পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পূর্বাভাষ

  • 09 October, 2024
  • 1 Comment(s)
  • 415 view(s)
  • লিখেছেন : সাত্যকি হালদার
ওই ভিডিও-টা তুমি মুছে ফেল। বলেছি তো মুছে দেব। কবে? আর কয়েকটা দিন যাক, তারপর তোমার সামনেই না হয় মুছে দেব।

এ রকম সংলাপ গত প্রায় তিন মাসের। সেই যে দুপুর বেলা কোথা থেকে বৃষ্টি এল একদিন। হঠাৎ চার পাশ অন্ধকার। প্রেরণা স্কুলে। ওয়ার্ক ‌ফর হোমের কারণে দীপ্তেশ বাড়িতে। অঙ্কনা নিয়মমাফিক-ই ঘরে। সেদিন মোবাইলে তোলা ভিডিও। আর তারপর থেকেই মাঝেমাঝে অঙ্কনা আর দীপ্তেশের এ রকম সংলাপ।

সকাল বেলাটায় রোদ আর গরম ছিল সেদিন। ভ্যাপসা গরম। দশটা নাগাদ গেটের মুখ থেকে স্কুলের বাস প্রেরণাকে নিয়ে গেল। রাস্তায়, সামনের গলিতে কাজের দিনের ব্যস্ত হয়ে ওঠা লোকজন। মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিল না তখন।

অথচ দুপুরের আগেই রোদ ফিকে। তারপর একটু একটু করে ভেসে এল মেঘেরা। কালচে মেঘ। অকাল বর্ষণের আরাম নিয়ে আসা মেঘ। প্রথমে টিপটিপ তারপর টানা বৃষ্টি। তাপমান সাময়িক অনেকটা নিচে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে এল। অঙ্কনা বলল, কোথায়, তেমন পূর্বাভাষ তো শুনিনি।

দেওয়ালে হেলান দিয়ে কোলের ওপর ল্যাপটপে চোখ রাখা দীপ্তেশ বলেছিল, ভাগ্যিস এখনও সবটাই পূর্বাভাষ অনুযায়ী হয় না।

তারপর বলল, এই যে দিন পনের আগে অ্যালিয়নদের সিগন্যাল এল পৃথিবীতে এও কি আগেভাগে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন! তারা তো গত প্রায় তিরিশ বছর মহাকাশ তোলপাড় করে খুঁজেই যাচ্ছেন। কিন্তু যে দিন আসার সেদিনই তা এল।

অঙ্কনা কী একটা ঘরের কাজ করছিল। জানালার বাইরে বৃষ্টির ধারা। সে বলল, মেয়েটা তিনটেয় আসবে। এখনও দু ঘন্টা। তার মধ্যে বৃষ্টি না থামলে ছাতা নিয়ে আমাদের কাউকে গেটে যেতে হবে।

তারপর বলল, কী বলে পাঠিয়েছে মহাকাশের প্রাণীরা? তারা কি পৃথিবীর খোঁজ জেনেছে!

প্রাণী কিনা তাই তো বোঝা যাচ্ছে না। দীপ্তেশের চোখ সামনে খুলে রাখা যন্ত্রেই। ...তবে পরিকল্পিত ভাবে পাঠানো একটা সিগন্যাল এটা বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন। ল্যাঙ্গুয়েজ তো নয়, একটা কোড। সেটার অর্থ বুঝতে নাসা-র হয়ত আরও পঁচিশ বছর বা তারও বেশি লেগে যাবে।

ওরা কি পৃথিবীর জন্যই পাঠিয়েছে?

তা হয়ত নয়। আর কবে পাঠানো তাও জানা যাচ্ছে না। হতে পারে কয়েক লক্ষ কোটি বছর আগের কোড। যারা পাঠিয়েছে তারাও এখন হয়ত আর নেই। সেই গ্রহ হয়ত কৃষ্ণগহ্বর হয়ে মহাকাশের কোথাও ঘুরছে।

ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয় দীপ্তেশ। বিছানায় আড়মোড়া ভাঙে। বলে, বৃষ্টিটা চললে ভালো। ক দিন একটু আরামে থাকা যাবে।

অঙ্কনার হাতে এটা-ওটা কাজ। বলে এপ্রিল মাসের বৃষ্টি, বেশি লম্বা হয় না কি!

দীপ্তেশ আড়মোড়া ভাঙে আরও একবার। তারপর গাঢ় গলায় অঙ্কনাকে বলে, এসো।

চেনা স্বর। অথচ পূর্বাভাষ ছিল না। অঙ্কনা সামান্য হাসে। বলে, এখন কোনও ভাবেই নয়। আমার হাতে অনেক কাজ।

কী কাজ শুনি?

