রাতে কী ঘুম হয়েছিল সেদিন? ছেলেটার? ছেলেটাই তো! এতদিনে অনেক রকম পরিচয়। শাহপুরের মুসলিম মহল্লায় রাস্তাতেই থাকা-খাওয়া-ঘুম। দিনে রোজগার বলতে জুতো সেলাই। বাড়ি ছিল একটা। আগে ফিরতো, বছর খানেক আর ফেরে না। বাপ-মা দুজনেই অতীত। তারও আগে ক্লাস টেন পৌঁছে স্কুলছুট। পেট চালাতে বেরাদরির পেশাটাই ভরসা! সে সময়, স্হানীয় দরিয়াপুরের রাস্তায় গত তিন দশকের জায়গাটাও জুটিয়ে দিয়েছিলেন কোনও পরিচিত মুসলমান।
এমনই একদিন, গোধরায় অযোধ্য ফেরতা ট্রেনে আগুন লাগলো। জ্বলে পুড়ে মরে গেল ৫৮ জন। দিনটা ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০২। গোধরা থেকে শাহপুর কত আর হবে! কমবেশি ৮০ কিলোমিটার। পরের দিন বনধ ডাকলো বজরঙ্গ দল। বদলে গেল শাহপুরের অলিগলি। এখানকার দরিয়াপুরের চেনা রাস্তাও থমথমে। কি আর করে ছেলেটা!
রাগ ছিল চারপাশে। মুসলমানের ওপর রাগ। এ রাগ কি ছেলেটারও হয়! ক্রোধ? বিদ্বেষ? হয় সম্ভবত, অন্তত হচ্ছিলো। রাস্তায় খবর থাকে, খবর ভাসে। খবরে ঘৃণা থাকে। বিদ্বেষ ওড়ে। কান্নার আওয়াজ হয়ে ফিরে আসে।
সকাল সাড়ে ১০ টার আসে পাশে খিদে পেল। দূরে খেতে যাবার জন্য পাশের একজনের কাছে এক টুকরো কাপর চায় ছেলেটা। গেরুয়া কাপর। একমুখ দাড়ি তো! এ সময় মুসলমান ভাবলে মুশকিল। তাই গেরুয়া ফেট্টি।
আরও আধঘন্টা গেল। মোড়ের মাথায় জনা কয়েকের জটলা। একটা মিছিল আসে। বজরঙ্গ দলের মিছিল। ক্রমে স্লোগানের তীব্রতা বাড়ে। রাগ বাড়ে ছেলেটার। পাশ থেকে কুঁড়িয়ে নেয় একটা লোহার রড। এক ফটো-জার্নালিস্ট হঠাৎ হাজির। ছেলেটিকে বলল, 'তোমার রাগ নিয়ে দাঁড়াতে পারো, ছবি তুলবো।' রাগ তো আছে, সত্যি আছে! ছবি উঠলো। ভয়ঙ্কর সে ছবি। পরের টানা কিছু দিনের মধ্য সরকারি পরিসংখ্যানে গুজরাত দাঙ্গায় মৃত ৭৯০ জন মুসলমান। হিন্দু ২৫৩। বেসরকারি পরিসংখ্যানে সংখ্যাটা ২০০০-এর বেশি। আহত ২৫০০-র অধিক। গোধরাকাণ্ডের পর হিন্দু-ক্রোধের রূপক হয়ে গেল ছেলেটা। অশোক পারমার, অশোক মুচি। গুজরাত দাঙ্গায় হিন্দুত্বের মুখ। কিন্তু এত মৃত্যু, রক্ত, ঘৃণার চাপ বইতে পারে মুচি? মুচির মুখ!
তিনটে দশক পেরিয়ে গেল। বাবরি ধ্বংসের এক দশক পার হতে না হতে নরেন্দ্র মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। গোধরার এক যুগ পেরিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সবটুকু ফুটপাতে থাকতে থাকতেই দেখেছেন আজকের বছর পঞ্চাশের 'দাঙ্গার মুখ'। গুজরাত-দাঙ্গা চলাকালীন গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতে হয়। পাক্কা ৮ বছর কেটে গেছে, কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি, সাক্ষী দেওয়া তো দূরের কথা! অপরাধ নেই কোনো। কিন্তু ছবিটা? ওই যে, বিখ্যাত ফটোগ্রাফার সেবাস্টিয়ান ডি'সুজা তুলে নিয়ে গেলেন। গুজরাত, ভারত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল! তার কি হবে? আগামীর সমস্ত হিংসা আর শান্তির মাঝে ফিরে আসবে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা অশোক মুচির মুখ! একটা দীর্ঘকালের সমাজ, রাজনীতি, হিংসা-বিদ্বেষের রূপক হয়ে বেঁচে থাকা লোকটার ছবি চোখ বুঁজলে দেখতে পায় কত কত মানুষ! 'এই বিভৎস স্মৃতির ছবি হয়ে কী করে বাঁচো মুচি!'
