এককালে রামকৃষ্ণ মিশন এবং পরবর্তীকালে সারদা মিশন পরিচালিত একটি স্কুলেই আমার ছাত্রজীবন কেটেছে। বলতে দ্বিধা নেই, আমার স্কুল ছিল আদ্যোপান্ত ধর্মীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি যে ধর্মাচরণ করার শিক্ষা আমাকে দেওয়া হত, স্কুলের নিয়ম এবং পালনীয় আচরণাবলির মধ্যে সেই ধর্মানুষ্ঠানের রীতি অন্তর্ভুক্ত করে তাকে ছাত্রদের অবশ্যপালনীয় করে তোলা হয়েছিল। আজ স্বীকার করছি, পারিবারিভাবে হিন্দু পরিবারের সন্তান হওয়ায়, আমার স্কুলের এই নন-সেক্যুলার আচরণে সেদিন আমার কোনো অসুবিধের বোধ তৈরি হয়নি। তখনও আমার চোখ খোলেনি, মন জাগেনি, কান খাড়া হয়নি, সাগরের হাওয়া নিয়ে নিশ্বাসে আমার গম্ভীরা নিশি কাটেনি। ফলে, আমার মুসলিম সহপাঠীটিকে একটি ভালো স্কুলে ভরতি হতে চাওয়ার বিনিময়ে কেন বাধ্যতামূলকভাবে 'বিশ্বরূপদর্শনযোগ' থেকে প্রার্থনা করতে হবে (গীতা আমাদের পাঠ্যও ছিল, কিন্তু সংস্কৃত ভাষা শিখতে গিয়ে গীতা পড়াটা ভাষাশিক্ষার কারিকুলামের অঙ্গ হতে পারে, তাই তা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু সেই টেক্সটটাকেই যদি প্রেয়ার টেক্সট হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেটা আর অ্যাকাডেমিক মিডিয়াম থাকে না), কেন ইদের দিন অ্যানুয়াল পরীক্ষা পড়লে ওকে অন্য দিন এসে পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে, এসব তখনও আমার মনে প্রশ্ন ধরাত না। কারণ, আমরা অধিকাংশই ছিলাম হিন্দু। আমাদের অসুবিধে হত না।
হ্যাঁ, আমাদের অসুবিধে হত না হাতজোড় করে চোখ বুজে গীতা আর উপনিষদ থেকে প্রার্থনা করতে, অসুবিধা হত না ক্লাস ওয়ান আর ক্লাস টুতে ইতিহাস বই হিসেবে যথাক্রমে রামায়ণ আর মহাভারত পড়তে, এমনকি ক্লাস সেভেনে উঠেও র্যাপিড রিডার হিসেবে আমাদের মহাভারত পড়তে হত, আমাদের অসুবিধে একেবারেই হত না স্কুলে জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা পালিত হলে। আমাদের ছুটি থাকত বড়োদিনে, গুরু নানকের জন্মদিনে, প্রার্থনার হলে বিশাল বড়ো শ্বেতপাথরের বুদ্ধমূর্তি ছিল, শুধু ইদ বা শবেবরাতে কোনোদিন কোনো ছুটি পাইনি আমরা। আমাদের ছোটোবেলায় 'বাণীর খাতা' নামে একটা কোটেশন কালেকশনের খাতা বানাতে হত। তাতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-সারদা দেবী-সিস্টারের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন বুদ্ধ, জিশু, জরাথুষ্ট্র, এমনকি কনফুসিয়াসও! কিন্তু ভুলেও কেউ কোনোদিন হজরতের কথা বলেননি, কোরান পড়াননি, নবীদের জীবনী পড়াননি।
কিন্তু স্কুলে তো এ ধরনের ধর্মীয় বিষয়ই একমাত্র পাঠ্য ছিল না, সেখানে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের টেক্সট বইও পড়তে হত। তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর সেক্যুলার টেক্সট ছিল, ক্লাস ফাইভে পাঠ্য ছিল 'মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান', ক্লাস সেভেনে লাইব্রেরিয়ান রিনা দি 'আদাব' পড়ে শুনিয়েছিলেন, টেনে পাঠ্য ছিল 'হারুন সালেমের মাসি' আর 'চিঠি'। ক্লাসে যাঁরা বাংলা পড়াতেন, কোনোদিন কিন্তু প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাননি। ধর্মীয় উদারতার পাঠ ক্লাসরুম থেকে ঠিক যেভাবে শুরু করা উচিত, সেভাবেই শুরু করতেন। গোঁড়ামির শিক্ষাও দেননি, অন্ধ কবন্ধও করে তোলেননি।
