সদ্য অনুষ্ঠিত হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচন ছিল অনেক দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ। ফলাফলও হয়েছে সেরকম আকর্ষণীয়।
প্রথমেই আসা যাক এই নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল রাষ্ট্রীয় জনতাদলের কথায়। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা লালুপ্রসাদ যাদব ভারতের রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র। তাঁর পুত্র তেজস্বী যাদব এই নির্বাচনে প্রচারে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। ফলাফল যাই হোক না কেন, ৭৫টি আসন এককভাবে পেয়ে নিজেকে যুবনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সফল তিনি। গত লোকসভা নির্বাচনে বেগুসরাইয়ে হার থেকে শিক্ষা নিয়ে বামেদের সাথে জোটে আগ্রহী ছিলেন তেজস্বী। আরটিআই করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে 'আরবান নকশাল'দের সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে আগের নির্বাচনে ৩টি আসন থেকে এবার ১২টি আসনে উঠে এসেছে নকশালপন্থী সিপিআই (এম এল - লিবারেশন)। দলিত ভোট পেতেও ব্যাপক সাহায্য করেছে নকশালপন্থীদের সাথে এই জোট। সাথে সিপিআই ও সিপিআই(এম) দুটি আসনে খাতা খুলেছে। বেশ কিছু আসনে স্বল্প ব্যবধানে পরাজয় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দীর্ঘদিন পর ভারতে কোন নির্বাচনে কমিউনিস্ট দলগুলির এই সাফল্য নজর কেড়েছে। একেবারেই দরিদ্র বাড়িতে থেকে কাটিহার জেলার বলরামপুরে ব্যাপক ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ব্যবধানে জিতে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন লিবারেশনের মেহবুব আলম। ভোট ভাগাভাগির আশঙ্কায় তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন অল ইন্ডিয়া মজলিস এ ইত্তেহাদুল মুসলেমীনের তরুণ আইনজীবি আদিল হাসান। এই দল দল মধ্যবঙ্গ লাগোয়া সীমাঞ্চল অর্থাৎ আরারিয়া-পূর্ণিয়া-কাটিহার-কিষাণগঞ্জ জেলাগুলি থেকে পাঁচটি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। যার মধ্যে কংগ্রেস ও রাজদ-এর দুটি করে আর সংযুক্ত জনতা দলের একটি আসন ছিল। এই দলগুলির তরফ থেকে ভোট কেটে বিজেপিকে জেতানোর অভিযোগ প্রাপ্ত তথ্যের বিচারে নস্যাৎ হয়ে যায়। মিমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যতগুলি আসনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জিতেছে তারমধ্যে কেবলমাত্র তফশীলি জাতি সংরক্ষিত রাণীগঞ্জ আসনেই মিম ও মহাজোটের মিলিত ভোট এনডিএর সামান্য বেশী হয়। যদিও সেই আসনে নোটায় মিমের দ্বিগুণ ভোট পড়েছে। মিমের সাথে জোট করে একটি আসনে জয়ী হয়েছে বহুজন সমাজ পার্টি। সীমাঞ্চল লাগোয়া সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মধ্যবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর-মালদা-মুর্শিদাবাদ জেলাগুলোতে মিমের এই সাফল্যের কি প্রভাব পড়বে তা নিয়ে চিন্তায় মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি। অধীর চৌধুরীর বক্তব্যে যার ছাপ ধরা পড়েছে। ৭০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ১৯টিতে জেতার পর তাঁর বামফ্রন্টের সাথে জোট করে ১৫০টি আসনে জেতার স্বপ্ন চৌচির হয়ে গেছে।
প্রাক্তন বিদ্রোহী মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঞ্ঝির হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা আর সাহনীর বিকাশশীল ইনসান পার্টি পেয়েছে চারটি করে আসন। আসন সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ায় এনডিএতে যোগ দেওয়ার আগে অবধি এই দুটি দল মহাজোটেরই অংশ ছিল। বহুজন সমাজ পার্টির সাথে জোট না হওয়ার খেসারত মহাজোটকে দিতে হয়েছে বাছওয়ারা, টিকারি, বারাছাত্তি, সাক্রা, বেলহার, হিলসা, ঝাঝা, ভোরের মত আসনে।
দফাভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আসনপ্রাপ্তি বিচার করলে দেখা যায় যে এনডিএ প্রথম দফায় ৭১টি আসনের মধ্যে ২২, দ্বিতীয় দফায় ৯৪টি আসনের মধ্যে ৫১, তৃতীয় দফায় ৭৮টি আসনের মধ্যে ৫২টি আসনে জয়ী হয়েছে। যোগি আদিত্যনাথের মত নেতাদের এনে উগ্রপ্রচার, ঘরে ঘরে কান ভাঙানো এবং সর্বোপরি মুঙ্গেরে বিসর্জনের মিছিলে পুলিশের লাঠিচালনাকে কেন্দ্র করে অশান্তির ভরপুর ফায়দা নিয়েছে বিজেপি চম্পারণ, মধুবনী, দারভাঙায়। সম্প্রদায়গত ভোট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কেওটি, গৌড় বাউরাম, জলাএ, বিসফি, আউরাই, ঢাকা, সুপাউল, সুরসান্দ, ফোর্বসগঞ্জ, প্রাণপুর, জামুই প্রভৃতি কেন্দ্রগুলিতে মহাজোট মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরে প্রায় ভোটই পায়নি।
