পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সাংবাদিকদের উপর পুলিশি আক্রমণ থেকে পুলিশের হাতেই সাংবাদিকতার নিয়ন্ত্রণের পথে মোদী

  • 03 February, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1811 view(s)
  • লিখেছেন : বিশ্বজিৎ রায়
ইন্দিরা জমানার জরুরী অবস্থা কালে অনেক সাংবাদিককে জেলে পাঠানো হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ প্রবীণরা মনে করতে পারছেন না। বস্তূত মোদি- শাহ- আদানি-আম্বানিদের রাজত্বে দীর্ঘতর অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। এই মুহূর্তে পরঞ্জয়ের মতো প্রবীণ ও মনপ্রিতের মতো তরুণ সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানো নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য। স্বাধীনচেতা সাংবাদিকরা আজ বিপন্ন। লিখলেন প্রবীণ সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায়।

দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিল পর্বে এক কৃষকের মৃত্যুর কারণ ঘিরে টুইটারে উস্কানিমুলক খবর ছড়ানোর অভিযোগে বিজেপি শাসিত পাঁচটি রাজ্যে দিল্লির সাত জন খ্যাতনামা টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় প্ররোচনা ইত্যাদি ফৌজদারি দণ্ডবিধির মারাত্মক সব ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন রাজদীপ সারদেশাই, সিদ্ধার্থ বরদারাজন, মৃণাল পান্ডে, জাফর আগা, অনন্ত নাথ, পরেশ নাথ ও বিনোদ কে জোসে। এঁদের সঙ্গে অভিযুক্ত কংগ্রেস সাংসদ ও সুলেখক- সুবক্তা শশী থারুর যিনি দেশে-বিদেশে সংবাদ মাধ্যমে একটি অতি পরিচিত নাম।

ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলের কন্সালটিং এডিটর রাজদীপের মাইনে কাটা গেছে। টিভির পর্দা থেকে পনের দিনের জন্য তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গত শীতে দিল্লি দাঙ্গার অন্যতম প্ররোচক-পান্ডা কপিল মিশ্র সহ বিজেপি নেতারা তাঁর গ্রেফতারির দাবি তুলেছে। দলের আই টি সেল প্রধান এই প্রবীণ সাংবাদিককে 'রিপিট অফেন্ডার' বলে দাগিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছে। ঘটনার দিন দুপুর থেকেই বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে টিভি ও অনলাইনে তীব্র আক্রমণে নামে।

রাজদীপের অপরাধ, 26 জানুয়ারি ট্রাক্টর- আরোহী তরুণ নবনীত সিংহ পুলিশের গুলিতে মারা গেছে বলে কৃষকদের অভিযোগটি হাঙ্গামা চলাকালীন তিনি টুইট করেছিলেন। তিনি নিজে বা তাঁর চ্যানেলের সংবাদদাতা নিজেদের প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেননি।

কিছু সময় পরে দিল্লি পুলিশ একটি ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে দাবি করে ওই যুবকের ট্রাক্টর দ্রুত গতিতে এসে পুলিশের ব্যারিকেড়ে ধাক্কা মারে। ফলে ট্রাক্টরটি উল্টে তাঁর মাথায় গুরুতর আঘাত লেগে মারা যান। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টও সেরকমই বলেছে পরে সরকারি ও শাসকদলীয় সূত্রে দাবি করা হয়। যদিও মৃতের পরিবার ও বন্ধুদের এখনও দাবি, মাথায় গুলি বা টিয়ার গ্যাসের শেল লেগে ট্রাক্টরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে উত্তরপ্রদেশের কৃষক পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। রাজদীপ সেদিনই পুলিশের বক্তব্য ও ভিডিও নিজের পরবর্তী টুইটে যোগ করেন। পরে আগের টুইটটি মুছে দেন। ঘটনা স্থলে পৌঁছে তিনি ইন্ডিয়া টুডের হিন্দি আজ তক চ্যানেলে লাগাতার কৃষক আন্দোলন-বিরোধী প্রচারে উত্তেজিত কৃষক জনতার ক্ষোভের মুখে পড়েন। সন্ধ্যায় নিজের টিভি শোতে কৃষকদের অভিযোগকে শেয়ার করায় কার্যত দুঃখ প্রকাশ করেন।

