কাঁদো ইতিহাস! কাঁদো। ঘটনা পেরিয়ে গেলে কান্নার সুর হয় নরম। আচমকা আর্তনাদেও সুরের বসত। সে সুর যিনি চিনতেন, মাপতে পারতেন কাঁটায় কাটায়, তিনি উস্তাদ ফৈয়জ খাঁ। শুনেছি, সেও নাকি এক উস্তাদই ছিলেন, যিনি মৃত্যু-শয্যায় মাথার ওপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যান আর দূরে নিশুতি-ভাঙা কুকুরের ডাকের স্বর পাশাপাশি গুণগুণ করে পাকাপাকি চোখ বুঁজলেন! ঘরসুদ্দু শিষ্য, আত্মীয়, পরিজন সুর আর শোকে ডুবলেন। আহা আর্তনাদ, আর গুমরে কাঁদা, ওগো গুঙিয়ে ওঠা,- শোনো সুর যাকে ছোঁয় না, ছোঁয়নি, আছে কি আহাম্নক কোনও!
নীরবতা ভাঙা চিৎকার, স্লোগান, আর্তি ভেঙে হাঁটছিলেন সাংবাদিক অর্ক দত্ত। হামলা, কান্না, গুজব, রক্ত, আশঙ্কা, যা যা থাকে পৃথিবীর সমস্ত দাঙ্গায়, তার মধ্য দিয়ে হাঁটা সহজ নাকি? আর যাঁরা হামলার আশঙ্কায় টু-শব্দও গিলে ফেলে, গিলতে বাধ্য হয়, জীবন্ত বাঁচা-মরার মাঝে কাটিয়ে দেন ঘন্টা-দিন-মাস? দাঙ্গার বাইরের ছবিটা বদলায় না, বদলায়নি। সময় বদলালে স্রেফ দাঙ্গা লাগানোর মাথাগুলো বদলায়। বাকি যা-কিছু প্রবাহে থাকে, মৃত্যু-ধর্ষণ-রাহাজানি-রক্তপাত, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে ঘুরপাক খায়।
২০০২, যে বছর গুজরাত দাঙ্গা হল, সে বছর জন্মানো নাগরিক তিন বছর আগেই ভোটার হয়েছে। সেদিনের চিত্র-সাংবাদিক অর্ক দত্ত এখন ৬৯। আর, এ পর্বের প্রোটাগনিস্ট এখন ৫০।
২৭ ফেব্রুয়ারি সবরমতি এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ড ও তার রেশ ধরে গুজরাতের নানান জনপদে সাম্প্রদায়িক হিংসা শুরু হল। আহমেদাবাদের বাপুনগরে একটি মুসলমান বাড়ির সামনে উন্মত জনতার ভিড়। যে কোনও মুহূর্তে ঘরে ঢুকে পড়বে তারা। পরিবারের ওপর যাতে আক্রমণ না হয়, হাতজোড় করে উন্মত্ত জনতার মাঝে আধাসেনাকে মিনতি জানাচ্ছেন যুবক। অর্ক ক্লিক করলেন। মিড-ক্লোজআপ। না, যুবক পালালেন না। চারপাশে আগুন লাগানো উন্মত্ত জনতাও পিছু হটলো। কারণ, ততক্ষণে আধা সামরিক বাহিনী ঘটনাস্হলের দখল নেয়। কিন্তু, ওই যে মুহূর্ত! ওই যে জীবন্মৃত্যুর মাঝের খানিকক্ষণ! ওই যে বাঁচা আর বাঁচানোর আকুতি! রয়টারের অর্ক দত্ত'র এই ছবিটিই গুজরাত দাঙ্গার হাজারো মৃত্যু, আহত, নিখোঁজ, ঘরবাড়ি ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি।
লোকটা কুতুবউদ্দিন, আনসারি। পেশায় ওস্তাগর, দর্জি। ছবি প্রকাশের পর আলোচনায় উঠে আসেন কুতুব। দাঙ্গা-পীড়িতের মুখ, আক্রান্ত মুসলমানের মুখ। দাঙ্গা থামলেও, বাপুনগরে তাঁর বাস করা কঠিন হয়ে পড়লো। সন্তানরা স্কুলে গেলে কুকথা শুনতে হয়। উপহাস ছুটে আসে। নানান সাক্ষাৎকারে কুতুবউদ্দিন আবেদন করতে থাকেন, তাঁকে আর তাঁর পরিবারকে স্বাভাবিক বাঁচতে দিক সবাই! পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকার কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। কিছু দিনের জন্য কলকাতায় আসেন এবং দর্জির কাজও শুরু করেন কুতুব।
এতক্ষণ পর্যন্ত সবটাই একজন ফটোগ্রাফার ও তাঁর ছবির চরিত্রের গল্প। তারপর, কোথায় গেলেন দর্জিমিঞা? ছবি বিড়ম্বনা নাকি নতুন পথের সূচনা? নাকি, খ্যাত হতে না চাওয়া একজন সাধারণের বিরক্তি? গত দু'দশকে কুতুবউদ্দিনের পরিচিতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে - এই প্রশ্নগুলোও এসেছে।
