পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অসম বন্ধুত্ব

  • 09 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 705 view(s)
  • লিখেছেন : আসরফী খাতুন
করিম যখন প্রথম প্রথম মতিলাল চৌধুরীর জমিতে লাঙল চষতে শুরু করে ,তখন আশেপাশের সরপুর, বেগমপুর, লালদীঘি ,পাঁচথুপি, খেজুরপট্টি এইসব গ্রামের চাষিরা আলের মাথায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখত। এতো লাঙলচষা নয়, যেন চোখের নিমেষে ম্যাজিক দেখানো। দশ দিনের কাজ একদিনে করা। দুটো মোষের শক্তি যেন একটা মানুষের গায়ে। অমন কাজে দশাসই মোষেরাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু করিম যেমন শক্তিধর তেমনই ক্লান্তি বোধহয় ওকে কখনোই ছুঁতে পারে না।

 

বড়লোক মতিলাল চৌধুরীর করিমের মত অত শক্তিশালী লোকের কেনই বা দরকার হলো তা পাঠকের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে। তা জানতে হলে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে আমাদের। সময়টা ছিল ১৯৭৮ সাল।  আমি তখন বেশ ছোট। ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্সে পড়ি, এক শনিবার হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তারপর মুষলধারে বৃষ্টি। সে বৃষ্টি  আর শেষ হয় না। সোমবার স্কুলে খেলার ক্লাস ছিল। খেলার ক্লাসে কেটস না পড়ে গেলে খেলার স্যার খুব বকতেন। তাই ব্রাশ দিয়ে সাদা কাপড়ের কেটস ধুয়ে সাদা চক ঘষে দিতাম। রোদে শুকানোর পর ফিট সাদা লাগবে। বেশ একটু নতুন নতুন লাগবে। শনিবার সাত তাড়াতাড়ি খেলার কেটস কেচে শুকোতে  দিলেও ঘন্টা দুয়েকের  মধ্যে এমন মেঘ করে এলো যে সেই জুতো আর শুকালো না। তবুও অতটা দুশ্চিন্তা হয়নি কারণ পরদিন রবিবার ছিল। তখনও ভাবিনি এরকম মুষলধারে বৃষ্টি আর থামবে না। ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল।  আর শুরু হলো তো হলো, কিন্তু থামার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। আমার জীবনে এরকম বৃষ্টি এখনো দেখিনি। তবে এতদিন পর্যন্ত মায়ের মুখে ছোটোবেলার বন্যার গল্প অনেক শুনেছি। মায়ের ছোটোবেলায় একবার নাকি ভাতকুণ্ডা গ্রামে গড়াই নদীতে বান এসেছিল। পুরো গ্রামকে গ্রাম ধুয়েমুছে একেবারে সাফ করে দিয়েছিল। তখন পাশাপাশি যত পুকুর ছিল, যেমন সিংপুকুর, ময়রাপুকুর, খাঁপুকুর, পচাপুকুর, ডুবুরগড়, তালপুকুর সব নাকি জলে এক হয়ে গিয়েছিল। যেদিকে তাকানো যায় শুধু জল আর জল। চারিদিকে শুধু জলই দেখা যেত।  পুরো গ্রামে তখন সবার মাটির ঘর।দাদুর নিজের পাকা বাড়ি ছিল না। তবে বেশ শক্তপোক্ত চিলেকোঠা বাড়ি ছিল। নিচের তলাতে দাদু তার মুনিষজন গ্রামের গরিবদের থাকার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। তবুও মানুষদের দুর্গতির অভাব ছিল না। জলে ভিজে তারা কোথায় যাবে ?কাজকর্ম তো কিছুই নেই। তারা খাবেটা কি? তাই দাদু নাকি চালের মড়াই এবং আলুর ঘর খুলে দিয়েছিল তাদের জন্য। তাইতো সেই সব মানুষেরা চিরদিন দাদুর কাছে কৃতজ্ঞ ছিল। এই গল্প কতবার যে মায়ের মুখে শুনেছি তার কোনো ঠিক নেই। শোনার পর খুব কষ্ট করে কল্পনা করতাম, যদি এমন সব জিনিস স্বচক্ষে দেখতে পেতাম, কি ভালোই না হতো! তখন তো এতসব কিছুই বুঝিনি।

