অসুররা ভারতের তথা বাংলার আদিমতম উপজাতিগুলির মধ্যে একটি৷ অসুর জনজাতি ভারতের-ঝাড়খণ্ড, বিহার, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, ছত্রিশগড়, অসম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যায়৷ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, ডুয়ার্স, কোচবিহার, মালদা, পুরুলিয়া এবং দার্জিলিং -জেলার চা বাগান অধ্যুষিত এলাকায় দেখাও মেলে৷ এছাড়া ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল, গুলমা ও লোহারডাঙা জেলায় এদের বসবাস৷ অসুররা ছিলেন বৃহৎ বঙ্গের মানুষ৷ বৃহৎ বঙ্গ বরাবরই ছিল বৈদিক আর্য সংস্কৃতির বাইরে৷ মহাভারতের আদিপর্বে বলা হচ্ছে, অসুররাজ বলির পাঁচ পুত্রের নামে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুহ্ম রাজ্যের নামকরণ করা হয়েছে। বঙ্গ' থেকে 'বাংলা' নামের উৎপত্তি হয়েছে৷ বৌদ্ধদের প্রাচীন গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-তে বলা হয়েছে বঙ্গের ভাষা হলো অসুর জাতির ভাষা। বেশ কিছু পুরাণেও বাংলা দেশের লোকদের অসুর জাতিভুক্ত বলা হয়েছে।অসুর আদিবাসীরা "অসুরী" ভাষায় কথা বলে যা অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষার মুন্ডা এবং অসুররা অস্ট্রিক (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড) জনগোষ্ঠীর সাঁওতালি পরিবারের অন্তর্গত৷ অসুরজাতি সাদ্রি, নাগপুরি, ঝাড়খন্ডি, বাংলা এবং হিন্দি ভাষায়ও কথা বলে৷ বাঙ্গালীদের সবচেয়ে প্রাচীন পূর্বপুরুষ হলো নেগ্রিটোরা। বর্তমানে সাঁওতাল, ভীল, কোল, মুণ্ডা, হাড়ি, চণ্ডাল ও ডোম উপজাতি নেগ্রিটোদের উত্তরসূরী ৷ পন্ডিতদের মতে, অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়রাই বাংলার প্রাচীনতম জাতি৷ কিরাত নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে আর্যরা তাদের বৈদিক আর্য সাহিত্যে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী, কিরাতদের অনেকটা ঘৃনাসূচক ‘নিষাদ’ বলা হয়েছে৷ এরাই অ- বৈদিক অনার্য বলে অভিহিত৷ সিন্ধু সভ্যতাকে অনার্য সভ্যতা বলা হয়৷ আর্য (বৈদিক জনগোষ্ঠী) ভাষাভিত্তিক (সংস্কৃত ভাষা) ও সাংস্কৃতিক (দুর্গাপূজা) পরিচয়কে বোঝায়৷ ভারতে আর্যদের প্রথম লিখিত সাহিত্য ঋকবেদ (রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে) ৷ ভারতীয় সভ্যতার প্রথম যুগ থেকেই আর্যদের মূল মন্ত্রই ছিল সামাজিক বিভাজন৷ আর্য মনোবৃত্তির বিচারে অপর সকলেই ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ৷
পশ্চিমবঙ্গে তপশীলি উপজাতিদের যে সরকারি তালিকা আছে, তার মধ্যে প্রথম নামটিই এই অসুর উপজাতির৷ অনার্যদের মধ্যে যাঁরা আর্য প্রভুত্ব স্বীকার করে নিতেন তাঁরাই ছিলেন দাস - যাঁরা করতেন না তাদের দানব, রাক্ষস, কিরাত, গন্ধব, দৈত, কিন্নর, নাগ-নাগিন, পনি, নিষাদ, যক্ষ