সেদিনের বাপুনগর থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে বিরজুনগর। আজকাল সেখানকার 'সোনে কি চাল' বস্তির বাসিন্দা কুতুবউদ্দিনের পরিবার। 'সারা দুনিয়া ছবি দেখেছে। খারাপকে খারাপ বলেছে। প্রিয় গুজরাত একদিন জ্বলেছে। বেঁচে থাকতে এ দুঃখ যাবে না।' প্রশ্নে, গল্পে-কথায়, অভিজ্ঞতায় অতীতে ফিরতেই হয়।
সাম্প্রদায়িক অশান্তি, ছোটখাট দাঙ্গা অতীতেও দেখেছে গুজরাত। কিন্তু, ২০০২-এ অতীতের কোনও অভিজ্ঞতা কাজে আসছিল না তখন। শোনা যায়, মৃত্যুর সংখ্যা নাকি ৫-৭ হাজার! বহু সম্পত্তি নষ্ট হয়ে গেল! আজো বহু মানুষ ঘরে ফেরেনি। কেউকেউ বিশ বছরেও ভয় কাটিয়ে বের হতে পারলেন না।
কলকাতায় এসে থাকার পরেও ভয় তাড়া করতো। গুজরাতের কারখানায় সেলাই করে ঘর চালানো দর্জি, পার্কসার্কাসে এসেও সেলাইয়ের কাজ করেছেন। পরিজন-বন্ধুরা বাড়ির খবর দিত। পরিস্হিতি স্বাভাবিক, খবর এলেও আশ্বস্ত হওয়া কঠিন! বছর পার করে সপরিবার কলকাতা ছাড়েন কুতুব।
ভয় ছিল, ভয়ঙ্কর ভয়। হয়তো দেশভাগের সময় বা পরের বাংলা সেই ভয় চিনতো। ভয়ের তাড়া সঙ্গী করেই বে-ঘর হওয়া মন, আজো দেখতে পায় খুন হওয়া মানবিকতা আর মাথায় খুন চেপে বসা প্রতিবেশীর ভয়ঙ্কর রাগের মুখ। দিনটা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০২। আগেরদিন পিছনের বস্তি পুড়ে গেছে। পোড়ানো হয়েছে। বস্তি ছেড়ে সবাই পালালেও, রাতে গোপনে ঘরে ফিরেছিলেন কুতুবরা। পরের দিন ঘরের সামনে উন্মাদ হওয়া বজরঙ্গ দলের ঘেরাও থেকে আধা সামরিক বাহিনীর দিকে চিৎকার ছুঁড়ে দেন মুমূর্ষু সংসারী। ভাগ্যিস! পাশে বিবি ছিলেন। কোলে ছিল সন্তান। সামনের সিঁড়িটায় টায়ার জ্বলছিল। আগুন নিভিয়ে সেদিন খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়েছিল সেনা।
কে মরলো? কারা মারলো? ভারতের রাজনীতিটাই বদলে গেল গুজরাত দাঙ্গায়। ভাল হলেও গুজরাত-মডেল, খারাপ হলেও! নেতারা যার যার নিজের ধান্দায় ব্যাস্ত। মানুষ চায় না, তাই অশান্তি নেই। কিন্তু জিনিস-পত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে যে! খরচ বেড়ে গেছে! ২০০২ আর ২০২৩-এর মধ্যে দোলাচল চলতে থাকে।
'সবরমতি এক্সপ্রেসের কামরায় কারো ভাই ছিল, কারো সন্তান। কারো মা, কারো বোন ছিল। যার ঘরে মরে, বো সমঝতে হ্যায়!' আহমেদাবাদে বসে দাঙ্গার গল্পে পিছু ফিরলে গোধরার জ্বলে যাওয়া ট্রেনের বগি দেখতে পান 'দাঙ্গার মুখ।' পিছু ফিরলে কথায়-কথায় সব দৃশ্য হয়ে ভাসে। বিশ বছর পেরিয়ে বারবার পিছনের পথটায় চোখ রাখতে হয়। আজকাল আলাদা করে রাজনৈতিক দলে আগ্রহ নেই। গুজরাতে বিজেপি থাকবে, অথবা থাকবে না! 'এ তো সব দোকানদারি।' তবু, 'গঙ্গা-যমুনা তহেজিবের ভারত।' হিন্দু -মুসলমানের মধ্যে 'ভাইচারা' আছে। সাধারণ মানুষ যদি হিন্দুরাষ্ট্র চাইতো, তাহলে অনেক আগেই হয়ে যেত! তবুও যদি গেরুয়াই হয় ভারত? 'বাপ-দাদা দফন হুয়া ইহা পর, হাম ভি হোঙ্গে।' এই আহমেদাবাদেই। তাই তো দাঙ্গার পর কলকাতায় গিয়েও 'আনমোল বতন' বাপুনগরে ফিরেছে আনসারি। সন্তান বড় হয়েছে আহমেদাবাদেই। এতো স্বপ্নপূরণ!