 

 

এরকম অবস্থায় মানুষের যে কি কষ্ট হয় সেই বয়সে বোধোদয় বা জ্ঞান  কিছুই ছিল না আমার। কিন্তু যখন শনিবার থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে সারাদিন সারারাত একবারও থামল না, রেডিওতে পরদিন আশেপাশের গ্রামগুলো জলে ভেসে যাওয়ার খবর শুনলাম। তখন ভাবলাম এই রকম বৃষ্টি অন্তত সোমবারটাও হোক। তাহলে আর যাই হোক খেলার স্যারের বকুনিতো খেতে হবে না!  কিন্তু

টানা সাত দিন যখন একনাগাড়ে বৃষ্টি হতে শুরু করল, থামল না একবারও, তখন সব মানুষ প্রমাদ গুণল, চারিদিকে জলে জলাকার হয়ে উঠলো। মানুষজনের দুর্দশার সীমা থাকলো না।  এক হাতা খিচুড়ির অভাবে মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে উপোষ থাকতে লাগল।

আমাদের সাত ভাই-বোনেদের পেটেতে  ছুঁচোয় ডন টানতে লাগলো। প্রতিদিনই খিদেয় আমরা যখন ছটফট করতাম, তখন দেখতাম আমার মা মাথায় গামছা দিয়ে ভিজে ভিজে রান্নাঘরে আমাদের জন্য চালে-ডালে-আলুতে খিচুড়ি রাঁধতো। আমরা ছোটোরা বারবার রান্নাঘরে উঁকি দিতাম। কিন্তু মা ধমকাতো।  দেখতাম রান্নাঘরের চাল ফুটো হয়ে চারিদিকে জল পড়ছে। আর সেই জল-কাদার মাঝে মা আমাদের ভাঙা টিন দিয়ে কোনোরকমে উনুনটা বাঁচিয়ে আধ শুকনো কাঠ দিয়ে একটা ডেকচি চাপিয়ে বারবার ফুঁকনি দিয়ে ফুঁক দিত। তখন বারবার মায়ের গাল দুটো ফুলে উঠতো। চুলা যেন জ্বলতেই চাইছে না। ধোঁয়া লেগে মায়ের চোখ লাল টকটকে হয়েছে। ফুঁ দেবার সময় সমস্ত শক্তিতে মুখটাও লাল হয়ে উঠেছে। তবু মা আমাদের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তখন মায়ের জন্য কেমন যেন বুকের ভেতরটা হাঁ হাঁ করত। পরক্ষণেই দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের মা দুর্গার লাল টকটকে মুখটা আমার চোখে ভেসে উঠত। আবার পরক্ষণেই মনে  হয় মা মা-ই। ভগবান আমার মায়ের তো দশটা হাত দিতে পারতো?  তাহলে দশটা হাত দিয়ে আমার মা খিচুড়িটা রেঁধে নিতে পারতো চটপট। আর আমরাও তা খেয়ে নিতাম ঝটপট।

 

দুর্গা মায়ের হাত দশটা। কিন্তু ছেলে-মেয়ে চারটে। আর আমার মায়ের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। হাত দুটি কিন্তু ছেলে-মেয়ে সাতজন। ইশ্ আমি যদি না জন্মাতাম তাহলে তো আমার মাকে এত কষ্ট করতে হতো না। মাগো তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, দুগ্গা মায়ের চেয়েও।

 

 

