যারা অভিজ্ঞ, যারা জিপিএস ব্যবহার করেন না, যারা স্বপ্নলোকে শিকারি তারা সকলেই জানেন যে পঞ্চাশ বছর আগে রাসবিহারীর মোড়ে একটি তেপান্তরের মাঠ ছিল। সেখানে দিবা-দ্বিপ্রহরে অথবা বিলম্বিত সকালে কয়েকজন দেবদূত নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্র করতেন। দৈবাৎ আমি সেখানে উপস্থিত হলে তাদের একজনের সঙ্গে এক গুপ্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই একজন নবারুণ ভট্টাচার্য। তিনি তখন থাকতেন ভবানীপুরে, আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে ১৪ নম্বর রাজেন্দ্র রোডে, গাঁজা পার্কের পাশে। সেখানে প্রথমদিন এরকম চিত্রনাট্য ছিল যে খালি গায়ে পৈতেধারী একজন প্রৌঢ় দাঁত মাজছেন। আমি তাকেই জিজ্ঞেস করি নবারুণ কোথায়? তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। আমি দেখি নবারুণের আধাখোলা ঘর। পরে জানতে পারি এই ব্যক্তি ইতিহাস প্রসিদ্ধ বিজন ভট্টাচার্য। যাকে অনেকে দেশের নাট্য-প্রতিভা বলে জানেন এবং তিনি প্রতিভা বলেই তার উপরে মিডিয়া সদয় হয় না। আমি একটু থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। ছোট ঘর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মায়াকভস্কির ছবি। নবারুণ আমাকে সতর্ক করে দেয়, যেন নাশকতার মূহুর্ত তৈরি হচ্ছে, যেন অদুরেই পেটো ফাটবে – এই তোষকে ঋত্বিক ঘটক ও বিজন ভট্টাচার্যের বমির দাগ আছে, এখানে কোনো মাজাকি চলবে না গুরু।
এই মাজাকি ছাড়াই আমরা দেখতাম রাসবিহারীর মোড়ে তখনও সভ্যতা সচল, বাঙালি তখনো এত খর্বকায় হয়ে যায়নি। ঐ মোড় দিয়ে আমাদের চোখের সামনে দেবদূতদের সাক্ষী রেখে কখনো দেবব্রত বিশ্বাস, কখনো আলি আকবর খাঁ, কখনো বিষ্ণু দে চলাচল করতেন। আর স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক রাজাধিরাজ-প্রতিম শুয়ে থাকতেন অধুনা লুপ্ত চন্দ্রকোনা স্টোর্সের সিঁড়িতে। এই যে অবস্থা এরমধ্যে থেকে নবারুণকে আমরা কিভাবে দেখব?
আজকে যখন নবারুণকে দেখা হয় তখন যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা নবারুণকে নিয়ে কথা বলে তাদের মধ্যে আমার কিঞ্চিৎ সন্দিগ্ধতা কাজ করে, এই যে উত্তর-বিশ্বায়ন নাগরিক আড্ডা, এই যে সিসিডি বা কাপুচিনোর চুমুকে সাহিত্য পড়ার মরাল-বিলাসিতা সেখানে তো চে গেভারা ভিয়েতনাম সবকিছুই টি-শার্ট। এই যুবক বা যুবতীরা খিস্তি-তরঙ্গেও একপ্রকার অজ্ঞাতকে জানার সুযোগ পেয়ে যায়। তারা নবারুণকে বিপন্ন ঘাতক মনে করবে? চুদুরবুদুর শব্দটি নিয়ে যে রসনাবিলাস তা নিয়ে আমি নবারুণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নতুন গন্ধনাশক বা নতুন বাথরুম টাইলসের মতো নতুন এ শহরের