মাঝে, ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগে চিঠি দিয়ে কুতুবউদ্দিনকে সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। অনেকেই পেয়েছিলেন সে চিঠি। কুতুব যাননি। অনেকে গেছেন, দেখানো নিমন্ত্রণের দিন কি রেগেছিলেন, নাকি বিমর্ষ!
বছর দশেক আগে অশোক পারমারের সঙ্গে পরিচয় হয়। অশোক মুচি। অশোকের ছবির সঙ্গে পরিচয় হয় দাঙ্গার দিনগুলিতে। 'মানুষটার দুঃখ আছে। আফসোস আছে।' একবার মিনিট দশেকের জন্য দেখা হয়েছিল বটে, আসল পরিচয়টা হয় কেরালায়। কুতুবউদ্দিনের বায়োগ্রাফি 'নাজান কুতুবউদ্দিন আনসারি' লিখেছেন কেরালার সাংবাদিক শাহিদ রুমি। বই প্রকাশের দিন কিছু নতুন করা যায় ? ভাবতে ভাবতে অশোক মুচির নাম আসে। কেরলে অশোক মুচির হাতে প্রকাশ পায় কুতুবের বই। ৫ বছর পর অশোকের দোকান 'একতা চপ্পল হাউস' উদ্বোধন করেন কুতুব। বিস্তীর্ণ গুজরাতে, আরো আরো বিস্তীর্ণ ভারতের দুজন সাধরণের এমন অসাধারণত্ব আশ্চর্য ঘটনা বটে। 'মুসলমান হুঁ, কিন্তু তার আগে মালিক ইনসান বানিয়েছেন। মজহব বাদ মে। মায়ের পেটে ইনসান জন্মায়, বাহার হ্যায় মজহব। মানবতা আগে।'
কুতুবউদ্দিন এখন গল্প। কুতুবউদ্দিন তথ্যচিত্র, সাক্ষাৎকার। কুতুবউদ্দিন বাবা, নাগরিক, সন্তান, স্বামী, বন্ধু, 'দাঙ্গার মুখ'। কুতুবউদ্দিন একটা ছবির নাম। 'যে ছবিতে লজ্জা পেয়েছিল স্বাধীনতা ।'যে ছবিতে অশ্রু ঝরে, ঝরবে। যে ছবিতে কেঁদে উঠলো আস্ত সংবিধান!
বাপুনগর থেকে বরোদার ফৈয়াজ খাঁ'র মাজারের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার হবে। কুতুবের ছবি প্রকাশের দিন কয়েকের মধ্যে বজরঙ্গ দল সেই মাজারে ভাঙচুর চালায়। ছাড়খাড় হয় সুর-ফকিরের ৫২ বছরের কবর। সেই ভাঙার শব্দেও সুর ছিল নির্ঘাত! ছন্দ? কুতুবের কান্নাতেও! ফৈয়াজ খাঁ নিশ্চই বলে দিতে পারতেন কোন স্বর ছুঁয়ে গেল আর্তনাদ বা গুমরে ওঠা!
এই বিষয়ে অন্য লেখা
দাঙ্গা-মুখের ভারতদর্শন : 'মনুস্মৃতিই মোদিস্মৃতি'
আরেক ভারতের গল্প বাবরির 'পাপ' করসেবকের মসজিদ