শুকোতে দেওয়া কয়েকটা জামাকাপড় ভিজেছে। ভেতরে দড়ি টানিয়ে নাড়তে হবে সেগুলো। মেয়ের আগামী কালের স্কুল ড্রেস ইস্ত্রি করব। অঙ্কনা বলে। ...তা ছাড়া এই তো পরশু একবার হল।

পরশু দিন কি বৃষ্টি ছিল এমন!

তাতে কী! তা ছাড়া আমার এখন ইচ্ছে করছে না।

গত নয় বছরে কবে প্রথমে তোমার ইচ্ছে হয়েছে শুনি!

না হয়নি। আজও হচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য এ সব কথাবার্তার পরিণতি যেখানে যায় সেখানেই গেল। ঘরে দড়ি টানানো ও কাপড় নাড়ার কাজ পিছিয়ে গেল। মেয়ের ড্রেস ইস্ত্রি পরে করা হবে। মহাকাশ বা অ্যালিয়নদের নিয়ে কথাও উঠল না আর। জানালার পর্দা খুঁটিয়ে টেনে দিয়ে এল অঙ্কনা। বাইরে তখনও একই ভাবে বৃষ্টি।

সেদিন আবেগ যখন তুঙ্গে একটা কাজ করল দীপ্তেশ। হঠাৎ-ই উঠে গিয়ে পাশের ছোট টেবিলে নিজের মোবাইল ফোনটা সোজা করে বসিয়ে দিয়ে এল। বলল, এই সময়ের একটা ভিডিও তুলব আমাদের। হয়ে গেলে দুজনে একবার দেখব। তারপরেই ডিলিট।

পাগল না কি তুমি! অঙ্কনা ওই অবস্থাতেই বিছানায় উল্টো দিকে পাশ ফিরে যায়।

দীপ্তেশ পাগল-ই। বলল, শোন প্লিজ, এ তো শুধু আমাদের। দুজনের দেখার জন্য। তারপর তো মুছে দেব...।

দীপ্তেশ বিছানায় ফিরে অঙ্কনার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে গভীর করে চুমু দিল। সে তো জানে অঙ্কনার প্রতিরোধ এলিয়ে পড়ে কখন। অঙ্কনা শুয়ে সোজা হতে হতে বলল, তোমার কিন্তু নানা রকম পারভারসান আসছে আজকাল।

দীপ্তেশ ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, তোমার সঙ্গে আমার তো পারভারসানের হাজার বছরের সম্পর্ক খুকি।

ব্যাস। তের মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডের একটি ভিডিও উঠে গেল দীপ্তেশের মোবাইলে। তখনের মতো শেষ হতেই সেটটি নিয়ে এল দীপ্তেশ। পোশাকহীন অবস্থায় পাশাপাশি টানটান শুয়ে তখনও দুজন। দেখতেও সামান্য আপত্তি করেছিল অঙ্কনা। সেই অবস্থায় পাশাপাশি শুয়েই হাতে সেটটি নিয়ে প্লে চেপে দেয় দীপ্তেশ। মোবাইলের পর্দা জোড়া দুজন। ছবি গড়াতে শুরু করলে অঙ্কনার মুখে কোনও কথা নেই। চোখে পলক নেই।

দেখা শেষ হতে দীপ্তেশের গায়ে হাত রেখে বলল, এ বার তাহলে মোছ।

দীপ্তেশ শেষের একটি চুম্বন ছুঁইয়ে দেয়। মুছব তো বটেই। আমি কি চাইব তোমার এ ছবি পৃথিবীর আর একজন মানুষের চোখে পড়ুক?

সেই অকাল বৃষ্টি রয়ে গেল বাকি দিন। সন্ধের পরও। মাঝে স্কুল-বাস একটু দেরি করায় প্রেরণা বিকেলে ফিরেছে। ছাতা নিয়ে গেটে গিয়েছিল দীপ্তেশ। প্রেরণা স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘন্টাখানেক ঘুমোয়। তারপর মা-র পাশে বসে রাত পর্যন্ত হোমটাস্ক। বৃষ্টির জোর কমলেও পুরোপুরি তখনও তা ধরেনি। সঙ্গে টানা বাতাস। খোলা ল্যাপটপের সামনে মাঝেমাঝে অফিস করে যাচ্ছিল দীপ্তেশ।

শুতে যাওয়ার আগে মেয়ের আড়ালে অঙ্কনা আর একবার মনে করিয়ে দেয়। মুছে দিয়েছ তো?