১৯৯২-এর বাবরি থেকে ২০২৩। ফুটপাতেই নতুন করে বেঁচে থাকতে থাকতে দেশকাল নিজের মত করে বুঝেছেন দলিত অশোক পারমার। জীবন ছেনে বুঝেছেন - দাঙ্গা করার লোক, আর নেতা হবার লোক আলাদা। 'বাবরি ধ্বংসে গুজরাতে নরেন্দ্র মোদির উত্থান, আর গুজরাত-দাঙ্গা দিল্লির তখত দখলের ইভেন্ট।'
মুম্বই মিররের সেবাস্টিয়ান ডি'সুজা ওই এক ছবিতেই বিখ্যাত। পরে অবশ্য, ২৬/১১-র মুম্বই হামলায় আজমল কাসাভের একমাত্র ছবিটিও ডি'সুজারই তোলা। সেটা ২০১৩। না, সেবাস্টিয়ান ডি'সুজার সঙ্গে অশোকের আজো দেখা হয়নি। তবে, সেদিন ছবি তোলার মুহূর্ত ভুলতে পারেন না অশোক। ওই দুটো ক্লিক বদলে দিয়েছে - জীবনের মানে!
কেমন আছেন অশোক মুচি? কেমন কাটলো গত ২০-২২ বছর? তাঁর মতো করে, তাঁরও কিছু কথা আছে। গল্পের মতো। একটি একটি করে কাটানো দিনগুলির নির্যাসে সেও এক ভারতকথা!
প্রতিদিনের রোটি-কাপড়-মকানের লড়াইয়ের মাঝে দাঙ্গার দিনগুলি ফিরে আসে। প্রশ্ন হয়ে আসে, আসে কৌতুহল হয়ে। 'মোদি যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, প্রশ্ন আসবে' - জানেন মুচি। মোদি হিন্দুত্বের মুখ, আর তিনি দাঙ্গার মুখ! অশোক মনে করেন, ২০০১-এ গুজরাতে হিন্দুত্বের নয়া-রাজনীতি নরেন্দ্র মোদি শুরু করেছেন। দাঙ্গার আগে সে ভাবে আর কে চিনতো তাকে! গোধরা হল, দাঙ্গা হল, দেশবিদেশের মানুষ গুজরাত চিনলো। চিনলো নরেন্দ্র মোদিকে। 'গুজরাত হয়ে গেল আরএসএসের হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি!' সফলতা এল। সে পথেই মোদির সাফল্য, প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি লাভ। কিন্তু, দেশের একতা, সংবিধানে পাওয়া স্বাধীনতার অধিকার, সবটুকু হারিয়ে যাচ্ছে দ্রত! 'খতরে মে হ্যায় সব!' গত বিশ বছর ফুটপাতে বসে এটাই নাকি 'দাঙ্গার মুখ' অনুভব করেছেন। দরিদ্র, মহিলা, দলিত, মুসলমান - কারো জন্যই হিন্দুত্বের রাজনীতি মঙ্গলকারী নয়। 'মনুস্মৃতি আউর মোদিস্মৃতি মে কোই ফরক নেহি হ্যায়।'
কথায় কথায় অনেক কথা। ২০০২ থেকে টানা। খবর, তথ্যচিত্র, দেশ-বিদেশের নানা পত্রপত্রিকায় উঠে আসা দাঙ্গার মুখের কাছে কখনো খোঁজ নিতে আসেনি বিজেপি, আরএসএস বা বজরঙ্গ দলের কেউ। 'তখনও কোনও দল ছিল না তাঁর, আজও নেই।'
'আজকাল কিন্তু আর দাঙ্গা হচ্ছে না।' চেনা প্রসঙ্গে সোজা কথায় উত্তর আছে মুচির। 'দাঙ্গাকারী ক্ষমতায়, দাঙ্গা করবে কে?' দাঙ্গা করে সব পেয়েছে নেতারা। মন্ত্রিত্ব, ক্ষমতা, সব সব সব! তবে চোরা স্রোতের মত আরো ঘটনা ঘটছে, ঘটে চলেছে। 'কৌমবাদ আউর জাতিবাদ বাড় গেয়া হ্যায়।' উন্নয়ন হয়েছে আদানি-আম্বানির, কৌমবাদী-জাতিবাদীর। গরিবের কিছু হয়নি। হিন্দুত্বের রাজনীতি আসলে একটি ছল,- মনে করেন অশোক। ধর্মের নামে জাতির নামে সমাজের 'ব্রেন-ওয়াশ' হয়ে গেছে। আগামীর জন্য ছবিটা ভাল না!
