজার মাখা জীবন কাটাতে হবে না। সামাজিক দূরত্ব পেরিয়ে মানুষ মানুষকে ছুঁতে পারবে। মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে মানুষের মুখ। ভ্যাকসিন যখন আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, তখন এসব ঘটতেই পারে।

সমস্যা একটাই। ভারতবর্ষে কোভ্যাক্সিন আর কোভিশিল্ড অনুমতি পাওয়ার ঠিক দু'দিন আগে হু-র চিফ সাইন্টিস্ট সৌম্যা স্বামীনাথন মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, এখনো নিশ্চিত হওয়ার সময় আসেনি। ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সম্পর্কিত যে সমস্ত ডেটা এবং এভিডেন্স হাতে এসেছে তা আদৌ যথেষ্ট নয়। এটা প্রমাণিত হয়নি যে, এই ভ্যাকসিনগুলি প্রয়োগের পরেও মানুষ আক্রান্ত হতে অথবা অন্যকে সংক্রমিত করতে পারবে না। তিনি বলেছেন, যাঁরা এই ভ্যাকসিন নেবেন, তাঁরা যখন অন্য দেশে প্রয়োজনে যেখানে অল্প হলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে যাবেন, তাদের কোয়ারেন্টাইন করতেই হবে। ভ্যাকসিন গবেষকেরা চেষ্টা করছেন এটা নিশ্চিত করার জন্য যাতে এই ভ্যাকসিনগুলি ভাইরাসের সংক্রমণের সম্ভাবনা বন্ধ করতে পারে, এবং কোভিদ-১৯ সিম্পটমস প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কার্যকরী হতে পারে। স্বামীনাথনের মতে, কোনও ভ্যাকসিনের বিষয়েই যথেষ্ট প্রমাণ নেই যা নিশ্চিত করে যে এটি মানুষকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে অথবা তা সংক্রমিত করতে প্রতিহত করতে পারে। ফলে যতক্ষণ না নিশ্চিত হতে পারছি, ততক্ষণ এটা ধরে নেওয়া ভাল, যে যারা ভ্যাকসিন নিচ্ছেন তাদেরও আগের মতোই মাস্ক, স্যানিটাইজার বা বা সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলা উচিত, নিজেদের এবং অন্যের সুরক্ষার জন্যই এটা করা উচিত যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা লেভেল অফ হার্ড ইমিউনিটি মানুষের মধ্যে জন্মাচ্ছে যা এই ভাইরাসকে প্রতিহত করতে পারে। মোদ্দা কথা যেটা দাঁড়ালো, অ্যালিস ইন দা ওয়ান্ডারল্যান্ডের গল্পের মতো এক বছর ধরে এক জায়ায়গায় প্রাণপণে দৌড়ে গেলাম কারণ না দৌড়ালেই পিছিয় যাবো এই আশঙ্কায়। প্রথমত, এই ভ্যাকসিন এই মুহূর্তে নিশ্চিত সুরক্ষা দেবে না, আক্রান্ত হওয়া এবং সংক্রামিত করা, দুই ক্ষেত্রেই। দ্বিতীয়ত, এক বছর ধরে যে অদ্ভূত পদ্ধতিতে (মাস্ক, স্যানিটাইজার বা সামাজিক দূরত্ববিধি, লকডাউন ইত্যাদি) দরজা জানালা, কলকারখানা, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য সব বন্ধ করে মানুষ বেঁচে আছে, তার কোনও ব্যত্যয় ঘটবে না। তৃতীয়ত, এতদিন ধরে যা জানতাম আজও তাই জানলাম, হার্ড ইমিউনিটি ডেভেলপ করলেই এই ভাইরাসকে প্রতিহত করা সম্ভব হলেও হতে পারে।

তবু ভ্যাকসিন প্রয়োজনীয়। আর তার জন্য প্রয়োজন তীব্র কোভিদ আতঙ্ক। আতঙ্কের বাতাবরণ না থাকলে মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে কেন? যে রোগে সুস্থতার হার ৯৬-৯৭ শতাংশ আর যে রোগে মৃত বলে প্রচারিত মানুষেরা কোমর্বিডিটিতে মৃত কিনা, চিকিৎসার অভাবে মৃত কি না তাই এখনও নির্ধারিত হলো না, সে রোগবাহী ভাইরাস আর যাই হোক মারাত্মক প্রাণঘাতী হতে পারে না এ কথা শিশুও বোঝে। তবু বিশ্বব্যাপী এই কোভিদ আতঙ্ক এবং ভ্যাকসিনের জন্য উন্মুখ কাতরতা যে অনেকটাই কৃত্রিমভাবে তৈরি তা কোভিদ ভ্যাকসিনের বিশ্ববাজার দখলের যুদ্ধ, ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসী আর করোনা অর্থনীতির প্রকোপে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ফলে উৎকণ্ঠার অবসান অথবা নতুন উৎকণ্ঠার শুরু।

0 Comments

Post Comment