ভাষা, উদিয়মান মধ্যবিত্ত তারা তো, বাংলা উপন্যাসের দাম কম, সস্তায় বেঙ্গল প্যাকেজে তোমার কাছ থেকে আমোদ পেয়ে যাচ্ছে। এই আমোদ মধ্যবিত্ত অপরাধবোধকে প্রশমিত করার মুদ্রিত ভায়াগ্রা, যার সম্মানমূল্য আছে, তা কি তুমি জানো না নবারুণ? হয়তো নবারুণ জানতও, আমি তাকে একটু বিষণ্ণ দেখেছিলাম। আসলে ঐ যে সত্তর দশকের কথা বলছিলাম সেসময় রক্তে একটা বিষ ঢুকে গিয়েছিল। সেই বিষ আমাদের মনে করিয়েছিল প্রত্যাখ্যান শব্দটাই হচ্ছে মধুবাতারিতায়তের বাংলা অনুবাদ। তখন ঋত্বিক ঘটকের নামে সমস্ত বায়ু আর সমুদ্রের নোনা জল মধুগন্ধি হয়ে ওঠে। এই যে বমি করার স্বাধীনতা ঋত্বিক ঘটক আমাদের দিয়েছিলেন স্বাধীনতার সত্তর বছর পড়েও তা পুরনো হলনা।
নবারুণ প্রত্যাখ্যান করার কথা ভেবেছিল, সৌভাগ্যবশত তার পিতৃদেবও। এই প্রত্যাখ্যান করার কথায় আমরা দেখেছিলাম বাংলা সংস্কৃতিতে কিছু ক্রোশপ্রস্তর আছে, কিছু আলোকস্তম্ভ আছে। এবং নবারুণ জানতো ভাষা কোনো নবীন প্রণয়ীনী নয় যাকে আদর করার জন্য ভিক্টোরিয়ার ঝোঁপ থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আন্টি-ফ্যাসিস্ট পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। যেখানে শুড়িখানা সেখানে শুড়িখানার গন্ধ পাওয়াই শ্রেয়। নবারুণ জানতো, জীবনের বাল্য অভিজ্ঞতা থেকেই জানতো যে, অলীক অবাস্তব কিন্তু প্রত্যক্ষ এমন এক ধরণের ম্যাজিক তৈরি করাই শিল্পীর দায়িত্ব। সেই ম্যাজিক দিয়েই অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাকে স্বর্গে নিয়ে যেতে পারবে। নবারুণ যখন ছোটবেলায় বাবা’র সঙ্গে সুবর্ণরেখা’র স্যুটিং-এ যায় তখন ঋত্বিক ঘটককে সে কাজ করতে দেখেছিল, তবে সেটা বড় কথা নয়। ঋত্বিক ঘটককে সে ‘ঋত্বিক’ বলত। কিন্তু সে আমাকে চিরদিনই বলে এসেছে যে ঋত্বিক ঘটকের একটা ব্যাপার সে কোনোদিন বোঝেন। সীতা যখন পূর্ণ যুবতী তখন কি করে শিশু অভিরাম সেখান দিয়ে চলে যায়। এই দৃশ্যটির মর্মার্থ সে কোনোদিন উদ্ধার করতে পারেনি। বস্তুত এই মর্মার্থ উদ্ধার করার জন্যই, সভ্যতার এই উত্থান এবং যৌবনকে প্রত্যক্ষ করার জন্যই সে শব্দরাশির মধ্যে ঝাঁপ দেয়। এই যে শব্দরাশির মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া এব্যাপারেও নবারুণের নিজস্ব গল্প ছিল। খুব গম্ভীর হয়ে গাল চুলকোতে চুলকোতে সে একবার আমাকে বলেছিল, “ঋত্বিক ঘটককে ঠিক বোঝা হলনা”। সেটা খুব আশর্য কথা নয়। ঋত্বিক ঘটককে আমাদের কারোরই এখনো বোঝা হয়নি। ফলে আমরা মাঝেমাঝেই তার শরণাপন্ন হই। কিন্তু নবারুণ ভেবেছিল সেটা আশ্চর্য। হয়তো নবারুণকে স্মরণ করছি বলেই আমরা ঋত্বিক ঘটকের কথা মনে করতে পারি।
