পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।

  • 17 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 926 view(s)
  • লিখেছেন : অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনিব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম - সবই তো গভীর এক চক্রান্তে জড়িয়ে। দেশে দেশে যারা সংস্কৃতি নয়, ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে যাবতীয় মানবিক অধিকার ঢাকা দিতে ব্যস্ত তারাই যেন গুরুত্ব পাচ্ছে। পদ স্খলন শুধু নয় এখন পদসেবা এবং পদ লেহন মনে হচ্ছে উম্নতিলাভের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছে। মনে পড়ছে সেই গানঃ "Till wrong feels right'"!

 

 আমার দেশ বা রাজ্য তো শুধু নয় পৃথিবী জুড়েই অন্ধকার  নেমেছে যেন। কে আছে যাঁরা বা যিনি পথ দেখাতে পারেন আমাদের এই অন্ধকারে! তেমন কোনও দার্শনিক বা চিন্তানায়ক বা  লেখক চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে কেবল যেন কিছু অসুখ-বিসুখ, কানে আসে অস্ত্রের ঝনঝনানি।  ইসরায়েল- আরব জগত, ইরাক-ইরান,রাশিয়া-আফগানিস্থান, রাশিয়া-ইউক্রেন, পাকিস্তান-ভারত,  পাকিস্তান-বাংলাদেশ এসব তো আছেই, আরও আছে।  যেমন ১১/৯-এর সমস্যা, কিউবা নিয়ে রাশিয়া আর আমেরিকার সম্পর্ক, বা সুয়েজ খালের সমস্যা ইত্যাদি। আজও অধিকাংশ দেশেই অধিকার  নিয়ে কাড়াকাড়ি চলেছে, গৃহহীনদের সমস্যা বেড়েছে; সমস্যা বেড়েছে পরিযায়ীদের, ইউক্রেন নিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা নাকি বেড়েই চলেছে, জলের দখল নিয়ে বা জ্বালানির দখল নিয়ে আবার এক বিশ্বযুদ্ধ বুঝি আসন্ন।


এর মধ্যে কোথাও কি উন্নতি চোখে পড়ে না? তবে কী উন্নতি হচ্ছেই না?
 উন্নতি নিশ্চয় হচ্ছে। তবে উন্নতি হচ্ছে প্রধানত প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। আরও স্পষ্ট বললে বলতে হয় উন্নতি হচ্ছে শিল্পক্ষেত্রে। জি ডি পি বাড়ছে! এমনকি কৃষিপ্রধান দেশগুলিও শিল্প-উৎপাদনে কেরামতি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কৃষি ও পর্যটন অবহেলিত, গুরুত্ব পাচ্ছে বাণিজ্য। বাড়ছে যুদ্ধের কৌশল। এখন আর সাধারণ ট্যাঙ্ক, রণতরী, বিমান যুদ্ধে তেমন কাজে লাগে না। নজর ফেরালে(নজর ফেরাতেই হয়) দেখি শিক্ষা আর স্বাস্থ্য সব দেশেই হয়ে উঠছে ব্যবসার প্রধান ক্ষেত্র। দেখা যাচ্ছে উন্নতি হচ্ছে পরিবেশ দূষণের বিনিময়ে। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ, আর উন্নতির বিনিময়ে বিসর্জন দিতে হচ্ছে বেশ কিছু  স্বাস্থের শর্ত।
কিছু চিকিৎসক নিশ্চয় আছেন। তবে তাঁরা যেন আছেন কোনও ব্যবসায়ীদের আশ্রয়ে। সকলে না হলেও, (গ্রামে চিকিৎসকরা ব্যবসায় তেমন দড় না ও হতে পারেন) অন্তত নগরের চিকিৎসকদের অধিকাংশই। যাঁরা ব্যবসায়ী তাঁরা কেবল যে চিকিৎসাকেন্দ্র চালাচ্ছেন এমন নয়, তাঁদের কেউ ওষুধ,  কেউ নানাবিধ যন্ত্রের ব্যবসায় যুক্ত। তাঁরা যা নিজেরা পারেন না তা, লাভের অঙ্ক কষে, লোক দিয়ে  করান। সেসব লোকের চিকিৎসা বিষয়ক ডিগ্রি থাকতে পারে, নাও পারে। থাকলেই বা কী? অসুখ-বিসুখ তো  উধাও হয় না।  ব্যবসাও উধাও হয়  না, উধাও হয় কেবল জি পি, তাদের জায়গায় আসেন নানা বিশেষজ্ঞ। পরে বলব না হয় তাঁদের কথা আরও, এখানে এখন থামি। থামার আগে কেবল এটুকু বলতে পারি যে একালে বাজারই যেন রাষ্ট্রক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। অন্য কথায় না গিয়ে মূল সমস্যার কথায় ফিরি।



মূল সমস্যা এখনঃ সর্ব বিচারেই পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন। যেমন ধরুন পৃথিবী জুড়ে আছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তাঁদের গুরুত্ব যেন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি ডিঙ্গিয়ে আমাদের উপকারে  তেমন আসে না। সরকারও তা চায় না যেন। তাঁদের হাল যেন  আবহবিদদের মতো। কেউ যেন বিশ্বাস করেন না তাঁদের।  তাঁদের কথা শোনে না। শুনলেই বা কী হতো? চারিদিকে মুদ্রাস্ফীতি আর বেকারির চাপে দেশগুলোতে কথা শোনার মতো লোকই বা কোথায়? লোক বেড়েছে নিশ্চয়, অন্য অনেক কিছুর মতো, তবে বাড়েনি তাঁদের গুণমান। তাই যেন দেখি মার্ক্সবাদ নিয়ে যত উত্তেজনা, সে নীতি সংশোধনের প্রয়াস তেমন জোরালো নয়। যেন ধরে নেওয়া হয়েছে, সর্বশক্তিমান  তাই মার্ক্স, যেন কোনও ঈশ্বর, ভুল থাকা সে নীতিতে সম্ভব নয় (মাও, লেনিন বা  হোচিমিন, কাস্ত্রো বা চে, এমনকি গ্রামসিও গুরুত্ব পায় না সেরকম আলোচনায়)।


অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে তুলনা করেছি আবহবিদদের। অথচ, একালে বিজ্ঞান কত উন্নত!  চাইলেই আপনি গ্রহান্তরেও নাকি যেতে পারেন এই পৃথিবী ধ্বংস করেও। সারা বিশ্বে, আবহবিজ্ঞানও অনেক দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞানের নানা কৌশল প্রয়োগে এবং নাসার সাহায্য পেয়ে (বা না পেয়ে)। কিন্তু অবিশ্বাস যায় না যে। আর  সে সব স্মরণীয় শিক্ষক বা কোথায়? যাঁরা আছেন তাঁরাও যেন নিজেকে তৈরি করে নিতে যে সময় দেওয়া প্রয়োজন তা মানতে বা খরচ করতে প্রস্তুত ন'ন। সর্বত্র এই কথা সত্য যেন!



সব কিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেন? তবে কী সারা বিশ্ব জুড়ে এই যে সংকট তাতে সভ্যতা বর্ণহীন হয়ে পড়ছে? আরও কিছু উদাহরণ দিই'।

বিজ্ঞানের কথা বলি সবার আগে।


১ম বিশ্বযুদ্ধের অল্প আগে থেকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয় পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানীরা আর রসায়নবিদরা মিলে দুনিয়া তোলপাড় করা এক একটি আবিষ্কার করে বিজ্ঞানচিন্তায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন। অন্তত, বিশ শতকের গোড়ার ৫০ বছর আমরা দেখেছি সাধনা কাকে বলে।  আশা ছিল এমন সাধনা চলতেই থাকবে। তা হল কোথায়? যা হচ্ছে এমন সাধনা আমরা আগে দেখিনি নাকি? স্পষ্ট বলতে পারি যে, এমন বিজ্ঞানসাধনা আমরা বিশ্বযুদ্ধের আগে যদি বা দেখে থাকি পরে  (বা, আরও ভালো বলতে হলে বলব ১৯৫০ -এর পরে) আর তেমন দেখিনি। বিশ্বযুদ্ধের আগে কিছুটা দেখেছি, যখন কেপলারের সূত্র পেলাম, অথবা গ্যালিলিও দেখা দিলেন বিশ্বমঞ্চে বা সেই নবজাগরণের কালে (গ্রিক-আরব-হিন্দু সভ্যতার কাল পেরিয়ে), বিশ্বযুদ্ধের পরে পরে বা ৫০- এর পরে যেন সে সাধনা তথা সে উদ্দীপনা যেন আর দেখিইনি।



পরে কী কিছুই দেখিনি? কম্পিউটার থেকে, মোবাইল ফোন আমাদের জীবনযাপনের ছবিটা একেবারে বদলে দিয়েছে, তাই না? কিন্তু এসবের কথা বলার আগে বলা ভালো যে এই সবই আমাদের প্রযুক্তিচর্চায় এগিয়ে চলার কথা বলে। তারই সাথে সেই এগিয়ে চলার অর্থ হল যেন প্রগতি আমাদের নিয়ে এগোল যুদ্ধের দিকেই।


২য় বিশ্বযুদ্ধ থামাতে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে ফেলা হল 'পরমাণু বোমা'। জার্মান বিজ্ঞানীরা, নীলস বোর থেকে আইনস্টাইন জার্মানী ছেড়ে গেছে হিটলারের স্বৈরাচারী শাসনে, অত্যাচারে। জার্মানীতে থেকে গেছেন হাইজেনবার্গ ও অটো হান। তাঁরা যদি পরমাণু বোমা' তৈরি করেন! তত্ত্ব তো জানাই তাঁদের। অতএব  ........
মার্কিনী (বা ধনবাদী) প্রভাব নিশ্চিত করা যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়েও ছিল জরুরী।  তাই, তড়িঘড়ি বোমা ফেলা  জাপানে - জাপান তো ইউরোপ না। অনেক অংক কষে সেখানে বোমা ফেলা। অংক যাই হোক বা যেমনই হোক, প্রযুক্তি চলল এগিয়ে। বিশ্বজুড়ে হৈচৈ শান্তি চাই। চাই তো পাই কোথায়, কোন শুভ বুদ্ধির জোরে? এর ফাঁকে কোথায় হারালেন রবীন্দ্রনাথ বা বার্নার্ড শ। উপন্যাস বা নাটক বাদ দিলাম নাহয়, এমন দিনে কেবল ছোটগল্প লিখে মন জয় করা সমারসেট মম বা নরেন্দ্র মিত্ররাও নেই। নেই প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব, পাবলো নেরুদা, জীবনানন্দরাও। নেই রাসেল, সুরেন দাশগুপ্ত বা ভিটগানস্টাইনের মতো কোনও দার্শনিকও।
ফিরি বাংলায়। গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে গিয়ে বেশ কিছু যুবক প্রাণ দিল।  আগেও তারা, বাংলার তরুণ-তরুণীরা, সন্ত্রাসে, সঙ্কল্পে  দেখিয়েছেন কতটা ও কেমন অকুতোভয় ছিলেন। এরা সব কোথায় হারালেন? নাকি আমাদেরও এসেছে তেমন বন্ধ্যাদশা?
অস্বীকার করছি না, তবে কেবল এই রাজ্য নয়  বন্ধ্যাত্ব সারা দেশেই। যতই নিন্দা করি এও তো ঠিক যেভাবে ইন্দিরা বা রাজীব গান্ধী কে বা বিয়ন্ত সিংহকে হত্যা করা হয় তাতে সাহস লাগে। সাহস লাগে  ১১/৯ এর ঘটনা ঘটাতেও। তার মানে এই নয় যে সমর্থন করতে হবে সন্ত্রাসবাদীদেরও। বরং বলা চলে যে কুকাজ বা আকাজে সময়, শ্রম নষ্ট হচ্ছে অনেক বেশী। যেমন এই রাজ্যে আমরা দলীয় রাজনীতির অন্ধ গলিতে ঘুরপাক খাচ্ছি প্রতিদিন। প্রশংসা করছি তাঁদের সাহসের যাঁরা একদিন পৃথিবীর বুকে নতুন সকাল আনার কথা ভেবেছে। আর সে সাহসও যেন ফুরিয়ে আসছে। অথচ, গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনিব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম  - সবই তো গভীর এক চক্রান্তে জড়িয়ে। দেশে দেশে যারা সংস্কৃতি নয়, ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে যাবতীয় মানবিক অধিকার ঢাকা দিতে ব্যস্ত তারাই যেন গুরুত্ব পাচ্ছে। পদ স্খলন শুধু নয় এখন পদসেবা এবং পদ লেহন মনে হচ্ছে উম্নতিলাভের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছে। মনে পড়ছে সেই গানঃ "Till wrong feels right'"!


তবে কেবল হতাশার দিক নয়। অন্ধকারের কথা নয়, বলি কিছু আশার, কিছু আলোর কথাও।


মানুষ লড়ছে। সাধারণ মানুষ তারা লড়ছে। কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-পথে-ঘাটে তারা লড়ছে। লড়াই চলেছে মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায়, চা বাগানে, কৃষিজমিতে-কারখানায়। কোনও নীতি যেন এদের পথ রোধ না করে, আমরা কেবল তাই দেখব। সেটাই হোক আমাদের কাজ। দেখব ওরা নতুন নিয়ম নীতি গড়ে নিয়েছে নিজেদের জন্য। ওঁরা এগোক। শুভমস্তু।

0 Comments

Post Comment