বিদ্বেষমূলক ও ঘৃণাসূচক, অপমানসূচক বা নিকৃষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হতো৷ এরাই সব মিলে যে অসুর সম্প্রদায়, তারা আসলে মানুষই ছিলেন৷ যে সকল দাস ও দস্যুকে আর্যরা ধ্বংস করতে পারলেন না অথচ যারা আর্য প্রভুত্ব স্বীকারও করল না, তাদের রেখে দেওয়া হলো সমাজের অন্তজ -অস্পৃশ্য করে৷ বৈদিক সভ্যতা ও অসুর সভ্যতার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আসলে দেব (সুর-যাঁরা সুরা পান করত) ও অসুরদের মধ্যেকার এক কিংবদন্তি সংঘাত, যা পরবর্তীকালে পৌরাণিক রূপ ধারণ করে।
গবেষকদের মতে মহিষাসুর সংক্রান্ত যে লোককথা রয়েছে, তা প্রায় তিন হাজার বছর পুরনো, যখন আর্যরা ভারতে আসেনি৷ অসুর জাতির ইতিহাস আর্যদের পূর্ববর্তী যুগের ইতিহাস৷ অসুররা একটি আদিম উপজাতি যারা বিশ্বকে লোহা গলাতে শিখিয়েছিল৷ এর ফলে ইস্পাত উৎপাদন শুরু হয়েছিল এবং মানব জাতি তার বস্তুগত অগ্ৰগতিতে একটি বড় লাফ দিতে সক্ষম হয়েছিল৷ এর ফলে ভারতের ঝাড়খন্ডে ১৯০৭ সালে টাটা স্টিল কোম্পানি খুলল৷ আধুনিক স্টিল কোম্পানি অসুরদের পদ্ধতি অনুসরণ করেই ব্লাস্ট ফার্নেসে লোহা তৈরি করে৷ এখানেই যে প্রকৃতির লৌহ আকরের ভান্ডার - জামশেদজী টাটার বহু আগে সহজাত প্রবৃত্তিতে অসুররা বুঝেছিল৷প্রোটো অস্ট্রলয়েড গোষ্ঠীর মানুষ ভারতে প্রথম লোহযুগের (১২০০ খ্রীস্ট পূর্ব -১৮০০ খ্রীস্ট পূর্ব) উদ্বোধন করেছিল- ঝাড়খণ্ডের মাটিতেই৷ এ থেকে বোঝা যায় অসুররা ভারতের আদিম মেটালার্জিস্ট৷ হরপ্পা যুগের শেষে এই সময়েই শুরু হচ্ছে ভারতীয় মহাকাব্যের যুগ ৷ লোহজাতীয় ধাতুর উল্লেখ আছে বেদে- কিন্তু কারিগরদের সম্পর্কে এলিট পুঁথি নীরব৷ পুরো ঝাড়খণ্ড জুড়ে যে অসুরদের লোহা তৈরির আদিম কারখানা ছিল তা প্রমাণ করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট শিল্পী পদ্মশ্রী বুলু ইমাম, অসুরদের নিয়ে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত K.K.Leuva র বই -The Asur- A study of primitive Iron Smelters ৷
অসুররা তিনটি দলে বিভক্ত - বীর (কোল) অসুর, বিরাজিয়া অসুর এবং আগরিয়া অসুর৷
বিরাজিয়া অসুর হল চাষী, ঘুরে বেড়ায়৷ আগোরিয়া অসুর হল যারা আগুনের জন্য কাজ করে, যেমন লোহা গোলানো৷ সুপরিচিত নৃবিজ্ঞানী ভেরিয়ার এলউইন আগরীয়দের বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে "আগরীয় " ( The Agaria- Verrier Elwin) নামে একটি বই লিখেছেন৷