তার পরও শাসক শিবিরের আক্রমণ থামেনি। তাঁর প্রতিষ্ঠানও তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। কোনও সন্দেহ নেই, সরকারি চাপে। গুজরাতে ২০০২ সালের দাঙ্গার কভারেজ পর্বের পর থেকে মোদির সঙ্গে এন ডি টিভি প্রাক্তন কার্যনির্বাহী সম্পাদক রাজদীপের সখ্যতায় চিড় ধরলেও ২০১৪ সালে মোদি দিল্লি দখলের পর তা তুঙ্গে ওঠে। রাজদীপ চ্যানেলের মাথায় থাকলে সরকারি বিজ্ঞাপনে কাটছাঁট করা হচ্ছে। ফলে কয়েক দফা চাকরি হারিয়ে বা সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

যদিও তিনি ভারসাম্য রক্ষার সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী বলে অভিযোগ তুলেছেন এন ডি টি ভি তে তার একদা অধীনস্ত এবং এখন হিন্দি এনডিটিভি ইন্ডিয়ার প্রধান রবীশ কুমার। হিন্দি টিভি সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল মুখ ও ম্যাগসআইসাই পুরস্কার প্রাপ্ত রবীশ মোদি সরকার ও গোদী মিডিয়ার ক্ষুরধার অথচ তথ্যনিষ্ঠ সমালোচক। এই কারণে তিনি এবং এন ডি টি ভির আরেক প্রাক্তন ম্যানেজিং এডিটর ও বর্তমানে অনলাইনে মোজো প্ল্যাটফরমে কর্মরত বরখা দত্ত সরকারি ও শাসক দলের নানাবিধ আক্রমনের শিকার বেশ কয়েক বছর ধরেই। রবীশের সাফ কথাঃ পুলিশের বয়ানকেই ধ্রুব সত্য মানাই যদি সাংবাদিকতার নতুন মাপকাঠি হয় তবে এখন থেকে পুলিশই চ্যানেলে চ্যানেলে খবর শোনাক।

দ্য হিন্দুর প্রাক্তন সম্পাদক ও অধুনা ডিজিট্যাল মিডিয়ায় সাড়াজাগানো দ্য ওয়্যার গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সিদ্ধার্থ বরদারাজনের অপরাধ, পুলিশের বয়ানকে ধ্রুব সত্য না মেনে তিনি মৃতের পরিবারের অভিযোগকেও গুরুত্ব দেন। বিশেষ করে তারা যখন দাবি করছেনঃ ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের একজন আড়ালে পরিবারের দাবিকেই সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু হাত-পা বাঁধা বলে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। লক ডাউনের মধ্যেই অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের সমারোহ নিয়ে সমালোচনা করায় এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক বিশেষাধিকার হনন হোক বা মোদীর স্বপ্নের ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্ট’ তথা নতুন সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও দফতর সহ ক্ষমতার একটি অতিকেন্দ্রীভূত ও দুর্গপ্রায় সংরক্ষিত অঞ্চল নির্মাণে বিপুল অর্থব্যয় এবং পরিবেশ ধবংসের বিষয়ে নানা তথ্যপ্রমাণ হাজির; সিদ্ধার্থ ও তাঁর সহযোগীদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন ও অনলাইন টিভিতে আলোচনা সরকারের রোষের কারণ।

হিন্দি খবরের কাগজে সাংবাদিকতায় মহিলাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব মৃণাল পাণ্ডে এবং ক্যারাভান ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত অন্যেরাও বি জেপি সরকারের নানা নীতি ও কার্য কলাপের সমালোচক। ক্যারাভানের তদন্ত ধর্মী রিপোর্টগুলি সরকারের ঘোর অপচ্ছন্দের কারণ।

ইতিমধ্যে আরেক প্রবীণ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার মাথার উপর গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। ২০১৭ সালে তিনি সরকারি আশীর্বাদে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অতিঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা আদানি পাওয়ারকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া নিয়ে প্রখ্যাত সাপ্তাহিক ইকনমিক য়্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে সহযোগীদের তদন্তমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেই সুত্রে মানহানির মামলায় তাঁকে জড়িয়ে জেলে পাঠাতে চাইছে আদানি গোষ্ঠী। এই প্রতিবেদন সুত্রেই ই পি ডব্লিউ সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন পরঞ্জয়।

এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য আর এক গুজরাতি শিল্পপতি, দেশের পয়লা নম্বর তথা এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির একটি কোম্পানিকে দেশের প্রাকৃতিক জ্বালানি গ্যাস ক্ষেত্র সংক্রান্ত ব্যবসায়ে বিশেষ সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে লিখেছেন। শুধু তাই নয়, এই বিষয়ে তাঁর ‘গ্যাস ওয়্যার’ নামে বইটিও পাঠক মহলে সমাদৃত। ফলে তিনি সরকার ও ওই বিপুল ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর বিষ নজরে পড়েন। কয়েক বছর আগে প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার বিশেষ গ্রুপের সদস্য হিসেবে ‘পেইড জারনালিজম’- এর বিরুদ্ধে তাঁর তদন্তমূলক প্রতিবেদন সাড়া ফেলেছিল। সাংবাদিকতার নামে মোটা টাকা ও বিজ্ঞাপনের বদলে ভোটের সময় শাঁসালো রাজনীতিক ও সারা বছর শিল্পপতিদের পক্ষে প্রচারমুলক খবর লেখা বা চলচ্ছবির ব্যবসার পর্দাফাঁস হয়। এতে বড় বড় কাগজ-চ্যানেলের মালিক ও সম্পাদকরা মোটেই খুশি হন নি।

অন্যদিকে ফেসবুক, ইউ টিউব ইত্যাদি আমেরিকান ডিজিট্যাল ‘সামাজিক মাধ্যমে’র মালিকদের সঙ্গে মুকেশ আম্বানি সহ দেশি শিল্পপতিদের গাঁটছড়া ব্যাপক বাড়ছে। পাশাপাশি দেশের অনলাইন খুচরো ব্যবসার বাজার ধরতে আমাজন, ফ্লিপকারট- নিয়ন্ত্রক ওয়ালমারট সুপারমারকেট চেইনের সঙ্গে জিও-মারট, স্পেন্সার ইত্যাদি দেশি ব্যবসায়ী সংস্থার বাণিজ্য- যুদ্ধও তুঙ্গে। সেই সুত্রে এদেশে ইন্টারনেট- ব্যবহারকারী ও সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় নেটিজেনদের ‘প্রাইভেসি’ বা ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা আক্রান্ত। তাঁদের আর্থিক ক্ষমতা ও ক্রেতা-উপভোক্তা হিসেবে কার্যকলাপ ইত্যাদি বিষয়ে নানা তথ্য বিক্রি ও পাচারের ব্যবসা প্রবল। দুনিয়া জুড়ে এই বানিজ্য-তথ্যযুদ্ধের পাশাপাশি জাতীয় সুরক্ষার অজুহাতে সরকারগুলি ইন্টারনেটে নাগরিকদের রাজনৈতিক অবস্থান বা পছন্দ- অপছন্দ নিয়ে নজরদারি- গোয়েন্দাগিরি চালায়। বিশেষ করে তথাকথিত সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলির সঙ্গেই যোগসাজশ বেশি।

এসব নিয়েই বই লিখেছেন, নানা জায়গায় বলেছেন পরঞ্জয়। এই ক্ষেত্রেও তিনি ভারত সরকারের নানা নীতির ঘোর সমালোচনা করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই শাসক শিবির তাঁকে আপদবিশেষ বলেই গণ্য করছে। তাই তাঁকে যেনতেন উপায়ে জেলে পাঠাতে মরীয়া মোদি-আদানি- আম্বানিরা। বিশেষ করে যখন বড় হাউসের ছায়া তাঁর মাথার উপর নেই। আপাতত গুজরাত হাইকোর্ট অধীনস্ত তালুক কোর্টের জারি গ্রেফতারি পরোয়ানা মুলতুবি রাখলেও তিনি কতদিন মুক্ত থাকতে পারবেন তা আমরা জানি না।

তরুণ ফ্রি ল্যান্স মোবাইল’ সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ বেশি

নামী প্রবীণ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করলেও দেশের বাইরে প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এখনও তাঁদের গারদে পোরার তৎপরতা দেখায়নি মোদি সরকার। কিন্তু তরুণ, অনামী বার্তাজীবীদের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন নয়। মনদীপ পুনিয়া নামে এক তরুণ সাংবাদিক মুলত দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তে চলতি কৃষক আন্দোলন ‘কভার’ করছিলেন। তিনি ক্যারাভ্যান ম্যাগাজিন এবং অন্য কয়েকটি অনলাইন পোর্টালের জন্য কাজ করেন। নিজের ফেসবুক পেজ থেকে ‘লাইভ’ খবরও দেন। তাঁকে গ্রেফতার করা হল পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে। আসল ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম।

