"একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে- একবার বেদনার । অনেক কবিতা লিখে চলে গেল যুবকের দল। ” এই অমোঘ, অক্ষয় লাইন গুলো লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বেদনার এই পৃথিবীতে যৌবনের স্বপ্ন দেখার যে স্পর্ধিত স্পর্ধা থাকে, তারই সেলিব্রেশান মনে হয়, আশ্চর্য বেদনার চাদরে আবৃত কবির এই লাইনটা।
আর আজ আমার বাংলায়, বেদনাকে পরাজিত করে, ব্যর্থ প্রাণের অবর্জনাকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে নতুন জীবনে ফেরার যখন এক আন্দোলন চলছে। যে সময় আমরা প্রায় সব্বাই বলছি- ন্যায় বিচার, ন্যায় বিচার উই ওয়ান্ট জাস্টিস। সে সময় আমরা আবার প্রত্যক্ষ করছি, হয়তো সেই পুরনো রোগ ক্ষমতার ন্যায় বিচারে প্রবল এলার্জি। তার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো যুক্ত হয়েছে এক বিদঘুটে সন্ত্রাস। এই আন্দোলনের গায়ে খুব যত্ন সহকারে আলকাতরা মাখানোর মিডিয়া সন্ত্রাস।
ফলে খুব উর্বর মস্তিষ্করা বাংলার তিলত্তমার মূর্তি (যা বসানো হয়েছে আরজি করে) তার ভেতর এক রাক্ষসীকে খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু যন্ত্রণাকে পাচ্ছে না। কিন্তু কেন তারা বলছেন ও মুখ রাক্ষসীর ? এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়ালে আমার পছন্দের গোয়েন্দার নাম ফেলুদা নয় । হবে বোম, বোম, ব্যোমকেশ। কেননা ব্যোমকেশ নিজেকে কখনও টিকটিকি বা ডিডেকটিভ বলেন নি, বলেছেন তিনি নিজেকে সত্যসন্ধানী।
আচ্ছা ভাবুন তো আপনার হাত কিছু লোক কেটে নিল। এবং সেই বিষয়ে আপনি স্মৃতি রোমন্থন করছেন । তখন কী হবে ? স্বাভাবিক ভাবেই আপনার রাগ, ঘেন্না, যন্ত্রণা চিৎকার ফুটে উঠবে আপনার মুখমন্ডলে। তিলোত্তমার মূর্তির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ওই গোটা মূর্তি জুড়ে বাংলার এক মেয়ের তীব্র চিৎকার আমরা খুঁজে পাচ্ছি। ন্যায় বিচার না পাওয়া থেকে রেপ ও থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে তীব্র এক আওয়াজ খুঁজে পাচ্ছি। তাতে এত গেল গেল রব তোলার কী হয়েছে ?
আসলে বিষয়টা এখনেই থেমে যাচ্ছে না। জাস্ট শুরু হচ্ছে। আচ্ছা এই যে রাক্ষসী বলা হল ওই মূর্তিকে। এটা কি আসলে একটা কালার সন্ত্রাসবাদ ? গৌড় বর্ণ আর্যরা আদি ভারতীয় অনার্যদের রাক্ষস বলতো। গায়ের রং-এর তফাত। আমি সাদা তুমি কালো সেখানে একটা বড় বিষয় হত। পরে ব্রিটিশ শাসন, সাউথ আফ্রিকায় এবং এখনও বিশ্বের নানা প্রান্তে। গণতন্ত্রের পিঠস্থান মার্কিন মুলুকে রমরমিয়ে চলতে থাকে এই কালার সন্ত্রাসবাদ। কালা আদমি হলেই পুলিস তোমায় ঘেচাংফু করে দিতে পারে। অর্থাৎ মেরে ফেলতে পারে। যে ভাবে দেবতারা মারতো আশুরদের গল্পে। সেটাই হয়ে যেতে পারে বাস্তব কারণ তোমার গায়ের রং কালো। তাহলে কী আদতে বাংলার তিলত্তমার মূর্তির মুখ রাক্ষসীর বলে এক কর্পোরেট বর্ণবৈষম্যর সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে আজকের বাংলায় ?