বীর অসুর হল বনে বসবাসকারী বা বনবাসী৷ বীর অসুরদের বিভিন্ন গোত্রও আছে৷ এদের সমাজে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের জন্য গিতিআড়া: বা যুবাগৃহ বানানো হয় ৷ এই গিতিআড়া: র ভিতরে নাচ গান শেখানো হয়ে থাকে৷ অসুর সমাজে কোনো কন্যাকে বিয়ে করতে হলে বর পক্ষকে " বধূমূল্য" দিতে হয়, যা এই প্রথা এখনো পর্যন্ত রয়েছে৷যে ঘর গুলোতে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা দেওয়া হত, সেই ঘর গুলোকেই "গীতি ওড়া" বলা হয়৷ ১৯৬০ এর দশকের মধ্যে গীতি ওড়া প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়৷ গীতি ওড়া মূলত শিশুদের সর্বাত্মক শিক্ষা প্রদানের কেন্দ্র ছিল৷ তাদের সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং লোককাহিনী এবং তাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কেও বলা হত৷ তাদের শিকার এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করা, নৃত্য ও সঙ্গীতের প্রশিক্ষণও দেওয়া হত৷ অসুররা মূর্তিপূজক নয়৷ প্রকৃতি তাদের জীবন দর্শনের মূল ভিত্তি৷তাদের প্রধান দেবতা সিংবোঙ্গা । অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে রয়েছে ধরতি মাতা, দুয়ারী, পাটদরহা এবং তুরি হুসিদ। তারা সারহুল, কর্ম, ধনবুনি, কাদেলতা, রাজ কর্ম, দশহারা করমের মতো উৎসব পালন করে। অনার্যদের প্রজাদরদী রাজা মহিষাসুর৷ মহিষাসুর সম্বন্ধীয় লোকগাথা (অসুর সহরুল) গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই পাওয়া যায়।ভারতে অসুর সম্প্রদায় , আদিবাসী (সাঁওতাল) সম্প্রদায়, দলিত ও শূদ্র সম্প্রদায়ে মহিষাসুর ও রাবনকে পুজো করতে দেখা যায়৷ আক্ষরিক অর্থেই তারা রাবণ এবং মহিষাসুরের বংশধর মনে করে৷ তার কারণ হয়তো বৈদিক আর্য সাহিত্যের ঐতরেয় ব্রাহ্মণে গ্ৰন্থে স্পষ্ট করে বলেছে- "শূদ্ররা নতুন কোন গোষ্ঠী নয়, নামভেদে মূল ভারতীয় অসুরেরাই শূদ্র হিসাবে কথিত৷" দেব ভে বর্ণ ব্রাম্মণ : অসুরা শূদ্র : বিদেশী আর্য দেবতারাই ব্রাম্মণ৷" ঐতরেয় ব্রাহ্মণে অসুরদের সঙ্গে দেব তথা আর্যদের লড়াইয়ের তথ্য পাওয়া যায়। বেদে ১০৫ বার অসুর শব্দের উল্লেখ আছে৷ তার মধ্যে ৯০ বারই প্রসংশা সূচক৷ বৈদিক যুগে অসুর অর্থ অশুভ বোঝাতো না৷ হরপ্পা বিশেষজ্ঞ ফিনল্যান্ডের আস্কো পার্পোলা তাঁর দ্য রুটস অব হিন্দুইজ়ম: দি আর্লি আরিয়ানস অ্যান্ড দি ইন্দাস সিভিলাইজ়েশন বইয়ে ভাষাতাত্ত্বিক উৎস দেখিয়ে বলেছেন ‘অসুর’ কথার অর্থ প্রভু, রাজপুত্র, দয়াশীল নেতা। নেদারল্যান্ডসের অসুর গবেষক এফ বি জে ক্যুইপার বলেছেন “অসুররাই হল উন্নত মানব সভ্যতার সৃষ্টিকারী।অসুরদের অবমাননা করা হয়েছে পৌরাণিক যুগে৷
"অসুর" প্রাচীন ইরানী জোরাস্ট্রীয় ধর্মের 'আহুর' (আহুর মাজদা) শব্দের সাথে সম্পর্ক রয়েছে৷হিন্দু ধর্মগ্ৰন্থ ও সাহিত্য (বেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও সূত্র)'অসুর' শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়, যা সাধারণত দেববিরোধী ৷জার্মানিক দেবদেবীদের সাথে"অসুর" ভাষাগত সম্পর্ক দেখা যায়৷ বৌদ্ধধর্মে অসুরদের (নেতাদের) অসুরেন্দ্র (Pāli: Asurinda) বলা হয়, যার অর্থ "অসুর-প্রভু"।ব্রাহ্মণেরা পুরাণ গ্রন্থ সমূহের মাধ্যমে বুদ্ধকে ‘অসুর’ বলতে শুরু করেছিল৷ব্রাহ্মণ শাসকরা কিভাবে অসুর সম্রাট কৃষ্ণ-মিথকে ফিরিয়ে আনে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রচারক হিসেবে- তার বর্ণনা রয়েছে কুলদীপ কুমার রচিত "গীতা এ বুক অব বাই ফর ক্রিমিনালস" বইটিতে৷
বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে (পুরানো নিয়ম) 'অসুর' বা 'অ্যাসেরিয়া' (Assyria) সাম্রাজ্যের কথা উল্লেখ আছে৷আসিরীয় সভ্যতার দেব-দেবী ও রাজাদের নামের সাথে 'অসুর' শব্দটি সম্পর্কিত ছিল, যেমন আসুর-বনিপাল (Asurbanipal), অসুর-সিরি-পাল (Asurnasipal)যা তাদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের অংশ৷মহান অসুর সাম্রাজ্যের সম্রাট আশুরবানিপালের লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩০,০০০-এরও বেশি মাটির ট্যাবলেট বা ফলক থেকে প্রাচীন অসুর সভ্যতার ইতিহাস জানা যায়।এটি অ্যাসিরিয়ান শহর নিনেভেহ বর্তমানে ইরাকে অবস্থিত৷নেপালের ফার্পিং-এর কাছে অবস্থিত ইয়াংলেশো পাথরের গুহাটি "অসুর গুহা" নামে পরিচিত৷ভারতের মধ্য প্রদেশে মহিষ রাজ্য ছিল, যার রাজধানী ছিল মহিষ্পতি নগরী। (Harivansa,I.14). অনুরূপভাবে ৮২৪ খৃষ্টাব্দে পাওয়া উড়িষ্যাতে তাম্রপত্র অভিলেখনীতে মহিসক অর্থাৎ মহিসক জিলার বর্ণনা পাওয়া যায়। উড়িষ্যা অভিলেখনীতে খারবেল নিজেকে ‘মহিসকাধিপতি সিরি সদ’ বলেছেন। (History of Odisha, Manas Kumar Das, P-38).৷ খাজুরাহোর যে বিশ্বখ্যাত মন্দির, সেখানেও মহিষাসুরের মূর্তি আছে৷ উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখন্ডে একটি মন্দিরে মহিষাসুর পুজো হয়৷ ভারত সরকারের আর্কিওলজিকাল সার্ভের সংরক্ষিত একটি নিদর্শন যার নাম মহিষাসুর স্মারক৷ (কুলাপাহাড় থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চাউকা নামে অবস্থিত)৷ মহীশূর শহরটির আদি কন্নড় নাম ছিল "মহিষাসুরানা ওরু", যার অর্থ মহিষাসুরের শহর। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি অসুররা বছরের দুবার অসুর পুজো করেন -একবার ফাল্গুন মাসে, আরেকবার দশেরার সময় ৷কোচবিহার জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত শুকানুকুটি " অসুর গ্ৰাম " বলে পরিচিত৷ পুরুলিয়া ভেলাগড়া গ্ৰামে নবমীর দিন পালন হয় " অসুর উৎসব"৷ এখানে অসুরের বড় মূর্তি নির্মাণ করে স্মরণ সভা চলে ৷ এরপর ঝুমুর, ছৌ, কাঠি নাচের অনুষ্ঠান৷ ছৌ নাচেও উঠে আসে অসুরবধের আখ্যান৷ পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি অঞ্চলের কেন্দাশোল গ্রামে ও ঝাড়খন্ড এবং উত্তরাখন্ডের সীমান্তের আলিপুরদুয়ারা জেলার মাঝেরডাবরি এলাকার একটি গ্রাম ‘অসুর গ্রাম’-এ অসুরদের পূজা করা হয়৷