বহুমাত্রিক এই নির্বাচন ভারতের রাজনীতিকে কোন দিকে মোড় নেওয়াবে তা ভবিষ্যতই বলবে। এই নির্বাচন রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের জন্য এক বিশেষ শিক্ষাস্বরূপ।
বিহার নির্বাচন একদিকে বামপন্থীদের পুনরায় রাজনীতি চর্চায় ফেরত এনেছে, অন্যদিকে মিম-এর শক্তিবৃদ্ধি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জাতপাতভিত্তিক শাসক (বর্তমানে ক্ষমতায় থাক বা না থাক) রাজনৈতিক দলগুলিকে চিন্তিত করে তুলেছে, তাদের জমিদারি হিসেবে মুসলমান ভোট চলে যাবার ভয়ে। বিহার নির্বাচন রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে বাস্তব সমস্যাগুলিকে হাজির করতে সক্ষম হয়েছে অনেকটাই। কেবল ধর্ম ও জাতপাতের রাজনীতি যে দেশের মানুষ আর মেনে নেবে না, রুটি-রুজি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সামাজিক ন্যায় যে জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তার হদিশ দিয়েছে বিহার নির্বাচন। আর ওই বাস্তব জীবনের দাবিগুলিকে জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে মহাজোট কারণ সেখানে ছিল বামপন্থীদের উপস্থিতি।
মিম-এর ভোটপ্রাপ্তিতে দলটিকে বিজেপির বি টিম হিসেবে তুলে ধরার এক প্রচেষ্টা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জাতপাতভিত্তিক শাসক দলগুলি শুরু করেছে। কিন্তু কেন মিম-এর উত্থান ঘটল, সে ব্যাপারে কোন বিশ্লেষণ নেই। এতাবৎকাল পর্যন্ত মিম-এর বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর কোন ইতিহাস নেই। যেকোন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে লড়াই করার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। তাই মিম-এর নির্বাচনে দাঁড়ালে বিজেপির সুবিধে হবে বলে মিম বিজেপির বি টিম তা বলা যায় না। মনে রাখ দরকার এপর্যন্ত ভারতীয় মুসলিমরা ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির উপর ভরসা করেছিল। এমনকি তেমন কোন জাঁদরেল মুসলমান নেতাও তাঁরা তৈরি করেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরের মুসলিমদের উপরে দেশের শাসক দলের ধারাবাহিক আক্রমণের সময়ে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে টালবাহানা মুসলিম সমাজকে ওইসব মূলধারার তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। কাশ্মির, তিন তালাকের অপরাধীকরণ, বাবরি মসজিদ রায়, দিল্লি দাঙ্গা ও তৎপরবর্তীতে পুলিশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, এনআইএ কর্তৃক মুসলমানদের অনায়াসে সন্ত্রাসবাদি হিসেবে গ্রেফতার এই সমস্ত ক্ষেত্রে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির অনেকাংশেই নিশ্চুপ থাকা মুসলিমদের নিজস্ব শক্তিশালী দল গড়ে তুলতে উৎসাহী করে তুলেছে। মুসলমানদের সমস্যা ও জীবনচর্চায় কোন আগ্রহ ছাড়াই কেবল বিজেপির জুজু দেখিয়ে মুসলিম সমর্থন পাওয়ার রাজনীতি দুর্বল হতে শুরু করেছে। মিম-এর উত্থান সেই ফাঁককে পূরণ করতে চাইছে। তাই মিম-এর উত্থানের জন্য বিজেপিকে কৃতিত্ব না দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির আত্মসমীক্ষা করা দরকার।
মিম নিয়ে হইচই শুরু করার অন্যতম কারণ হল এতদিন বাদে নকশালপন্থী সিপিআইএমএল লিবারেশনসহ বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যকে পিছনদিকে ঠেলে দেওয়া। এইও বাংলায় বহু অঞ্চলে গরিব মুসলমানদের ভোটের সময় লেঠেল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি। মিম-এর উত্থান সেই ব্যবহার বন্ধ করে দেবে। সেই আশঙ্কায় ওই রাজনৈতিক দলের নেতারা কাতর। তাছাড়া আগেই বলেছি, কেবল বিজেপিকে হারানোর জন্য মুসলমাদের ব্যবহার করা ও সেই বিপুল জনগোষ্ঠির অগ্রগমনের জন্য কোনোরকম ভাবনাচিন্তা না করার নেতিবাচক রাজনীতি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে মিম। অনেকে বলছেন, মিম ভোট কেটে বিজেপি-জেডিইউর সুবিধে করতে না পারলেও তাঁদের জন্য নাকি হিন্দুরা মেরুকৃত হচ্ছে। কিন্তু বিহারে এত উগ্র যোগির প্রচারে যা হয় নি, তা কেবল মিম-এর জন্য পশ্চিমবঙ্গে হবে এমনটা ভাবা বাতুলতা।