এই যে নবারুণকে আমি দেখেছিলাম সত্তর দশকের আদিপর্বে তখন নবারুণ কবিতা লিখত, এবং সেসব খুব রোমান্টিক লিরিক্যাল কবিতা, প্রেমিক প্রেমিকাকে যেরকম লেখে। সেসময় তার সবচেয়ে প্রিয় লেখা যা আমাদের সকলেরই প্রিয় প্রায় ঋকবেদের মতো, পাতলুন পরা মেঘ, ক্লাঊড ইন প্যান্টস, মায়াকভস্কি। সেই কবিতা পড়েই আমার মনে আছে নবারুণ ভিলানেল লিখল। সাহিত্যপত্রের সে তখন অন্যতম সম্পাদক, বিষ্ণু দে তাকে মনোনীত করেছেন। সে বিষ্ণু দে’র বাড়ি গেল এবং বিষণ্ণ মুখে বেরিয়ে এল। কারণ বিষ্ণু দে বলেছেন – এটা ভিলানেল হয়নি, ছন্দে ভুল আছে। নবারুণ রেগে গিয়েছিল। আসলে এই ছন্দে ভুল থাকা থেকেই সে বস্তুত গদ্যের দিকে চলে যায়। ‘প্রতিবিপ্লব জয়যুক্ত হোক’, ‘খোচড়’ এই গল্পগুলো যখন সত্তর-বাহাত্তর পর্বে যখন আমাদের এখানে ‘শান্তিপর্ব’ জারি আছে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সৌজন্যে তখন যেসব লেখা সে লিখেছিল সে লেখাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল আবর্জনার একধরণের মুখবন্ধ তৈরি করা। পরবর্তীকালে যখন নবারুণ আমার সঙ্গে কথা বলত তখন নবারুণ আমাকে বলেছিল, আশ্চর্য রবিবার ছিল তার ছোটবেলায়। যখন ঋত্বিক ঘটক তাকে নিয়ে টকি শো হাঊসে যেতেন এবং নবারুণ আমাকে বলত, ছবিটা তো আমি বুঝতাম না, কঠিন কঠিন ছবি – যেমন ‘লা স্ত্রাদা’ – এ আমি বুঝব কি করে। আমি তো চুপচাপ থাকতাম, ঋত্বিক আমাকে বলেছে লজেন্স দেবে, আমিও লজেন্সের জন্য চুপচাপ থাকতাম। বেরিয়ে যখন একটা দোতলা লাল ২বি-তে উঠতাম, কি আশ্চর্য টাইমং ভাই, সিনেমা-মেকারদের এরকম থাকে। আমি বললাম কেন? আমাকে নিয়ে বাসে দোতলায় উঠে যেত। আমি যখন বলতাম গল্পটা কি বলো, কি আশ্চর্য, এমনকি ‘লা দোলচে ভিতা’র গল্পও, ফরিয়াপুকুর থেকে ঠিক জগুবাবুর বাজারের মধ্যে শেষ করে দিত ঋত্বিক। এ এক অলীক সিনেমা স্রষ্টা যে জানতো পৃথিবীর যত মহৎ ছবিই হোক না কেন ফরিয়াপুকুর থেকে গাঁজা পার্ক সময় বাধা, ৩-৬, ৬-৯, ৯-১২টা এর মধ্যেই অমরতার সিঁড়ি।
সাহিত্যকে এই শব্দবন্ধ এই মিউজিক্যালিটি পেতে হবে। শব্দের মধ্যে অনন্ত অভিজ্ঞতাকে টেনে আনতে হবে। টেনে এনে তাকে ঐ তেপান্তরের মাঠের মধ্যেই জমি বিতরণ করতে হবে। ভেবে দেখলে দেখা যাবে যে ‘হারবার্ট’ থেকে সে যে লেখা শুরু করে যেখানেই যাক সে, তার বন্ধুদের কথা যখন সে বলে, অনন্য রায়ের কথা যখন সে বলে, ভোগী’তে উদ্ধৃত করে, সে যখন আলোর অপেরার কথা বলে, সব জায়গাতেই সে জানে একটা ফরিয়াপুকুর আছে একটা গাঁজা পার্ক আছে এবং শেষ পর্যন্ত একটা রাসবিহারীর মোড় আছে। নবারুণ অসময়ে চলে গেল কিনা তা নিয়ে আমার আগ্রহ নেই কিন্তু আমি জানি সে সময়ের কারুকার্য।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা ঃ মানস ঘোষ