২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে পুলিশ বনাম কৃষকদের খন্ডজুদ্ধে, বিশেষ করে লালকেল্লার সামনের প্রাচীর লাগোয়া পতাকা দণ্ডে অত্যুৎসাহী কিছু শিখ যুবক খালসা পন্থের পতাকা উড়িয়ে দেয়। সেই সুযোগে শাসক শিবিরের তরফে কয়েক মাস ধরে চলা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটাকে খালিস্তানি-পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের ষড়যন্ত্র বলে দাগিয়ে দেওয়ার খেলা জোরদার হয়। লাল কেল্লার শীর্ষে উড্ডীন জাতীয় পতাকার কোনও ক্ষতি বা অসন্মান হলেও দেশপ্রেমের হিড়িক তুলে সংযুক্ত কিষাণ মোরচার নেতাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু হয়েছে। কেল্লা-কান্ডের নিন্দা করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘী বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে দিল্লির সঙ্গে হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের সীমান্তে সিঙ্ঘু, টিকরি ও গাজিপুরে অবস্থানরত কৃষকদের জবরদস্তি হঠিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় দিনে দিনে হিংস্রতর ।

প্রজাতন্ত্র দিবসের পরই স্থানীয় গ্রামবাসীদের কৃষকদের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়া হয় তাঁদের যাতায়াত ও দৈনন্দিন জীবনে অসুবিধার অছিলায়। পুলিশের সামনে সিঙ্ঘুতে কৃষকদের অবস্থানে এহেন আক্রমণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদন্তধর্মী প্রতিবেদনে মনপ্রিত জানায় তথাকথিত গ্রামবাসীরা আসলে অধিকাংশ বাইরে থেকে আসা সঙ্ঘ-সমর্থক। এই রিপোর্টই শাসক শিবিরের রোষের কারণ হয়। আপাতত সে জামিনে মুক্ত হলেও পুলিশ ও শাসক দলের কালো তালিকায় নাম উঠে যাওয়ার পর তার ও পরিবারের নিরাপত্তা কত দূর তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

মনদীপ সেই বিপুল সংখ্যক তরুণ নাগরিক সাংবাদিকদের মুখ যারা স্মার্ট ফোন ও সস্তা ইন্টারনেট যোগাযোগের সূত্রে গড়ে ওঠা তথাকথিত ডিজিট্যাল গণতন্ত্রের ফসল যারা ‘এস্পায়ারিং ইয়ুথ’ বটে, তবে মোদী-মুকেশের বাধ্য নয়। এরা কর্পোরেট মিডিয়া হাউসের কর্মী নয়, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সরকারি প্রেস কার্ড পায়নি। বড় টিভি চ্যানেলে ওদের মুখ দেখা যায় না বা পরিচিত ব্র্যান্ডের লোগোওয়ালা বুম বাগিয়ে নেতা-মন্ত্রী- সান্ত্রীদের বাইট নেওয়ার সৌভাগ্য ওদের হয় না। এমন সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকরা বেশির ভাগ সময়েই পুলিশ- ফৌজি এবং শাসকদলীয় নিগ্রহ ও ধরপাকড়ের শিকার।