শুনেছি আমাদের দাদাবাবু জমিদার ছিলেন। বিশাল দোতলা বাড়ি তাঁর।তবুও উনি কোনোদিন একবারের জন্যও বলেননি আমাদের ওনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। ওনার বাড়ির নিচের তলাটা মুনিষ চাকরে ভর্তি থাকে। যত কষ্টই হোক, মা বলেছে মুনিষ চাকরদের সঙ্গে আমি কোনোদিন থাকতে পারবো না। মরে গেলেও যাব না আমি। গ্রামের সহজ সরল লোকগুলো মাকে বলে, কি হবে বর্ষার সময় তোমার এই ঘরে এত কষ্ট  করে থেকে। মা বলে   হোক না কষ্ট, ওনাদের বাড়ির বড় বউ আমি, আমার কি কোন মান-সম্মান নেই? মেজ ও ছোট ছেলের বউকে দোতালায় ঠাঁই দিয়েছে। আর আমার বেলায় নিচে মুনিষ চাকরদের সঙ্গে থাকতে হবে? মরে গেলেও যাব না আমি।

 

সেই সময় মনে হয়েছিল আমার মা বোধহয় ভুল করছে। সেই দুর্যোগে কিছু না হোক আমরা পেট ভরে খেতে তো পেতাম। ঠাকুমা নিজের হাতে মুনিষদের সিদে মেপে দিত। চাল, ডাল, আলু, শুকনো লঙ্কা, সর্ষের তেল, কেরোসিন তেল, জালুন সেই সঙ্গে কাঁচা কলা আরো কত কি?

 

আমি ভাবতাম আমাদের কেন এসব দেয় না? আমরাও তো গরিব।  মুনিষদের থেকে আমাদের তফাৎটা কোথায়? মাঝে মাঝে বাবা ঠাকুমার কাছ থেকে চাল, ডাল, আলু, তেল নিয়ে আসতো, তারপর আমাদের ঘরে হাঁড়ি চাপতো। সেসব দিনের কথা কেন কি জানি আমি আজও ভুলতে পারিনি, সে কি ভয়ানক দিন ছিল। দুটো নড়বড়ে তক্তার ওপর আমরা সাত জন শুতাম। তখন ছোট বোনটার বয়স সবে তিন কি চার। আমাদের মত ওরও খুব খিদে পেত।ও খুব পেটুক ছিল। তাই আমি কোনোদিন ওকে সঙ্গে খেতে নিতাম না।

 

বন্যা অবশ্য আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু এ হেন বর্ষা আমি সারাজীবনে আর দেখিনি। সেই বন্যার বছরে মতিলাল চৌধুরীর তিনতলায় উঠে গিয়েছিলাম আমরা। নীচে গুদাম ঘরে ছিল এক ঘর ভর্তি বস্তা বস্তা খোল, বারো মাসের খোল। নিজেরই জমির সর্ষে থেকে তৈরি করা খোল। চার চারটি হালের চাষ। তার ঘরে দশ দশটি গোরু, মোষ ছিল। আর তাদের খাবার মজুত থাকতো গুদামঘরে। সেই ঘর যখন বন্যার জলে জলময় তখন মতিলালবাবু বললেন মোষগুলোর গলার দড়ি খুলে দাও, সেই সঙ্গে খোলের ঘরটাও, ওরা যত খুশি খোল খাক, না খেলে খোলগুলো সব জলে পচে যাবে। মোষদের খুলে দিতেই তারা মহানন্দে সারাদিন, সারারাত খোল খেতে লাগলো। প্রায় দিন দশেক পর যখন বৃষ্টি থামল তখন সেই মোষরা একেবারে গন্ডারের মত শক্তি অর্জন করলো। এত শক্তি যে প্রতিদিনের মাহিন্দার খগেন আর তাদের সামলাতে পারে না। লাঙল দেওয়ার জন্য তাদের মাঠে নিয়ে যেতেই তারা এক কাণ্ড  করে বসল। লাঙল সমেত খগেনকেও লাঙলের সাথে তারা উড়িয়ে নিয়ে চলল। আছাড় খেতে খেতে হাত পা ছিঁড়ে, কেটে লাঙল মাঠে ফেলে খগেন ছুটে এলো বাবুর কাছে। খগেনের রক্তারক্তি অবস্থা দেখে মতিলাল বাবুর খুব দুঃখ হয়। ছোট থেকেই খগেন তাদের বাড়িতে আছে। কেমন যেন একটা মায়া বসে গেছে তার ওপর। বাবু বলেন, "না খগেন তোমার দ্বারা এ কাজ আর হবে না। তুমি ওষুধ খেয়ে আগে সুস্থ হও। একজন শক্তিশালী জোয়ান ছেলে দরকার যে আমার মোষগুলোকে কাবু করতে পারবে।" এদিকে মোষরা তো চারিদিকে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো। তাদের বশে রাখা দুর্দায় হয়ে উঠল।

 

মতিলাল চৌধুরী যাকে পায় তাকেই ধরে বলে- "আমাকে একটা বেশ শক্তিশালী ছেলে দেখে দাও। তার সারা জীবনের ভার আমিই নেব।" কয়েকদিনের মধ্যেই চারিদিকে কথাটা চাউর হয়ে যায়। কথাটা করিমের কানেও যায়। গ্রাম ছাড়িয়ে তার খ্যাতি চারিদিকে রয়েছে। তার এক বন্ধুর মুখে কথাটা শোনামাত্র সে রওনা দেয় মতিলাল চৌধুরীর লালদীঘির বাড়ির উদ্দেশ্যে। চৌধুরীবাবু সুঠামদেহী স্বাস্থ‍্যবান  করিমকে দেখামাত্রই বুঝতে পারলেন এই হল সেই যোগ্য লোক, অবাধ্য মোষদের বশে আনতে গেলে এইরকম ছেলেরই প্রয়োজন। এক কথায় করিমের সব শর্তেই রাজি হয়ে গেলেন বাবু। তার ভরণ-পোষণ, অসুখ-বিসুখ সব ধরনের ভার নেবার অঙ্গীকার করলেন তিনি এবং ভালো মাইনেও দেবেন বললেন তিনি।করিমও কিন্তু ইমানদার ছেলে, জীবন চলে গেলেও সে বেইমানি করবে না। যে তার রুজিদাতা তার সঙ্গে বেইমানি কখনোই নয়। পরদিন থেকেই সে কাজে লেগে গেল।

 

প্রথমদিন কাজে নেমেই সে উল্টো পথ বের করল শক্তিশালী মোষেদের বাগে আনার জন্য। মোষদুটোর সে নাম রাখে রামু ও শামু। কাজের ফাঁকে তাদের বিশ্রাম দেয়, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ও তেল মালিশ করে। খুব যত্ন করে খেতে দেয় সে। বিশেষ করে যে মোষগুলো খুব শক্তিমান, সেগুলোকে বেশি করে যত্নআত্তি করে, ভালোবাসে, আদর করে। মোষগুলো মনিবের প্রতিদান দিতে ভোলে না। মেশিনের মত কাজ করে তারা মনিবকে খুশি করতে চায়। মনিব যা বলে তাই শোনে। এসব দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। করিমের কথা এখন গ্রামের সবার মুখে মুখে। ছেলেটা ভালোবেসে মোষদের বশ করেছে, শাসন করে নয়। তবে করিম যে শাসন করে না তা নয়, ওরা দুষ্টুমি করলে তবেই বকাঝকা করে। এমন দুরন্ত জোড়া মোষদের যে করিম কয়েকদিনের মধ্যে এইভাবে বশ করতে পারবে কেউ তা ভাবতেই পারেনি।

 

 

