গণতন্ত্র সম্পর্কে ডক্টর আম্বেদকরের দূর দিশারী চিন্তাধারার পুনরুজ্জীবনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে আছে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। বর্তমান অভিজ্ঞতার আলোতে সেই দিশাকে আরও সুদূর প্রসারী ও সমসাময়িক করে নেওয়াও প্রয়োজন।
বিপ্লবী গণতন্ত্র
ডক্টর আম্বেদকরের গণতন্ত্রের দিশা তাঁর “শুভ সমাজ”-এর আদর্শের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এই আদর্শ ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কোনরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব তিনি রাখেননি। বহুবার বহু প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে শুভ সমাজ বলতে তিনি সেই সমাজকেই বোঝেন যা “সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা” নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্রকে তিনি সেই আদর্শের লক্ষ্য এবং একই সাথে সেই লক্ষ্য পূরণের মাধ্যম হিসেবে বুঝেছিলেন। কারণ তাঁর কাছে গণতন্ত্র আসলে স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী বাস্তবায়নের সমার্থক। একই সাথে গণতন্ত্র হচ্ছে সেই উপায় যার মাধ্যমে এই আদর্শ বাস্তবায়িত করা যায়।
“গণতান্ত্রিক সরকার” সম্পর্কে ডক্টর আম্বেদকরের ধারণার শেকড় সেই আদি মর্মবাণী —জনগণের জন্য, জনগণ দ্বারা, জনগণের সরকার— ধারণাতে পৌঁছে যায়। কিন্তু “গণতন্ত্র” বলতে তিনি গণতান্ত্রিক সরকারের থেকেও অনেক গভীর কিছু বোঝাতেন। এক যাপন বুঝতেন: “গণতন্ত্র কেবল এক ধরণের সরকারকে বোঝায়না। গণতন্ত্র হল সম্মিলিত জীবন যাপনের একটি রূপ, অভিজ্ঞতা আদানপ্রদানে যৌথতার একটি ব্যবস্থা। সহনাগরিকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার মনোভাব বজায় রাখা গণতন্ত্রের অন্তর্বস্তু”।
ডক্টর আম্বেদকরের গণতন্ত্র-ভাবনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তা সামাজিক পরিবর্তন ও মানব-প্রগতির ধারাকে সর্বদাই সচল রাখতে চায়। কেউ কেউ ভাবেন গণতন্ত্র হল খারাপ মানুষকে ক্ষমতা দখল থেকে দূরে রাখার একটি পদ্ধতি। কিন্তু গণতন্ত্রের এরকম রক্ষণশীল ধারণা আম্বেদকরকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেনি। তিনি গণতন্ত্রকে এক অনুপ্রেরণাময় অর্থে সংজ্ঞায়িত করছেন— “সরকারের এমন একটি ধরণ ও পদ্ধতি যার দ্বারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে রক্তপাতহীনভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যায়”।
বাস্তবে এরকম পরিবর্তন সাধন করতে অবশ্যই রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক গণতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। বাস্তবিক পক্ষে ডক্টর আম্বেদকরের গণতন্ত্রের দিশা আর সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা। কখনও কখনও তিনি এই সম্যক ধারণাকে “সোশাল ডেমক্রেসি” বা “সমাজ-গণতন্ত্র” বলে উল্লেখ করেছেন; যে অর্থে এই শব্দবন্ধটিকে আজকের দিনে বুঝা হয়ে থাকে তার থেকে অনেক প্রসারিত ভাবার্থে। অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকে অবহেলা করা, তাঁর মতে, “পশ্চিম ইউরোপে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা”-র অন্যতম প্রধান কারণ। তাঁর ভাষায়, “দ্বিতীয় যে ভ্রান্ত মতাদর্শ সংসদীয় গণতন্ত্রকে কলুষিত করেছিল তা হল এ’কথা অনুধাবন করার ব্যর্থতা যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র কখনই সফল হতে পারে না... সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র হল রাজনৈতিক গণতন্ত্রের শরীরের অস্থিমজ্জা। তা যত দৃঢ় হয় দেহও তত শক্তিশালী হয়। গণতন্ত্র সাম্যের আরেক নাম। সংসদীয় গণতন্ত্র স্বাধীনতার আবেগ আকাঙ্খা বিকশিত করেছিল। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র সাম্যের প্রতি তেমন অন্তরঙ্গতা দেখায়নি। তা সাম্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় এবং এমনকি, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে ন্যুনতম একটি ভারসাম্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা পর্যন্ত চালায়নি, যার ফলে স্বাধীনতা সাম্যকে গ্রাস করে এবং গণতন্ত্রকে নিছক একটি শব্দে, একটি প্রহসনে পর্যবসিত করে”। এই উদ্ধৃতিটিতে বা অন্যত্র পশ্চিম ইউরোপীয় গণতন্ত্রর ভবিতব্য সম্পর্কে আম্বেদকরের করা বিশ্লেষণ ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতেও বহুলাংশে প্রযোজ্য।