সরকার-বিরোধী প্রতিবাদ- আন্দোলন বা দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর-ছবি সংগ্রহের সময় এমনটা প্রায়ই ঘটে। যাদের কলম- ক্যামেরা ক্ষমতাতন্ত্রের অবাধ্য বলে পরিচিত বা সন্দেহভাজন, তেমন দুর্বিনীতদের জন্য লাঠি-গুলি, হাজতবাস, জেল এমনকি পোষ না মানলে গুমখুন বা প্রকাশ্য কোতল ঘটে থাকে। জেলা স্তরে বা আরও তলায় সাংবাদিক যশোপ্রার্থী তরুণদের একাংশ হয় ক্ষমতার মধু চাখতে স্থানীয় নেতা-পুলিশ-মাফিয়া চক্রের দোসর হয়ে পড়ে, নয় পিঠ বাঁচাতে সমঝোতা করে। কিন্তু যারা একবগগা, আদর্শের ভুত যাদের মাথায় চড়েছে, তারা সব দিক থেকে বিপদে। দিল্লি সীমান্তে চলতি কৃষক আন্দোলনেও এমন নাগরিক সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী আদর্শবাদী তরুণদের দেখা গেছে। যাদের সম্বল একটি স্মার্টফোন, বড় জোর একটি পুরোন যুগের ক্যামেরা। অধিকাংশই ছোট কাগজ ও ডিজিট্যাল মিডিয়া তথা অনলাইন নিউজ পোর্টালের সঙ্গে যুক্ত অথবা নিজেরাই চালায়। অনেকের তাও নেই। ফেসবুক লাইভে নিজেদের সংগৃহীত ছবি ও তথ্য তারা শেয়ার করে।

ডিজিট্যাল গণতন্ত্র ও কর্পোরেট- সরকার জুটির নজরমিনার

এহেন মুক্তবল্লম নাগরিক সাংবাদিক এবং ডিজিট্যাল মিডিয়া কর্পোরেট ও সরকার যুগলবন্দির কাছে বিপদ । কেন না ভারচুয়াল গণপরিসরে বিরোধী কণ্ঠস্বর বা সত্যসন্ধানী মিডিয়া গুলিকে দাবিয়ে শাসক শিবিরের প্রচারের ঢক্কানিনাদ এখন নাগরিকদের মগজ- ধোলাইয়ের ব্যবস্থা এখন দেশে দেশে হিটলার- মুসোলিনির ভাবশিষ্যদের প্রধান অস্ত্র। তিরিশের দশকে নাজি- ফ্যাসিস্তদের আর্যামি আর যুদ্ধবাজ জাতীয়তাবাদ আদর্শে উদ্বুদ্ধ আর এস এস তথা সঙ্ঘ পরিবার এমনিতেই ‘হিন্দুদের পুণ্যভূমি ও মাতৃভূমি’ ভারতে জাতীয় ঐক্যের নামের অতিকেন্দ্রীভুত পুলিশ-রাষ্ট্রের পক্ষে যেখানে ব্যক্তি রাষ্ট্রের পূজায় বলিপ্রদত্ত। ইন্টারনেট টেকনোলজি তথা আমেরিকানদের ভুবন জোড়া আন্তর্জাল ছড়ানোর প্রযুক্তি এখন সঙ্ঘের প্রচারক নরেন্দ্র মোদীর তুরুপের তাস। তিনি ক্ষমতায় আসার পর সরকারি মদতে বিজেপি ও সহযোগী কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি বিপুল অর্থ ও লোকবল এই মগজ ধোলাইয়ের কাজে লাগিয়েছে। অন্যদিকে অনলাইন মিডিয়ার পায়ে বেড়ি পরানোর আইনি ব্যবস্থাও বাড়ছে।

কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে যে রঙের রাজনৈতিক দলই হোক, দেখেছি ক্ষমতা পেলেই শাসক দল হিসেবে তারা বিরোধী পর্বের সাংবাদিক-বান্ধব ভাবভঙ্গি ছেড়ে স্বমূর্তি ধরে। পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ কংগ্রেস শাসন, তিন দশকের বাম জমানা এবং তার পর চলতি তৃণমূল শাসনে সংবাদ মাধ্যম ও কর্মীদের উপর বারবার আক্রমণ নেমেছে। দেশ জুড়ে ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থার পর্বে সাধারণ নাগরিক অধিকার হরণের সঙ্গে মিডিয়ার পায়ে শেকল পরানো হয়। কিন্তু আগের শাসকদের হার মানিয়েছে মোদী সরকার। সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাকারী, নরমপন্থী বা উদারপন্থী হলেও রেহাই নেই। সশস্ত্র বিপ্লব, সম্পূর্ণ বিপ্লব ইত্যাদিকে তওবা করে বাজারবিপ্লবের পক্ষে থাকলেও হিটলার-মুসোলিনি থেকে ট্রাম্প-পুতিন-জিংপিংয়ের ধারা বেয়ে হিন্দু হৃদয়সম্রাট ও বিকাশপুরুষ মোদিজির শ্রীচরণে সাষ্ঠাঙ্গ প্রণিপাত ভিন্ন এখন আর রক্ষা নেই।

সে কারণেই ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ’ ভারত আজ বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স বা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকের মাপকাঠিতে দুনিয়ার ১৮০ টি দেশের তালিকায় ক্রমশ নিচের দিকে নামছে। প্যারিস-স্থিত আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টারস সানস ফ্রন্টিয়ারস- এর এই তালিকা অনুযায়ী ২০১৭ তে ১৩৮ নম্বরে থাকা ভারত ২০২০ তে ১৪২ নম্বরে নেমেছে। হবে নাই কেন, গত বছরে অন্তত ৬৭ জন সাংবাদিককে আটক বা গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ শীর্ষে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন প্রয়োগ বাড়ছে।

গোদী মিডিয়ার সাত খুন মাপ

অন্যদিকে মোদী-ভক্ত গোদী মিডিয়ার প্রতি তিনি ক্ষমাসুন্দর। তাঁর তথা বিজেপির প্রধান মিডিয়া-মুখ রিপাব্লিক টিভির অর্ণব গোস্বামী, ইন্ডিয়া টি ভির রজত শর্মা, জি টি ভির সুধীর চৌধুরী, আজ তকের অঞ্জনা , এ বিপি টিভির রুবাইকা, সবার উপরে সুদর্শন টিভির মালিক সম্পাদক প্রমুখ মুসলমান সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি এবং বিরোধী শিবির সহ সরকারের তাবৎ সমালোচকদের বিরুদ্ধে অষ্টপ্রহর ঘৃণা ও হিংসায় ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে মোদী ও গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ কুটো টি নাড়েন নি।

অর্ণবকে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সরকার টি আর পি কেলেঙ্কারি মামলায় গ্রেফতার করলেও সে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে দ্রুত ছাড়া পেয়েছে। সেই মামলায় সরকারি সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে দাখিল হওয়া অর্ণব ও টি আর পি মাপার সংস্থা বার্ক-এর প্রাক্তন প্রধান পার্থ দাসগুপ্তের ই-মেইল চালাচালির নথি সূত্রে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। তাতে প্রধানমন্ত্রী ও প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং তাবড় মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে অর্ণবের প্রায় হটলাইন খাতিরদারির দাবি ছত্রে ছত্রে ছড়ানো। তার চেয়ে বড় কথা, সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে কোতল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষাধিকার ও রাজ্য মর্যাদার অবলোপ এবং কাশ্মীরে পুলওয়ামায় পাকিস্তানি মদতে জঙ্গি হানার পালটা বালাকোট হানা ইত্যাদি জাতীয় নিরাপত্তা র সঙ্গে সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় তথ্য আগাম জানার দাবি করেছে । মোদী- শাহ মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

ইন্দিরা জমানার জরুরী অবস্থা কালে অনেক সাংবাদিককে জেলে পাঠানো হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ প্রবীণরা মনে করতে পারছেন না। বস্তূত মোদি- শাহ- আদানি-আম্বানিদের রাজত্বে দীর্ঘতর অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। এই মুহূর্তে পরঞ্জয়ের মতো প্রবীণ ও মনপ্রিতের মতো ত্রুণ সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানো নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য। স্বাধীনচেতা সাংবাদিকরা আজ বিপন্ন। বিকল্প ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ব্যক্তি জীবনে অনেক মূল্য দিতে হয়। বিশেষ করে যারা নিজেদের সাংবাদিক বলে দাবি করি। তেরঙা-লাল-সবুজ জমানা হোক বা গেরুয়া জমানায় মোসাহেবিকে ঘৃণা করি। তাদের কাছে আমার আবেদনঃ প্রতিবাদে সোচ্চার হন । পরাক্রান্ত শাসক ও তার গুন্ডাবাহিনীর হাতে ওরা আক্রান্ত হলে এরপর নতুন প্রজন্ম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার গাঁটছড়ার বিরুদ্ধে কলম বা ক্যামেরা ধরতে ভয় পাবে। গোদী মিডিয়ায় দাপটে কোণঠাসা স্বাধীন সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে। নানা ক্রটি সত্ত্বেও আজকের ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র অনেক প্রজন্মের রক্ত-ঘামের ফসল। তাকে বিনা প্রতিরোধে ফ্যাসিস্তদের হাতে ছেড়ে দেবেন না।

0 Comments

Post Comment