(মানুষকে যে কত সহস্র বছর ধরে, কত পরিশ্রম করতে হয়েছে, অর্থবাহী ধ্বনি, লিপি আর ভাষা তৈরির পেছনে! কথোপকথন চালাবার মতো একটা ধ্বনি হয়তো তৈরি হয়ে উঠল, তারপর এমন এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেল যে, মানুষের সভ্যতা নিশ্চিহ্ন। ভাববিনিময়ের সব চিহ্ন লুপ্ত। আবার মানুষ এল, আবার আবিষ্কার করতে হল ভাব প্রকাশ করবার এবং তা বুঝে নেবার মতো ধ্বনি বা সংকেত। আবার কোনও মারণ ব্যাধি শেষ করে দিল মানুষকে। কোথাও তো লিখিত কিছু নেই! ফলে, কোনও গোষ্ঠীর উত্থান পতন আর বিলোপের সঙ্গে ভাষারও উত্থান পতন আর মৃত্যু। পূর্বসুরীদের জ্ঞান অভিজ্ঞতার কোনও কিছুই লিখিত না থাকার ফলে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হল সব। কত শত সহস্র বছর পেরিয়ে গেল এই রকম সাপলুডো খেলতে খেলতে! ভাষা আবিষ্কারের পরেই সব কিছু এগিয়ে চলল খুব দ্রুত। শূন্য আবিষ্কার করেছিলেন, অনামা কেউ; পরবর্তীতে, তার গুরুত্ব বোঝালেন, আর্যভট এবং ব্রহ্মগুপ্ত। এই আখ্যান সেই অজানা মানুষটির।)
যজ্ঞের আয়োজন করা কি সামান্য কাজ? যজ্ঞের দায়িত্ব অয়ধৌম্য ব্রাহ্মণের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে ঠিকই, পূজাপাঠের কর্ম, তার আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি এবং যজ্ঞের প্রয়োজনীয় উৎকৃষ্ট জাতের মাধ্বী জোগাড়ের দায়িত্ব তাঁর, কিন্তু তিনি তো আর যজ্ঞবেদি তৈয়ার করবেন না! শুল্বসূত্রের হিসাব অনুযায়ী যথাযথ গড়তে হবে অগ্নিধারকটিকে। এর প্রধান উপকরণ ইঁট, যা বানাতে জটিল গণিতের কিছু জ্ঞান লাগে! কাঁচা ইঁট দিয়ে এ কাজ হবে না, বেদি গড়তে হবে একেবারে সুসমঞ্জসভাবে পোড়ান রক্তিম ইঁট দিয়ে--এ কথা বলা হয়েছে শতপথ ব্রাহ্মণ আর যজুর্বেদে। বেদের কথা মানতেই হবে, কোনও ত্রুটি রাখা চলবে না।
যজ্ঞ শুরুর পূর্বে বৈদিক নিয়ম মেনে শুরু হয়েছিল এর স্থান নির্বাচন পর্ব। কুসুমপুরে পবিত্র ভূমি হল অদূরের গঙ্গা নদী আর হিরণ্যবাহ নদের সঙ্গমের তীরবর্তী কোনও ভূমিখণ্ড। অথবা গণ্ডক যেখানে গঙ্গার সঙ্গে মিশেছেন, সেই স্পর্শবিন্দুর অদূরেই যে হরিহরনাথের মন্দির, তার সম্মুখভাগের জমি। যদিও হিরণ্যবাহ তীরবর্তী স্থানটি বাসভূমির নিকটে, তুলনায় মন্দির সামান্য হলেও দূরে, হরিহরনাথ ক্ষেত্রটিকেই অনেক আলোচনার শেষে নির্বাচন করা হয়েছে। যে জায়গায় অগ্নিকুণ্ড সহ যজ্ঞবেদি স্থাপন করতে হবে সেই ভূমিটি হতে হবে সমতল। এই কাজ করবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ধনিয়াকে। ধনিয়া অর্থাৎ ধনদেব বৃহৎ কৃষিজীবী, মাটিকে ওর থেকে ভালো আর কেউ চেনে না; জল সঞ্চালন করে, ধাতব পিটনা দিয়ে মাটি সমতল করে দিয়েছে, অচিরেই। তারপরেই যজ্ঞস্থলে গিয়ে মন্ত্র পড়ে জায়গাটি শুদ্ধ করে নিয়েছেন বৌধায়ন।
বেদি-অগ্নিকুণ্ড হবে বর্গাকৃতি অথবা আয়তাকার, সেই হিসাবে এর কাঠামো গঠন; নানান স্তরে বিভক্ত এই যজ্ঞবেদি। সর্বোপরি, একে হতে হবে পূর্বমুখী। শান্ত মাথায়, বেশ হিসাব করে সম্পন্ন করতে হবে সব কিছু। বৌধায়ন তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে গণিতচর্চায় ব্যস্ত থাকেন দিনের অনেকটা সময়। এত কিছু তদারকের সময় তিনি পাবেন কী না সন্দেহ। অতএব, নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কুসুমপুরের নামী ইঁট প্রস্তুতকারক মণিভদ্রকে। এ অঞ্চলে মাটি আর জল পর্যাপ্ত। তবে যথেষ্ট সংখ্যক কর্মান্তিক, শিল্পকার, সূত্রধর, খনক এবং গণকের প্রয়োজন। মণিভদ্র এ-সবের দায়িত্ব নিয়েছে; কার্তিক পূর্ণিমার দিন থেকে শুরু হবে কাজ।