যুক্তিশাসন ও মুক্তি
গণতন্ত্রের প্রতি ডক্টর আম্বেদকরের অনুরাগ আসলে যুক্তিশাসন ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। যুক্তির শাসন গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য জরুরী। কারণ, গণতান্ত্রিক অনুশীলনের মূল উপাদান বিতর্ক। সাধারণ বোধ এবং যুক্তির ভিত্তিতে বিচার ও সমালোচনামূলক অনুসন্ধান ছাড়া মানুষের মাঝে তর্কবিতর্ক অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আম্বেদকরের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ি গণতন্ত্রকে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার সমার্থক এক অবস্থা হিসেবে বুঝলে যুক্তিবাদী চিন্তাপদ্ধতি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এই আদর্শের বাস্তবায়নে যুক্তিশাসন প্রকৃতই সহায়ক, অপরিহার্য যদি নাওবা হয়। যিনি স্বাধীন নন তিনি হয়তো অযৌক্তিক কাজ করার ঝুঁকি নিতে পারেন, কারণ তাঁর হাতে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নাই। কিন্তু জীবনের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে চাইলে যুক্তিশাসন ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী আবশ্যিক।
যুক্তিবাদ ও সাম্যের মধ্যে এক অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কও আছে। একথা তো ঠিক যে অপপ্রচার ও কারসাজি (ম্যানিপুলেশন) হল অধীনস্ত রাখার সাধারণ হাতিয়ার। উদাহরণ স্বরূপ, শতকের পর শতক ধরে অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাসের এক সুবিস্তৃত প্রচারজালের মাধ্যমে জাত ব্যবস্থার ইমারত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মতাদর্শে অন্ধ রাখার কারসাজি থেকে কাউকে সুরক্ষিত রাখতে চাইলে বা মুক্ত করতে চাইলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী করা নিতান্ত জরুরী। আরও একটি বিষয় হল, বৈজ্ঞানিক মেজাজের মধ্যেই কর্তৃত্ববাদ-বিরুদ্ধ এক জোরালো মাত্রা অন্তর্নিহিত আছে। এক ব্যক্তির তুলনায় অন্য আরেক ব্যক্তির মতামত বা ইচ্ছা বেশী প্রাধান্য পাবে —এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে কর্তৃত্ব তৈরী হয়। বৈজ্ঞানিক তর্কে তা মোটেই চলেনা। সেখানে যা বিবেচ্য হয় তা হল বক্তব্যের অন্তর্নিহিত সঙ্গতি ও প্রমাণের গুণমান। সেই অর্থে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ স্বরূপ।
কেউ কেউ মনে করেন যে যুক্তি বা বিজ্ঞান আসলে “ওয়েস্টার্ন” ধারণা, ভারতে তা অচেনা, ভারতের আছে নিজস্ব “জ্ঞানচর্চার ধারা”। গৌতম বুদ্ধ’র শিক্ষণ সম্পর্কে একটু ধ্যান দিয়ে পড়াশোনা করা যেকোনও ব্যক্তি এই কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। দেকার্তের বহু শতাব্দী আগে বুদ্ধ তাঁর অনুগামীদের যুক্তি প্রয়োগ করতে ও প্রামাণ ছাড়া কোনও কিছুই বিশ্বাস না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেষ দিকের একটি ভাষণ “বুদ্ধ অথবা কার্ল মার্ক্স”-এ ডক্টর আম্বেদকর, বুদ্ধের মৌলিক শিক্ষার সারাৎসার করতে গিয়ে নিম্নলিক্ষিত কথাগুলি রেখেছিলেন: “প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার আছে শেখার। শেখাটা একজনের জীবনে ততটাই প্রয়োজন যতটা প্রয়োজন খাদ্যের... কোনও কিছুই অবিনশ্বর নয়। কোনও কিছুই চিরস্থায়ি নয়। সবকিছুই পরখ ও তদন্ত সাপেক্ষ”।
তার মানে কিন্তু এটা দাবি করা নয় যে, যুক্তিশাসিত তর্ক ও বৈজ্ঞানিক বিসম্বাদ ছাড়া জ্ঞানের অন্য রকম কোনও ধারা থাকতে পারে না। কেবল ভারতে নয় সারা পৃথিবীর জন্যই একথা সত্য। যেমন, কোনও যুক্তি দিয়েই বোঝানো যায়না জুঁই ফুলের সুগন্ধ আসলে কেমন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিকল্প নাই। একইভাবে, যদি আপনি একজন ইরাকি শিশুর হাতটা ধরেন —যে শিশুটি মার্কিন বোমায় আহত হয়েছে— তাহলে আপনি যুদ্ধ বিষয়ে এমন কিছু শিখে ফেলবেন যা “কোল্যাটেরাল ড্যামেজ”-এর হাজারো বৈজ্ঞানিক যুক্তিও আপনাকে শেখাতে পারবেনা। ‘বুদ্ধ ও তাঁর ধম্ম’ শীর্ষক লেখাতে আম্বেদকর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা-র সুক্ষ্ম পার্থক্যের সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞায় উত্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানোর্দ্ধ শিক্ষা প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। কিন্তু ব্যক্তির আলোকপ্রাপ্তি ও সামাজিক যাপনে যুক্তিশাসনের সর্বব্যাপ্ত গুরুত্ব তাতে একটুও কমে না।
এই বিষয়টি উত্থাপন করার একটি কারণ হল, ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি বর্তমানের হুমকিগুলির সাথে প্রায়শই যুক্ত থাকে যুক্তিশাসন ও বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার ওপর আক্রমণ। বিশেষত হিন্দুত্ব আন্দোলনের কথাই ভাবছি আমি। অনেক বিদ্বান ব্যক্তিই এটা লক্ষ্য করেছেন যে এই আন্দোলনকে এক হিসাবে “উচ্চ বর্ণের বিদ্রোহ” বলে ব্যাখ্যা করা যায় — উচ্চবর্ণের পরম্পরাগত কর্তৃত্ব আরেকবার জোরালো করার প্রচেষ্টা, স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রসারের মধ্যে দিয়ে যে কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। “হিন্দু ঐক্য”-র নামে ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃত্বের এই পুনর্ঘোষণার জন্য জরুরী হল যুক্তিবাদী চিন্তা ও সমালোচনামূলক অনুসন্ধিৎসাকে দমন করা। গৈরিক ঘরানার রাজনৈতিক নেতারা যে এক-দু-দিন বাদে বাদেই বহু বিচিত্র “অবাস্তব যুক্তিহীন” বিবৃতি দেয় আর অযৌক্তিক কার্যকলাপ চালায় তার আসল তাৎপর্য সেখানেই নিহিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষ চালু করা, ইতিহাসকে পুরান দিয়ে প্রতিস্থাপন, ভগবান রামচন্দ্রের “সত্যিকারের” জন্মভূমি খোঁজা, পরিচিত মায়াবাদীদের হাতে গবেষণাকেন্দ্রগুলি তুলে দেওয়া ইত্যাদি অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। আমার সন্দেহ হয় যে মিস্টার মুরলী মনোহর যোশি সত্যিই জ্যোতিষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে চান কি না, কিন্তু ব্রাহ্মণ্য মায়াবাদের কাছে আত্মসমর্পণের মানসিকতাকে যত্ন সহকারে লালনপালন করার যথেষ্ট কারণ তাঁর আছে। আজ ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে যুক্তিশাসনের ওপর এইসব ও অন্যান্য আক্রমণকে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
নৈতিকতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা
ডক্টর আম্বেদকরের রাজনৈতিক দর্শনের একটি অন্যতম আকর্ষক বৈশিষ্ট্য হল গণতন্ত্রে নীতিবোধের(এথিকাল) দিকটিতে জোর দেওয়া, তিনি যাকে বলতেন “মোরালিটি”। এর একটি রূপ হল “কনস্টিটিউশনাল মোরালিটি”, অর্থাৎ, শুধুমাত্র আইনী দিকটির বদলে সংবিধানের নৈতিক মেজাজের দিকটিকে অনুসরণ করা। এখান থেকে আরও এগিয়ে ডক্টর আম্বেদকর অনুভব করছেন যে “মোরালিটি”, সামাজিক নীতিনৈতিকতার ভাবার্থে, স্বাধীনতা ও সাম্য বাস্তবায়নে অপরিহার্য। নীতিনৈতিকতার অনুপস্থিতিতে হাতে থাকে মাত্র দুটি রাস্তা: নৈরাজ্য অথবা পুলিশ।
মোরালিটির ওপর ডক্টর আম্বেদকরের গুরুত্ব আরোপ আসলে যুক্তিশাসন ও বৈজ্ঞানিক মেজাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতারই অঙ্গ। বিশেষত তিনি মনে করতেন যে নৈতিকতা সর্বদাই যুক্তির ভিত্তিতে পরখ সাপেক্ষ বিষয়। আর, নৈতিকতা সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে খুব কাছাকাছি অর্থে বলা যেতে পারে “যুক্তিশাসিত সামাজিকতা”।
সামাজিক যুক্তিশাসনের গুরুত্বের একটি কার্যকরী উদাহরণ বোঝা যেতে পারে সমাজে বিদ্যমান ‘বিশ্বাস’-এর ভূমিকা বিচার করে। আমি যেভাবে বুঝেছি তা হল, সমাজে মোটা দাগে তিন রকমের বিশ্বাস আছে। এবং সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েও আমরা বলতে পারি যে সেগুলি যথাক্রমে, যুক্তিবিচারহীন বিশ্বাস, ব্যক্তিগত স্তরের যুক্তিশাসিত বিশ্বাস ও সামাজিক যুক্তিশাসিত বিশ্বাস —এই তিনটির সাথে সম্পর্কিত। প্রথম ধরণের বিশ্বাস হল অন্ধ বিশ্বাস। “দয়া করে কেউ টুকলি কোরোনা” বলে পরীক্ষা হল ছেড়ে বেরিয়ে আসা হল পরীক্ষার্থিদের প্রতি অন্ধ আস্থা। উদাহরণটা হয়তো একটু কষ্টকল্পিত হয়ে গেল, কিন্তু বাস্তব জীবনে অন্ধ বিশ্বাসের উদাহরণের তো কমতি নাই। জার-শাসিত রাশিয়ায় রাসপুটিন এই অন্ধ বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছিল, আর তার ফল কী হয়েছিল তা আমাদের সকলের জানা।
দ্বিতীয় ধরণের বিশ্বাসকে বলা যেতে পারে হিসেবনিকেশ করা বিশ্বাস। এই ধরণের বিশ্বাসের কথা গেম থিয়োরির লোকেরা বলে থাকে। ‘ক’ কোনও কাজ করতে গিয়ে ‘খ’-কে বিশ্বাস করে কারণ ‘ক’ ধরে নেয় যে ‘খ’ ‘ক’-র স্বার্থটা জানে ও তা রক্ষা করবে। উদাহরণ স্বরূপ, ভারতের রাস্তায় সব ড্রাইভাররাই বাঁদিক বরাবর গাড়ি চালায় কারণ তাঁরা সকলেই একথা জানেন যে অন্যরাও তা জানে ও সেইমত চালাবে। অন্ধ বিশ্বাসের মতই এই দ্বিতীয় ধরণের বিশ্বাস সর্বব্যাপ্ত, কিন্তু তা আমাদের বেশিদূর নিয়ে যায়না।
তৃতীয় ধরণের বিশ্বাস হল বিবেচনাপূর্ণ চিন্তাপদ্ধতির অভ্যাস, অন্ধ বিশ্বাস ও হিসেব মাফিক বিশ্বাসের মাঝামাঝি ধরণের। গেম থিয়োরির মত নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ক্যালকুলেশন করে বিশ্বাস করার প্রবণতা নয়। বরং তার পরিবর্তে কোনও কাজে আমরা অন্যের ওপর “বিশ্বাস” রাখি এই সাধারণ বোধ থেকে যে এই আস্থা বা বিশ্বাস ছাড়া সামাজিক যাপনই অসম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সময়ানুবর্তীতার অভ্যাস এই ধরণের বিশ্বাসকে সূচীত করে। এটা “সামাজিক যুক্তিশাসন”-এর একটি উদাহরণ। সামাজিক জীবন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে এই ধরণের বিশ্বাসের প্রভূত গুরুত্ব আছে এবং সাধারণভাবে সামাজিক যুক্তিশাসনের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য।
নৈতিকতার ওপর ডক্টর আম্বেদকরের জোর দেওয়ার সাথে সামাজিক যুক্তিশাসনের এই গুরুত্বের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। মূল পার্থক্য হল, নৈতিকতার(মোরালিটি) একটি জোরালো নীতিশাস্ত্রীয়(এথিকাল) উপাদান আছে যা সামাজিক যুক্তিশাসনের থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। সময়ানুবর্তীতার উদাহরণটি নিয়ে আরেকটু এগোলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে। সামাজিক যুক্তিশাসনের অভ্যাসে আমরা সময় মেনে চলার কথা ভেবে থাকি, অথবা আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছয় এই অনুভব থেকে যে অন্যকে অপেক্ষায় রাখা অনৈতিক। আম্বেদকরের কাছে এই নৈতিক দিকটি সর্বাধিক গুরুত্বের।
প্রকৃতপক্ষে জাতব্যবস্থা সম্পর্কে আম্বেদকরের বহু ধরণের সমালোচনার অন্যতম দিকটি হল এই ব্যবস্থা সামাজিক যুক্তিশাসন ও নৈতিকতাকে খর্ব করে। “জাতের বিনাশ” লেখাটিতে তিনি গর্জে উঠে বলেন : “হিন্দু নীতিবোধে জাতের প্রভাব, যাকে বলে, শোচনীয়! জাত গণচেতনাকে ধ্বংস করেছে। জাত জনসেবার অনুভূতিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। জনমত গঠন অসম্ভব করে তুলেছে। হিন্দুর ‘গণ’ হচ্ছে তার জাত... সদ্গুণ জাত-কন্টকিত হয়ে গেছে আর নৈতিকতা হয়ে গেছে জাত-আবদ্ধ।” শেষ পর্যন্ত তিনি মোরালিটিকে “সমমর্মিতা” হিসেবে চিহ্নিত করছেন – “এমন এক সেন্টিমেন্ট যা কোন ব্যক্তিকে অপরের মঙ্গল সাধনের দিকে চালিত করে”।
বৌদ্ধ মতবাদের প্রতি আম্বেদকরের আকর্ষণকে নৈতিকতা ও যুক্তির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার আলোতেই বুঝতে হবে। তিনি বুদ্ধের “ধম্ম”-কে কেবল যুক্তিবুদ্ধির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ (প্রকৃতপক্ষে দায়বদ্ধ) হিসেবেই গণ্য করেছেন এমন নয়, তিনি একে “সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা”-র আদর্শের অভিব্যক্তি হিসেবেও উপলব্ধি করেছেন। এক জায়গায় তিনি এমনকি এ’কথাও বলছেন যে এই আদর্শ সরাসরিভাবে “আমার শিক্ষক বুদ্ধের শিক্ষা থেকে” পাওয়া। জীবনের শেষ দিকে মনে হয় তিনি এমনকি এই আশাও পোষণ করতে শুরু করেছিলেন যে ‘ধম্ম’ একদিন সামাজিক নীতিবোধের(এথিকসের) বিশ্বজনীন সুত্ত হয়ে উঠবে।
ধম্মকে এরকম বিশ্বজনীন নীতিশাস্ত্রের কোড হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীকে সম্ভবত কিছুটা অতিসরলীকরণ মনে হবে। নৈতিকতার কোনও বিশ্বজনীন রূপ থাকা আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার সন্দেহ আছে। বহুত্ব, নৈতিক রীতির ক্ষেত্রেও বহুত্ব, সামাজিক যাপনের এক অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য যা কাম্যও বটে। আমি এমনকি এ’ও বলব যে বুদ্ধর শিক্ষার প্রতি আম্বেদকরের ভক্তি কিছু ক্ষেত্রে চিত্তের স্বাধীনতা ও সমালোচনামূলক অনুসন্ধিৎসার প্রতি আম্বেদকরের দায়বদ্ধতার বীপরীতে দাঁড়িয়ে যায়। এ’কথা বলেও, সামাজিক নৈতিকতাকে গণতন্ত্রের মূল উপাদান হিসেবে বোঝার প্রাসঙ্গিকতা কমে যায়না। গণতন্ত্র যদি কেবলমাত্র আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে দুই ব্যক্তির প্রতিযোগিতাকে বোঝায় তাহলে তা কখনই সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেনা। বিশেষত তা কখনই সংখ্যালঘুর স্বার্থের প্রতি সুবিচার করতে পারেনা।
আরেকটু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে আমরা ভারতের শহুরগুলির দৈন্য দশার কথা আলোচনায় আনতে পারি —পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো ভিখিরী, পথশিশু, কুষ্ঠরোগী, গৃহহীন ও অন্যান্যদের কথা। এই মানুষগুলো একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠি যাদের কোনওরকম রাজনৈতিক ক্ষমতা নাই (বেশীরভাগই ভোট দিতে পায়না)। আগামী ভবিষ্যতে কখনও তাঁরা সেরকম কোনও ক্ষমতা পাবে বলেও মনে হয়না। মূলত এই কারণেই এই সমস্যাটি নিয়ে কোনও আলোচনাই কখনও হয়না সেরকম। যদি এই সমস্যাকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিধির মধ্যে আনতে হয় (এবং তা শুরু হওয়ার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে), তাহলে তা হতে পারে একমাত্র নৈতিক তাগিদ থেকেই। এই উদাহরণটি হয়তো ভারতের সামাজিক সমস্যাগুলির মধ্যে তুলনামূলকভাবে এক ক্ষুদ্র অংশের জন্যই প্রযোজ্য, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নৈতিক তাগিদের গুরুত্ব অপরিসীম। যদি সামাজিক নৈতিকতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির কেন্দ্রে স্থাপিত হয় তাহলে এক নতুন বিশ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে গণতন্ত্র সম্পর্কে ডক্টর আম্বেদকরের দিশা “রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক” গণতন্ত্রকে একীভূত করে। তিনি যেভাবে বুঝেছেন তা হল রাজনৈতিক গণতন্ত্র একা একা বেশীদূর এগোতে পারেনা যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য থেকেই যায়। তাঁর এই উদ্বেগের একটি বহুল পরিচিত প্রকাশ পাওয়া যায় সংবিধান সভায় তাঁর বিদায়ী ভাষণে : “১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারী আমরা এক দ্বন্দ্বপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। রাজনীতিতে আমরা সমানাধিকার পাব, আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে থাকবে বৈষম্য... এই দ্বন্দ্ববৈরীতার জীবন আমরা কতদিন টেনে নিয়ে যেতে পারব? সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে সমতার চাহিদাকে আর কতদিন অস্বীকার করে চলব আমরা? এই সমতাকে অস্বীকার করে চলা মানে শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া।”
সমস্যা বিশ্লেষণে ডক্টর আম্বেদকরের এই দিশা থেকে যে প্রশ্নে আমরা উপনীত হই তা হল কীভাবে এই “বিরোধাভাস” অপসারণ করা যায়। যেহেতু এই একই বক্তব্যে তিনি নিজেকে সংবিধান বহির্ভূত পদ্ধতি প্রকরণ (কেবল হিংসাত্মক পদ্ধতি নয়, “সত্যাগ্রহ”ও) থেকে দূরত্বে রাখতে চেয়েছেন তাই উত্তরটা সম্ভবত : গণতান্ত্রিক অনুশীলন। তবে ডক্টর আম্বেদকর নিজেই সতর্ক করে বলেছেন যে, বৈষম্যমূলক সমাজে এই গণতান্ত্রিক অনুশীলন কায়েমি স্বার্থের দ্বারা সহজেই বিপথগামী হতে পারে। এখানে এসে সমস্যাটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ সমস্যায় এসে পৌঁছয় : প্রথমে কোনটা, গণতন্ত্র না সমাজতন্ত্র?
এক পর্বে মনে হবে যে সমাজতন্ত্রকেই প্রথম হিসেবে দেখছেন আম্বেদকর, যা গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরী করবে। এই সময়ে তাঁর আশা ছিল যে ভারতীয় স্বংবিধানে “রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র” (স্টেট সোশালিজম) সন্নিবেশিত থাকবে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সম্পূরক করতে একটি সমাজতান্ত্রিক সংবিধানকেই চাবিকাঠি হিসেবে ভেবেছিলেন তিনি। জমি ও মূল মূল শিল্পগুলির রাষ্ট্রীয় মালিকানা সহ অন্যান্য বিবিধ সমাজতান্ত্রিক নীতিকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত না রাখলে একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কায়েমী স্বার্থের দ্বারা সমাজতন্ত্র বিপথগামী হয়ে যাবে। একদম প্রথম দিকেই সংবিধানসভাকে দেওয়া একটি স্মারকলিপি ‘স্টেটস অ্যান্ড মাইনরিটি’-তে ডক্টর আম্বেদকর এই সমাজতান্ত্রিক সংবিধানের নক্সা হাজির করেছিলেন।
এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দেখলে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এই স্মারকলিপিকে সরলীকরণ মনে হবে। যেমন, সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রেক্ষিতে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ওরকম আত্মবিশ্বাসের সাথে “যৌথ খামার”-এর পক্ষে সওয়াল করতে অনেকেই হয়ত দ্বিধা করবেন। কিন্তু গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের হাত ধরাধরি করে চলার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক সংবিধানের সাধারণ ধারণাটি তাতে একটুও টাল খায়না। এবং আম্বেদকরের ব্লুপ্রিন্টের বেশ কিছু দিক এখনও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।
তাৎপর্যে যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, ডক্টর আম্বেদকরের সমাজতান্ত্রিক সংবিধানের প্রস্তাবনা রাজনৈতিক গতি পায়নি। সংবিধান সভায় তা গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। সেখানে সুবিধাভোগীদের স্বার্থই প্রতিনিধিত্ব করত। যাই হোক না কেন, ডক্টর আম্বেদকর কিন্তু অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত রাখার চিন্তা কখনও ত্যাগ করেননি। শেষ পর্যন্ত সেগুলি সংবিধানের “নির্দেশাত্মক নীতি” (ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপলস) হিসেবে সন্নিবেশিত হয় যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে। নির্দেশাত্মক নীতিগুলি প্রকৃতই সুদূর প্রসারী, যদি সেগুলিকে কেউ আন্তরিক গুরুত্বের সাথে নেয়:
