পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিজেপি আর এস এস এর বিপদ ভালোভাবে না বুঝলে তার মোকাবিলা অসম্ভব

  • 12 February, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1041 view(s)
  • লিখেছেন : সৌভিক ঘোষাল
প্রশ্ন তৃণমূলকে আক্রমণ করা নিয়ে নয়। প্রশ্ন বিজেপি আর এস এস এর বিপদকে তুলনামূলকভাবে বেশ খানিকটা ছোট করে দেখা ও দেখানোর। মূল রাজনৈতিক নিশানা এই মুহূর্তে কারা এবং কেন, সেটা স্থির করার। এই প্রশ্নে গোড়ায় গলদের ফলে সি পি আই (এম) প্রভাবিত জনগণের কাছে এই বার্তা যায় যে তৃণমূল কংগ্রেস দল ও সরকারই বামপন্থীদের এই মুহূর্তের মূল নিশানা এবং বামপন্থীদের মূল রাজনৈতিক কাজ হল যেন তেন প্রকারেণ তৃণমূলকে পরাস্ত করা ও তৃণমূল শাসনের অবসান ঘটানো।

 

পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বাম আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। এখানকার  যে বামপন্থীরা একসময় প্রায় সাড়ে তিন দশক একটানা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা প্রায়শই ভূমিসংস্কার বা পঞ্চায়েতী রাজের পাশাপাশি আর একটি বিষয়কেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বলে উল্লেখ করে থাকেন। সেটা হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং মৌলবাদী শক্তির আগ্রসনকে রোখা। নব্বই দশকের শুরুর দিনগুলিতে যখন ভারতের নানা রাজ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি দেখা গিয়েছিল, রাম মন্দির বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত ঘটনাবলীর সেই পর্বেও এ রাজ্য তা থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল। লোকসভা ভোটে তৃণমূলের জোটসঙ্গী হিসেবে লড়ে বিজেপি এরাজ্য থেকে আসন জিততে পারলেও বিধানসভা ভোটে একা লড়ে সে সময় বরাবরই তাদের ঝুলি শূন্য থেকেছে। এ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলতেন তৃণমূলের অন্যতম অপরাধ তারা এ রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে ডেকে এনেছে।

আশ্চর্যের বিষয় যে বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নকে ক্ষমতায় থাকার সময়ে এতখানি গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন, আজ এ রাজ্যে কার্যক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক আক্রমণের মূল নিশানায় চরমতম সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি আর এস এস নেই। নেই সেরকম একটা সময়ে যখন বিজেপি কেন্দ্রীয় স্তরে ক্ষমতায় আসীন ও জোরকদমে একের পর এক পদক্ষেপে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম ও হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপণের অ্যাজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। একসময়ে ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা সঠিকভাবেই এ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তথা কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের কথা তুলেছিলেন। আজ বিজেপি শাসনে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজ্যের অধিকার অনেক বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হলেও এই প্রশ্নে তারা খুব বেশি সরব নন।

সি পি আই (এম) এর সাম্প্রতিক পর্বের যে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচী, প্রচার, আন্দোলনকে যদি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে বিজেপি আর এস এস এর বিরুদ্ধে অল্প কিছু কথা বলেই দ্রুত তারা চলে যান তৃণমূল দল ও সরকারের সমালোচনায় এবং সেটাকেই প্রধান রাজনৈতিক নিশানা করে তোলেন। প্রশ্ন তৃণমূলকে আক্রমণ করা নিয়ে নয়। প্রশ্ন বিজেপি আর এস এস এর বিপদকে তুলনামূলকভাবে বেশ খানিকটা ছোট করে দেখা ও দেখানোর। মূল রাজনৈতিক নিশানা এই মুহূর্তে কারা এবং কেন, সেটা স্থির করার। এই প্রশ্নে গোড়ায় গলদের ফলে সি পি আই (এম) প্রভাবিত জনগণের কাছে এই বার্তা যায় যে তৃণমূল কংগ্রেস দল ও সরকারই বামপন্থীদের এই মুহূর্তের মূল নিশানা এবং বামপন্থীদের মূল রাজনৈতিক কাজ হল যেন তেন প্রকারেণ তৃণমূলকে পরাস্ত করা ও তৃণমূল শাসনের অবসান ঘটানো। তৃণমূল শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় আসার জায়গায় নেই, এটাও বর্তমান শক্তি ভারসাম্যের জায়গা থেকে বেশীরভাগ বাম কর্মী সমর্থক বোঝেন। এই সব বোঝাপড়া মিলে গিয়ে যেন তেন প্রকারেণ তৃণমূল সরকারকে সরাবার পথ ও পদ্ধতি হিসেবে যে বার্তা শেষমেষ তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছয়, তার ভিত্তিতে সি পি আই (এম) প্রভাবিত জনগণের একটা বড় অংশ বিজেপিকে ভোট দিয়ে বসেন। ২০১৯ এর লোকসভা ভোট ও ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে একারণেই তাদের নিজেদের ভোট শতাংশ ব্যাপকভাবে কমে যায় ও তা যুক্ত হয় বিজেপির খাতায়।