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের "অল ইন্ডিয়া ব্যাকওয়ার্ড স্টুডেন্টস ফেডারেশন (AIBSF) এর উদ্যোগে কয়েকবছর ধরে মহিষাসুর শহীদ দিবস পালন করা হয়৷ অসুর উৎসব, মহিষাসুর শহীদ দিবস, মহিষাসুর স্মরণ সভা ইত্যাদি নামে পশ্চিমবঙ্গে সাতে সাত হাজার অনুষ্ঠান হয়৷ এই সব অনুষ্ঠানে পশ্চমবঙ্গ সরকারের কোনো অনুদান পাওয়া যায় না৷ আদিম সান্তাড় রামেশ্বর মুর্মু রচিত "জাহের বঙ্গা সান্তাড় ক" গ্রন্থে হুদুর দূর্গার কথা জানা যায়৷
সাঁওতালদের দাঁসাই পরবের লোককথাতেও মা দূগা ছলনাময়ী নারী৷ ওদের রাজা ছিলেন হুদুর দুর্গা৷ অসুর দলনেতা হুদুড় দুর্গাকে বধ করায় তার নাম রাখা হলো দুর্গা। আদিবাসী ভাষায় দুর্গা অর্থ- সেনানায়ক আর হুদুড় দুর্গা অর্থ মহাসেনানয়ক।আদিবাসীদের নবপত্রিকার পুজো হয় ,এটাই আধিবাসীদের প্রকৃতি পুজো৷আবার তামসিক পদ্ধতিতে যে দুর্গাপূজা হয়, সেটা তো কিরাত, শবরদের পুজো৷ শারদ মাসতো আধিবাসীদের দাসাই মাস৷ সেই মাসের ষষ্ঠী, সপ্তমী থেকেই শুরু হয় শোক পালন৷ দাসাই, ভুয়াং এগুলো চলতে থাকে পাড়ায় পাড়ায় আর দশমীর দিন হয় বড় অনুষ্ঠান৷ কোথাও অরন্ধন পালন করা হয় ৷ কেঁদে কেঁদে গান করে -- "ওকার এদম ভুয়াং এদম জনম লেনা রে, ওকার এদম ভুয়াং এদম বছর লেনা রে"৷ এ যেন দুর্গা পুজোর অ্যান্টিথিসিস৷ সাঁওতালরাও দুর্গা পুজোর সময় ন'দিন কাঁদে৷শেষদিন মেয়েদের মতো শাড়ি ব্লাউজ পরে কেঁদে ঘোরে৷ অসুর ও সাঁওতাল সম্প্রদায় মহালয়ার দিন থেকে শোকপালন শুরু করে (কেবল আদিবাসীদেরই শোকের দিন নয় সমস্ত মূলনিবাসী অনার্য মানুষদেরও শোকের দিন) এবং কোনো ঘরে দশমি পর্যন্ত আলো জ্বলে না৷৷ বুক চাপড়ে কাঁদবে ঘরে দুয়োর এঁটে৷ তারপর একটা শশা খায় - মহান রাজা মহিষাসুর - যে তোমাকে মেরেছে তার প্রতিশোধ নিলাম, এই তার কলিজা খেলাম ,শসা হয়ে যায় সেই ছলনাময়ী নারীর কলিজার প্রতীক৷ বাংলার উত্তর অংশের একটা জনগোষ্ঠী দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি থেকে আড়াল করে রাখেন নিজেদের৷ শুধু আড়ালই নয়, মা -দুর্গার মুখ যেন দেখতে না হয়, তাই বাড়ির চারপাশ কালো কাপড় ঢেকে রাখে ৷ তাঁদের বিশ্বাস, মহিষাসুর তাঁদের পূর্ব পুরুষ৷ এরা কেউ রাবনের কুশপুতুল পোড়ায় না ৷ পরিবর্তে তারা দশেরার দিন রাবণ এবং মহিষাসুরের পূজো কোথাও ভৈঁসাসুর, কোথাও মাইকাসুর আবার কোথাও মহিষাসুর নামে তাঁর পুজো দেন দলিত শ্রেণীর যাদব আর পাল বংশীয় মানুষ৷
ঝাড়খেন্ডর সমাজকর্মী ও কবি সুষমা অসুর বলেন - সম্প্রদায়গত সোহরাই উৎসব পালন করে সময়টা দেওয়ালির কাছাকাছি৷ মহিষাসুর বধের দিন আমরা শোক পালন করি৷’ ঠিক একই ভাবে রাবণ বধের দিনও শোক পালন করেন অসুর সমাজের এই মানুষরা৷ যার নাম সোরাই৷ কী করা হয় সে দিন ? করঞ্জের তেল নিজের নাভি, নাক আর বুকে লাগান এই সম্প্রদায়ের মানুষ৷ সুষমার কথায় , ‘ওই তেল আমাদের বংশপতির চোট আঘাতকে মনে করিয়ে দেয়৷" আরও বলেন "আমাদের সম্প্রদায়ের যে ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে যায়, জানেন তাঁদের প্রায়শই রাক্ষস বলে খেপানো হয়৷ লাঞ্চনা ,নিপিড়ন ,অবেলায় অসুর সারনেম বদলে নিচ্ছে অনেকেই, স্কুলে ঢেলাও ছুড়ে, অসুর যে খারাপ তা বলে, মেরে দাও অসুরকে৷ মায়েরা বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়৷