“আমার বিচারে নির্দেশাত্মক নীতিমালার গভীর মূল্য আছে, কারণ সেখানে বিধৃত আছে যে আমাদের আদর্শ হল অর্থনৈতিক গণতন্ত্র... সংবিধানের কাঠামো রচনায় [আমাদের] লক্ষ্য দুটি: ১) রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কাঠামো প্রতিষ্ঠা ও ২) আমাদের আদর্শ যে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র তা প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিটি সরকারকে এই নির্দেশ দেওয়া... যে তারা অর্থনৈতিক গণতন্ত্র আনতে সংগ্রাম করবে।”
বাস্তবে অবশ্য স্বাধীন ভারতে এই নির্দেশাত্মক নীতিমালাকে গুরুত্ব দিতে মোটেই দেখা গেল না। আম্বেদকর যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন সেইমতো এইসব নীতিমালা আইন আদালতের মাধ্যমে কার্যকর করার ব্যবস্থা হয় নি এবং নির্বাচনী রাজনীতিও এইসব নীতিমালা কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা পেয়েছি এক আধখ্যাঁচড়া গণতন্ত্র যেখানে মোটামুটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি সহাবস্থান করছে এমন এক সামাজিক বাস্তবতায় যা সংসদীয় গণতন্ত্রকে “নিছক একটি শব্দ ও পরিহাস”-এ পর্যবসিত করেছে। ডক্টর আম্বেদকরের প্রত্যাশার বিপরীতে স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্র বিকশিতও হয়নি আবার সম্পূর্ণ ধ্বংসও হয়নি। তার বদলে তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে, তিনি যে “বিরোধাভাস” চিহ্নিত করেছিলেন তার ভারে, যা আজও আমরা বহন করে চলেছি।
ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তার নিরিখে এই বিরোধাভাস কোথায় নিয়ে ফেলে আমাদের? এমন অবস্থায় আশাবাদী হওয়ার কোনও কারণ কি অবশিষ্ট থাকে? ডক্টর আম্বেদকরের স্বপ্নের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত হতে পারেনি। রাজনৈতিক গণতন্ত্র টিকে থেকেছে, কিন্তু অর্থনৈতিক গণতন্ত্র এক সুদূর পরাহত লক্ষ্যই থেকে গেছে। এবং ফলস্বরূপ গণতন্ত্র থেকে গেছে অসম্পূর্ণ ও নড়বড়ে। আসলে রাজনৈতিক গণতন্ত্রও তেমন সুস্থ সবল নাই। তদুপরি, ভারতীয় গণতন্ত্র নতুন বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে: ‘হিন্দুত্ব’ আন্দোলন। গভীর হতে থাকা অর্থনৈতিক বৈষম্য, সমরবাদের উদ্ভব, রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা (এমনকি যেসব দল নিপীড়িতদের প্রতিনিধিত্বের দাবী করে তারাও) নৃশংস ক্ষমতা ব্যবহার ইত্যাদির কথা বলা যায়।
তেমনই আবার পাল্টা ধারার বিকাশও আছে। গণতান্ত্রিক পরিসর তথা গণতান্ত্রিক মেজাজ বৃদ্ধি পাওয়ার নিরিখে একথা বলা যায়। বহু বিচিত্র ধরণের সামাজিক আন্দোলন বিকশিত হয়েছে ভারতে, বহু সৃজনশীল উদ্যোগ রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পরিধিকে বছরের পর বছর প্রসারিত করেছে। গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অনেক নতুন নতুন হাতিয়ার সামনে এসেছে যেগুলি ডক্টর আম্বেদকরের সময়ে জানা ছিলনা: তথ্য জানার অধিকার, পঞ্চায়েতরাজে নতুন পরিবর্তন, যোগাযোগ মাধ্যমের আধুনিক কারিগরি, আন্তঃ জাতীয় সহযোগিতা ইত্যাদি অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। রাজনীতিতে মহিলাদের অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ, স্থানীয় সরকারে জনতার অংশগ্রহণের সুযোগ এবং সমাজের সুযোগসুবিধাহীন অংশের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ভারতীয় গণতন্ত্রের গুণমানকে ক্রমশ উন্নত করেছে। গণতান্ত্রিক প্রকৃয়ায় সুযোগসুবিধাহীন অংশের অধিক মাত্রায় অংশগ্রহন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এটাই আগামী ভবিষ্যতের ঢেউ বলে আমার বিশ্বাস।