প্রাতঃকালে, একঘণ্টা কাল পদচালনা, শরীর প্রক্ষেপণ শেষে বাড়ির অদূরেই ক্ষীরদ্রুমের পাদদেশে বসে বৌধায়ন নিজের মনে যজ্ঞের সূচনাপর্বটি ভেবে নিচ্ছিলেন। ভাবনার পাশাপাশি তাঁর অভিজ্ঞ চোখ দেখে নিচ্ছিল আর এক প্রাত্যহিক কর্ম। গোহাল থেকে গরুদের বের করে উন্মুক্ত বাতাসে তাদের পদসঞ্চালন করাতে নিয়ে যাবার আয়োজন করছে সুন্দর রাখাল। ছেলেটির চোখেমুখে সর্বসময় সপ্রতিভতা জড়িয়ে থাকে। তাঁর তিনশো সাতান্নটি গাভীর হিসাব ও কেমন করে রাখে কে জানে! কখনও কখনও ঊষাকালে গাভীর সংখ্যা গুনে দেখেন তিনি। কিন্তু সংখ্যার কোনও অমিল হয়নি গত দু-বছরে। ও কী করে পারে?
ছেলেটিকে প্রথম দিন থেকেই কিছু রহস্যময় লাগে। অতিমানবও মনে হয় কখনও! কেন? তা সঠিক বলতে পারেন না বৌধায়ন, তবু লাগে। ওর যখন সদ্য কৈশোর, হঠাৎ যেন অলক্ষ্য থেকে এসে পড়েছিল গাজিপুরে, হরিহরনাথ মন্দিরের মেলায়। কৃষ্ণবর্ণ ঘোড়ার সওয়ারি হয়ে মেলার ভূমিখণ্ডে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছিল ছেলেটি। উন্নত নাসা, কপিশ চোখ, গাত্রবর্ণ চন্দ্রমুখীর তৈয়ার করা ননীর মতো! সিংহের কেশরের মতো চুল কাঁধ ছুঁয়ে ফেলেছে। সেদিনের প্রারম্ভিক কথোপকথন এখনও মনে পড়ে বৌধায়নের।
কী নাম জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, জিয়াস, তবে এদেশে আসবার পর নূতন নাম নিয়েছি, সুন্দর। কথার শেষে হাসির আভা দেখা গিয়েছিল ওর গোলাপী ওষ্ঠে।
-সুন্দর? জিজ্ঞাসার সঙ্গে কিঞ্চিৎ বিস্ময় মিশেছিল বৌধায়নের কণ্ঠে।
-হ্যাঁ, এক কর্মান্তিকের পুত্রের তো এমনই নাম হয় এই দেশে, তাই নয় কী?
-হ্যাঁ, তা অবশ্য। মাথা নাড়তেই হয়েছিল বৌধায়নকে।
কথোপকথনের মধ্যেই লক্ষ করা গিয়েছিল, শুধু অশ্ব নয়, মেলার প্রতিটি গাভী-বৃষ, প্রতিটি মহিষ, প্রতিটি উট-হস্তী-কুক্কুরের সঙ্গে তার সখ্য! প্রতিটি চতুষ্পদের পিঠে আদর করে হস্তচালনা করতে করতে তাদের সঙ্গে কথা বলছিল। যেন ওদের ভাষা বোঝে! আরও যা আশ্চর্য, তার সম্ভাষণে ওইসব অবোধেরা মস্তক চালনা করতে করতে যে প্রতি-সম্ভাষণ জানাচ্ছিল, তা বুঝতে কণামাত্র অসুবিধা হয় নি বৌধায়নের।
তিনি বললেন, এসো বৎস, তুমি আমার গৃহে থাক।
কিছুমাত্র না ভেবে ছেলেটি উত্তর দিল, থাকতে পারি কিন্তু এমনি নয়, আমি আপনার বাড়ির কোনও কাজ করে দেব, তার বিনিময়ে...
কী কাজ ওকে দেওয়া যায়? মনে মনে ভাবছিলেন বৌধায়ন। সব কাজের জন্যই তো কেহ না কেহ--
একাদশ কিংবা দ্বাদশ বর্ষীয় ছেলেটি যেন তৎক্ষণাৎ মন পড়ে নিল! আমি যে কোনও কাজই করতে সক্ষম, সে ধেনু চরান থেকে--
তখনই মনে হল, গোহাল দেখবার উপযুক্ত কর্মী দরকার। কিন্তু আর্য চেহারার ছেলেটিকে এই কাজের কথা বলতে দ্বিধা হচ্ছিল।
সে-কথা যেন কী করে বুঝে ফেলল এই মেধাবী কিশোর। আমি আপনার গোহালের রক্ষণাবেক্ষণ করব, অবসর সময়ে আপনার কাছে পাঠ নেব, গণিতের পাঠ...
