তখন আমার বছর চারেক বয়স। ১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপ চলছে। বেশ কিছু খেলা দেখেছিলাম টেলিভিশনে। সেই বয়সে ফুটবল খেলা যে খুব ভালো বুঝতাম তেমনটা দাবি করি না। কিন্তু এটুকু বুঝেছিলাম আমার চারপাশের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষগুলো একটা নাম নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে রয়েছেন-‘মারাদোনা’। শুধু এইটুকুই যথেষ্ঠ ছিল ফুটবলপ্রেমী বাঙালির কাছে। একটা নাম-‘মারাদোনা’। আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সিধারী তাদের অধিনায়ক মারাদোনা। পেলে যদি ফুটবলমুখী বাঙালিকে ব্রাজিলের অনুগামী করে থাকেন তবে সেই আবেগে ফাটল ধরিয়ে এক বড় সংখ্যার বাঙালি মননে আর্জেন্টিনার নীল-সাদা এলবিসেলেস্তে জার্সির মায়াময়তা যিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি হলেন দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। বিশেষ করে ১৯৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপের মারাদোনাকে যারা দেখেছেন তাদের বক্তব্যে মারাদোনার মাদকতা এখনও অমলিন। না, ১৯৯০-এ ইতালি বিশ্বকাপে সেই অতিমানব মারাদোনাকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু যেটুকু পাওয়া গিয়েছিল তার নির্যাসও কিছু কম নয়। ফাইনালে জার্মানীর কাছে হেরে যাওয়ার পর মারাদোনার সেই কান্না। একটা হৃদয়ের আবেগ উজার করা অনুভূতি। একটা স্বপ্ন পূরণের কাছে পৌছে থেমে যাওয়ার আকুল অভিব্যক্তি সেই কান্না। আমাদের গলফ-গ্রীনের এম-আই-জি ব্লকের পাশের ফ্ল্যাটের রেফারী অজিত ঘোষ বলেছিলেন, ‘মারদেনা (মারাদোনাকে তিনি সবসময় মারদেনা বলতেন) জিতে গেল’। তখন বুঝিনি এই কথার তাতপর্য কি? পরে বুঝেছিলাম। মারাদোনারা সবসময় জিতে যান। মারাদোনার নিজের কথায় ঐ ফুটবলটাকে ধাওয়া করে ছুটে যাওয়া জীবনের সবথেকে সুখকর মুহুর্ত। যাঁর মধ্যে ফুটবলের এই উপলব্ধি রয়েছে তিনি তো ফুটবলকে জীবনস্রোতে পরিণত করবেনই। ১৯৯৪-এর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট বিশ্বকাপের সময় নিষিদ্ধ ঔষধ সেবনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে যখন বিদায় নিলেন বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে তখন তাঁর সেই চোখের জল ভাসিয়ে দিয়েছিল শত্রু-মিত্র সমগ্র ফুটবল বিশ্বকে। ২৫ নভেম্বর ২০২০, মারাদোনার পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের তিথি যেন আবারও প্রমাণ করে দিয়ে গেল যে আপামর বিশ্বের ফুটবলপ্রেমী মানুষের কাছে জীবনের আরেক নাম ছিল মারাদোনা। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার আগে পর্যন্ত ভীষণভাবে জীবন্ত ছিলেন তিনি। ফুটন্ত আবেগের প্রতীক ছিলেন ‘এল দিয়েগো’।