সংগ্রামী বামপন্থীদের তরফে বিশেষ করে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে এই নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু সি পি আই (এম) এর বামপন্থী বন্ধুদের অনেকেই সেই সব বিতর্কে কান দেওয়া দূরে থাকুক, সংগ্রামী বাম শিবিরের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দ থেকে সামাজিক মাধ্যমের সমর্থক – সবাইকেই কুৎসিত ও নিন্দনীয় ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। বিধানসভা নির্বাচনের পর আড়াই বছর অতিক্রান্ত, কিন্তু নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর সি পি আই (এম) এর নিজেদেরই সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃত্বের তরফে ‘বিজেমূল তত্ত্ব ভুল ছিল’ এই স্বীকারোক্তি কেবল সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতি হিসেবেই থেকে গেছে। সেই স্বীকারোক্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে রণকৌশল বদলানো দূরে থাক, এটাকে ভুল বলে তারা মেনে নিতেই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রকৃতপক্ষে প্রস্তুত হন নি, বরং আজও সেই একই  ভুলের পথেই তারা চলেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে সংগ্রামী বামেদের বেশীরভাগ অংশ ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি মোকাবিলার প্রধান কর্তব্যটিকে সামনে রেখে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ এই রণধ্বনি তুলেছিলেন ও জনগণের মাঝে তাকে প্রচার করেছিলেন। ২০২৩ যখন শেষ হয়ে নির্বাচনের বছর ২০২৪ আসছে, তখন সেই সংগ্রামী বামেদের একটি অংশ বিজেপি আর এস এস বিরোধী জনচেতনা যাত্রা শুরু করেছেন। এই উদ্যোগে তারা বিজেপি বিরোধিতার জায়গা থেকে গড়ে ওঠা ইন্ডিয়া জোটের কোনও দলকে শরিক করতে চান নি; এমনকী তাদেরও না, যারা লড়াই আন্দোলনের মঞ্চে এই প্রশ্নে ধারাবাহিকভাবে সরব; যাদের সঙ্গে নানা যৌথ কর্মসূচীতে তারা নিয়মিত সামিল হন। ‘নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা যাবে না, তাই চাই মাঠে ময়দানের লড়াই’ – এরকম এক ‘লেফটউইং কমিউনিজম’ ধর্মী বুলি নিয়ে তারা অসংসদীয় লড়াইয়ের সর্বোচ্চ গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চান হয়ত; কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, যেখানে নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করাটা প্রধানতম একটা কাজ; সেখানে সংসদীয় সংগ্রাম ও অসংসদীয় সংগ্রামের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করাটা কতটা সমীচীন – সেটা তাদের আরো একবার ভেবে দেখা দরকার। বিজেপি আর এস এর সামগ্রিক বিপদ ও তার রাজনীতির পুরো ছককে ভালোভাবে অনুধাবন না করলে তাকে যথাযথভাবে মোকাবিলা করা ও পরাস্ত করা সম্ভব হবে না।

বিজেপি আর এস এস কে নির্বাচনী লড়াই থেকে প্রচার আন্দোলন – সর্বত্র পরাজিত ও উন্মোচিত করাটাই এই সময়ের কাজ এবং এই দুইয়ের মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয় দরকার। ২০২৪ এর নির্বাচনী লড়াই নিছক কোনও একটি সরকার বদল বা সরকার গঠনের লোকসভা ভোট নয়, আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার ভোট। এই নির্বাচনে বিজেপি আর এস এস বিরোধী অবস্থান ও প্রচারকেও তাই এক গণ আন্দোলনের চেহারা দেওয়া দরকার।

 

0 Comments

Post Comment