কথায় কথা বাড়লে অস্তিত্বে টান পড়ে। পঞ্চাশের দোর গোরায় পোঁছে নিজেকে গান্ধীর দেশের প্রতিবাদী ভাবেন হিন্দুত্বের মুখ। কিন্তু সহজে নতুন সে মুখ হয়ে ওঠা যায় না। ব্যক্তিগত কোনও অপরাধ করেননি অশোক পারমার। শুধু কিছু মুহূর্ত স্রেফ সবরমতির জলে ভেসে গেল! ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে গুজরাত দাঙ্গার আরেক মুখ কুতুবউদ্দিন আনসারির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সিপিআই(এম) কেরালায় আয়োজন করেছিল সম্প্রীতি সভা। আত্মার টান অনুভব করে দু'জন। ওই তো আবারও নতুন হয়ে ওঠা! ক্রোধ ও কান্না ছবি হয়ে রয়ে গেছে। থেকেও যাবে। না চাইলেও ফিরে ফিরে আসবে। কিন্তু, এ বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক ও সরল।
'শহিদ ভগৎ সিং-বালা ভারত বননা চাহিয়ে, আম্বদেকর-বালা ভারত বননা চাহিয়ে।' গান্ধী-প্যাটেলের ভারত চাই। যাঁর মধ্যে গান্ধীর মানবতা আছে, সর্দার প্যাটেলের সমানতা আছে, আম্বেদকরের মিত্রতা আছে, তেমন ভারত চান অশোক। উঁচু মূর্তি বানালেই কোনও সাম্রাজ্য মহান হয় না। 'সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বানিয়েও মোদিজির মধ্যে সাম্যের ভাবনা নেই।' - অকপটে আজকাল এমনই বলেন ফুটপাতের মুচি।
এত লোক মারা গেল দাঙ্গায়, সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী, আজকের প্রধানমন্ত্রী 'আই আই অ্যাম সরি - বলতে পারলো না কেন!' কারণ চিন্তায় সমানতা নেই। ছিল না। মুসলমানের সঙ্গে, দলিতের সঙ্গে ভেদাভেদ করেছে বিজেপি। করে চলেছে।ফিরে আসে শুরুর কথা। চোখ-মুখ বদলালো কই অশোক? এখনও যেন ক্রোধ আছে বহিরঙ্গে! আশ্চর্য হয় না সে। ফিরে যায় আরো অতীতে। "দারিদ্রে জন্মেছি, বাপ ফুটপাত ছাড়া কিছু দেননি। পড়তে চেয়েছিলাম, পারিনি। যে জাতে জন্মেছি, সে জাত শিক্ষার পথ নিজেই পায়নি। - এসব রাগের কারণ নয়?" তাঁর পাল্টা প্রশ্নের উল্টো দিকে মরমি মন কই?
প্রেম? বিয়ে? - বেশ কিছুকাল আগে থেকেই অবস্হান স্পষ্ট করেছেন দাঙ্গার মুখ। প্রেম নিয়ে গেছে সেবাস্টিয়ানের ক্লিক। অমন দাঙ্গার মুখকে ভালবাসলে বিপদ। সন্তান এলে দাঙ্গার মুখের পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে বড় হবে কেন? তাঁর চেয়ে, নতুন স্বপ্নে সবার ভারত চান 'দাঙ্গার মুখ।' সে ভারত হাতে হাত ধরে বানাবে - 'দলিত ও মুসলমান।' এখনও যাঁরা অন্যের ইশারায় দাঙ্গা করে, মরে বা তাঁর মতো দাঙ্গার মুখ হয়ে যায়!
অশোক পারমার বেঁচে আছেন। ইতিহাসের অসংখ্যা ধর্মীয়, জাতিবাদী দাঙ্গার রক্তাক্ত রূপক হয়ে বসে আছেন ফুটপাতে। তাঁর নিজের গল্পের - সারল্য ও দারিদ্র নিয়েই সেলাই করছেন জুতো। হয়তো বিড়বিড় করে নিজেকে বলছেন, -'দাঙ্গার কেউ পরিকল্পনা করে, কেউ নেতৃত্ব দেয়, কেউ মারে, কেউ মরে। কেউ স্রেফ মুখ হয়।' এখানেই ভ্রম। কারণ, 'দরিদ্র দলিতের সঙ্গে হিন্দুত্বের দূরত্ব মেটেনি, মিটবে না কোনও দিন। কারণ, শেষমেশ থেকে গেছে ভেদাভেদ, জাতপাত।'
সংযোজন: যেখানে জুতো সেলাই করতেন অশোক মুচি, শাহপুরের স্হানীয় দরিয়াপুরের দিল্লি দরওয়াজা'য় বছর চারেক হল, একটি জুতোর দোকান দিয়েছেন তিনি। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে 'একতা চপ্পল ঘর' নামের সে দোকানের উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন গুজরাত দাঙ্গার আরেক মুখ - কুতুবুদ্দিন আনসারি৷ দেখতে দেখতে তাদের বন্ধুত্বের বয়সও এখন এক দশক।
এই লেখকের অন্য লেখা পড়ুন।
সংবিধানের কান্না : দর্জির দেশকাল