এত অবহেলার মধ্যেও অসুর সাহিত্যের একমাত্র প্রকাশিত রচনা অসুর সিরিং ( কবিতা সংকলন, ২০১৬) ৷ সুষমা অসুর এবং বন্দনা তেতে এই বইটি সম্পাদনা করেছেন, যাতে অসুরদের ঐতিহ্যবাহী গানের পাশাপাশি নতুন গানের সংকলন রয়েছে৷ এটি রাঁচি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল৷এছাড়া বাংলায়ও অতুল সুরের "বাঙ্গালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়৷ নীহাররঞ্জন রায়ের "বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব"৷ স্বপন কুমারের বৌদ্ধ ধর্ম্ম সিন্ধু-হরপ্পা কালের ভারতীয় ধর্ম্ম"৷ পরিমল হেমব্রমের "সাঁওতালি সাহিত্যের ইতিহাস" ৷ সুমন কল্যাণ মৌলিকের "অথ মহিষাসুর কথা" ৷ সুহৃদ কুমার ভৌমিকের "আর্য রহস্য" ৷ চুমকি পিপলাই-এর "অসুর : অতিকথন ও গোষ্ঠী পরিচয়" ৷ ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের "বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রাক-প্রভাব"-। সুনীল কুমার রায়ের "অসুর জাতি, অসুর মত, অসুর ভাষা এবং আসুরী মায়া"৷ সুনীল কুমার রায়ের "ইতিহাসে নমজাতি"৷ ইত্যাদি গ্ৰন্থে অসুর সমাজের মানুষদের সাহিত্য কীর্তি।অসুরদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ,ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণিত হয়েছে।এছাড়া Anand Neelakantan তাঁর "Asura Tale of the Vanquished The Story of Ravana and His People" বইয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে অসুর সাম্রাজ্যে কিভাবে আর্য আক্রমণ ঘটেছিল, এবং কিভাবে অসুর সাম্রাজ্যের শহর, নগর, স্কুল, বিহার ধ্বংস করেছিল। অসুর সাম্রাজ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল-তাও বর্ণিত হয়েছে।
অসুররা উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল, বৈদিক সাহিত্যে তার উল্লেখ পাওয়া যায়৷ মহাকাব্যের যুগেও তার নিদর্শন আছে৷ কিন্তু প্রাচীন যুগের রাজনৈতিক সংঘর্ষের জের আধুনিক গণতান্ত্রিকন ভারত আজও টেনে যাবে এ কেমন কথা? দেবাসুরের সংঘর্ষ ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক যাই হোক, ওই অসুর নামে ভারতের একটি তপশীলি উপজাতি গোষ্ঠী বিভিন্ন রাজ্যে বর্তমান৷ বাংলার শব্দ ভান্ডার ও বাঙালির মনে অশুভ অর্থে অসুর শব্দই বা ব্যবহার করতে হবে কেন? একটা সম্প্রদায়কে এই ভাবে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া কি ঠিক?
