পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শীতকালের রাত

  • 06 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1844 view(s)
  • লিখেছেন : সাদিক হোসেন
প্রগতিশীলতা এক মনোমুগ্ধ বুদবুদ। উড়ন্ত। ভাসমান। হাল্কা ও স্বচ্ছ। সূর্যকিরণে তা চকচক করে। কবিতায় তা হয়ে ওঠে স্বর্ণাভ। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাকে ছোঁয়া যায়। হারমোনিয়ামের প্রতিটা রিডে তারই শরীর। আবার এই শরীর যেহেতু ঈশ্বরতুল্য, তাই তা একই সঙ্গে অলীক ও অসীম। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে আজ তিরিশ বছর কেটে গেছে, একজন মুসলমান যুবকের কী অনুভূতি হয়েছিল সেদিন, আজ ই বা তিনি কী ভাবেন... ছবি - আনখ সমুদ্দুর।

বাংলা সাহিত্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে খুব বেশি গল্প/উপন্যাস লেখা হয়নি। এর কারণ কী হতে পারে, তা নিয়ে, একটা চালু মত রয়েছে - যেহেতু কলকাতা তথা বাংলায় বাবরি ধ্বংসের পর সেইভাবে সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয় হয়নি, সেজন্য এর প্রভাবও সাহিত্যে কম এসেছে। অথচ একজন মুসলিম পরিবারে বড়ো হয়ে ওঠা আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু ভিন্ন। '৯২ সাল আমাদের শিখিয়েছে সংখ্যালঘু হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ কী। রক্তক্ষয় প্রতিনিয়ত হয়েছে - কারণ এই মসজিদ ধ্বংস করে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাধীন ভারতবর্ষে আমরা ততটুকুই স্বাধীনতা পেতে পারি যতটুকু স্বাধীনতা সংখ্যাগরিষ্ঠরা আমাদের জন্য বরাদ্দ করবে। বস্তুত, স্বাধীনতা, এক্ষেত্রে পদদলিত করবার একক মাত্র। এই এককের মাধ্যমে জানা যাবে কতটুকু দমিয়ে রাখা হয়েছে, বা আরও কতটুকু দমিয়ে রাখা প্রয়োজন। বাবরি মসজিদ ধ্বংস শুধু যে একটা ধর্মীয় গোষ্ঠীকেই চিরকালের জন্য কোণঠাসা করে দিল তাই নয়; ভারতের রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়ল। ৯২' এর পর থেকে ভারতের রাজনীতি মুখ্যত হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারাই চালিত হয়েছে।

 

বাংলায় শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে যেমন মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় নেই; গদ্য সাহিত্য কিন্তু তেমন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে, প্রায় প্রতিটি দশকেই শক্তশালী মুসলমান লেখকদের আমরা পেয়েছি। তাঁরা মূলত মুসলমানদের মধ্যেকার সমস্যা নিয়েই লিখেছেন। মুসলমানদের ভেতরকার ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয় শিল্পসম্মতভাবে তাঁরা উপস্থিত করেছেন বিভিন্ন আখ্যানে। কিন্তু বাবরি পরবর্তী সময়ে হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসনে কীভাবে মুসলমানদের কোণঠাসা করা হয়েছে, কীভাবে তাদের দৈনন্দিনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে - তার বিস্তৃত আখ্যান এখনো আমরা সেইভাবে পাইনি। তাহলে কি আমাদের প্রগতিশীলতার চর্চার মধ্যেই ফাঁক থেকে গেছে? কিছু জটিল ও আত্মসমালোচনামূলক প্রশ্ন উত্থাপন করতে ভয় পাচ্ছি? ভয় পাচ্ছি, কারণ, এইধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করলে প্রগতিশীলতার তকমা খসে যেতে পারে ব'লে?

 

আমি বড়ো হয়েছি কলকাতার কাছেই, একটি মফস্বলে। তরুণ বয়েসে, লেখালিখি করার সুবাদে, আমাদের অঞ্চলের বেশকিছু তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যাক্তি ও সংঘটনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। প্রায় প্রতি বছর, ৬ই ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে, তাঁরা কিছু না কিছু অনুষ্ঠান করতেন। সেইসব অনুষ্ঠানে কবিতা, গান ও ছোটোখাটো বক্তৃতা দেওয়া হত। যে-কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতোই, এটিও মূলত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। বক্তৃতায় হিন্দুত্ববাদী বলতে বোঝানো হত গোবলয়ের মৌলবাদী মানুষদের। ধরেই নেওয়া হত, আমাদের এখানে, আমাদের বাংলায়, হিন্দুত্ববাদীদের অস্তিত্ব নেই। এবং প্রমাণ হিসাবে তাঁরা পেশ করতেন – ৯২'-এ বাংলায় কিন্তু কিছু হয়নি। অর্থাৎ, বাংলার মুসলমানরা নিরাপদে রয়েছে। এবং তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠরা।

