না, ইন্ডিয়া নয়, ভারত ভ্রমণ করেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের করসেবক জুটিয়ে ছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। 'এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো', - না, স্লোগান মানে নাড়া হলেও, এটা স্লোগান নয়। নাড়া।
৫ ডিসেম্বর ১৯৯২। একদিন আগেই বন্ধু যোগেন্দ্র পালের সঙ্গে অযোধ্যা পৌঁছেছিলেন পানিপথ, হরিয়ানার বলবীর সিং। ৬ ডিসেম্বর, খানিক দূরের মঞ্চ আলো করে ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবাণী, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতীরা। শুরু হল দৌড়। কে আগে উঠতে পারে প্রাচীন মসজিদের মাথায়। বাবরের মাথায়। মুঘলের মাথায়। মনের কোণে জমে থাকা ঘৃণা ততক্ষণে সাবল আর গাঁইতি। ক্রোধ ঝরে পড়ল বাবরির গায়ে। 'একটা ইতিহাসের বদলা নেওয়া গেল!' চরম বদলা!
গান্ধীবাদী স্কুলশিক্ষক দৌলত রামের ছেলে বলবীর। জন্ম পানিপথের কাছে একটি গ্রামে। দেশভাগের জ্বালা ছিল দৌলত রামের। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির পরিমণ্ডলে বাঁচতে চাইতেন। চাইতেন, তিন সন্তানও সে পথে হাঁটুক। বলবীর তখন বছর দশ, পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে এল পানিপথ শহরে। বদলে গেল পরিবেশ। প্রতিবেশীদের সঙ্গে নানান ঝামেলা চলছেই। এরই মধ্যে একদিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্গের শাখায় পা রাখে বছর দশেকের ছেলেটা। শাখায় 'আপ' মানে আপনি সম্বোধন শুনে আপ্লুত হয় বলবীর!
লাগাতার দশ বছর আরএসএসের শাখায় নানান রকম, নানা কিছু শেখার পর, শিবসেনায় যুক্ত হয় বলবীর। সঙ্গে চালিয়ে যায় পড়াশুনা। রোহতক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন-তিনটি এমএ পাশ করে । তা না-হয় হল, কিন্তু মনে মুসলমানের প্রতি ঘৃণা এল কোত্থেকে? কঠিন ছিল না সে প্রক্রিয়া, সে সব দিনে চারপাশের 'সমস্ত খারাপ বিষয়ই মুসলমান' বলে প্রতিপন্ন করা হতো।' বাঁ হাতে খাবার খেলেও বলা হতো, - ''মুসলমান হ্যায় কেয়া!" মস্তিকে ভরে দেওয়া হয়েছিল -''আমাদের ইতিহাস বিকৃত, বাবর-আওরঙ্গজেবরা এসে আমাদের মন্দির ভেঙেছে, জমি দখল করেছে!" এসব মনে নিয়ে বদলার প্রহর গুনছিল বলবীররা।
৫ ডিসেম্বর, অযোধ্যা পৌঁছনোর পর, বারবার মনে আসছিল - বন্ধুদের কথা। 'কিছু না করে ফিরিস না!' যোগেন্দ্রকে নিয়ে অযোধ্যায় পোঁছে বজরং দলের আসরে ভিড়লেন দুই জিগরি-দোস্ত। চারপাশের আলোচনায় উঠে আসছিল, 'সিন্ধ্রি লালাকৃষ্ণ আদবাণী আর যাই হোন, ঠিকঠাক হিন্দু না, আর উমা ভারতী তো ড্রামা কুইন! এদের দিয়ে কিস্যু হবে না! নাড়া উঠছিল, -'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে, কল্যাণ সিং কল্যাণ করো - মন্দির কা নির্মাণ করো', ইত্যাদি প্রভৃতি। "পরের দিন জানোয়ারের মত হয়ে গেলাম। গাঁইতি নিয়ে বাবরির টিলায় উঠলাম...।" কিন্তু তারপর? ৬ ডিসেম্বর পার করে পানিপথে ফিরলে, যোগেন্দ্র আর বলবীরকে হিরোর মত বরণ করা হয়। জীবনে কিছু করা গেল শেষমেশ!
ওদিকে, ঘরের পরিবেশ উল্টো। বাবা দৌলত রাম সাফ বললেন, "ঘরে নয় তিনি থাকবেন, অথবা বলবীর।" বাড়ি ছাড়তেই হল। বলবীরের স্ত্রী সঙ্গে যাবার ডাক শোনেননি। ফলত, একাই ঘর ছাড়েন বলবীর। দাঙ্গার পরিবেশ ছিল, দাঙ্গা চলছিল। কোথাও মনে হচ্ছিল -' এই পরিস্হিতির জন্য সেও দায়ী।' পালিয়ে বেড়াচ্ছিল বলবীর। দাড়ি আছে, এমন কারোকে দেখলে ভয় পাচ্ছিল দিন কয়েক আগের করসেবক। মাস কয়েক এখানে ওখানে ঘোরার পর জানতে পারেন, - বাবা দৌলত রাম আর নেই। অগত্যা, বাড়ি ফেরা। সেখানে শুনতে হল, বাবার মৃত্যুর কারণ সে। গান্ধীবাদী দৌলত রামের সন্তান স্বয়ং করসেবক, মানতে পারেননি অশীতিপর প্রবীণ । পরিবারকে আগাম দৌলত রাম জানিয়ে যান,- 'যেন তাঁর পারলৌকিক কাজে বলবীর অংশগ্রহণ না করে!'
কিছুকাল পরিবার ও চারপাশ থেকে আসা বিষাদ সঙ্গী করে একাই ছিলেন করসেবক। একদিন জানতে পারেন, বাবরিকাণ্ডের পর দাঙ্গা দেখে বন্ধু যোগেন্দ্র পাল চরম মানসিক অস্হিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তা থেকে মুক্তি পেতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যোগেন্দ্র'র মনে হতো, সে পাপ করেছে। যেন সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। খবর নিয়ে, মাস ছয়েক পর সোনিপথে মওলানা করিম সিদ্দিকির কাছে পৌঁছান 'পবিত্র পাপী'। যোগেন্দ্র করিম সিদ্দিকির কাছেই ইসলাম গ্রহণ করেন। বলবীরও তাই করলেন। নাম হল মহম্মদ আমির। প্রতিজ্ঞা করলেন,- 'গড়বেন অন্তত ১০০ মসজিদ।' ধর্মান্তরিত হবার পর কিছুকাল সোনিপথের মসজিদেই ছিলেন আমির। একদিন স্ত্রী-ও পানিপথ ছেড়ে আসেন সোনিপথে। ইসলাম গ্রহণ করেন।
গত ২০২১-এর ২৪ জুলাই, মহম্মদ আমির, ওরফে বলবীর সিং রহস্যজনক ভাবে মারা যান। শেষদিকে হায়দরাবাদের বাবা নগরে থাকতেন। মরার পর তাঁর ঘরে রহস্যজনক গন্ধ পাওয়া গেছে। না, সে রহস্য গত দু-বছরে মেটেনি। ১০০ মসজিদ বানানোর লক্ষ্যে চলা বলবীর ততদিনে কমবেশী ৫০ টি মসজিদ বানিয়ে ফেলেছেন!
যোগেন্দ্র পালের নাম এখন মহম্মদ উমর। তিনিও এখন প্রায় প্রবীণ। জানা যায়, সে দিনকার বলবীর আর যোগেন্দ্রর আরেক করসেবক বন্ধু শিবপ্রসাদ, যিনি অযোধ্যায় বজরঙ্গ দলের কর্মী ছিলেন, নিজের হাতে ৪০০০ করসেবককে মসজিদ ভাঙার ট্রেনিং-ও দিয়েছিলেন। দাঙ্গা তাকেও পথ বদলাতে বাধ্য করেছে। শিবপ্রসাদও ইসলাম গ্রহণ করেন, নাম হয় মহম্মদ মুস্তফা।
বলবীর থেকে আমির হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত, - স্রেফ 'আমন' মানে শান্তি চেয়েছেন এক-কালের পবিত্র পাপী! দাঙ্গার মরণ, আর বিদ্বেষের ফলাফলে যা ক্ষতি, তা পূরণ হয় না, স্রেফ স্মৃতিতে কালো দাগ নিয়ে এগিয়ে চলে সময়। মহম্মদ আমির, মহম্মদ মুস্তফা, মহম্মদ উমররা হয়তো এর পরেও গোরক্ষকদের হাতে আক্রান্ত হবেন। বা বজরঙ্গ দলের কেউ টুটি টিপে ধরবেন। রক্তাক্ত হবে ভারত। এই বহুকালের সভ্যতায় পড়ে থাকবে রক্তাক্ত কিছু ধর্মস্হান, আর তার পাশে ছড়ানো ছেটানো থাকবে বলবীরদের আমির হবার গল্প। এক ভারতের নানান রকম হওয়ার ইতিকথা।
এই লেখকের অন্য লেখা পড়ুন