পঞ্চদশ শতকে কৃত্তিবাস ওঝা অকালবোধন তত্ত্ব এনে বাংলায় নিজস্ব অসুর সংস্কৃতির সর্বজনীন শারদ উৎসব মোকাবিলা করার জন্য দুর্গাপুজো তত্ত্ব প্রচলন করলেন৷ বর্ষার শেষে শরৎকালে এই বঙ্গের নিজস্ব সংস্কৃতি, শাকম্ভরী এবং নবপত্রিকার উৎসব পালিত হত প্রতিটি ঘরে৷ সেই উৎসব প্রকৃতই ছিল সর্বজনীন শারদোৎসব ৷ এই শারদোৎসব শেষ হত গাসি পরবের মধ্যে দিয়ে৷ গাসি পরব ঘরে ঘরে পালিত হত৷ ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকরা অসুর সংস্কৃতিকে দমন করে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন যা মহীরুহ রূপ ধারণ করে পলাশী যুদ্ধের পরে৷ এই ভাবে ব্রাহ্মণরা অনার্য জাতির ইতিহাস প্রায় মুছে ফেলে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বলে দুর্গাপূজা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ গূঢ় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং সাম্রাজ্যেবাদী বাসনা নিয়ে চলছে বাঙালি সংস্কৃতির মহোৎসব৷ সংস্কৃতির নামে একটি সম্প্রদায়ের প্রতি ধর্মীয় মোড়কে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে ঘৃণার বার্তা দেওয়া হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সবর্ণ সমাজ কখনও প্রশ্ন তোলেনি! অসুর সম্প্রদায়কে অশুভ তকমা লাগিয়ে অসুর নিধন প্রদর্শনী করা, অস্পৃশ্যতার চেয়েও এক কাঠি বেশি৷ এই জাতীর সংস্কৃতিচর্চা তপশীলি নির্যাতন আইনে অভিযুক্ত হওয়ার যোগ্য নয় কি? এখানে " বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য" একটি প্রহসনের মতো লাগে৷
তথ্য সূত্র:
১। অসুর জনজাতি- সাঁওতালি জিকে ২৪ এপ্রিল২০২৪
২। ওঁরা এখন মন্ডপে যান, দুর্গার উপর রাগ খানিক কমেছে মহিষাসুরের বংশধরদের৷ - আজতক বাংলা, ১ সেপ্টেম্বর ২০২২।
৩। অসুর সম্প্রদায় ভারতের প্রথম মেটালার্জিস্ট-লোককথা ও ইতিহাস - শর্মিষ্ঠা দাস (৩১ মার্চ ২০২১), ইতিহাস তথ্য ও তর্ক, ইতিহাস আড্ডা
৪। দুর্গা - মহিষাসুরের যুদ্ধের ভিন্ন যে কাহিনীতে বিশ্বাস করেন অসুরের বংশধরেরা- অমিতাভ ভট্টশালী( ১১ অক্টোবর ২০২৪) বিবিসি নিউজ বাংলা
৫। বীর, বিরাজিয়া ও আগারিয়া অসুর এবং তাদের অতীত- রাজন কুমার (৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭)