কর্মসূত্রে ও শিক্ষাগ্রহণের জন্য মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয তথা দু- একটি পেশাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার সুবাদে এই সংক্রমনজনিত অতিমারির বাজারে অনলাইন বিদ্যাচর্চার যে বিপুলাকার সম্প্রসারণ ঘটেছে তার খবরাখবর সেই অনলাইনেই ই-মেইল, হোয়াটসএ্যাপ বা এসএমএস-এ পেয়ে থাকি। বুঝতে পারি যে, এই অতিমারির অবসরে শিক্ষক অধ্যাপক গবেষকরা প্রভূত পরিমাণে বিদ্যা-আলোচনা বা ওয়েবিনারে ব্যস্ত থেকে আমাদের জ্ঞানের গভীরতা ও পরিধিকে বাড়ানোর জন্য অপরিসীম পরিশ্রম করে চলেছেন। যেহেতু অর্থনীতির ছাত্র ও রাজনীতির কর্মী তাই সেই ধরণের আলোচনার প্রতি আগ্রহ সমধিক। তবে কোনো এক সময়ে সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সুবাদে সেই ইনসটিটুটটির প্রতিও দৃষ্টি রেখে থাকি।
কোভিড অতিমারির প্রথমদিকে আমাদের মত জ্ঞানী শিক্ষক বা হিসাবরক্ষকরা কোরোনাভাইরাস নিয়ে তেমন কোন আলোচনা করছিলাম না। যদিও চিন হয়ে তা ইতালি, ফ্রান্স জার্মানি, স্পেনের মত পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিতে বা আমেরিকায় তা পৌঁছে গিয়েছিল, অনেকানেক রুগি মারাও যাচ্ছিল, তবুও আমাদের মত বিদ্বজ্জনেরা তাকে পাত্তাই দিই নি কারণ ভগবান মোদিজি তখনও নিদ্রা যাচ্ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতাদিদি দেশের রাজার আগে কোভিডের ভয়াবহতাকে উপলব্ধি করলেও, যতক্ষণ না এদেশের ‘হ্যামলিন’-এর বাঁশিওয়ালা আমাদের ঘন্টা কাঁসর বাজাতে বলেছেন আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, মোদি হায় তো মুমকিন হায় ভেবে। যেই বাদ্যি সহযোগে ১৪ ঘন্টার লকডাউন তিনি ঘোষণা করলেন, অমনি হোয়াটসএ্যাপ বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র ১৪ ঘন্টায় ভাইরাসের শৃঙ্খল ভাঙার অকাট্য তত্ব তথ্য সহযোগে হাজির করল। ব্যাস! আমাদের মত বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞজনেরা গুরুবাক্য শিরোধার্য করে থালা বাটি ঘটি শাঁখ কাঁসর বাজালাম বারান্দায়, রাস্তায় মিছিল অবশ্য করিনি, ভদ্রলোক বলে কথা। ব্যালকনি থেকে গো করোনা গো বলেও বেশ শোরগোলও তুলেছি। ২২ মার্চের ১৪ ঘন্টা লকডাউনের কোচিং দেওয়ার পরে দেশগুরু বুঝলেন প্রশিক্ষণটি যথাযথ হয়েছে, তাই তিনি ২৪ মার্চ ৪ ঘন্টার নোটিশে দেশ জুড়ে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করে জানালেন যে কৌরবদের থেকে কোভিড বেশি শক্তিশালী বলে যুদ্ধজয়ে ১৮ দিনের বদলে ২১ দিন লাগবে। ইতিমধ্যে মহারণের দ্বাদশ দিবসে রাত ৯ টার সময় ৯ মিনিট আলো নির্বাপিত করে আলো প্রজ্বলিত করার নির্দেশ এলে তা যথাবিহিত পালন করা হল। এব্যাপারে সনদপ্রাপ্ত হিসাব রক্ষক বা মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ কোন ধরণের দ্বিধা দেখাননি। রাজার আদেশ শিরোধার্য করেছেন।
ধীরে ধীরে ৩ সপ্তাহ (২১ দিন) পার করে আমরা ৭ সপ্তাহান্তে উপস্থিত হলাম। কোভিডের অন্ত হলনা। মহারাজাধিরাজ এলেন প্রজাদের নির্দেশ দিতে। বললেন, আত্মনির্ভর ভব:। এতদিন ইংরেজিতে মেক ইন ইণ্ডিযা ছিল, এখন দেশি ভাষায় সেল্ফ রিলায়েন্সের কথা ঘোষিত হল। অবশ্য রিলায়েন্স ওদিকে আত্মনির্ভর হয়েছে দ্রুতই, বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতে, আমেরিকা থেকে সৌদি আরব হয়ে সংযুক্ত আরবশাহি পর্যন্ত, লক্ষ কোটি টাকার শেয়ার বেঁচে, তার উপরে কোন মূলধনী লাভ কর না দিয়ে, মুকেশ আম্বানি নিজের সম্পদ ১ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে গিয়েছেন ও বিশ্বের ৪র্থ ধনী ব্যক্তিতে উন্নীত হয়েছেন। যাকে বলে যারপরনাই আত্মনির্ভর। যাই হোক, দেশের রাজাধিরাজ যেই না বলেছেন আত্মনির্ভর, অমনি আমরাও শিক্ষক অধ্যাপক থেকে সনদপ্রাপ্ত হিসেবরক্ষক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী থেকে ভেটারেন্স ক্লাবের সদস্যবর্গ পর্যন্ত প্রতিদিন আত্মনির্ভরতার শ্লোগান তুলতে শুরু করলেন। যদিও আমাদে মত অর্থনীতি-বাণিজ্যের অধ্যাপক বা সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষকদের দেশের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে গবেষণা, চিন্তা ও প্রস্তাব দেওয়া উচিৎ, তবুও এতদিন ঘন্টা-কাঁসর- প্রদীপ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল ছিল না বা হীরকরাজা না বললে আগে বলা অপরাধ বলে বলা হয়ে ওঠেনি; যেই দেশগুরু বলেছেন যে, ভারত এবার বিশ্বগুরু হবে কোভিডের সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তরিত করে, আমরা সবাই হররোজ চতুষ্পার্শে ‘মানুষের বিপন্নতাকে সুযোগে রূপান্তর করে উন্নতির পথে যাত্রা’র ওয়েবিনার করতে শুরু করলাম। অতিক্ষুদ্র ঋণপ্রদানকারী সংস্থার কর্তা, স্ন্যাক্সের বিক্রেতা, ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া কোম্পানির মালিক, নামে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তা, বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বা বাণিজ্যের অধ্যাপক একদম রত্নখচিত বক্তারা কীভাবে এই দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ অবস্থাতে কাণ্ডারী হয়ে দেশকে আত্মনির্ভর করে তুলবেন তা নিয়ে বিদগ্ধ বিশ্লেষণ করতে লাগলেন।
কোভিডের এই সঙ্কট আমাদের নতুন নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে, মোদিজি যেমনটি বলেছেন। অতিক্ষুদ্র ঋণপ্রদানকারী সংস্থার কর্তা বললেন, তাঁদের ঋণ আদায়ে তেমন অসুবিধে নেই কারণ তাঁরা স্বল্প সুদের হারে (২৩-২৪% বার্ষিক) ঋণ দেন। এদিকে কিন্তু গ্রামে গঞ্জে ওই ঋণ আদায়কারীরা খাতকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করছে। স্ন্যাক্স কোম্পানিগুলি ঘরে বসা মধ্যবিত্তবাবুদের উপরে ভর করে ভালই ব্যবসা করেছে; তিনি বললেন আমাদের লাভ কমেনি। কমবেই বা কেন, চানাচুরের কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে আয়ুর্বেদিক মশলাদার চানাচুরের কথা বলে। এভাবেই অর্থনীতি বা বাণিজ্যের অধ্যাপকরাও দেশের মানুষদের আশার আলো দেখালেন। ঠিকইতো নিরাশার কীই বা আছে? খোদ আমেরিকাতে, যেখানে ২ লক্ষ মানুষ কোভিডে মারা গেছে, অর্বুদপতিদের সম্পদ বেড়েছে ৪২লক্ষ কোটি টাকার। কোভিড কালে বেকার হয়েছে প্রায় ৪ কোটি মানুষ। ওদিকে বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী আমাজনের মালিক জোফ বেজোসের সম্পত্তি বেড়েছে ৬ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার। একেইতো বলে সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তর। আগেইতো ভারতের মুকেশজির কথা বলেছি। কেবল তিনিই নন, কোভিড সঙ্কটের সুযোগে দেশের মানুষকে যে ভয় দেখানো হয়েছে তাতে সমস্ত ওষুধ কোম্পানিরমালিকদের সম্পদ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের মধ্যবিত্তকে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়াতে, ট্রেন বন্ধ রাখাতে শ্রমজীবী মানুষের রোজগার কমলেও টেলিকম কোম্পানির মালিক মিত্তলের সম্পদ বেড়েছে, যেমন বেড়েছে গৌতম আদানির সম্পত্তি। কোভিডের দৌলতে সিরাম ইন্স্টিটুট অফ টেকনোলোজির মালিক সাইরাস পুনাওয়ালার সম্পদ বেড়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকার। এরকম সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তর করার কথাই তো বলছেন দেশগুরুজি, এবং আমাদের আলোচকরা।
