হিস্টেরিয়া বা আবেগোন্মত্ততা কে কথ্য ভাষায় বলা যায় অনিয়ন্ত্রিত আবেগের আধিক্য। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত ব্যক্তি প্রায়ই অতিরিক্ত ভয় পেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আর এই অনিয়ন্ত্রিত আবেগ যখন বহু বহু সংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়, তখন তাকে আমরা বলি গণ হিস্টেরিয়া। জীবনে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এই অতিরিক্ত ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে। আবার তেমনই নানা ধরনের গুজব, নানা কিছু একই রকম কথা, শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে, সেটা সম্পর্কে একটা ভয় দৃঢ়ভাবে চেপে বসা। এভাবেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময় এখানে বাড়ি পুড়েছে, ওখানে মন্দির পুড়েছে, ওখানে গরুর মাংস জোর করে খাইয়েছে, সেখানে মহিলা শিশুদের তুলে নিয়ে গেছে, এরকম পরপর একই ধরনের কথা শোনার পর, যখন বলা হল এই পাশের পাড়ায় হামলাকারীরা এসে পৌঁছেছে, তখন কিন্তু আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। বাচ্চাকে জড়িয়ে নিয়ে হাতে যা হোক কিছু একটা হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়া। সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠীগত দাঙ্গা হাঙ্গামার ক্ষেত্রেও গণ হিস্টিরিয়া বিশেষভাবে সক্রিয়।
গণ হিস্টেরিয়ার একটা বিশেষ রূপ গণ ধোলাই বা গণপিটুনি চারদিকে গুজব ছড়াতে থাকবে, এখানে বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গেছে, ওখানে শিশুকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, অমুক জায়গায় ঝোলার মধ্যে বাচ্চা শিশুকে নিয়ে যাচ্ছিল এবং সবটাই তথ্য প্রমাণ ছাড়া। হুগলির মানুষকে শোনানো হবে শিলিগুড়িতে এমন ঘটছিল। শিলিগুড়ি শুনবে আসানসোলে এমনটা ঘটেছে। আসানসোল শুনবে হলদিয়া, আর হলদিয়া শুনবে সন্দেশখালি । এভাবে একটা প্রচার সবার মনে সন্দেহ ও আতঙ্কের বিষ বন্টন করবে। তারপর যখন বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়ানো নিরীহ ছেলেটা, দুপুরের পথে একাকী এদিক-ওদিক তাকাবে, পড়ে থাকা কাগজের সন্ধান করবে, হয়তোবা ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের কৌটো, জুতো টাও খুঁজবে। সেই অবসরে আওয়াজ উঠবে, এই কে যেন বাড়ির ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল, ঢোকার চেষ্টা করছিল। আস্তে আস্তে লোক জড়ো হবে এবং অবশেষে গণপিটুনি, গণপ্রহার। পরিশেষে মৃত্যু অথবা কপাল ভালো থাকলে পুলিশ এসে উদ্ধার করবে। কিছুদিন আগেই এই ছেলে ধরার হিস্টিরিয়া ও গণপিটুনি ব্যাপকতা লাভ করেছিল। আপাতত সেটা মুলতুবী আছে।
স্বাভাবিকভাবে যে মানুষ ভীতু প্রকৃতির, ভয় ত্রাস তার মধ্যেই বাসা বাঁধে। এই ভয় থেকে একজন ব্যক্তি বিচিত্র সব আচরণ করতে থাকে। নিজেরই ভেতর ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। বিড়বিড় করে ভয়ের কথা আওড়াতে থাকে। কিন্তু এই হিস্টিরিয়া যখন গণ চরিত্র নেয় তখন এই ভীতু মানুষটি বহু মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যে নিজেকে অঙ্গীভূত করে। বহু মানুষের সান্নিধ্যে সংখ্যাটা বহু বহুতর করে তোলে। আসলে গণপিটুনেতে তো খুব সাহসের দরকার হয় না। কোথাও কোন অন্যায়ের সামনে একা এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ বা প্রহার করতে সাহস লাগে। কিন্তু একজনকে যখন ৫০ জন মিলে পেটায়, তখন তার ভেতরে অনায়াসে অংশ নেওয়া যায়। অর্থাৎ বলতে চাইছি অংশগ্রহণকারীরা সাধারণ ভাবে দুর্বল ও ভীতু প্রকৃতির হয়।
আবার একইভাবে একথাও বলা যায় :
"সহস্র লক্ষ কন্ঠে মিলিয়ে গলা
কঠিন তো নয় বলা ।
কিন্তু হট্টগোলের মাঝে
যতি চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ,
আত্মবিশ্লেষণি হওয়া,
ভিন্ন স্বরে কওয়া,
নয়কো সহজ, বড়ই কঠিন
হাওয়ার উল্টো পথে চলা।"
লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন বলছে উই ওয়ান্ট জাস্টিস, সেই স্বরে গলা মেলানো খুবই সহজ। কিন্তু ওই ভিড়ে দাঁড়িয়ে একক কন্ঠে বলা যে সন্তানহারা পিতা মাতার কাছে কে কি জাস্টিস দিতে পারে। সর্বোচ্চ জাস্টিস বড়জোর ওই অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলানো। কিন্তু এতেও তো মায়ের শূন্য কোল শূন্য ই থেকে যাবে। অভয়া বা অভয়ার পরিবার কারো কি কিছু গুণগত পরিবর্তন ঘটবে, জাস্টিসের আগের সাথে জাস্টিসের পরে। ভবিষ্যতে আর একটাও অভয়া বা নির্ভয়ার ঘটনা ঘটবে না, এই নিশ্চয়তা কি পাওয়া যাবে? কথা বলে দেখেছি সবাই যা বলছে চিত্র তারকা থেকে ছাত্র ছাত্রী সবই গণমাধ্যমে ফেসবুকে টুইটারে বহু পঠিত ও বহু চর্চিত ও কথিত সেই সব বয়ান -- আমার ঘরেও মেয়ে আছে, ..... আমার ভাইঝির মুখটা মনে পড়ছে,....... রাতে ঘুমোতে পারিনি,..... মনে হচ্ছে আমার সাথে কথা বলছে,...... তীব্র এক যন্ত্রণা,..... আমার মেয়েটাও তো বড় হচ্ছে,...... এমন একই শব্দবন্ধ হাজার হাজার পাঠ করেছি, শুনেছি সমাজ মাধ্যমে। আর সেগুলোই লক্ষ লক্ষ হয়ে ফিরে আসছে মিছিল মিটিং থেকে ক্যামেরার সামনে।
হিস্টেরিয়ার একটা বৈশিষ্ট্য হল এই যে আমি যেটা ভাবছি আমি বলছি, আসলে আমি বলছি না, কোন একটা উৎস থেকে একটা তীব্র ভয় ভীতি আশঙ্কা আমাকে গ্রাস করছে। একটি কেন্দ্র থেকে উৎসারিত সেই ভয়। আপনি সাধারণভাবে প্রতিদিন আপনার মেয়েটার কলেজ ফেরার জন্য প্রতীক্ষা করেন। কলেজ থেকে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে ফিরতে দেরি হলে একটু হয়তো বকাঝকাও করেন। কিন্তু নির্ভয়া কান্ডের পর আপনি কি আতঙ্কে ঘুমোতে পারেন নি? দিব্যি ঘুমিয়েছেন। হাথরাস উন্নাও এর পর আপনি কি ঘুমাননি? হ্যাঁ তাও ঘুমিয়েছেন। ঘরের পাশে ধরা যাক সন্দেশখালিতে যা যা শুনেছিলেন সব সত্যি। তখনও কি আপনি ঘুমাননি? যেখানে প্রতি রাতে নাকি শাহজাহানের সিপাই সান্ত্রীরা মহিলাদের বাছাই করে আনন্দ উপভোগের জন্য ডেকে ডেকে নিয়ে যেত? তখনও তো আপনি ঘুমিয়েছেন। তাই না? তাহলে আরজি করের ঘটনার পর এমন বিপন্ন হলেন কিভাবে? কেন?
কারণ জনৈকার অডিও রেকর্ড হাসপাতাল কলেজ তার পরিবেশ সম্পর্কে একটি রগরগে বর্ণনা সহ নাটকীয় উপস্থাপনা দিয়েছেন। অভয়ার মর্মান্তিক নৃশংস অত্যাচারের পর তার ক্ষতবিক্ষত শরীরের ছবি সমাজ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। অভয়ার ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার টুকরো টুকরো গল্প কাহিনী, চর্চিত হয়েছে সমাজ মাধ্যমে। এগুলোর মধ্য দিয়ে আপনার মধ্যে একটা বোধ, আতঙ্ক ও ভয়ের আবহ, তৈরি করা হয়েছে। আমার মেয়েটা তো এমনই বড় হয়েছে, অভয়ার বয়সী, অথবা আমার মেয়েটাও তো আর ২০ বছর পর এই বয়সী হবে। অভয়ার সাথে তার পরিবারের সাথে নিজেকে তুলনায় এনে, নিজেকেই আরজিকর ঘটনার মধ্যে আইডেন্টিফাই করেছেন। এভাবেই গণহিষ্টিরিয়া তৈরি হয়, মেনুফাকচার্ড হিস্টিরিয়া।
আমি নিজে ১৪ই আগস্ট এর রাতে পথে বেরোই নি। কারণ, দেখেছি সেইসব মানুষ যাদের হৃদয়ে প্রেম প্রীতি করুণার লেশ মাত্র নেই। টিচার্স রুমে অসুস্থ শিশু ছাত্রীকে শুইয়ে রেখেও কারো কপালে বা গায়ে পিঠে হাত বোলানোর অবকাশ নেই। কারণ সকলে সহশিক্ষিকার ঘরে নাতনি হওয়ার আনন্দে ভোজ সভা বসিয়েছে। সেই শিক্ষকদের দলে দলে অংশগ্রহণ দেখেছি রাত দখল অভিযানে।
ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় কোনও এক দু'জন মহিলা, যখন রাত দখলের অভিযানের আহ্বান করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার একটা যুক্তি ও আবেগ খুঁজে পাওয়া যায়, বুঝে ওঠা যায়। আমিও আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই আবেগকে দখল করার জন্য যে লোভে চকচক চোখ ঘুরতে থাকে, সুযোগ খুঁজতে থাকে, সেই চোখ গুলোকে আমি ঘৃণা করি। আমি চাইনা আমার আবেগকে নিয়ে কেউ বেশাতি করুক। খেয়ে দেয়ে সাজগোজ করে ভাবটা বুঝি ৩১ ডিসেম্বরের রাত। সময়ের ঢের আগে যেনো চতুর্থীর রাতে বেরিয়ে পড়া। রাত দখলের ভিড় থেকেই উঠে আসে কন্যাশ্রী লক্ষ্মীর ভান্ডার চাইনা, ভিক্ষা চাই না, এ তো নির্বাচনে ঘোর বিপর্যস্ত সেই হায়েনার দলের কন্ঠস্বর। যারা এগুলোর ভোক্তা নয়। একটু বেশি রাতেই যে স্বরগুলো স্পষ্ট হয়েছিল। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে দাবিগুলো কেমন পাল্টাতে থাকে, we want justice বদলে যায়, দফা এক দাবি এক পদত্যাগ পদত্যাগ।
১৪ তারিখ রাতে না বেরিয়ে একটা মানসিক অস্বস্তি হচ্ছিলো। এখন মনে হয় ভালোই করেছিলাম। কারণ ১৫ তারিখ আমার এক বহু পুরাতন বামপন্থী রাজনৈতিক বন্ধু বয়স প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই, ফোন করে বলল, ইস আর জি করের ঘটনাটা যদি তিন মাস আগে হতো, তাহলে আর দেখতে হতো না, .......কে দুই ঠ্যাং ধরে ফেড়ে ফেলতাম, জরাসন্ধ করে দিতাম। বুঝলাম দুমাস আগের হারের ঘা এখনও শুকায় নি। রক্তের গন্ধ পেয়ে হায়নার দল অন্ধকারে ভিড় জমিয়েছে। ভাবুন উনিশে আগস্ট এক প্রাক্তন ছাত্র ফোন করে বলছে একটা কিছু তো আমাদের প্রাক্তনীদের থেকে করতে হবে, কি করা যায় বলুন তো, একটা সাজেশন দিন। আমি বললাম ঘটনার তাৎক্ষণিকতার সাথে যদি ১৫ তারিখের মধ্যে কিছু করতে সেটা করা যেতো, আবেগ থেকে। কিন্তু এবার যেটা হবে, সব্বাই করে বলে, সব্বাই করি তাই। সবাই তো এমনটাই করছে। সেই পড়ুয়াকে বললাম, জানো, ২০১৯ এ ঠিক এভাবেই স্কুল কলেজ ক্লাব লাইব্রেরি এমনকি যোগাসন কেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতি, সকলে ই মোমবাতি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে ছিল। হোয়াটসঅ্যাপে প্রায় সকলের ডিপিতে শহীদ বন্দনা, শোক, ঘৃণার ছবি, পুলওয়ামার জওয়ান শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। শুধু তো শ্রদ্ধা নয় সেই সাথে ছিল প্রতিবেশী দেশের প্রতি ঘৃণা। একটা বদলার আকাঙ্ক্ষা। আর তার সুযোগে এলো দ্বিতীয় পর্ব, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। আর দুয়ে মিলে ২০১৯ এর নির্বাচনী বৈতরনী পার। এখন তো কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের ভিডিও থেকে এটা স্পষ্ট যে, পুলওয়ামা ছিল ম্যানুফ্যাকচার্ড। আমরা কিন্তু সেই ম্যানুফ্যাকচার্ড ইভেন্টে গা ভাসিয়েছি। এমনই গা ভেসেছিল ১৯৮৪ সালের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর মৃত্যুজনিত আবেগে। সেটাও ছিল ম্যানুফ্যাকচার্ড।
আমরা ভাবি আমরা বলছি কিন্তু আসলে দক্ষ বাজি করের সুতোর টানে আমরা হাত-পা নাড়ছি, মুখ নাড়ছি। মানুষের আবেগকে নিয়ে শাসক বড় বেশি খেলে ফেলেছে। এখন তাই আবেগ দেখাতে ভয় পাই।একলব্য কে বড় বেশি বার বুড়ো আঙ্গুল দক্ষিণা দিতে দেখেছি। তাই এখন সব সময় বুড়ো আঙ্গুলটা মুঠো করে রাখে। জানি উই ওয়ান্ট জাস্টিস এর মধ্যে সূচনা পর্বে যে আবেগটা কিছ্লে,মহিলা জাগ্রত করে ছি্লেন, সেই আবেগ ক্রমে ক্রমে অন্তর্হিত হচ্ছে। উঠে আসছে দাবি এক দফা এক, পদত্যাগ পদত্যাগ। শ্লোগান পাল্টে যায় ফুটপাত বদল হয়। সেমিনার হলে পড়ে থাকা ধর্ষিতা নিহত তরুণী সমাজ মাধ্যমে মানুষের মুখে মুখে মৃত্যুর পরেও, সমাজ মাধ্যমে অসংখ্য বার ধর্ষিতা হয়। আর জি কর হাসপাতালে একটি গুরুতর অপরাধের ঘটনা সামগ্রিকতার ভেতরে হারিয়ে গিয়ে নারীর নিরাপত্তার দাবিতে, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে, দিশাহীন হয় । একটি নির্দিষ্ট ঘটনার তদন্ত না করে, ক্রমশই আনুষঙ্গিক নানা বিষয়ে আলোকপাত করে ক্রমশ তদন্তের মূল বিষয় দূরে সরে যাচ্ছে। কম্বলটা ভিজিয়ে যত ভারী করা হবে, কম্বলটা শুকানো ততই অসম্ভব হয়ে পড়বে। জানি সেসব বুঝেই বগটুই কান্ডের মতো, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদকের মতো, সিঙ্গুরের তাপসী মালিক, কামদুনি বা সন্দেশখালির ঘটনার মতোই সিবিআই সবকিছুকেই হিমঘরে পাঠিয়ে দেবে।
শুধু আজ যারা হিস্টিরিয়াগ্রস্থ তাদের জন্য বলছি। ১৫ই আগস্ট বসেছিলাম চায়ের দোকানে একজন কম বয়সী পরিচিত অভিভাবক গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলেন, মেয়ে তো সরকারি কলেজে নার্সিং এ চান্স পেয়েছে। এ দিকে হাসপাতালে তো কি ভয়ংকর পরিস্থিতি। কি ভরসায় পাঠাবো বলুন তো? সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমি জানি আন্দোলনকারীরা আমার উত্তরে খুশি হবেন না। আমি তাকে বললাম কুচবিহারে হাসপাতালে নার্স বর্ণালী দত্ত ধর্ষণ ও খুন হয়েছিলেন সেই বুদ্ধ বাবুর জমানায়। আর এত বছর বাদে আরজি করে খুন হলেন লেডি ডাক্তার। মাঝে আর দুটো চারটে দৃষ্টান্ত দিতে পারবেন? আপনার বাড়ি যাওয়ার পথে হাফ ইউটার্নে প্রায়ই দিনে রাতে মোটর বাইক এক্সিডেন্ট করে। এ নিয়ে তো কম মানুষ মরল না। ওখানে আপনি ওই পথ দিয়ে আর বাড়ি যান না? গত দুমাসে কম করে আট নটা রেল দুর্ঘটনা হয়ে গেল, তারপরেও তো রেল যাত্রা করি। চাকরি স্থলে নিরাপত্তার একটা যুক্তিপূর্ণ অনুসন্ধান করুন। পড়াশোনায় ভালো মেয়ে। সরকারি নার্সিং কলেজে সুযোগ পেয়েছে। পড়ানোয় আপনার খরচা হবে না। তিন বছর বাদে বেরোলেই চাকরি। এমন সুযোগ ছাড়বেন কেন? বিপদের আশঙ্কা সব জীবিকাতেই আছে, এমনকি ঘরে বসেও আছে। আমি ওই অভিভাবককে ভীত আশঙ্কিত সন্ত্রস্ত ট্রমাটাইজড করার পরিবর্তে আশ্বাস ও সাহস দিয়েছি।
যারা এই আন্দোলনে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে, তাদের জন্য বলছি না। আরজি করে সেদিনের ওই নির্দিষ্ট ঘটনা ও তার সাথে যুক্ত অন্যান্য দোষীদের চরম শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যে নিরাপত্তার দাবি করা হচ্ছে, সেই দাবি কি মূল ঘটনা থেকে ফোকাসটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেনা? একবার ভাবো দেখি, এই সমাজে কার কোথায় কতটা নিরাপত্তা? হাসপাতালে রোগীর নিরাপত্তা আছে? নারী আন্দোলনের সংগঠকদের কাছে সংখ্যাতত্ত্ব আছে, কত সংখ্যক মেয়ে নিজের পরিবারে ধর্ষিতা হয়। স্কুলে কলেজে ইউনিভার্সিটিতে, খেলোয়ারদের ট্রেনিংয়ে কোচিংয়ে, কত কত সহস্র নারী ধর্ষিতা হয়? সাক্ষি মালিক, চুনি কোটাল? নিরপেক্ষ আদালতে রঞ্জন গগৈ বা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে আপনি সুরক্ষিত? যাদবপুরের স্বপ্নদীপ , রোহিত ভেমূলা, তারা তো মারা গেল নিজের বন্ধুদের কাছে হোস্টেলে। গত দু- আড়াই মাসে রেলের কাণ্ডকারখানায় আপনি নিজেকে নিরাপদ বলে ভাবেন? পিতা-মাতার বিবাহ অতিরিক্ত সম্পর্কের কারণে পথের কাঁটা শিশুসন্তান খুন হয় পিতা মাতার হাতে। সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন হয়। কে দেবে? কাকে নিরাপত্তা? রানাঘাট হাসপাতালে ডাক্তার চন্দন সেন খুন হয়েছিলেন তারই সহকর্মী ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীদের ষড়যন্ত্রে। তার খুনের অভিযুক্ত চিকিৎসক বহালতবিয়তে চুঁচুড়ায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। শ্রীরামপুরের গাইনোকোলজিস্ট ডাক্তার সুশীল পাল খুন হলেন বেলুড় এর সেবায়ন নার্সিং হোমে। দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করতে রাজি না হওয়ার কারণে। নিরাপত্তার অভাব যখন সহকর্মীর কাছ থেকে, পরিবারের মধ্য থেকে আসে, তখন কে কাকে নিরাপত্তা দেবে? কেন্দ্রীয় বাহিনী আর সিসিটিভি? আমি বিশ্বাস করি না। জানো, একজন চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বেরোনোর পর এম আর রা প্রেসক্রিপশন এর ছবি তুলে নেয়। ওই প্রেসক্রিপশনে তাদের কোন কোন ওষুধ আছে, রিপোর্ট করতে হয়। আরো আশ্চর্যের কথা প্রেসক্রিপশন এর নিচে একটি রবার স্ট্যাম্পে লেখা আছে, কোন বিকল্প ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। চুঁচুড়ার জনৈক স্কীন স্পেশালিস্ট চিকিৎসক, শুধুমাত্র একটি কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, Gary Pharmaceutical। সমগ্র জেলায় অন্য কোন ওষুধের দোকানে ওই কোম্পানির ওষুধ পাওয়া যায় না। একমাত্র ওই চিকিৎসকের ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। আর ইলেক্টোরাল বন্ডের দাতাদের তালিকায় নাম দেখেছি ওই কোম্পানির। এগুলি নিরাপত্তার অভাব নয়? পণ্য ও বাজার ভিত্তিক এই সভ্য সমাজে কেউ নিরাপদ নয়, কেউ সুরক্ষিত নয়। এই সভ্যতা এই সমাজ এক প্রাত্যহিক বধ্যভূমি। এখানে খুন হওয়া অথবা খুন করা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ঘটে থাকে। সেই কোন কালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, শহরে এসে ডাক্তার দেখিয়ে সর্বস্বান্ত হতে এসেছিল যে মানুষটি, খানিক আগে বাসে এক পকেটমার তাকে আগেই সর্বস্বান্ত করে গেল। কোথায় নিরাপত্তা? ওই কবিরই আরেকটি উক্তি, কোথাও ডাক্তারের অভাবে রোগী মরছে, কোথাও আবার রোগীর অভাবে ডাক্তার মরছে ..... । এটাই বাস্তব চিত্র। মেকি কাল্পনিক নিরাপত্তা খোঁজা অর্থহীন, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ।
পরিশেষে আমি আমার সন্তান সম জুনিয়র ডাক্তার ও মেডিকেলের ইউ জি ও পি জি ছাত্র-ছাত্রীদের বলতে চাই একটি নির্মম নৃশংস ঘটনা, সেই ঘটনার প্রতিবাদী আন্দোলনে আপনারা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলকে ঢুকবার অনুমতি দেননি। আন্দোলন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করেছে। আজ যেন কোনোভাবে সেই শুদ্ধতা নষ্ট না করা হয়। আমার বিদ্যালয়ের বহু ছাত্র ছাত্রী পশ্চিমবাংলার সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। এখনো অনেকে পাঠরত। একটা অনুরোধই করবো, কারোর দ্বারা চালিত হয়ো না। একলব্য কে বুড়ো আঙ্গুল দক্ষিণা দিতে, বড় বেশি বার দেখতে হয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আবার সেই দৃশ্য যেন দেখতে না হয়। সিবিআই তার নিজের পথে এগোবে। জানিনা কোন কূলে তার তরী ভিড়বে, কবে। অথবা হয়তো কখনো ভিড়বেই না, আরও দিশাহীন হবে। লক্ষ্য থেকে ক্রমশই সরে যাচ্ছে। সরকার একগুচ্ছ নিরাপত্তার প্রস্তাব ও নির্দেশ দিয়েছে। প্রতিবারের মতোই এই নির্দেশ কি এবারও কোন ফলো আপ ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হবে? নাকি সরকারকে স্পষ্ট বলা হবে দশ দিন পর এই প্রস্তাবের অগ্রগতি পর্যালোচনা করব। প্রতি ১০ দিন পর এই পর্যালোচনা চলবে। আর ততদিন পর্যন্ত রিলে অবস্থান কর্ম বিরতিও চলবে। একদল পড়ুয়া ডাক্তার কাজ করবেন, কারণ গরিব হতদরিদ্র মানুষের সরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই। অন্য ডাক্তার পড়ুয়ারা অবস্থান চালাবেন। পর্যায়ক্রমে এটা চালু থাকবে। কিন্তু ধর্ষিতা মৃতা ডাক্তার ছাত্রীর তদন্তের কিনারা করতেই হবে। ওই নারকীয় হত্যার সাথে যুক্ত সকলকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সিবিআইকেও কোনোভাবে পাশ কাটাতে দেওয়া হবে না। ছাত্রীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের সঠিক তদন্ত থেকে সংশ্লিষ্ট দুষ্ট চক্র কে অনুসন্ধানের আওতায় আনতে হবে। দুষ্ট চক্র কে দিয়ে শুরু করলে সিস্টেমের পর্বত প্রমাণ দুর্নীতির গর্ভে তদন্ত পথ হারাবে। আমার মনে হয় আন্দোলনকারীদের এই কথাগুলো বলার সময় এসেছে মানুষের কাছে। তা না হলে মানুষ ভুল বুঝবে। হয়তো ভুল বুঝছে।