আজ সেই শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলি, ওই স্কুলটায় আপনারা খুব বেমানান ছিলেন, আছেন, থাকবেন। আপনাদের শেখানো সমস্ত বুলি যে শুধুই পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে আসার জন্য, নম্বর তোলার জন্য আর রাজনৈতিক নেতাদের মতো করে মিথ্যে বক্তৃতা দিতে পারার জন্য, সেকথা প্রমাণ হয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতায়, কিংবা বিভেদকামী পাওয়ার স্ট্রাকচারের বিরোধিতায় বিশ্বাস করে না এই মিশন।
স্বামীজির জন্মদিন চলে গেল, কিন্তু তার আগের দিন দেশের দুই জাতির মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া, রক্তলোভী একটা পিশাচকে রাজকীয় অভ্যঅর্থনা করে রাত্রিবাস করতে দিয়েছে তাঁর হাতে-তৈরি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। চাড্ডিরা যখন দাবি করত, বিবেকানন্দ আমাদের, আমি হাসতাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবেকানন্দের বাণী ডিসপ্লে বোর্ডে রাখা নিয়ে ছাত্র সংসদ যখন প্রবল অশান্তি করেছিল, বলেছিল ধর্মীয় নেতাকে ক্যাম্পাসে প্রোমোট করা যাবে না, তখন ভুরু কুঁচকেছিলাম। স্বামীজির দর্শন কি শুধুই ধর্মীয় প্রোপাগান্ডার ম্যানিফেস্টেশন ছিল? স্বামীজি কি শুধুই আরএসএস-এর সম্পত্তি নাকি? আজ বুঝতে পারছি, আমি ভুল। স্বামীজির হাতে-গড়া, তাঁরই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ভারতীয় রাজনীতির একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে তাদের সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। আর কোনোদিন জোরগলায় বলতে পারব না যে, স্বামীজি মৌলবাদীর সম্পত্তি নন। লজ্জাই হচ্ছে মিশন পরিচালিত একটি স্কুলে পড়েছি বলে। একটাই শুধু আলোর রেখা। স্কুলটা সিস্টার তৈরি করেছিলেন। আমার শুধু সিস্টার রইলেন। সেই সিস্টার, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে যিনি যুক্ত হওয়ায় একদিন সংবাদপত্রে প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল রামকৃষ্ণ মিশন। চিরকালের সুবিধাসন্ধানী। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
সময় এবং পরিস্থিতির যোগ মনের মধ্যে থাকা কিছু খটকাকে পরিষ্কার করে একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়। দশ বছর ধরে খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে সারদা মিশন ও রামকৃষ্ণ মিশনের পরিচালকদের নিয়ে অনেক প্রশ্ন জমতে থাকে, চিড় ধরে স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন দাঙ্গাবাজ পিশাচকে তাঁরা বরণ করলেন, নানা অভিধায় ভূষিত করলেন, সেলফি তুললেন তখন নিশ্চিত হলাম মিশন সম্পর্কে, তাদের বদমায়েশি মেশানো সাম্প্রদায়িক চরিত্র বিষয়ে। এই ক্রোধ থেকেই মিশনের প্রাক্তনী হিসেবে লেখাটি লিখি ফেসবুকে আর তখন একদিকে বিপুল সমর্থন আর অন্যদিকে ভয়ংকর আক্রমণ চলতে থাকে। চলতে থাকুক, কিছু যায় আসে না। পাঠক, পড়ার সময়ে মাথায় রাখবেন যে এটা ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্ট, কোনো প্রবন্ধ বা প্রতিবেদন নয়।