যন্ত্রের পর্দায় চোখ রেখে দীপ্তেশ বলে, চিন্তা নেই, মোবাইল থেকে সরিয়ে দিয়েছি। ল্যাপটপেও রাখিনি। এমনকি গুগল ড্রাইভেও নয়। আমার পার্সোনাল একটা মেমোরি চিপ্ আছে, লক নাম্বার দেওয়া। নিজস্ব কিছু ফাইলটাইল থাকে সেখানে। সেটাতে পুরে রেখে দিয়েছি।

কিন্তু কেন! দরকারটা কি? অঙ্কনার গলা ছুঁয়ে হালকা উদ্বেগ। ...নেটের যুগে কোথায় কী চলে যায় তার ঠিক আছে! তুলেছ, দেখেছ, মোছ এবার।

মুছব তো বটেই। কয়েকটা দিন যাক। মাঝে কখনও দেখলে দেখব তো শুধু আমরা দুজন।

কেন, খোলা চোখে দেখে আশ মেটে না তোমার!

মেটে। নিশ্চয়ই মেটে। তবু দুজনকে একটা থার্ড আই দিয়ে দেখা। ভেবেছ কখনও! ফাইল ট্রান্সফারের সময় আরও একবার দেখলাম। জাস্ট মুগ্ধ হয়ে আছি।

আমাকে দুশ্চিন্তায় রেখে মুগ্ধ হতে হবে না। তুমি কাল পরশুর ভেতর মুছবে। আমার সামনেই মুছবে।

পরের দিন সকালে রোদ। বৃষ্টির স্মৃতিটুকুও জমে নেই। রাস্তাঘাট স্বাভাবিক। গরমে একটা বাড়তি ঘাম ভাব। সেদিন আবার দীপ্তেশের ঘন্টা দুয়েকের জন্য অফিস যাওয়া। সামনের সপ্তাহ থেকে ছুটি হয়ে যাবে প্রেরণার স্কুল। কার্শিয়াং যাওয়ার জন্য ওই সপ্তাহেই তিন জনের ট্রেনের টিকিট।

কিন্তু এই যে জীবন, অঙ্কনার এই যে তেমন ঘটনাবিহীন প্রতিদিনের জীবন, একটা আপাত সুখী সংসার, তার ভেতরে ওই একটা ছোট্ট উদ্বেগ। দুপুরে একা বসে ভাবে, দীপ্তেশের কাছ থেকে ছবি কোথাও যাবে না ঠিক, পেশাগত ভাবেও দীপ্তেশ এসবেই দক্ষ, তবু কখনও যদি কিছু হয়ে যায়! দীপ্তেশের কিংবা তাদের দুজনের জীবনে। হঠাৎ যেমন সব দুর্ঘটনা আসে। সবই তো অগোছাল পড়ে থাকবে তখন। মেয়ে যেভাবেই মানুষ হোক বড় হয়ে মেয়ে যদি কোনও দিন খুঁজে পায় সেই বিশেষ চিপ্, তার ভেতর দীপ্তেশের লুকানো ফোল্ডার! কেন তেমন একটা জিনিসকে রেখে দিতে হবে! যার ভেতর দুজনের অতি গোপন ছবি, কেন তা ধরা থাকবে কিছু দিনের জন্য হলেও!

কার্শিয়াং যাওয়া হল পরের সপ্তাহেই। প্রেরণার গরমের ছুটি শুরু হল। এই কার্শিয়াংয়ে ওরা দুজনে এসেছিল বিয়ের ঠিক পরপর। ট্যুরিস্টের চাপ কম থাকত তখন। এখনও অনেকটাই তাই। দার্জিলিং গ্যাংটকের মতো কার্শিয়াং এখনও গরমের ছুটিতে তেমন গিজগিজে নয়। ন বছর আগে ফিরে যাওয়ার সময়ই দুজনে ঠিক করেছিল আবার আসবে কখনও। সেই আসা হল প্রেরণার যখন ক্লাস থ্রি।

ঠিক করাই ছিল চার দিন কখনোই খুব ছুটোছুটি নয়। সকাল বিকেল কফি খেতে যাওয়া ঈগলস্ ক্র্যাগে, তার বাইরে পায়ে হেঁটে ছোট্ট শহরটায় ঘোরা। তবু একদিন প্রেরণার জন্য টয় ট্রেন হল। কার্শিয়াং থেকে ট্রেনে চেপে ঘুম পর্যন্ত যাওয়া, সেখান থেকেই বিকেলের ফিরতি ট্রেনে আবার কার্শিয়াং। ডাওহিলে যেদিন গেল সেদিন হঠাৎই একটা খবর এসেছিল অঙ্কনার ফোনে। একটা ছোট্ট মৃত্যুসংবাদ। বরানগরের পিসি আর নেই।

