পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভাবছিলাম গোরাদার ওখানে যাব

  • 06 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1169 view(s)
  • লিখেছেন : উপল মুখোপাধ্যায়
ভাবছিলাম গোরাদার ওখানে যাব। সেই ছোট বয়সে গিয়েছিলাম যখন ছোটরা ছোটর মতো থাকতে ও দেখতে হয়। সেই ছোটবেলায় চারপাশের গাছের সঙ্গে মাপতে মাপতে ছোট হতে হতে, চারপাশের সব বাড়ি ও জানলা কপাটগুলোর সঙ্গে গোটা বাড়িটাকে অনেক বড় মনে করতে পারে যে ছোটবেলায় সেখানে গিয়েছিলাম। যাত্রাপথ অতি মঙ্গলসম ছিল খারাপ কথারা ও গালাগাল ভীড় ট্রেনের জানলার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করেছিল বটে তবে সুপ্রচুর ভেজানো ছোলা নিয়ে গিয়েছিল রিন্টু।


সেই ছোলা আমরা খাচ্ছিলাম আর যাচ্ছিলাম বটে - ছোলার সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা হয়ত আদার কুচি ছিল, পেঁয়াজ ছিল না কোথাও, কক্ষণও পেঁয়াজ ছিল না। আমরা প্রতিজ্ঞা ও প্রতীক্ষা করেছিলাম বারবার জঙ্গল দেখতে দেখতে অবছায়া হয়ে এলেও যাব। এর ফলে প্রচণ্ড গতিতে আমরা যেতে যেতে অন্যপথে গিয়েও বারবার বাড়ি ফিরে আসি ও বেরই। আর ভাবি গোরাদার ওখানে যাব। সেই কবে গিয়েছিলাম তখনই জঙ্গল দলামলা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম— জঙ্গল এ রূপ দলামলা হল কেন?
—— হয় হয় এ রূপ দলামলা।
—— কেন হয়?
—— সে দলামলা না হলে বোঝা যায় না।
—— কখন হয়?
—— সে দলামলা না হলে বোঝা যায় না।
—— কী ভাবে হয় ?
—— সে দলামলা না হলে বোঝা যায় না।
এই সব উত্তর পেতে পেতে ভাবি যাই দেখি সব উত্তরগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। যেখানে পার্থক্য তার কোন বরাবর যেতে দেখলাম জলপ্রপাত । অনেক উঁচু থেকে জল স্তম্ভিত হয়ে থমকে যায় আর তখন ক্লান্তি থাকে না বরং আসপাশ জলকণা দিয়ে ছেয়ে ফেলে। আমাদেরও জলকণারা ছেয়ে ছেয়ে ফেলেছিল আর বুঝলাম ওরা জলপ্রপাত থেকে এসেছে। অনেক উঁচু যাকে সুউচ্চ বলে। সেই প্রপাতের খাড়াই বেয়ে দুটি ছেলে উঠছিল আর একটি মেয়ে সঙ্গে এক ছাগল তারা সুঁচলো পাথরের ওপর হাঁটছে অথচ তাদের পা ঠিকঠাক। তারা যেন পড়বে এই সংকল্প নিয়ে এসেও পড়বে না ঠিক করেছে কারণ যদিও অতল খাদ আছে অথচ তাদের চোখে পড়ে না। নীচু থেকে এইসব খাদেদের স্পষ্ট দেখেছি তাই ভাবি উপরে উঠলে আর খাদ দেখা যায় কিনা সে বুঝতে গেলেও আবার উঠতে হয়। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। কেটে কেটে সময় চলে গেছে - পাথর শুয়েছে।
সেখানে কাটার দাগ অস্পষ্ট চোখে পড়ে বলে টাকাপয়সার কথাও মনে পড়িয়ে দেয়। হ্যাঁ, টাকারও দরকার আছে এ কথা রোজ মনে করাতে করাতে আবার পাথরদের ওখানে বা ধূলোময়দের সঙ্গে যাব ঠিক করেছি। সে নিয়ে আলোচনা চলল বিস্তর। অতএব গোরাদার ওখানে যাওয়া ঠিক করব করব করেও হয় নি। এরপর মনে ক্লান্তি এসে বসবাস করে করে মিটিং শেষ করতে দেয় না, কথাবার্তা ঝগড়ার মতো মনে হয়। যতই যাবার দিন এগিয়ে আসে ততো দেখা যাচ্ছে যাবার জায়গা নিয়ে কারু উৎসাহ নেই। শেষ পর্যন্ত যাবার দিনটা এসে পড়লে দেখা যায় গাড়ি ছাড়া আর কিছু নিয়ে কেউ ভাবছে না। গাড়ির রঙটি সবার বড়ই মনে ধরতে থাকে। তাকে সূর্যের মাঝ বরাবর ফেলে নিজের চোখে দেখা সাক্ষাৎ চলে। সেটা নিয়ে যথেষ্ট ষন্দেহ প্রকাশ করে বলে উঠি,“ রঙটা পছন্দ হলেই গাড়ি পছন্দ হয়।”
—— মোটেই না।
—— তা হলে গাড়ি চিনব কী করে?
—— তার কোন দরকার নেই।
—— কিসের দরকার নেই? গাড়ির?
—— নিশ্চয়ই দরকার আছে।
—— তবে?
—— তার মানে এই নয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে হবে।
—— জানলে অসুবিধে কী?
—— সুবিধে নিয়ে কথা হোক।
এই ভাবে কথারা নানান অসুবিধে সৃষ্টি করায় রঙ নিয়ে না ভেবে ভেবে সবাই গাড়ি চড়তে থাকে। প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চলে চলে সে এক জঙ্গলে পৌঁছলাম। হ্যাঁ, সেটা এক জঙ্গল বটে তবে তার রাস্তা বড় বড় আর গাছেরা অতীত হয়ে ছবির ভেতর দিয়ে অদ্ভূত ভাবে যাতায়াত করতে পারে। সেখানে অনবরত মূর্তি ও নদীর ভ্রম হতে হতে কোথায় যেন পৌঁছনো গেল। সেটা বড় কিছু নয়, পাহাড়ের এক টিলা। গাড়ি টিলায় উঠতে উঠতে গড়িয়ে যায় তবে টাল খায় না। ততক্ষণে সে ঘামতে আরম্ভ করেছে, তার সারা গায়ে লাল ও কালো রঙের ধূলোর মিশেল। সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে কেনা গাড়ির রঙ — সূর্য পড়লে যা আরো চকচক করার কথা, সে যেন ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়েছে। সে টিলায় উঠছে আবার অনবরত গড়াতে গড়াতে পড়ে কিনা সেটা দেখার জন্য টুবাই প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ব্রেক কসছিল। সে বলল,“ তোমরা সবাই নেমে যাও। শুধু তুমি ছাড়া।”
—— কেন?
—— কারণ গাড়িটা তোমার।
—— তাতে কী? আমিতো চালাতে পারি না।
—— তাতে কিস্যু এসে যাচ্ছে না। দেখছ না?
—— কী?
—— কথা শুনছে না।
—— কে?
—— গাড়ি।
—— কেন শুনবে না? শোনাবার চেষ্টা কর।
—— তুমিও কর।
আমি গাড়ির প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি- কেন ও টিলায় উঠবে না? কী কারণ তার থাকতে পারে? নাকি টিলাই উঠতে দেয় না। এইরূপে গাড়ি নিয়ে ভাবি।
#########################


আমার হাতে একদম সময় নেই। এক্ষুণি যেতে হবে। যেতে যেতে ভাবব। যেতে যেতে খেতে খেতে ঘামতে ঘামতে ভাবব। যেতে যেতে খেতে খেতে ঘামতে ঘামতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ভাবব। যেতে যেতে খেতে খেতে ঘামতে ঘামতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছুটতে ছুটতে ভাবব। যেতে যেতে খেতে খেতে ঘামতে ঘামতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছুটতে ছুটতে মুততে মুততে ভাবব।
যেতে যেতে খেতে খেতে ঘামতে ঘামতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছুটতে ছুটতে মুততে মুততে ঘুরতে ঘুরতে ভাবব। যেতে যেতে খেতে খেতে ঘামতে ঘামতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছুটতে ছুটতে মুততে মুততে ঘুরতে ঘুরতে গুঁজতে গুঁজতে ভাবতে থাকি গাড়িটা কি বাড়ির মতো হয়ে গেছে?


###########################
এই ভাবনা করায় গাড়ি সাড়া দিয়ে টিলায় উঠে হাঁফাতে থাকল আর টুবাই বলল,“ দেখলে তো! বলেছিলাম না!” আমি কারণ খোঁজার চেষ্টায় টিলার ওপর ছিলাম। বহুদিন আগে থেকেই সূর্যরা ডুবতে আরম্ভ করেছে। একাধিক সূর্যের প্রতীক্ষায় না থেকে আমরা সবাই কী রকম করে অন্ধকার দেখতে ছিলাম। অন্ধকার আগে থেকে হয়ে আছে কিনা সে ভাবতে ছিলাম। টিলার ওপরে ধূলোরা অনেক কমে গেছে কারণ তাদের নীচের দিকেই থাকার কথা। রাত আগে থেকে এসে অপেক্ষা করছিল বলে আমরা ধূলোর মধ্যে পড়ি। আর্থমুভারগুলো গর্জন করে আর ধূলো পাঠিয়ে দেয় আর রিন্টু বলল,“ রুংটারা এ বছর টেণ্ডার পায়নি।”
—— কারা পেয়েছে।
—— আরো বড় কোম্পানি।
—— কী হবে তা হলে?
—— কিসের?
—— এত যন্ত্রপাতি?
—— বিক্রি করে দেবে।
—— কাদের?
—— যারা নতুন টেণ্ডার পেয়েছে।
—— তারা নেবে?
—— নিশ্চয়ই নেবে। এত যন্ত্রপাতি সব কাজে লেগে যাবে।
এইরূপে আমরা নানান খনির জন্য তৈরি যন্ত্রপাতি দেখি। সার সার যন্ত্রপাতি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা কোন কারণ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বুড়ো হবে কিনা ভাবি। অথবা চাকরি চলে গেলে আর কমে গেলে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না গতিতে এগিয়ে যেতে রাস্তা এবড়ো খেবড়ো করে দেবে? আর উঠবে উঠবে করে ধূলোর ঝড় উঠবে না। অন্য দিকে যন্ত্রেরা চলে গেলে আমরা আবার বাকি রাখা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে ভারতবর্ষ তৈরি করে দেব। তাতে আলো বানানো চলবে, অন্ধকার বানানো চলবে। আর দেখি সারা সারি করে ছবি বাঁধানো আছে। সেখান থেকে ওখান থেকে ছুটে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার ছুটতে যাই— গোরাদার ছবি খুঁজতে থাকি। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হল কোন ব্যথা ছাড়াই। ভাঙাচোরা হয়ে সেই কষ্টের মধ্যে এক গাছের গুঁড়িতে বসতে গিয়ে গোরাদাকে দেখলাম। গোরাদা জল দেয়। তা খেয়ে সবাই সুস্থ হয় আর গোরাদা বলে,“ শেষ লেপার্ডটা মারা গেছে— হ্যাঁ তা পনেরো বছর তো হলই।” বলা হল— এখানে একটা নদী আছে তার নাম মূর্তি। গোরাদা বলল,“ আমাদের স্কুলটা চলছে বটে তবে আমার বোধহয় আর থাকা ঠিক হবে না।”
—— তালে থাকবে কোথায় ?
—— জঙ্গল।
—— সে কোথায় ?
—— একমাত্র গাড়িই জানে।
—— কেন?
—— কারণ সেই একমাত্র চলতে পারে।
—— আর আমরা?
—— পারি না।
—— কেন?
—— শ্বাসকষ্ট হয়। গাড়ির হয় না। সে অত্যন্ত তাজা ও বলবান বলবতী হয়।
এই বলে আমরা সবাই ও গোরাদা গাড়ির দিকে এগোই। পেছন থেকে হলদে, কালো, সবুজ, বেগুনি , লাল , সাদা গাছ ও বাঘের মূর্তিরা সরে সরে যায়। যত সরে ধূলোর আস্তরণ ছেয়ে ফেলে রাস্তা বড় হয়, দীর্ঘ ও পেশল হয়। পুনর্বার শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হতেই আমরা সবাই ও গোরাদা কাচ তুলে দিই। আর তখনই আমি গোরাদাকে বলি,“ ভাবছিলাম তোমার ওখানে যাব — জলপ্রপাত দেখতে।” গোরাদা বলে কী বলে শুনতে শুনতে আবার আমরা সবাই এগোই বলে ভুল হতে থাকে কারণ কিনা গাড়িটা দ্রুতই এগিয়েছে।

0 Comments

Post Comment