- লকডাউন কী?
- নিজেকে বাঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে অপরকে বাঁচানো, অর্থাৎ মানবসভ্যতাকে বাঁচানোর প্রয়াস।
- আচ্ছা, আমরা কি বেঁচে আছি?
- কী আলফাল বকছিস! বেঁচে আছি বলেই তো আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছি।
- বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। হয়ত আমরা কেউই বেঁচে নেই। আমাদের আত্মারা বেঁচে আছে। এক আত্মা আর এক আত্মার সঙ্গে কথা বলছে।
একটি কাল্পনিক কথোপকথন।
২
হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়ে, উপার্জন হারিয়ে নিজ নিজ ঘরে ফিরতে চাইছে, কিন্তু ফিরতে পারছে না। ফিরবে কী করে লকডাউন চলছে যে! ট্রেন নেই, বাস নেই অন্য কোনও বাহন নেই। রাষ্ট্র মানুষকে, মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে সব বন্ধ রেখেছে। কেউ যদি পায়ে হেঁটে ফিরতে চাইছে। রাষ্ট্রের পুলিশ তাকে বাধা দিচ্ছে। লাঠিপেটা করছে। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে উঠবোস করাচ্ছে। এমনকি রাসায়নিক স্প্রে করে আটক পরিযায়ী শ্রমিকদের শুদ্ধ করা হচ্ছে যাতে রাষ্ট্র কোনও মতে করোনা আক্রান্ত না হয়।
৩
- রাষ্ট্র কী?
- রাষ্ট্র সেই ঘর, যার চারটে দেওয়াল আছে কিন্তু ছাদ নেই।
আর একটি কাল্পনিক কথোপকথন।
৪
কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন না তো! বুঝবেন কী করে, আমিও কি ছাই কিছু বুঝতে পারছি? পারছি না বলেই তো আলফাল বকছি। না, ফালতু আলফাল বকে লাভ নেই। বরং আসুন একটি মুখফেরতা গল্প শুনিঃ
এক বুড়ি ছিল। আর ছিল তার দুই ছেলে আর দুই ছেলের বউ। দুই ছেলে আর দুই ছেলের বউ- এই চারজন মিলে রাতদিন বুড়িকে কষ্ট দিত। শাপ-শাপান্ত করত। বুড়ির চেনাজানা এমন কেউ ছিল না যার কাছে গিয়ে সে তার দুঃখের কথা, কষ্টের কথা বলে একটু হালকা হতে পারে। অগত্যা বুড়ির ভিতরে তার যত দুঃখ, যত কষ্ট, সব রাগ-অভিমান হয়ে জমতে লাগল। আর সে মোটা হতে শুরু করল।
বুড়ি যে এমন মুটিয়ে যাচ্ছে তা নিয়েও তার ছেলে আর ছেলের বউয়েরা তাকে গঞ্জনা দিতে ছাড়ল না। শুধু তাই না, তারা তার খাওয়া কমিয়ে দিল এই বলে, বসে-বসে খেয়ে তো খুব মোটা হচ্ছো! এই বয়সে এত মোটা হওয়া কি মানায়! তোমার লজ্জা করে না?
বুড়ির লজ্জা করছিল না, বললে ভুল হবে। আসলে সে তার লজ্জা প্রকাশ করবার সুযোগ পাচ্ছিল না।
একদিন বাড়িতে যখন কেউ ছিল না, ‘ধ্যাৎ তেরি ছাই’ বলে বুড়ি যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে চলে যাবে বলে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম পেরিয়ে গেল। নদীনালা, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে গেল। শেষপর্যন্ত তার শরীর আর পেরে উঠল না, তখন সে একটা পোড়ো ভিটে পেয়ে সেখানেই বসে পড়ল।
তারপর সে দেখল, সেই ভিটের চারটে দেওয়াল আছে ঠিকই কিন্ত কোনও চালা নেই। তখন তার মনে হল, ভিটেটার অবস্থা ঠিক তার মতোই।
একথা মনে হতেই সে তার দুঃখ-কষ্ট আর চেপে রাখতে পারল না, একটা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে তার বড় ছেলে তাকে কত দুঃখ দেয়- কত কষ্ট দেয়, সে-কথা বলতে লাগল। অদ্ভুত কাণ্ড, সব শুনে দেয়ালটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। বুড়ির নিজেকে একটু হালকা মনে হল। বুড়ি তখন আর একটা দেওয়ালের দিকে মুখ করে তার বড় ছেলের বউয়ের কাণ্ড-কারখানা বলতে লাগল। শুনতে-শুনতে সেই দেওয়ালটাও ধসে পড়ল। বুড়ির ছোটছেলে আর ছোট বউয়ের কথা শুনতে শুনতে বাকিদুটো দেয়ালও ধসে পোড়ো ভিটেটা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেল।
আর বুড়ি দেখল, তার মোটা শরীরটা হঠাৎ-ই কেমন শুকিয়ে গেছে। সে এত হালকা হয়ে গেছে যে হাঁটতে গিয়ে তার মনে হল যে, সে উড়ে উড়ে যাচ্ছে।
শেষপর্যন্ত বুড়ি উড়তে উড়তে সেই পেরিয়ে আসা গ্রাম, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে আবার ছেলে-ছেলেবউদের সংসারে ফিরে এল যখন, দেখল ছেলে-ছেলেবউদের সংসারটাই নেই আর, একটা ধ্বংসস্তূপ হিসেবে ইতিহাসের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
৫
কিছু বোঝা গেল কী ...
ঋণ স্বীকার: দেবেশ রায়