তবে কিছু মানুষ আছে যারা একদম কথা শোনে না। তাঁরা এমনিতে গুরুবাক্য মাথায় করে রামমন্দিরের জন্য মোদিজিকে ধন্য ধন্য করেন, জয়শ্রীরাম বলে শ্লোগানও দেন, কিন্তু কিছুতেই বিলিয়নেয়ার হতে চান না, আর চান না বলেই পারেন না। তাঁরা সঙ্কটকে একদম সুযোগে রূপান্তর করতে অদক্ষ। ওই যেসব অগুন্তি অতিক্ষুদ্র ঋণ বা মাইক্রোফিন্যান্সের খাতকরা তাদের যতই আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য ২৩-২৪% এর মত অতি অল্প সুদে ঋণ দিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠির মাধ্যমে আত্মনির্ভর হতে বলা হোক না কেন পারবেই না মুকেশজির মত কোভিডের সঙ্কটকে কাজে লাগাতে, খালি ঋণ মকুবের আন্দোলন করে দেশকে বিপদে ফেলতে পারবে। ওদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন বলেছে যে, ভারতে কোভিডের ফলে ৪০ কোটি শ্রমিকের দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভাবুন তো এই শ্রমিকগুলো কী বেইমান! সঙ্কটের সুযোগও নিতে শেখে নি। মোদিজি এত করে বলা সত্বেও শুনছে না। আম্বানি,পুনাওযালা, সাংভি (সান ফার্মা), আদানি, মিত্তল (এয়ারটেল), রেড্ডি (রেড্ডিজ ল্যাব), হামিদ (সিপলা) প্রমুখ কত কষ্ট করে সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তর করে দেশেকে সম্পদশালী করছেন, আর গরিবগুর্বো দারিদ্রসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা নাকি অতিমারির ফলে দ্বিগুণ হতে চলেছে। যদি ২৫% আয়ও কমে তাহলেও আরো ৩৫ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে চলে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই সব বেআক্কেলে বজ্জাত মানুষগুলোর জন্যই দেশের এই দুর্দশা। উপরের ১%, মানুষ, যার মধ্যে ওইসব আলোচক শিক্ষক অধ্যাপকরা না পড়লেও (হীনমন্যতায় ভোগা উচিৎ নয়, চেষ্টা করুন হবে, নিদেন একটা আকাশ কিংবা ফিটজিও তো খুলতে পারেন) কর্পোরেটের কর্তারা, সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষকদের কেউ কেউ অন্তর্ভুক্ত, যে পরিমাণ সম্পত্তির মালিক নিচের ৭০% মানুষের সম্পত্তি তার ৪ ভাগের একভাগও নয়। কোন প্রযুক্তি সংস্থার মুখ্য আধিকারিক (সিইও) একজন গার্হস্থ্য শ্রমিকের তুলনায় ২২, ২৭৭ গুণ আয করেন (বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে সিইওর তুলনা করায় রাগ করবেন না প্লিজ)। ওইসব গরিবদের জন্যই তো দেশের জিডিপি ২০২০-২১ এর প্রথম ত্রৈমাসিকে গত ত্রৈমাসিকের তুলনায় ৩২% কমে গেছে। এইসব দেশের শত্রু, দেশের সম্মানকে যারা ধুলিসাৎ করছে তাঁরা যে সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তর করতে পারবে না, এতো জানা কথাই।
তাই দেশকে আত্মনির্ভর করার আলোচনায়, সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তর করার এই মহতি যজ্ঞের শুভকাজে যেন কিছুতেই ওই সব হাঁটতে হাঁটতে মারা যাওয়া, রাস্তায় প্রসব করা, ট্রেন লাইনে শুয়ে কাটা পড়া, পরিযায়ী শ্রমিক বা তেলেঙ্গানা থেকে ২৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফরতে চাওয়া ১২ বছরের জামাল মাকড়ামের কথা কেউ উচ্চারণ না করে; তাছাড়া রাজাধিরাজের খাতায় তো পরিযায়ী শ্রমিকদের কোন হিসেবই নেই, ফলে তাঁরাও নেই, আলোচনাতেও নেই। এই আলোচনায় যেন কিছুতেই কাজ খোয়ানো ২ কোটির বেশি বেতনভুক কর্মচারীর কথা উচ্চারিত না হয়। শুভকাজে অশুভ বর্জন করতে হয়, যেমন হিন্দু বিবাহের সময স্বামীহারাদের, গর্ভগৃহে পুজার সময় দলিতদের।