মারাদোনার আগেও আর্জেন্টিনীয় ফুটবলে অনেক মহাতারকা ছিলেন। ওমার সিভোরি, ডি স্তেফানো, মারিও কেম্পেসরা ছিলেন। মারাদোনার পরেও এসেছেন হিগুয়েন, আগুয়েরা, লিওনেল মেসিরা। কিন্তু তিনি দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা, তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম, তিনি অতিমানব, সুপার-হিরো। এলবিসেলেস্তেকে এতটা মহিমান্বিত আর কোনও আর্জেন্টিনীয় ফুটবলার এখনও পর্যন্ত করতে পারেননি। মারাদোনা নিজে অবশ্য একবার ‘এল ট্রিঞ্চে’ ওরফে টমাস কার্লোভিচ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টনার সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় কোনওদিন আর্জেন্টিনার বাইরে যাননি’। কিন্তু আর্জেন্টিনার নামকে যিনি ফুটবলবিশ্বের প্রতিটা কোণায় সম্ভ্রমের সঙ্গে পৌছে দিয়েছিলেন তিনি ‘এল দিয়েগো’।
মারাদোনাকে কখনওই আদর্শ পুরুষ বা অনুকরণযোগ্য বলা যায় না। সারা জীবন ব্যাপী শুধু বিতর্ককে তাড়া করে বেরিয়েছেন তিনি। হ্যাঁ বিতর্ক তাড়া করেনি তাঁকে, তিনিই যেন ঝাঁপিয়ে পড়তেন বিতর্কের ঘাড়ে। কারণ তিনি জীবনবোধকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবলের সাথেই শুধু নয় আবেগের সাথে। তাই মারাদোনা স্বতন্ত্র। সবার থেকে আলাদা। তাই নীল-সাদা জার্সির সর্বকালের সেরা দশ নম্বর অবলীলায় জানাতে পারেন ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত নৈকট্যের কথা। বাঁ-পায়ের সেই জাদুকর আবার কিভাবে জড়িয়ে পড়েন ইতালির নেপোলি শহরের অন্ধকার মানুষগুলোর সঙ্গে। সততই তাঁর মধ্যে স্ব-বিরোধিতা বিরাজমান তবু তিনি মহানায়ক। নিজেকে গুটিয়ে রাখতে শেখেননি তিনি কোনওদিন। আর্জেন্টিনার দরিদ্র এক পরিবারের তাঁর প্রজন্মের পঞ্চম সন্তান তাঁর সেই ছোটবেলা থেকেই একটা জিনিস আত্মস্থ করেছিলেন, কিভাবে ভীষণ জীবনী শক্তি দিয়ে বারে বারে ফিরে আসতে হয়। কিভাবে আগ্নেয়গিরির মতো সশব্দে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে হয় নিজের উপস্থিতি। ১৯৭৮-এ সিজার মেনোত্তি বাদ দিয়েছিলেন প্রতিভাবান কিশোর মারাদোনাকে বিশ্বকাপ দল থেকে। পরের বছরই অনুর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে বিজয়ী করে ‘এল ফ্লাকো’ মেনোত্তিকে বাধ্য করলেন তাঁকে সসম্মানে জাতীয় দলে গ্রহণ করতে। ১৯৮২-র স্পেন বিশ্বকাপে টাফ-ফুটবলের শিকার হলেন, ১৯৮৬-র মেক্সিকোতে দেখালেন তিনিই সেরা। তাঁর হাত দিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা গোল তাই তাঁর নিজের ভাষায় ‘হ্যান্ড অফ গড’। তিনি যে ফুটবল ঈশ্বর, বিতর্কের খাদ থেকে উঠে সেটা প্রমাণ করতে লেগেছিল মাত্র ৪ মিনিট। ‘হ্যান্ড অফ গড’-এর চার মিনিট পর তাই ইংরেজ খেলোয়াড়দের সাথে সারা বিশ্ব দেখল ফুটবল ‘গড’ যখন পা দিয়ে গোল করে তখন সেই গোলের মাধুর্যের প্রকাশের বিচ্ছুরণ কি অপূর্বভাবে হয়। আজও ইউ টিউবের কল্যাণে সেই গোলের রিপ্লে দেখলে মায়াময় মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। বার্সেলোনায় সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি দিয়েগো। কিন্তু নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় উন্নীত হলেন দক্ষিণ ইতালির তুলনায় এক অখ্যাত ক্লাব নেপোলি-তে। ইতালি সেরা করলেন নেপোলিকে। অবিশ্বাস্য অতিমানবীকতায় মাতিয়ে দিলেন সমগ্র ইতালিয় ঘরোয়া ফুটবলকে যা আর্জেন্টিনা থেকে এসে ইতালির জাতীয় জার্সি গায়ে চড়িয়েও করতে পারেননি ওমার সিভোরি ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে। তাইতো আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোচ কার্লোস বিলার্দো বলেছিলেন যে তাঁর আর্জেন্টিনা দল হল মারাদোনা ও অন্যান্য বাকি ফুটবলাররা।
খেলার মাঠে প্রতিটা মুহুর্তে প্রতিটা গোলের পর মারাদোনার উজ্জীবিত আবেগের প্রকাশ ছুঁইয়ে যেত দর্শকের মনের প্রতিটা আবেগের উপলব্ধিকে। আবার পরাজয়ে সেই আকুল কান্না। অতিমানব হয়েও কোথাও মানবিক জীবনের প্রতিটা আবেগকে মানুষের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারতেন ‘এল দিয়েগো’। এই আবেগের স্পর্শ পেয়েছিল কলকাতাও। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে যখন তিনি এসেছিলেন এই শহরে এক ফুটবল স্কুল উদ্বোধনের উদ্দেশ্যে। তিনদিনের নানাকর্মকান্ডে তিনি দেখিয়েছিলেন কলকাতা তথা বাংলাকে জীবনীশক্তি কতটা আবেগতাড়িত হতে পারে। কলকাতাও নিজেকে উজার করে সমর্পন করেছিলেন ফুটবল রাজপুত্রের পায়ে। মারাদোনা বলেছিলেন, নেপোলির পর একরকম আবেগঘন আপ্যায়ন তিনি আর কোথাও দেখেননি। কিন্তু নেপোলিতে তো তিনি খেলেছেন, তাদেরকে জিতিয়েছেন নামী-দামী ট্রফিতে। কিন্তু কলকাতাতে তিনি এসেছিলেন অতিথি হয়ে। খেলা ছাড়ার অনেক বছর পর। কলকাতা তথা বাঙালী আবেগ তাই শুধু খেলোয়াড় মারাদোনাকে নয় কুর্নিশ জানিয়েছিল জীবন্ত আবেগের অপর নাম দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে। সেই নিখাদ ভালোবাসাকে উপলব্ধি করে মারাদোনাও বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রয়োজন বিশ্ব ফুটবলকে আর বিশ্বফুটবলেরও ততটাই প্রয়োজন ভারতকে’। দ্বিতীয়বার ২০১৭ সালে নিজের মূর্তির উদ্বোধনের সময়েও নিজের সেই অফুরান জীবনমুখী আবেগের সাক্ষী রেখে গিয়েছিলেন কলকাতাবাসীকে। বর্ণময় আলোক ছটা সমৃদ্ধ চরিত্র মারাদোনার। নিজের জীবনাদর্শ তৈরী করেছিলেন নিজে। বাঁ-পায়ের ফুটবল জাদুর পাশাপাশি সবসময় পরিচয় রেখে গেছেন অফুরান জীবনী শক্তির। মৃত্যুকে আলিঙ্গনও করলেন যেন জীবনকে ছুঁয়ে। ৩০শে অক্টোবর ষাটতম জন্মতিথি অতিক্রম করার পরই ২৫শে নভেম্বর যেন নিজেই আলিঙ্গনবদ্ধ হলেন মৃত্যুর শীতল ছোঁয়ায়। থেমে গেল তাঁর হৃদস্পন্দন। অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল সারা ফুটবলবিশ্ব। মহানায়কের মহাপ্রস্থান। রয়ে গেল জীবনমুখী আবেগধারার অব্যক্ত স্রোত আর সেই মাতোয়ারা নাম ‘এল দিয়েগো’ মা-রা-দো-না।