দিন দিন সুখে-দুখে ভালোই চলছিল। একদিন ভোর থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। করিমকে বাবু বলে- "করিম, কাল হাটে ধান নিয়ে যেতে হবে রে।" করিম বলে- "ঠিক আছে বাবু, আমি তাহলে রামু-শামুকে তাড়াতাড়ি খেতে দিয়ে দিই, ওরা বিশ্রাম নিক, নাহলে ভোরে অতদূর যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে।" ভোরে উঠে করিম দেখে মেঘ করেছে, সঙ্গে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়াও বইছে। তবু রামু শামুকে গাড়িতে জুড়ে এসে হাটের দিকে যাত্রা শুরু করে। অবলা জন্তু হলেও তারা হাটে যেতে চায় না। করিমকে বোবা চাউনিতে যেন নিষেধ করতে চায়। করিম বুঝতে পারেনা। রামু-শামুকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে রাজি করায়। ফেরার পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। পথ-ঘাট অন্ধকার হয়ে আসে। করিম ভালো পথ দেখতে পায় না। রামু-শামুই যেন গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। তবুও শেষরক্ষা হয় না। আলো-আঁধারিতে রামু-শামুও ঠিকমতো পথ দেখতে পায় না। রাস্তার পাশে একটা গর্তে গাড়ি পড়ে যায়। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে তাল সামলাতে না পেরে করিম গাড়ি থেকে পড়ে যায়। তার পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা চলে যায়, মর্মর শব্দে তার দুটো পা-ই ভেঙে যায়। রামু-শামু যখন বুঝতে পারে তখন করিম একেবারে অজ্ঞান। পরিচিত একজন মতিলালবাবুকে খবর দেয়। হ্যাজাক লাইট, ছাতা নিয়ে লোকজন সেখানে পৌঁছে দেখে পাশে করিম পড়ে আছে। মোষদুটো সেখানেই দাঁড়িয়ে ঠায় ভিজছে। মনিবকে ফেলে রেখে তারা এক পাও এগোতে পারেনি।

 

 

গাড়ি করে তুলে করিমকে হাসপাতালে নিয়ে যায় বাবুর লোকজন। ডাক্তার বলেন- দুটো পা-ই তার ভেঙে গেছে। বাবু করিমকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন। বহু টাকা খরচ করে তার দুটো পায়েরই অস্ত্রোপচার করা হয়। বহু কলকব্জা এঁটে পা দুটো মোটামুটি সচল করে দেন ডাক্তারবাবু। করিম যতদিন হাসপাতালে থেকেছে রামু-শামু ততোদিন কোনো কিছুই ঠিকমতো খেতে চায়নি, শুধুই চোখের জল ফেলত। কেউ তাদের জোর করে খাওয়াতে বা কাজ করাতে পারেনি।  শুধু বোবা চাউনিতে তারা যেন কাকে খুঁজে চলেছে সবসময়।

 

যেদিন করিমকে গাড়ি করে বাড়ি আনা হয়, উঠানে একটা খাটে শোয়ানো হয়। তখনও তার দুটো পায়ে ব্যান্ডেজ। সেদিন গোয়ালে রামু-শামু চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারা দড়ি ছেঁড়াছেঁড়ি শুরু করে। চোখের চাউনিতে যেন বলতে চায় তাদের দড়ি খুলে দিতে। তখন গ্রামের সবাই করিমকে দেখতেই ব্যস্ত। রামু-শামু অসম্ভব শক্তিতে দড়ি ছিঁড়ে ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় উঠানের দিকে। সবাই তখন ভয়ে সরে যায়। ভাবে মোষদুটো নিশ্চয়ই ক্ষেপে গেছে।

 

করিমের তখন ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। হঠাৎ দেখে কারা যেন তার মুখে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখ খুলে দেখে রামু-শামু তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের চোখ জলে ভর্তি। দুহাত দিয়ে করিম রামু-শামুর মুখ জড়িয়ে ধরে। করিমের গরম নোনা জলের সোহাগে রামু-শামুর চোখের জল একাকার হয়ে যায়। দুই অসম বন্ধুত্বের ভালোবাসার দৃশ্য দেখতে থাকে অগণিত মানুষজন। এই অসম ভালোবাসা দেখে মতিলালবাবুও তার চোখে জল আটকাতে পারেন না...

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment