সম্প্রতি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত অনিলচন্দ্র শাহ্ এই বাংলার মতুয়াগড়ে এসে বলেছেন, তিনি বা তাঁরা মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেবেন।
এত দিন মতুয়ারা ভোট দিয়েছেন। বেনাগরিক হয়ে কীভাবে তাঁরা ভোটার তালিকায় নাম তুললেন, এই প্রশ্ন করা যায় এবং বেনাগরিক ভোটের লিস্টে নাম তুললে তার কী শাস্তি হয়, সে কথা সকলেই জানেন! মতুয়ারা এতদিন রেশন তুলেছেন, ভারতীয় জনগণের করের টাকায় চাকরি করেছেন, নিজেরা ভারত রাষ্ট্রকে কর দিয়েছেন, দেশের বিধায়ক-সাংসদ হয়েছেন। বেনাগরিক হয়ে এই সব সম্ভব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-দের রাজত্বে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, দেশে সব মানুষের কোভিড টিকা সম্পন্ন হলে এই নাগরিকত্ব প্রদানের কাজ শুরু হবে। তাহলে ‘বেনাগরিক’ মতুয়ারা বিনা পয়সায় কোভিড ভ্যাকসিনও পাবেন।
‘বেনাগরিক’ মতুয়ারা ভারতের নাগরিক হবেন। সিএএ—নাগিরকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এর বলে তাঁরা এই নাগরিকত্ব লাভ করবেন। যতদূর জানা যায়, ওই সংশোধনী আইন হিন্দু, বৌদ্ধ, জরাথ্রুষ্টবাদী, শিখ, জৈন ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। মতুয়ারা শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুগামী একটি স্বতন্ত্র উদার ও ঋদ্ধ ধর্ম ও দর্শন। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাঁরা হিন্দু না মতুয়া? হিন্দুদের একটি শাখা, নাকি স্বতন্ত্র স্বাধীন ধর্মমত?
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত নামক পবিত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে, শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্র ঘরে জন্মেছেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম বৈষ্ণব নয়, বা তার শাখাও নয়। ছেলেবেলা থেকে ঠাকুর ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। তিনি বেদ মানেন না, বৈদিক কর্মকাণ্ডের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। লীলামৃত বলছে,
ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ।
ব্রাহ্মণ প্রধান মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।।
…কুকুরে উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খায়।
বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।।
…নামে প্রেমে মাতোয়ারা মতুয়ারা সব।
কোথায় ব্রাহ্মণ লাগে কোথায় বৈষ্ণব।।
কোথায় ব্রাহ্মণ লাগে কোথায় বৈষ্ণব।
স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভণ্ড সব।।
ছান্দোগ্য উপনিষদের ঋষি বলেছেন, ধনার্জনের উপায় হিসাবে পণ্য হিসাবে বাইরে চলে যায় সে সব, অনাহারে মরেন দরিদ্র মানুষ—মতুয়াদের মতো অন্ত্যজরা। অন্ন হল চৈতন্য আর ক্ষুধা হল মৃত্যু। এই মৃত্যু থেকে চৈতন্যে মতুয়া-মানুষদের উত্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন শ্রীশ্রী ঠাকুর।
আজ ভারতের নাগরিক মতুয়া তথা সাধারণ মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সমাধান না করে কেন তাঁদের সামনে নাগরিকত্ব নামক গাজর ঝোলাচ্ছে এই কেন্দ্রীয় সরকার? মতুয়ারা ভারতের নাগরিক, কারণ তাঁদের ভোটাধিকার আছে, তাঁরা চাকরি করেন, কর দেন, ভোটে দাঁড়ান।
এই বেনাগরিক করার খেলাটা করলে খুব সুবিধা হয়। অন্নের কথা, স্বাস্থ্যের কথা, কর্মসংস্থানের কথা ভুলিয়ে দেওয়া যায়। এবং এটা বিশেষভাবে করা হচ্ছে অসম-ত্রিপুরা আর বাংলায়। কেন? অনুপ্রবেশকারী এবং বাংলাদেশী হিসাবে তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া সহজ, কারণ তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু স্মরণে রাখা দরকার, এই বাঙালিরা কিন্তু নিজের ভাষাকে নিয়ে আন্দোলন করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে সারা দেশের মাতৃভাষা দিবস বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশ থেকে এক কালে আসা মতুয়ারা ভারতেরই নাগরিক, কারণ সরকার তাঁদের ভোটার লিস্টে নাম তুলেছেন, প্যান কার্ড, আধার কার্ড দিয়েছেন। এখন কেন তাঁরা সিএএ দিয়ে নিজেকে আবার নাগরিক বানাতে যাবেন? তাঁরা সিএএ-তে যাবেন মানেই প্রথমেই তাঁদের ঘোষণা করতে হবে যে তাঁরা বেনাগরিক। এই জায়গাটিকে প্রশ্ন করুন মতুয়ারা, বঙ্গের মানুষ, অসমের মানুষ, সারা ভারতের মানুষ। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। এমন সময়ে বেনাগরিক করে নাগরিক করে দেওয়ার আষাঢ়ে অস্বাভাবিক যুক্তিহীন গল্পে ভুলবেন না।
আচ্ছা ধরেই নিচ্ছি, মতুয়াদের বেনাগরিক বানিয়ে আবার নাগরিক করা হবে, একটা গেরুয়া নাগরিকত্বের কার্ড দেওয়া হবে। সমস্ত ভারতীয়র টিকাকরণের পর মতুয়ারা ‘নাগরিকত্ব’ পাবেন, এই কথা যদি অতি কষ্টে মেনে নিই তাহলে ক্ষতি কী? দেখে নিই চলুন।
২৬ দিনে ভারতে ৭০ লক্ষ মানুষকে টিকা দিয়েছে সরকার। বিশ্বরেকর্ড। ভাবাই যায় না। অতএব, সহজ অঙ্কে ভারতের ১৩০ কোটি লোককে ভ্যাকসিন দিতে সময় লাগবে ৪৪২০ দিন অর্থাৎ ১২ বছরের কিছু বেশি সময়। ইতিমধ্যে বহু শিশু জন্মাবে, তাদের টিকা দিতে আরও কয়েক বছর লাগবে। অর্থাৎ, মোট সময় লাগবে কমপক্ষে ১৪ বছর।
রামচন্দ্রকে কিন্তু কৈকেয়ীর প্ররোচনায় ১৪ বছর বনবাসে যেতে হয়েছিল!