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ডক্টর আম্বেদকরের দূরদিশারি ধারণা ছিল, আজকের সময়ে যা “পুনরাবিষ্কার” করা জরুরী। এবং সময়ের গতিতে আরও এগিয়ে আমাদের সেই দিশাকে প্রসারিত করতে হবে সাম্প্রতিক বিকাশের আলোকে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যেকার যোগসূত্রের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে ডক্টর আম্বেদকর তাঁর নিজের কালে সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তবে, অন্য কিছু বাদ দিয়েও কেবল রাজনৈতিক গণতন্ত্রেরই সদ্ব্যবহারের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা তিনি হয়ত অনুমান করতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন যে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া সাধারণ মানুষ হীনবল থেকে যাবে। রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে তিনি নির্বাচনী বা সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাষাতেই ভেবেছিলেন। আজকের দিনে অবশ্য আমরা গণতান্ত্রিক অনুশীলনের নতুন নতুন রূপ নিরন্তর আবিষ্কার করে চলেছি যেগুলি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র হাসিল না করেও সাধারণ মানুষ প্রয়োগ করতে পারেন।
অংশগ্রহন করার এই সক্ষমতা তৈরী হয় কারণ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অর্থনৈতিক সুবিধাই সুযোগ তৈরী করার একমাত্র ভিত্তি থাকেনা। ‘মানি পাওয়ার’ নিশ্চয়ই সুবিধা দেয় কিন্তু তা সর্বদাই নির্ধারক ভূমিকা নিতে পারেনা। সাংগঠনিক কার্যকলাপ, সংখ্যার ভার, বক্তব্যের শক্তি, জনমতের চাপ, যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষমতার ব্যবহার এবং দরকষাকষির অন্যান্য উৎস। দরাদরির ক্ষমতা ছাড়াও গণতন্ত্রে সামাজিক নীতিবোধও কাজ করে — যদি, আম্বেদকরের ভাষায়, সে সমাজে ‘মোরালিটি’-র কোনও যায়গা থাকে।
এগুলোর কোনওটাই অবশ্য অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করেনা। কিন্তু আম্বেদকর যেমনটি স্বপ্ন দেখেছিলেন বাস্তবে সে’লক্ষ্য সুদূরপরাহত মনে হলেও “জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন” আনতে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া থেকে তো আমরা বিরত থাকতে পারিনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, জাতগত বৈষম্য অবসান করার লড়াই এই সময়ের সঙ্গে অতীব সঙ্গতিপূর্ণ এক গণতান্ত্রিক অনুশীলন। একইভাবে লিঙ্গসাম্যের লড়াই। অথবা কাশ্মীরে শান্তির জন্য লড়াই, দূর্নীতি খতম করা, সার্বজনীন শিক্ষা, বিশ্বের নিরস্ত্রকরণ, অনাহারের অন্ত ঘটানো ইত্যাদি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় এগোতে পারি আমরা।
এটাও লক্ষ্য করা যেতে পারে যে খোদ অর্থনৈতিক গণতন্ত্রও ততটা দূরবর্তী না হতে পারে যতটা আমরা মনে করছি। আসলে সমসাময়িক রাজনীতির এ এক ধাঁধাঁ যে অর্থনৈতিক শক্তি যত ঘনীভূত হয় তত বেশী তাকে ভঙ্গুর মনে হয়। সম্প্রতি এনরন কোম্পানীর ধ্বসে পড়া, বিনিয়োগ নিয়ে বহুপাক্ষিক চুক্তির পতন, ডব্লিউটিও বিপর্যয়, ব্রেটনউড ইন্সটিটিউটগুলির নড়বড়ে দশা ইত্যাদি থেকেও এই শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে। এক সময় যা “রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব” মনে হত তা দিন পেরোতে না পেরোতেই সম্ভব হয়ে উঠছে।
বাস্তব বিচারে সবচেয়ে ভালো কর্মধারা হতে পারে সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিগুলিকে পুনরায় সামনে আনা এবং এই নীতিগুলি যে “দেশ শাসনের মৌলিক নীতি” (আর্টিকেল ৩৭) তা জোরের সাথে পুনর্ঘোষণা করা। প্রকৃতপক্ষে, এই নীতিগুলির প্রতি সরকারী সমস্ত বৈরিতা সত্বেও, সংবিধানে চর্চিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রভূত সুযোগ আছে – শিক্ষার অধিকার, তথ্যের অধিকার, খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার, সমতার অধিকার ইত্যাদি। ডক্টর আম্বেদকরের “প্রচার আন্দোলন সংগঠন” —“এডুকেট, অ্যাজিটেট, অর্গানাইজ”— শ্লোগানটি এখন আরও বেশী বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
(‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিউম্যান রাইটস’ সংকলনে ২০০৫ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ। ভাষান্তর: মলয় তেওয়ারি, জানুয়ারি ২০২০)