রবি ঠাকুর বলতেন আরও চেতনা আরও বেদনার কথা। শিল্প সৃষ্টির অন্দর মহলে মনে হয় চেতনা আর বেদনা সেই ভূমি হয় , যার ওপর দাঁড়িয়ে শীল্পী আর শিল্প মাথা তোলে- এবং বিশ্বকে দেখে। তাই বোধহয় আমরা দেখি আদি কবি বাল্মিকী বিচলিত হয়ে পড়েন এক ক্রৌন্চির কান্নায়। ফলে সেই কান্নার অণু-পরমাণু থেকে সৃষ্টি হতে থাকে সেই মহাকাব্য - যার নাম রামায়ণ। যাই হোক মাইকেল এ্যানজেলোর সেই বিখ্যাত মূর্তি। যেখানে মৃত যীশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মাতা মেরী। সেই শিল্পও তো আসলে একটা চিৎকার। হয়তো ছেলের ন্যায় বিচারের জন্য এক মায়ের নীরব চিৎকার।
আবার প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের মৃত্যু মিছিলের পর- জার্মানি সহ ইউরোপে যে ডাডা ইজমের জন্ম হল। এ্যান্টি আর্ট মুভমেন্টের আবির্ভাব হল। সেই ডাডা আন্দোলনের শিল্পী হার্না হোশরা কী আঁকলেন ? একটা মুখ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে- দুটো নয়। একটা চোখই সব দেখছে। এভাবে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে মানুষ যে কত কিছু হারিয়েছিল। পা থেকে চোখ, পরিবার, মুখ । এই হারানোর বিরুদ্ধেই এক যুদ্ধ ঘোষণা করলো শিল্প। এ প্রসঙ্গে বলা ভাল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে গুলি বিদ্ধ মুখ গুলো এত বিভৎষ হয়ে গিয়েছিল যে সে সময় থেকেই প্ল্যাসটিক সার্জারি চিকিৎসা , আরও তার গুরুত্ব বাড়াতে থাকে। আর যুদ্ধের বিরুদ্ধে ডাডা শিল্পীদের প্রতিবাদ নিশ্চয়ই পুরনো রাজা-রাণীদের সুইট, সুইট মুখের ছবি তুলে ধরে হত না।
আর সে ভাবেই বাংলার তিলত্তমার মূর্তিও আমাদের এক যন্ত্রণা আর আস্বস্তির সামনে দাঁড় করাতে চায়। শাসকের মসৃণ আল ইজ ওয়েলে ভাষার বিরুদ্ধে এ মূর্তি কথা বলতে থাকে। তার জন্যই কি এই মূর্তি নিয়ে কিছু মানুষের এত সমস্যা ? এবার কেউ বলছেন- নির্ভয়ার মূর্তিটা ১৮ শতকের ফরাসী এক ভাস্বকর্য থেকে অনুপ্রানিত বা টোকা।
শিল্পের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা =টোকা হয় না। ও ভাবে সহজ বাংলায় অনুপ্রেরনা মানে টোকা বলা যায় না। তবু তারা সহজ বাংলায় টোকাই বলেন। এর পর তাদের মাস্টার স্ট্রোক এই টোকা মূর্তি দিয়ে নাকি বাংলার নির্ভয়ার বাবা মাকে ঠকানো হয়েছে। এই হাস্যকর যুক্তির সামনে দাঁড়ালে মনে হয়। এত আবর্জনার স্থান হবে কোথায়। আচ্ছা সত্যজিৎরায়ের ছবির ওপর তো ইউরোপের প্রভাব রয়েছে। তিনি নিজেও বলেছেন একথা। তার মানে সেই সব মান্যবরের যুক্তি মানলে বলতে হয়। সত্যজিৎ কি জণগনকে ঠকিয়েছেন ? কেননা তার ছবিতে ইউরোপীয় অনুপ্রেরনা আছে। রবি ঠাকুরের গানে জার্মান লিড সংগীতের অনুপ্রেরনা আছে মানে তাদের যুক্তিতে রবি ঠাকুরও ঠকিয়েছেন জণগনকে ? আসলে এভাবেই এক কুৎসা আর মিথ্যের জাল তৈরি করা চলছে আন্দোলনের বিরুদ্ধে। আর এই অন্ধকার সময়ই বলছে - প্রবল অন্ধকার মানে আলো একটু পরেই আসবে।