দীপ্তেশের পিসি। খুব অনভিপ্রেত খবর এমন নয়। পিসির বয়স হয়েছিল এবং শয্যাশায়ী ছিলেন অনেক দিন। বেড়ানোর মাঝে এমন খবরে কী-ই বা করার থাকে! দীপ্তেশ ফোন করেছিল পিসতুতো দিদিকে। বলেছিল বাইরে আছে। ফিরেই একদিন যাবে।

রাতে ওর মনখারাপ হয়েছিল সামান্য। ছাত্রজীবনে বহরমপুর থেকে কলকাতায় এসে পিসির বাড়ি ছিল ওর প্রাথমিক আশ্রয়। ছ মাস ছিল ওখানে। তারপর হস্টেল পেয়ে উঠে যাওয়া। পিসি অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত বছরে দু তিন বার ফোনে কথা হত। পিসি দীপ্তেশের মেয়েকে দেখতে চাইতেন। কিন্তু সময়ের অভাবে প্রেরণাকে কখনও পিসির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

জীবন তো এমন-ই। বড় হয়ে যাওয়া মানেই ব্যস্ততা। কাজ ও সংসারে জড়িয়ে যাওয়া ক্রমশ। ছোটদের সময় ও মনোযোগ দেওয়া। পাশাপাশি প্রথম যুগের পূর্বপুরুষদের এক-এক জনের ফিকে হতে হতে প্রস্থান। তখন কাজে বা ছুটিতে থাকলেও অতীতের কাছে ঘনিষ্ঠ ভাবে হাজির হওয়া হয় না। চাইলেই কি কার্শিয়াং থেকে হুট করে বরানগরে পৌঁছে যাওয়া যায়!

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাপটপ নিয়ে বিভিন্ন কাজ করছিল দীপ্তেশ। বেড়াতে এলে বা বাইরে কোথাও এলেও অফিসের ট্র্যাক রাখতে হয় বলে ল্যাপটপ সঙ্গেই থাকে। সারা দিনে হয়ত পনের মিনিট বা আধ ঘন্টা খুলল। আবার কোনও দিন ঘন্টা খানেকও লেগে যায়। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দেখল। হয়ত পারিবারিক ছবির পুরানো কোনও ফোল্ডারে পিসির ছবিও খুঁজছিল।

পর দিন ঈগলস ক্র্যাগের দিকে সকালে হাঁটতে বেরিয়ে প্রেরণা যখন খানিকটা এগিয়ে তখন অঙ্কনাকে বলল, তুমি এস-ই-টি-আইর কথা শুনেছ কখনও!

সকালের হাল্কা ঠাণ্ডায় অঙ্কনার পরনে জিনস আর পাতলা উলের কার্ডিগান। দীপ্তেশের কাছ থেকে হঠাৎ হঠাৎ কখনও না শোনা শব্দের মতো আর একটি শব্দ। বলল, কী সেই বস্তু!

দীপ্তেশ চলতে চলতেই বলল, একটা মেথড, বা বলতে পার একটা পার্সোনালাইজড পাথওয়ে। মহাকাশে সিগন্যাল বা কোনও কোড পাঠাতে ব্যবহার হয়। পৃথিবীর অন্তত কয়েক হাজার পাগল এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। বলতে পার নাসা-র তৈরি করা মহাকাশে সিগন্যাল পাঠানোর একটি উন্মুক্ত গেটওয়ে।

হঠাৎ কার্শিয়াংয়ের পথে সে-ই পথের কথা কেন? মেয়ের এগিয়ে যাওয়ার দিকে চোখ রেখেই কথা বলে অঙ্কনা। দীপ্তেশের মহাকাশ নিয়ে শৌখিন ভাবনা আর ঘাঁটাঘাঁটির কথা তার জানা। কলকাতায় থাকতে সে খুবই উত্তেজিত ছিল দূর গ্রহ থেকে আসা কোডের খবরে।

দীপ্তেশ বলে, কাল রাতে কী যে হল! বাড়ির সেভ করা পুরানো ছবি, পিসির ছবি খোঁজা, এসবের পাশাপাশি নিজের জন্য একটা কানেক্টিভ পাথওয়েরও চেষ্টা করছিলাম। খুব কঠিন এমন তো নয়। নাসা-র বিজ্ঞানীরাই ব্যাপারটাকে বেশ সহজ করে রেখেছেন। কাল রাতে পেয়েও গেলাম।

