সারা পৃথিবীতে এখন একটাই কথা। কোন দেশে কত মানুষ মারা যাচ্ছেন। কোন রাজ্যে কত মানুষ এই করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত এই আলোচনা সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এমনি মিডিয়া সর্বত্র। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এর একটা অন্যদিকও আছে। করোনার রাজনীতিকরণ বা বলা ভালো সাম্প্রদায়িকীকরণ। অনেকে বলতে পারেন ভারতে তো সমস্ত কিছু নিয়ে রাজনৈতিক কথা হয় সুতরাং এটা নিয়ে হবে এ আর নতুন কী? ইদানীং আরও একটা কথা চালু হয়েছে এটা রাজনীতি করার সময় নয়, বেঁচে থাকলে অনেক রাজনীতি করার সময় পাওয়া যাবে। এটা বলা হচ্ছে বটে কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনীতি হচ্ছে। করছেন কেউ কেউ খুব সূক্ষ্মভাবে।
ধরা যাক এই যে গত ১০ দিনে দেশের প্রধানমন্ত্রী ৪ বার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, সেটার মধ্যে কি রাজনীতি ছিল না? কেউ কি এটা অস্বীকার করতে পারবেন? যদি খেয়াল করা যায় প্রত্যেকবার উনি এসেছেন তাঁর বক্তব্য রেখেছেন কিভাবে তাঁর প্রশাসন এই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। প্রত্যেক বারের ভাষণেই উনি বলেছেন দেশবাসীকে কি করতে হবে দেশের জন্য কিন্তু একবারও বলেননি উনি কি করবেন দেশের মানুষের জন্য?
প্রথম যেদিন উনি দেশের লোকের সামনে এসেছিলেন তখন উনি কি বলেছিলেন? বলেছিলেন যে পরের রবিবার যেন ‘জনতা কার্ফু’ পালন করা হয়, এবং তাঁর মাঝখানে বিকেল ৫টায় যেন সমস্ত স্বাস্থ্য কর্মী এবং যারা নিত্যদিন মানুষের সহায়তা করছেন তাঁদের জন্য হাততালি, থালা, ঘণ্টা, কাঁসর বাজানো হয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এতে নাকি দেশের ঐক্যবদ্ধ ছবি পৌঁছবে বিশ্বের দরবারে। তারপর উনি এলেন ২৪শে মার্চ, সেদিন এসে মাত্র ৪ ঘণ্টার নোটিসে পুরো দেশকে স্তব্ধ করে দিলেন। অপ্রস্তুত মানুষজন, যারা মূলত খেটে খান তাঁরা তাঁদের সহায় সম্বল তুলে নিয়ে সংসারের সবাইকে নিয়ে যে যেখান থেকে পারলেন দূর দুরান্তের বাড়ির পথ ধরলেন। পথে অন্ততপক্ষে ২৫ জন মানুষের মৃত্যুও ঘটলো। তারপরে উনি আবার এলেন তাঁর ‘মন কি বাত’ নিয়ে, দুঃখ প্রকাশ নয়, শুধু বললেন যে অনেকের হয়তো অনেক অসুবিধা হয়েছে। উনি কিন্তু বুঝতে পারছিলেন যে লকডাউনের সিদ্ধান্তের জন্য চারিদিকে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে, তাই তিনি বিতর্কটিকে ঘোরানোর জন্য পরের বার ৩রা এপ্রিল আবার একটি ভিডিও মেসেজের মাধ্যমে দেশবাসীর জন্য একটি কর্মসূচী হাজির করলেন। অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন যে উনি অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা যেমন আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের নিজের দেশের মানুষদের কথা ভাবছেন উনিও হয়তো সেটা ভাবছেন বা সেই রকম ভাবে এই অসুবিধা থেকে বের হবার কোনও দিশা দেখানোর চেষ্টা করবেন, কিন্তু না উনি তা করলেন না, তার বদলে আবারও দেশবাসীকে ঠিক যেমন মাদারির খেলায় হয় সেইরকম ‘ বোল জামুরে’ বলে সুতোয় বেঁধে পুতুলের মতো নাচানোর পরিকল্পনা করলেন। বললেন ৫ই এপ্রিল রাত ৯টায় ৯ মিনিট ঘরের আলো নিভিয়ে মোমবাতি, টর্চ এই সব জ্বালিয়ে আবার একবার দেশের ঐক্য সামনে তুলে ধরার কথা বললেন। একবারও ভাবলেন না বিদ্যুৎ একটি বৃত্তের মতো চলাচল করে, চাহিদা এবং জোগানের তফাৎ হলে গ্রিড বসে যেতে পারে।
এতো কিছু কি উনি ভেবে করেন? অতীত অভিজ্ঞতা কি বলে? আগেও যখন নোটবন্দী বা জিএসটি চালু করেছিলেন, তখনও কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই করেছিলেন। ফলস্বরূপ যা হবার তাই হয়েছিল। ঠিক সেই ভাবেই এবারের এই লকডাউনের প্ল্যান। তাতে কে মরলেন কে বাঁচলেন তাতে কি দেশের প্রধানের কিছু আসে যায়? তিনি সমস্ত কিছুর একটা অতি সোজা সরল সমাধান বার করে আনেন, আর আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেকবার মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেন। ঠিক যেভাবে গত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিস্ঠতা নিয়ে জিতে আসার পর তিনি সংবিধানের ৩৭০ ধারা বা নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী আনলেন তাহলে কি তিনি একইভাবে এই মহামারী বা অতিমারীরও মোকাবিলা করতে পারবেন? তিনি কি সব পারেন?
এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু না’ই হবে। কারণ যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন এই ধরনের বিষয়কে বুঝতে গেলে তা কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় নি। একমাত্র কেরালা ছাড়া অন্য কোনও রাজ্য কিন্তু এই বিষয়ে কি করতে হবে তার পথ দেখাতে পারেনি। কেন্দ্রের তরফ থেকে এই করোনা যে ভয়ানক বিপদ আনতে পারে তা অবধি স্বীকার করা হয়নি। যদি একটু সচেতন হওয়া যেত তাহলে কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা আটকানো যেত। তার বদলে কখনও থালা বাজাও বা কখনও মোমবাতি জ্বালানোর মতো কর্মসূচী পালনের দিকে দেশের মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয়। তারপর সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রচার চালানো হয় সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে আর সেই প্রচারে ভুলে বেশ কিছু মানুষ সেই কর্মসূচী পালনও করেন। অথচ তাঁরা প্রশ্ন করতে ভুলে যান এই যে সমস্ত জায়গা থেকে খবর আসছে যে দেশের ডাক্তারেরা যারা চিকিৎসা করছেন তাঁরাই যথেষ্ট সুরক্ষিত নন, তাহলে তাঁদের জন্য কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত? তাঁরা প্রশ্ন করতে ভুলে যান এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়লেন তাঁদের কি হবে? তাঁরা কি তাঁদের কাজ ফিরে পাবেন? তাঁরা কি তাঁদের পরিবারের জন্য দুমুঠো খাবার পাবেন? তাঁরা কি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন? তাঁরা প্রশ্ন করতে ভুলে যান এই যে ২৫ জন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গেলেন তাঁদের কি দোষ ছিল? আর এখানেই প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচী সফল হয়ে যায়। উনি যেটা চান যে মানুষ আসল বিতর্ক থেকে সরে অন্য বিতর্কে মনোনিবেশ করুক, সেটাই এখানে জিতে যায়।
এরমধ্যে ঘটে যাওয়া তবলিগ জামাতের সমাবেশ এই বিষয়টিকে আরও একধাপ এগিয়ে করোনা সংক্রমণকে সাম্প্রদায়িক রূপও দিয়ে দেয়। নিশ্চিত বিষয়টি ভুল কিন্তু বারবার এই করোনা সংক্রমণে সাম্প্রদায়িকতা আনলে যা হবার তাই হয়, আলোচনার ভরকেন্দ্র অন্যদিকে ঘুরে যায়। আসলে সংখ্যাগুরু হিন্দুর একটা অংশ এতোটাই সাম্প্রদায়িক তাঁরা সব ভুলে আবারও সেই একই জায়গায় পৌঁছে যান, যে সমস্ত কিছুর জন্য ‘ওই ওরা’ দায়ী। এই অপর বানানোর প্রক্রিয়াতে বেশ কিছু মিডিয়ার ভুমিকাও যথেষ্ট ন্যক্কারজনক। কোথাও কোনও প্রমাণ না পাওয়া গেলেও করোনা সংক্রমণের জন্যেও মুসলমানদেরই দায়ী করা হয়।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও কি প্রধানমন্ত্রী পারবেন এই মহামারীকে তার স্বভাবসুলভ পদ্ধতিতে মাত করতে? অনেক সুবিধা ত্যাগ করে অনেক কিছু ত্যাগ করেও ভারতের মধ্যবিত্ত মানুষজন কিন্তু তাঁদের আত্মসম্মান এবং স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েও লকডাউনের সিদ্ধান্তকে মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন । অনেকেই হয়তো ভাবছেন যে যেদিন এই লকডাউন উঠবে সেদিন থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যা হাল তাতে কি ভারতের মানুষের আদৌ কোনও লাভ হবে? এখানে কিন্তু কোনও বিরোধীপক্ষ নেই, কোনও নিদিষ্ট পরিবারের প্রতি বিদ্বেষ নেই, কোনও জাতি বা ধর্মকে শুধু দায়ী করে কিন্তু দায় এড়ানো যাবে না, একটু ভুলের জন্য কিন্ত কোটি কোটি মানুষের জীবনে আশঙ্কা নেমে আসবে। এই মুহূর্তে যা দরকার তা হল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে এবং কিভাবে এই করোনার প্রতিষেধক বার করা যায় এবং তা খুব দ্রুততার সঙ্গেই করতে হবে, কিন্তু কি দেখা যাচ্ছে ? কখনও হাততালি দিয়ে ডাক্তারদের অভিনন্দন জানানো বা কখনও ঐক্যবদ্ধ ভারতের চিত্র তুলে ধরার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই চলছে না। এই পদ্ধতিতে কি কখনও এই ধরনের মাহামারী বা অতিমারী ঠেকানো যায়? এই মুহূর্তে সারা দেশের যারা এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ তাঁদের পরামর্শ নিয়ে, মানুষের মনে যে ভয় তৈরি হয়েছে তা থেকে বের করার সঠিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি সামনে আনতে হবে, তার বদলে অন্ধ কুসংস্কার যা দেশকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে সেই কর্মকাণ্ডকে রাষ্ট্র যদি প্রশ্রয় দেয় তা হলে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই হঠাৎ করে ক্রিকেট খেলার উন্মাদনায় পরিণত হবে এবং মানুষ তাঁর নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে একটি শোকস্তব্ধ পরিবেশকে হঠাৎ উৎসবে পরিণত করে ফেলবে, তাতে হিতে বিপরীতই হবে।