প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া যায় কিন্তু সারাজীবন প্রতিষ্ঠানবিরোধী থাকাটা প্রায় একটি অসম্ভব প্রক্রিয়া। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে গেলেন সুবিমল মিশ্র। একটি সমিধ সর্বভূক অগ্নিতে পরিণত হওয়া পর্যন্ত সুবিমল মিশ্র থেকে গেলেন সংশপ্তক। কিন্তু কী মজার ঘটনা, যে সুবিমল একটি অক্ষরও বাজারি পত্রিকায় লেখেননি, তাঁর মৃত্যুর পরে সেই বাজারি কাগজেই খবর হলেন সুবিমল মিশ্র। কেউ কেউ আবার লিখে ফেললেন 'নক্ষত্র পতন'। সুবিমল থাকলে হয়ত 'বাজারের পোঁদে আগুন, অন্তর্ঘাত ও কৃষ্ণমোহনের মাসী' বলে একটা কিছু লিখে ফেলতেন।
পুঁজির ধর্মই বাজারজাত করা। নিরবচ্ছিন্নভাবে পুঁজি তা করে যায়, বেঁচে থাকতে থাকতে না করতে পারলে, ইন্তেকাল হলে করে। সেটাই চলছে। চলবে। অ্যান্টি উপন্যাস সংগ্রহের পুস্তানির ভিতরে সিঁধিয়ে গিয়েও করবে। এখানেই আমরা পুঁজির ক্রীড়নক। আমি, আমরা ও অন্যরা। সুবিমল মিশ্র এখানেই আলাদা। তিনি যদি স্বল্পকাল বাঁচতেন, তবে এই কাজটা সহজ হত, কিন্তু আশি বছরের জীবনে এই অবিচল থাকাটা সব বিবেচনাতেই নেক্সট টু ইম্পসিবল। গত পাঁচ দশক ধরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এক একক প্রদর্শনী। স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ব্রহ্মাণ্ডময়। তিনি একা এবং একা। সুবিমলের পক্ষে যদি কেউ থাকে সেটাও সুবিমল। সুবিমলের বিরুদ্ধেও যদি কেউ থাকে তিনিও সুবিমল।
তাই প্রথম বইসংগ্রহের উৎসর্গপত্রে তিনি বলতে পারেন, ‘মহৎ সাহিত্য হয়ে উঠেছে কি গেল... তোমার লেখা যেন কোনভাবেই মহৎ না হয়ে যায়...’। আর সে কারণেই নিজের লেখার পাঠক যখন কেউ হয়ে উঠছেন, আরও নিবিড় ও খননকারী পাঠক হয়ে উঠতে চাইছেন, সুবিমল অক্লেশে তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছেন। যেন সচেতনভাবেই তিনি এক অন্তর্ঘাতী। কিন্তু কেন করতেন? এটাও কি প্রচারে থাকার কোনও চোরাগোপ্তা পথ? না। এসবের কারণ একটাই, বাজার নামক শব্দটাকে অশ্লীল বলে মনে করতেন। তবে এসবের জন্য শুচিবাই না রেখেই সব রকমের বাজারি ধ্যাষ্টামোকে পা নোংরা হবে বলে সরাসরি পেটে লাথি না মেরে পোঁদে লাথি মারতে জানতেন তিনি। তবে অথর আর টেক্সটের মধ্যের রসায়নটা তাঁর এতটাই জানা ছিল, যে কেউ কাউকে ছাপিয়ে যেতে পারত না, ফলে মহৎ হওয়ার কোনও আশঙ্কা ছিল না। যতদিন তাঁর কলমে কালি ছিল আর সেই কলম চালানোর মতো তাগত ছিল, কাউকে রেয়াত না করে ততদিন লিখেছেন বা বলা যায় নিজের কথা বলেছেন। বুর্জোয়া মধ্যবিত্তর নৈতিকতা আর যৌনতা নিয়ে কাতরানি উন্মুক্ত করেছেন। ন্যাংটো করে দিয়েছেন উচ্চমার্গীয়দের নীচতাকে। চন্ডাল ও ব্রাহ্মণকে একপাতে খাইয়ে-শুইয়ে আমাদের ভিক্টোরীয়-মার্ক্সীয় নৈতিকতার সাড়ে সব্বনাশ করে ছেড়েছেন। তাই একটুও হোঁচট না খেয়ে, ‘হারাণ মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গাঁধী মূর্তি’ -তে
লিখতে পারেন, 'বিধবা মেয়েমানুষের উপোষী পেট হচ্ছে বাচ্চা পাড়ার সবচেয়ে প্রশস্ত জায়গা।' তার আগেই পাথরে খোদাইয়ের মতো লেখা হচ্ছে, 'হারাণ মাঝি মরে বৌটাকে অনাথ করে গিয়েছিল, বৌটা মরে বাচ্চাটাকে অনাথ করে গেল। শিশুর শরীরে পাপ নাই, শিশু ঈশ্বরের তুল্যি, তুলে নিয়ে যাও পুণ্যি হবে –কারা যেন কথাগুলো বলে ওঠে।…’
‘… বৌয়ের গলার হারটা, তার শেষ সম্বল, অত্যন্ত সাধের জিনিস বেচতে গিয়ে হারাণ কেঁদে ফেলেছিল, অবশ্য তার সেই কান্না পৃথিবীর কাকপক্ষীও টের পায়নি।'
এই যে চোরাগোপ্তা চালিয়ে দেওয়া, এটাই অ্যান্টি গল্প, অ্যান্টি সাহিত্য৷ আসলে এটাই রামায়ন চামারের গল্প হয়ে ওঠার নেসেসারি অ্যান্ড সাফিসিয়েন্ট কন্ডিশন। নো লেফট, নো রাইট। কোনও সরকার বা সরকারবাড়ির লোক না হয়ে ওঠা সুবিমল মিশ্র হয়ত নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান বা প্রোটো-প্রতিষ্ঠান।
কম বয়সে শুনেছিলাম, নিউ ওয়েভ সিনেমার পুরোধা-মুখ জাঁ লুক গোদারের 'ব্রেথলেস' দেখে নাকি সুবিমল মিশ্র পরিচালককে চিঠি লিখেছিলেন। 'ব্রেথলেস'এর কাজ নিয়ে তাঁর মুগ্ধতা ও আকর্ষণের কথা সেই চিঠিতে উল্লেখ ছিল। চিঠির সঙ্গে নিজের লেখার কিছু স্পেসিমেন নাকি সুবিমল পাঠিয়ে ছিলেন। এটাও শোনা, গোদার নাকি প্রাচ্যের এই লেখককে উত্তরও দিয়েছিলেন। সুবিমলকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন -- 'গোদার অফ লিটারেচার' বলে। এর মধ্যে কতটা জল আছে জানি না। তবে সুবিমলের লেখার মধ্যে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম, ফর্ম উঁকি দিয়ে যায় অহরহ। কোলাজ, মন্তাজ, জাম্প কাট, ক্যালিগ্রাফি। তবে গোদার ছাড়াও তাঁর সাহিত্যভাবনায়, তাঁর সাহিত্য-আদর্শে লুই বুনুয়েল, আন্দ্রেই তারকভস্কি, ঋত্বিক ঘটকের প্রভাবও পড়েছে। পড়েছে জঁ-পল সার্ত্র, জেমস জয়েস, স্যামুয়েল বেকেটেরও।
'প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৩ ঘণ্টা লিখি, ৫ ঘণ্টা পড়ি, দিনে ২ পাতা হিসেবে বছরে ৭০০ পাতা লিখি, ৭০ পাতা ছাপতে দেই’। তাঁর এই আত্মকথনের মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে তাঁর রচনা প্রক্রিয়া। নিজের লেখার পারফেকশন নিয়ে তাঁর ছিল গভীর উৎকণ্ঠা। আর তা থেকেই এসেছিল সন্দেহ। এই সন্দেহ থেকেই প্রবলভাবে পরখ করে প্রয়োগ করতেন প্রতিটি বাক্য, শব্দ, দাড়ি, কমা, ..., হাইফেন, সেমিকোলন, ড্যাশ । ফলে সুবিমল-পাঠক যদি এগুলো ভেদ না করে সুবিমলের লেখা পড়তে গিয়ে গল্প খুঁজে না পান, সেটা চূড়ান্তভাবেই পাঠকের ব্যর্থতা। অর্থাৎ সুবিমল পড়তে হবে হাইফেন, ড্যাশ সরনির মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে ইন-বিট্যুইন দ্য লাইনস। সুবিমল মিশ্র’র গল্প-উপন্যাসে কোনও ধরতাই কাহিনিসূত্র খুঁজে দেখতে গেলে হাতড়াতেই হবে। কেননা, একজন রক্তমাংসের স্রষ্টা হিসেবে সুবিমল বিশ্বাস করেন মানুষের জীবনের কোনো একমাত্রিক-টইটম্বুর-নিটোল কাহিনি থাকে না। সুবিমলের কথামালা তাই সতর্কীকরণের চিহ্নমাত্র। তাই তাঁর কোনও গোষ্ঠী নেই। একা বেঁচেছেন। একা বিচরণ করেছেন বাংলা সাহিত্য জগতে অর্ধশতাব্দী। এবার একা মারা গেলেন। বোধহয় সেটাই ছিল তাঁর ইচ্ছে। কেননা,
সবরকম ক্ষমতাই নানা কসরতের মধ্য দিয়ে একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থার দিকে আমাদের ঠেলে দেয়। পৌঁছে দেয়। সুবিমল মিশ্র সেই সিস্টেমটাকে অস্বীকার করতেই কলম ধরেছিলেন।