নোবেল প্রাইজ পেয়ে যাচ্ছ না তো! শীত আর কুয়াশার ভেতর সকালের পথে অঙ্কনা হাসে। 

পাহাড়ের চূড়ায় বসার সাজানো জায়গাটি এসে গেছে। গত দু দিন সকালে আসায় প্রেরণার চেনা। ও সোজা গিয়ে দোলনায় বসে যায়। দীপ্তেশ বলে, মহাকাশ সম্বন্ধে ধারণা আর কিছু অঙ্কের লগারিদম, তাতেই গেটওয়েটা খোলা যায়। তোমাকে বলেছি তো, পৃথিবীর কয়েক হাজার পাগল অলরেডি সেটা ব্যবহার করে যা খুশি কোড হিসাবে পাঠিয়েছে। পৃথিবীর কেউ তা রিসিভ করতে পারবে না, এমনকি নাসা নিজেও নয়। কেউ গান পাঠিয়েছে, কেউ ভয়েস মেসেজ, কেউ আবার হিউম্যান জেনেটিক ম্যাপ। তুরস্কের একজন লিখেছে সে তার বাড়ির বাগানে পপি ফুলের ওপর ফড়িং বসে থাকার ছবি পাঠিয়েছে ভিন গ্রহের উদ্দেশ্যে।

শেষ দিনের সকালে ক্র্যাগের ছোট্ট দোকানটি থেকে ধোঁয়া ওঠা কফি এল। ফিরে গিয়ে দুপুরের পর ব্যাগপত্তর গুছিয়ে পাহাড় থেকে ওদের নেমে যেতে হবে। এনজেপি থেকে রাতের ট্রেন। কফিতে ছোট চুমুক দিয়ে অঙ্কনা বলে, তুমি পাঠালে, না কি ভাবছ পাঠাবে!

দীপ্তেশও কফির কাপ তোলে। বলে, কাল রাতেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ছবি।

নিশ্চয়ই পিসিমার...

না।

তবে!

তোমার আর আমার। আমাদের সেই তের মিনিটের ভিডিও।

সর্বনাশ! অঙ্কনার কাপ থেকে কফি ঝলকে ওঠে। সে কাপ নামায়। তুমি করেছটা কী...!

দীপ্তেশ অনেকটাই স্বাভাবিক। বলে, কিচ্ছু না। সে ছবি তো পৃথিবীতে ডিকোড-ই হবে না। এতক্ষণে হয়ত পৃথিবীর সীমা পার হয়ে গেছে।

তবু এমনটা করতেই হল তোমাকে!

দীপ্তেশ কফি নিয়ে কাছে আসে। শান্ত ভাবে বলে, শোন। তেমন‌ টেনশন কি তোমার একার, আমার ছিল না? আমি খুঁটিয়ে জেনেছি সব। আমাদের ছবি হয়ত পৌঁছবে কুড়ি হাজার আলোকবর্ষের দূরের কোনও গ্রহে। সে গ্রহ এখনও হয়ত তৈরিই হয়নি। সে গ্রহ তৈরি হবে হয়ত দেড় কোটি বছরের পর। তখন তুমি কোথায়, আমি কোথায়, আমাদের এই পৃথিবী কোথায়!

চুপ হয়ে থাকে অঙ্কনা। একেবারেই চুপ। তার ভাবনাও যেন দূর গ্রহে পাড়ি জমায়। সে যেন বুঝতে চায় মহাবিশ্ব, অন্ধকার পার হয়ে যাওয়া দুজনের ছবি, দেড় কোটি বছর পরের ডিকোড ও মহাজাগতিক কৌতূহল।

দোলনা থেকে নেমে কাছে এসে প্রেরণা মা বলে ডেকে ওঠে তখন। অঙ্কনা যেন পৃথিবীতে ফেরে। দীপ্তেশ বলে, আমার পার্সোনাল ফাইল থেকে সেই ভিডিও কাল রাতেই ডিলিট হয়ে গেছে।    

কভার ছবি - করতোয়া সেনগুপ্ত  

   

1 Comments

সুদীপ্ত আচার্য

09 October, 2024

বছর কয়েক আগে "এই সময়ে" র "রবিবারোয়ারি"তে প্রথম পরিচয় সাত্যকি হালদারের লেখার সঙ্গে। তারপর থেকে ভক্ত, গাংচিল থেকে সংগ্রহ করি একাধিক উপন্যাস, প্রতিবারের মতোই এবারও এক চুমুকে শেষ করলাম গল্পটা।

Post Comment