বৌধায়ন চমৎকৃত। ও কী করে বুঝল যে তিনি গণিতবিদ, পাঠ দেন?
কিন্তু প্রশ্ন করবার আগেই বৌধায়ন শুনেছিলেন অস্পষ্ট স্বগতোক্তি--যেদিন আকর্ষণ গত হবে...।
বাক্য অসমাপ্ত রেখেই অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়েছিল সে। মাত্র কয়েক পল। আবার যেইখানে উচ্চারিত কথার শেষ, সেই সূত্র খুঁজে পেয়েই যেন বলল, আপনার কোন দ্বিধা নেই তো আমাকে শিক্ষণ দিতে?
দ্রুত মাথা নেড়েছিলেন বৌধায়ন, না না, কিন্তু তুমি কিছু শিক্ষা করেছ কী?
-হ্যাঁ, সামান্য কিছু, আমি যে স্থান থেকে এসেছি, সেই পুরুষপুরা নগরীতে অধিকাংশই শিক্ষিত, গণিতে বিশেষ ব্যূৎপত্তি তাদের...স্থানের প্রভাবে কিছুটা শিক্ষা পেয়েছি...
কথাটি যে অসত্য নয়, ওকে পাঠ দিতে গিয়ে অনুভব করেছিলেন বৌধায়ন। কিশোর একঘাত-দ্বিঘাত দুরকমের সমীকরণই জানে, পরিমিতি বিদ্যাতে, সামান্য হলেও, জ্ঞান আছে। বর্গমূল নির্ণয় করবার একটি জটিল প্রক্রিয়াও ওর আয়ত্তে! আরও কিছু শিক্ষা গ্রহণ করলে, নিয়মিত চর্চায় থাকলে, অনায়াসে গণিতবিদ হিসাবে মান্যতা পাবে।
তাহলে এ এমন চতুষ্পদের সান্নিধ্য ভালোবাসে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যই যেন কিছুটা আচম্বিতে, ঘোড়াটির গায়ে হস্তলেপন করতে করতে ছেলেটি বলেছিল, আমার এই বন্ধুটির নাম ইউক্লিড।
ইউক্লিড! যথেষ্ট মাত্রায় আশ্চর্য হয়েছিলেন বৌধায়ন। এইভাবেই, নামকরণের মধ্য দিয়েই, সে বোধহয় গণিতের সঙ্গে চতুষ্পদের সখ্য গড়েছে, এ ছাড়া ওই প্রহেলিকার কোনও সমাধান পাওয়া যায়নি। তবে এ সত্য বোঝা হয়েছিল যে, এই কিশোর তার নবীন চোখ দিয়ে ভুবনডাঙা দেখতে বেরিয়েছে।
কৌতূহলবশত, বৌধায়ন একবার দেখেছিলেন ওর হিসাব রাখার পদ্ধতি। ওর কাছে বেশ কিছু নুড়ি আছে আর আছে বিভিন্ন রঙের কাপড়ের টুকরো যাতে নুড়ি রাখা যায়। সে যখন এক এক করে গরু মাঠে ছাড়ছে, এক একটি গরুর জন্য এক একটি নুড়ি সাদা কাপড়ে রাখছে। সাদা কাপড়ে যখন দশটি নুড়ি হল, তখন তাতে আর নুড়ি না রেখে, খালি করে দশটির বদলে একটি নুড়ি সবুজ কাপড়ের টুকরোতে রাখল। তারপর আবার গরুদের হিসাব রাখতে সাদা কাপড়ে দশটি নুড়ি হবার জন্য অপেক্ষা করল। তারপর ওই সাদা কাপড় থেকে নুড়ি তুলে নিয়ে এদের বদলে আবার একটি নুড়ি সবুজ কাপড়ে রাখল। এইভাবে সবুজ কাপড়ের থলেতে যখন দশটি নুড়ি হয়ে গেল, তখন এদের বদলে একটি নুড়ি লাল কাপড়ে রাখল। এইভাবে হিসাব রাখার শেষে দেখা গেল ওর লাল কাপড়ে তিনটি নুড়ি, সবুজ কাপড়ে পাঁচটি নুড়ি আর সাদা কাপড়ে সাতটি নুড়ি আছে। অর্থাৎ মাঠে চরতে যাওয়া গরুর সংখ্যা ৩৫৭। বৌধায়ন চমৎকৃত! খুবই কৌতুক হয়েছিল ওর হিসাব রাখার পদ্ধতি দেখে!
এ সব তিন বৎসর পূর্বের ঘটনা। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতেই অকস্মাৎ মনে এল, এখনও কী গাভীর সংখ্যা তিনশো সাতান্ন, না কিছু বেশি? ছেলেটির দিকে নজর রাখলেন গণিতবিদ।
বৌধায়ন নিজে ব্রাহ্মণ; নামের অন্তিমে গুপ্ত পদবি দেখে কেউ-কেউ তাঁকে বৈশ্য ভাবলেও, তিনি আদতে ব্রাহ্মণ। শুধু ব্রাহ্মণ নয়, শিবের একনিষ্ঠ পূজারি। গণিতের প্রতিটি সন্দর্ভ লেখবার আগে শিবের বন্দনা করে দুই-চারটি স্তোত্র লিখে দেন। নিয়মিত ধ্যান করে থাকেন। অনুশাসন অনুযায়ী তিনি এই যজ্ঞ নিজেই সম্পন্ন করতে পারেন তবু যার যা কাজ তাকেই করতে দেওয়া বিধেয়। এ ছাড়াও একটি গূঢ় কারণ আছে; এবং তা অন্তঃপুরজনিত। বিবাহের ছ-বৎসরকাল অতিক্রান্ত, অথচ তাঁদের কোনও সন্তান হয় নি। গণক জানিয়েছে পুত্রকামেষ্টি যজ্ঞ করলে পুত্র লাভ হবে। পুত্রের প্রয়োজন নেই, সন্তান হলেই যথেষ্ট; বংশপ্রবাহ বজায় থাকে। তাঁর যে ভার্যা গৃহকর্মে সদা ব্যস্ত, যার গর্ভে তিনি ঔরসজাত সন্তান কামনা করেন নি, সেই চন্দ্রমুখী আনন্দিত মুখে তাঁর প্রতিটি কর্মে সম্মতি জানালেও যাঁর গর্ভবতী হওয়ার জন্য এই আয়োজন, সেই সুভদ্রাঙ্গী করজোড়ে অনুরোধ জানিয়েছেন, যারা পেশাদার যাজ্ঞিক তাদের কাউকে দিয়ে এই অনুষ্ঠান করাবার জন্য। প্রত্যুত্তরে, তিনি বলেছিলেন, কেন পেশাদার যাজ্ঞিক কী আমার চেয়ে--
ঘরে অতিথি...। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখা গেল, মোংলা। উচ্চগ্রামে ঘোষণা করল-- তিনজন এসেছেন দূরদেশ থেকে। দক্ষিণ হাতের পাঁচটি আঙুল প্রসারিত করে, বাম হাত দিয়ে দু’টি আঙুল নামিয়ে আবার বলল, তিন জন।
মৃদু হাসলেন বৌধায়ন। দুই বৎসর আগে তিনি যখন পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের উত্তরভাগে গিয়েছিলেন, গণিত শিক্ষা দিতে, এই অনাথটির সঙ্গে পরিচয় হয়। ও স্বেচ্ছায় চলে এসেছিল তাঁর সঙ্গে। নাম মঙ্গল। কিন্তু বহুজনের ব্যবহারে তা বক্রতা পেয়ে হয়ে গেছে মোংলা!
বৌধায়ন ভ্রূকুঞ্চিত করলেন, দূরদেশ?
-হ্যাঁ, তাই মনে হয়, কারণ চক্ষুর জ্যোতি কমে গেছে, মুখগুলো সব শুখাভুখা...। এই শব্দটির উপর সুরেলা টান দিল মঙ্গল। ও যেখান থেকে এসেছে সেই মহাস্থানগড়ের ঝোঁক।
বৌধায়ন নীরবে ওর দিকে তাকালেন। মঙ্গল মৃদুস্বরে নিজের যুক্তি খাড়া করল। অনেক দূরদেশ থেকে না এলে এমন যাযাবরদের মতো মুখ হবে কেন?
মঙ্গলের উপবৃত্তাকার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বৌধায়ন হেসে ফেললেন, ও তাই? চল দেখি...
ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল, অতিথি তিনজন নয়, চারজন। মোংলা যখন খবর শোনাচ্ছিল, আর একজন গৃহে প্রবেশ করেছেন। পশ্চিম মগধের একাংশে দুর্ভিক্ষ চলছে। ওই অঞ্চল থেকে ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে তিনজন নবীন গণিতচর্চাকারী এই কুসুমপুরে উপস্থিত। ওরা চলেছেন রাজগীর নগরীতে; তারই নিকটে, নালন্দায় গড়ে উঠেছে একটি বৌদ্ধবিহার; ওইখানে বৌদ্ধপণ্ডিতদের যাতায়াত বেড়েছে সেই সম্রাট অশোকের সময় থেকেই। ওই গ্রামেই গণিতবিদদের মহাসম্মেলন বসবে। সম্মিলন শেষে ওঁরা প্রথমে যাবেন উজ্জয়িনী, তারপর দক্ষিণে, মহীশূর। ওই নগরী এখন আধুনিক গণিতচর্চার নামী কেন্দ্র। ওদের বাসনা ওই নগরীতেই থেকে যাবার। পথিমধ্যে ওরা এসেছেন বৌধায়নের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে।
বসুবন্ধু বললেন, মহোদয় আপনিও আমাদের সহযাত্রী হউন।
বিশ্ববসু মাথা নাড়লেন, ঠিক কথা, আপনি থাকলে আমাদের বল বৃদ্ধি পায়।
আমি? বৌধায়ন কিঞ্চিত অবাক হলেন। আপনাদের কি বুদ্ধিবৈকল্য হল! আমি তো আপনাদের মতো ভাল বাগ্মী নই, কারণ, আপনারা তো জানেন--
তাতে কী? ভগদত্ত স্পষ্ট কথার মানুষ। আপনি এমন নতুন কথা শোনাবেন যে, তার দিকেই মনোনিবেশ করবেন শ্রোতারা, আর তাহলেই, আপনি যে কিঞ্চিৎ অস্পষ্টবাক, কেউ অনুধাবনই করবে না।
ভদ্রবাহু করতালি দিলেন, সঠিক কথা, যথার্থ বাক্য...।
ভদ্রবাহুর বয়স বৌধায়নের কাছাকাছি। সুঠাম, সুন্দর স্বাস্থ্য। বৌধায়ন এক বত্সর আগে চত্বারিংশৎ-এর চৌকাঠ পার হয়েছেন, ভদ্রবাহু এই বছরেই, আর মাত্র দু’টি পূর্ণিমা অতিক্রম করলেই ওই সংখ্যা চৌচাপটে অতিক্রম করবেন। ভদ্রবাহুর অনুরোধ সহজে উপেক্ষা করা যায় না। বৌধায়ন দোলাচলে পড়ে গেলেন।
পাঁচজন গণিতবিদ একত্রে থাকলে সর্ব সময় যে সংখ্যা নিয়েই কথা হতে হবে, তেমন কোনও হঠকারী অনুশাসন তো রাজ্যের বর্তমান অধীশ্বর, সম্রাট অশোকের প্রপৌত্র, সম্প্রতি মৌর্যের পুত্র, শালিশুক মৌর্য এখনও ঘোষণা করেননি। অতএব আলোচনা চলল কোনও শৃঙ্খল ছাড়াই।
ভগদত্ত বলল, এ রাজা হঠাৎ ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে...
বিশ্ববসু বললেন, হ্যাঁ একটু বেশিই ঘামাচ্ছে...কারণ ক্ষুধাকে ভোলাতে ধর্মতে জোর দিতে হয়...
বসুমিত্র মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, এ শুধু নিজের কথাই প্রচার করে চলেছে, বলছে ওর নামই নাকি সমগ্র রাজকর্মের অঙ্গীকার, সততার নিশ্চিতি...
ভগদত্ত বলল, হ্যাঁ তজ্জন্যই তো গব্যঘৃতের উপর এই শালিশুখ মৌর্যের চিত্র অঙ্কন করে বিক্রয় করবার পরিকল্পনা করেছেন হয়গ্রীব বৈশ্য এবং--
কী দিনকাল পড়ল, বিশ্ববসুর চোখে কপট বিস্ময়। গব্যঘৃতের ধারক পাত্রে গাভীর চিত্র নেই, আছে সম্রাটের ছবি অর্থাৎ তার দুগ্ধজাত ঘৃতের বিশুদ্ধতার দায় ধেনুটির নয়, দায় হল তারও চেয়ে সৎ গাভী শালিশুখের...
হা-হা-হা-হা। সমবেত হাসির উচ্ছ্বাসে যুবকটির বাক্য অসমাপ্তই থাকল।
হঠাৎ ভদ্রবাহু বললেন, অশ্বত্থামা পাহাড়ের গায়ে সম্রাট অশোক যেমন তাঁর অনুশাসন খোদাই করে বলেছিলেন, প্রতিটি প্রজা আমার সন্তানের মতোই আমার পরিবারের অঙ্গ, এও বোধহয় ওর পূর্বগামীর মতোই নিজের কীর্তি বজায় রাখতে নিজের কথা বলে চলেছে।
বৌধায়ন মাথা নাড়লেন, কথাটি সঠিক কী না মন্তব্য করব না, কারণ এ ভীষণ প্রতিহিংসাপরায়ণ, অতএব, বাক্যস্ফূর্তির সময় যথেষ্ট সংযম অবলম্বন করা দরকার আমাদের...। এরপর বাক্যালাপ আর অগ্রসর হল না। তাছাড়া রাত্রিও ঘন হয়েছে।
পরদিন প্রাতে ভ্রমণে বেরিয়ে আনন্দে ভরে গেল অন্তঃকরণ। যথানিয়মে সূর্য তার বিভায় ভরিয়ে দিয়েছেন সমগ্র চরাচর। সামনের জলাশয়ে জলকেলি করে বেড়াচ্ছে সুভদ্রাঙ্গীর পোষ্য রাজহংসীর দল। পদ্মপাতার উপরে জলফড়িং-এর স্বচ্ছ ডানায় সূর্যের কিরণ বিম্বিত হচ্ছে। এত আনন্দের উপকরণ থাকা সত্ত্বেও, বৌধায়ন মনের গহনে আজ এক ভার; ভদ্রবাহুর অনুরোধ। তাকে মান্যতা দিতে হবে। কিন্তু একটিই প্রশ্ন--গণিতবিদদের সম্মিলনে গিয়ে নতুন কী কথা শোনাবেন তিনি? কিছুক্ষণ পদচারণার পরে তিনি বসে পড়লেন ক্ষীরদ্রুমের পাদদেশে। নতুন কথা? নূতন কী বলার আছে? কী হবে তাঁর বিষয়? মকর দাঁতের মতো প্রশ্নসকল আঘাতে জর্জরিত করতে থাকল তাঁকে। নূতন কথা না বলতে পারলে, শুধুমাত্র শোভাবর্ধনের জন্য এমন সম্মিলনে যোগদানের কোনও অর্থ হয় না।
হঠাৎ নজর গেল সামনের দিকে। সুন্দর। এক কর্মান্তিকের পুত্রের এমন নাম ভাবাই যায় না! এ ছেলের রহস্য আজও ভেদ করতে পারলেন না বৌধায়ন। গোহাল থেকে বাইরে আসতে শুরু করেছে গরুর দল। এক-দুই-তিন-চার...।
বৌধায়ন ওর পাশে গিয়ে বসলেন। ছেলেটির হিসাবের পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিটি গরু নিষ্ক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সে এখন খড়ির খণ্ড দিয়ে মসৃণ কালো পাথরের উপর লিখে চলে হিসাব। যেই দশ পূর্ণ হয়, লেখে এক এবং তদসংলগ্ন একটি বিন্দু! এমনভাবেই একশোর হিসাবের সময় যে প্রতীক লেখে, তা একের পরে দুটি ক্ষুদ্র বিন্দু! সব মিলিয়ে এখন গাভীর সংখ্যা তিনশো সত্তর। এ ছাড়া আছে একটি মহিষ, যার নাম সুন্দর রেখেছে পিঙ্গলা। ওকে ক্রয় করা হয়েছিল গত বৎসর, কার্তিক পূর্ণিমার দিন থেকে একমাস ব্যাপী গবাদি পশুর যে মেলা চলে, গাজিপুরের সেই অনুষ্ঠান থেকে।
পরদিন সকালে বৌধায়ন আবার দেখলেন সুন্দরের গণনা পদ্ধতি। একই রকম সব। তবে ওই বিন্দু কিছুটা বড় হতে হতে ডিম্বের আকার নিয়েছে। পরপর আরও কয়েকদিন বৌধায়ন লক্ষ করলেন সুন্দরের হিসাব লিখন। ছেলেটি ওই ডিম্বাকৃতি প্রতীকেই স্থিত। আগে যা ছিল শূন্যস্থান, তা প্রথমে হল শূন্যবিন্দু আর এখন তার এক নিশ্চিত আকার! ডিম্বাকৃতি! এই নবীন কিশোর যেন তাঁর সঙ্গে ওই ডিম্বাকৃতি প্রতীকটির পরিচয় ঘটাতেই গৃহে অধিষ্ঠান করছে! এমনই মনে হল বৌধায়নের। সামনে পড়ে থাকা একটি ডিম্বাকৃতি উপলখণ্ড তুলে নিয়ে জলাশয়ে নিক্ষেপ করলেন। উপলটি জলে আত্মগোপন করতেই তাকে ঘিরে বৃত্তাকার তরঙ্গ উঠল, একটি-দুটি-তিনটি-চারটি। প্রতিটি রোমকূপ শিহরিত হল বৌধায়নের।
বন্ধু, পরিজনদের উপস্থিতিতে পুত্রকামেষ্টি যজ্ঞ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা গেল। যথেষ্ট পরিমাণে মাধ্বী এবং বারুণী মদ্যের সদব্যবহার করলেন সবাই। সর্বতোভাবে পরিতৃপ্ত বৌধায়ন চললেন ভদ্রবাহু এবং তাঁর তিন ছাত্রপ্রতিম বন্ধুর সঙ্গে। সারাদিন পদব্রজে চলবার পর সন্ধ্যাকালে গৃহ খুঁজে নিয়ে বিশ্রামের আয়োজন।
বিশ্রামের সময় কিছু গল্প হয়। ভদ্রবাহু বললেন দুই হস্ত দীর্ঘ সর্পের কথা। সে সর্পের ডানা আছে বাদুড়ের মতো, পাতলা চামড়ার...
বৌধায়ন বললেন, হ্যাঁ এরা রাত্রিকালে উড়িয়া বেড়ায় আর বিন্দু-বিন্দু মূত্র নিঃসরণ করে--
যথার্থ। ভদ্রবাহু মস্তক আন্দোলিত করলেন। অসতর্ক ব্যক্তির গায়ে ওই মূত্র পড়লে, দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষত উৎপন্ন করে।
ভদ্রবাহুর সঙ্গীরা মাথা নাড়া দিলেও, মুখাবয়বে অবিশ্বাসের ভাব ঠিকই দৃষ্টিগোচর হল বৌধায়নের। তিনি বললেন, যাদের অবিশ্বাস, তারা যেন মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ পড়ে নেয়, শুধু পক্ষযুক্ত সর্প নয়, বৃহৎ পক্ষযুক্ত বৃশ্চিক, বিশালকায় হস্তী, ব্যাঘ্র, সাহসী কুকুর এইসব প্রাণীরও সন্ধান পাওয়া যাবে সেই রচনায়। এ বহু পূর্বের কথা হলেও সব প্রাণী এখনও বিলুপ্ত হয়নি। অতএব রাত্রিকালে সাবধান, ঘরের বাইরে গিয়ে কোনওরকম চপলতা দেখাতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা।
এতসব হিংস্র প্রাণীর খবরে ভদ্রবাহুর সঙ্গীদের মুখ অচিরেই ক্ষুদ্রাকৃতি। চোখে ভীতভাব। বৌধায়ন কৌতুক অনুভব করলেন। আখ্যান শেষ হতে, এতটাই ভীত ওরা যে, পরস্পরকে জড়িয়ে নিদ্রা গেল! ঊষাকালে সব ভয় দূর হয়ে যায়। প্রাতঃকৃত্যের শেষে আবার পথচলা। পথিমধ্যে গণিত নিয়ে কোনও আলোচনা করলেন না পাঁচ গণিতজ্ঞ। আনন্দ কলরব করতে করতে পৌঁছে গেলেন গন্তব্যে।
নালন্দার সম্মেলনে বৌধায়ন বললেন শূন্য আবিষ্কারের কথা। শূন্য এক অদ্ভুত সংখ্যা। কোনও সংখ্যার সঙ্গে শূন্য যোগ করলে, সংখ্যাটির কোনও পরিবর্তন হয় না; কিন্তু সংখ্যাটিকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে তার মান হয় শূন্য! আবার ওই সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে, ভেবে দেখুন, কোনও মীমাংসা হবে না, সব অনন্তে পৌঁছে যাবে, এ আশ্চর্য নয় কী?
বলতে বলতে কল্পনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন বৌধায়ন। এই শূন্যের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করা গেছে দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতি!
শ্রোতৃমণ্ডলীর থেকে প্রশ্ন ছুটে এল, কীভাবে?
বৌধায়নের ওষ্ঠে স্মিত হাসি। ধরা যাক, সাত সহস্র চব্বিশ অঙ্কে প্রকাশ করতে হবে। আমরা কেমনে লিখি? সাত সহস্রের জন্য একটি প্রতীক, কুড়ির জন্য একটি এবং চারের জন্য আর একটি প্রতীকের সমন্বয় ঘটিয়ে। দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতিতে এর প্রকাশ খুব সহজ এবং সুবিধার। নিশ্বাসবায়ু গ্রহণ করলেন বৌধায়ন। এই উপায়ে সহস্রের ঘরে সাত, শতকের ঘরে আমার আবিষ্কার করা বর্তুলাকার শূন্যের প্রতীক, দশকের ঘরে দুই আর এককের ঘরে চার লিখলেই তা হবে সাত সহস্র চব্বিশ। বলতে বলতেই বৌধায়ন হাতে তুলে নিলেন একটি শুভ্র খড়ির মণ্ড। অন্ধকারের মতো কালো পাথরের দেওয়ালে সংখ্যাটি লিখে ফেললেন।
শ্রোতা আসন থেকে কোলাহল উঠল, সাধু সাধু...। দর্শনের নামী পণ্ডিত কুমারজীব স্বামী ধীরস্বরে বললেন, এ আবিষ্কার আমাদের জ্ঞানের দিগন্তকে আরও প্রসারিত করে দিল...
রুদ্রদামন উচ্ছ্বসিত, আধুনিক গণিতের জয়যাত্রায় আজ সংযোজিত হল এক নতুন কেতন!
আনন্দ-কোলাহলে ভেসে গেলেন পাঁচজন--ভদ্রবাহু, বসুমিত্র, বিশ্ববসু, ভগদত্ত এবং বৌধায়ন। গণিতবিদরা পুরস্কারে-পুরস্কারে ভরিয়ে তুললেন তাঁকে। ঘোষণা করা হল, উজ্জয়িনীর কোনও বিখ্যাত মন্দির গাত্রে খোদাই করে রাখা হবে শূন্যের এই প্রতীকটিকে!
গৃহে ফেরবার পথে বৌধায়ন একা। তাঁর মনে কণ্টক ফুটে আছে; আসলে এ তো সুন্দরের আবিষ্কার, ওরই পাবার কথা এই শিরোপা। কিন্তু এখন তো কলিযুগ। দ্বাপর যুগে ন্যায়পরায়ণতা কমে হয়েছিল সত্যযুগের অর্ধেক। সে যুগের শাস্ত্র পুরাণ। তারপরেই, কৃষ্ণ মারা যাবার পর, শুরু হয়েছে এই কলিযুগ। ন্যায়পরায়ণতা প্রত্যহ কমছে। এখন এই যুগের শাস্ত্র তন্ত্র। তাছাড়া, সামান্য এক রাখালের কথার কোনও গুরুত্ব নেই এইসব সম্মিলনে। ওরা নামী গণিতবিদ বৌধায়ন গুপ্তকেই মান্যতা দেবে। তবু, কুসুমপুরে এসে মনে হল, উপহার হিসাবে পাওয়া স্বর্ণসকল থেকে কয়েক মাষা স্বর্ণ তিনি ওই কর্মান্তিকের পুত্র সুন্দর রাখালের হাতে তুলে দেবেন।
*** *** ***
কে শূন্য আবিষ্কার করে বাহবা পেল, কে কয় মাষা স্বর্ণ পেল, কার মাথায় উঠল উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির অঙ্গন থেকে আনা নিম-বট-পিপুল পাতার কিরীট, সুন্দর রাখালের তাতে কিছু আসে যায় না। এক কাহন আনন্দ কম নেই তার, বরং কিছু বেশি; কারণ, কোনওরকম যাগ-যজ্ঞি-সাধনা ছাড়াই ভোর রাতের দিকে গোহালের ভেতর বিলাসী একটি অনিন্দ্যসুন্দর গাই প্রসব করেছে! স্ত্রী বাছুর। আদরযত্ন করবার পরে বাচ্চাটা একটু শান্ত হতেই মাথায় চিনাংশুক বস্ত্র বেঁধে নিল সুন্দর। হাতে নিল গাছের সরু ডাল দিয়ে বানান তার প্রিয় প্রাজন দণ্ডটি। উঠে বসল ইউক্লিডের পিঠে। সুন্দর হাঁক দিল, হোই...; কয়েক পল বিরতির পর কণ্ঠ এবং জিহ্বার সহযোগে আওয়াজ তুলল আহ্ আহ্...টা টা...ট্রা..ট্রা...ট্রা। ওষ্ঠ আর জিহ্বা সমন্বয়ে শিসধ্বনি করতে করতে চলল উত্তর-পশ্চিম দিগন্তের নীল পাহাড়ের দিকে। কিছুদূর যেতেই কী যেন মনে পড়ায় ইউক্লিডের মুখ ঘুরিয়ে দিল বৌধায়ন গুপ্তের সদর বরাবর। প্রণাম জানাবে সুন্দর। এতদিন যার আশ্রয়ে ছিল তাঁকে তো একবার কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে। লাগাম ধরে হাঁক পাড়ল হোই ইয়াঃ...। এ আদেশ অশ্বটির চেনা, সে থমকে দাঁড়াল। শুধু তার সোনালি বালামচি কম্পমান। প্রণামের শেষে, পিঠে দুবার চাপড় মেরে, লাগামের টানে ওর মুখ আবার ফেরান হল উত্তর-পশ্চিমে। এইবার জোরে তিনটি চাপড় দিল তার পিঠে বসা সওয়ার। ট্রা-ট্রা-ট্রা-ট্রা। এ সংকেতও অশ্বটির চেনা। ঘরে ফেরবার আদেশ। সেই ঘর যেখানে সুন্দরের অপেক্ষায় তার মাতাপিতা। দীর্ঘপথ যেতে হবে তাকে। তীব্র হ্রেষা-ধ্বনিতে ভরে গেল চারদিক। প্রতিধ্বনি ভেসে এল দূর বনাঞ্চল থেকে। একবার শিষ-পা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরক্ষণেই ভূমিতে পা রাখল চতুষ্পদ। তারপরেই, দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করল গান্ধার রাজ্যের অশ্ব।
হ্রেষাধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বৌধায়নের। সদর দিয়ে বাইরে আসতেই দেখতে পেলেন ধাবমান অশ্ব এবং তার আরোহীকে। ছেলেটির পীতাভ চুল উড়ছে হাওয়ায়, কখনও লুটিয়ে পড়ছে মসৃণ স্কন্ধদেশে। ঘন কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব তীব্রগতিতে ছুটেছে নীল পাহাড় অভিমুখে। গণিতবিদের সামনে এই ছবি ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। একটি বৃহৎ বিন্দু ক্রমশ ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রতর। আশ্চর্য! ওরা কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? তবে কি?...
বৌধায়ন গুপ্ত উচ্চগ্রামে ডাকলেন, সুন্দর সুন্দর...। প্রতিধ্বনি ফিরে এল শুধু। তারসপ্তকে কণ্ঠ ছাড়লেন, সুন্দ...র। নিজের স্বরের তীব্রতায় তিনি নিজেই বধিরপ্রায়; ক্রমাগত উচ্চকণ্ঠের নিনাদে গণিতবিদের স্বরভঙ্গ হল।
তবু তিনি বলতেই থাকলেন, সুন্দর, সুন্দর, সুন্দর...