 

৬ই ডিসেম্বর বাংলার প্রগতিশীলদের কাছে হয়ে উঠেছিল এক উৎসব। যেখানে তাঁরা নিজেরাই নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চিহ্নিত করতেন। এবং আমরা তাদের বিশ্বাস করতাম।

 

প্রগতিশীলতা এক মনোমুগ্ধ বুদবুদ। উড়ন্ত। ভাসমান। হাল্কা ও স্বচ্ছ। সূর্যকিরণে তা চকচক করে। কবিতায় তা হয়ে ওঠে স্বর্ণাভ। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাকে ছোঁয়া যায়। হারমোনিয়ামের প্রতিটা রিডে তারই শরীর। আবার এই শরীর যেহেতু ঈশ্বরতুল্য, তাই তা একই সঙ্গে অলীক ও অসীম।

 

ফলত ধাঁধাঁ...

 

৯২'-র পর ২০০২। সেই একই পুনরাবৃত্তি। আমি তখন কলেজে। কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়েছে। সেই সূত্রে কিছু বামপন্থী বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ। কয়েকটা মিছিল। কয়েকটা পথনাটক। সবই যেন উদযাপন। বিজ্ঞাপন। সেই বুদবুদকে ছোঁয়ার আকুতি। সমর্পন। বাঙালি প্রগতিশীলতা যত না সাম্প্রদায়িক, তার থেকে বেশি বিশ্বাসী। এক্ষেত্রে ইশ্বর যেহেতু ঘুরপথে দেখা দেন – ফলে এর সমর্পনও বৃত্তাকারে আবর্তিত হতে পারে।  প্রায়শই আহ্নিকগতির ন্যায় প্রাকৃতিক ভেবে ভ্রম হয়। কিন্তু পার্থক্যও কিছু আছে। প্রকৃতি নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে না।

 

অবশেষে ঈশ্বর এলেন – সম্মুখে; তবে সমরে নয়। তিনি এলেন এবং দেখলেন। এবং দেখেই গেলেন।

 

২০১৪'র পর থেকে তিনি দেখছেন। মাঝে মাঝে রথ টানার মতো মিছিল। মাঝে মাঝে পথনাটক। প্রথম যখন গরুর মাংসকে কেন্দ্র করে খুন হওয়া শুরু হল, তিনি ভাবলেন – এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন নিজেকে প্রচার করিতে হইবেক। কিন্তু এই উত্তরাধুনিক সময়ে সব পাওয়া গেলেও, প্রকৃত ভক্তকে ধরে রাখা মুশকিল। ফলত গরু ক্রমে বিরতি লইল। পড়ে থাকিল সিএএ। সেটিও এখন অস্তমিত। এখনো বিরোধী জোট সগর্বে ঘোষণা করতে পারল না যে তারা ক্ষমতায় এলে সিএএ বাতিল করবে। এখনো আদালতের প্রতি তাঁদের অগাধ আস্থা। বিশ্বাসীদের আস্থা ছাড়া হারানোর কিছু নেই। তাই আস্থাটাই এদের সম্বল। বিলকিস বানু ছবি হয়ে থাকবেন। চিহ্ন হয়ে থাকবেন। তাঁকে মাঝে মাঝে ডিস্টার্ব করা হবে। মাঝে মাঝে তাঁকে ঘিরে সোনালি বুদবুদের সেমিনার গঠিত হবে।

 

কিন্তু রাজনীতিতে ফাঁকা জায়গা থাকে না। ইতোমধ্যে বেশকিছু নতুন দল, যারা মূলত মুসলমানদের দ্বরাই গঠিত, এবং মুসলমানদের অধিকার নিয়ে লড়াই-এর বার্তা দিতে চাইছে - তারা আবার নারীর অধিকারের প্রশ্নে পুরনোপন্থী, তাদের বিভিন্ন বয়ানে পুরুষতান্ত্রিকতার আবর্জনা লক্ষ করা যাচ্ছে।

 

হে, বুদবুদ, এ সোনালি বুদবুদ এবার ফেটে পড়। তোমার অট্টহাস্য অশ্লীল হয়ে উঠছে ক্রমশ।

 

----

0 Comments

Post Comment