ছবিটা দু'জনেই দেখেছিল। গোটা পাতা জোড়া ছবি। সাদাকালো কিন্তু স্পষ্ট। কিম্ভূত চেহারার একটা লোক বিরাট একটা গোলকার বস্তুকে দু'হাতে ধরে কামড় বসাচ্ছে। গোল বস্তুটা অবশ্য শ্যাম-জসিমের খুব চেনা। ভূগোল ক্লাসের দিদিমণির নির্দেশে মাঝেমধ্যে টিচার্সরুম থেকে বস্তুটাকে তাদের বয়ে আনতে হয় নিজেদের ক্লাসরুমে— সেটা আর কিছুই নয়, বেশ বড়োসড়ো আস্ত একটা গ্লোব।
এটাতো…
ফটোগ্রাফি। অরিজিনাল। স্যাটেলাইট জানিস তো। কৃত্রিম উপগ্রহ। সেখান থেকে তোলা ছবি। শ্যামের কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে ওঠে অমিতদা। শ্যাম স্যাটেলাইট কাকে বলে বিলক্ষণ জানে। ক্লাস এইটে পড়ে আর এটুকু জানবে না! ওকে জিজ্ঞেস করলে, পিএসএলভি আর জিএসএলভি রকেটের পার্থক্যও বুঝিয়ে দিতে পারে সবাইকে। সেই কথাটা বলতে গিয়েই জসিমের দিকে চোখ যায় তার। দেখে, অমিতদার কথাটা ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করে নিয়েছে সে। আর জুলজুল করে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। অমিতদাও শ্যামকে থামিয়ে দিয়ে ফের বলতে শুরু করে।
পৃথিবীর যেখানে যেখানে তেল আছে, এই রাক্ষস সিম্পলি খেয়ে ফেলবে সেই জায়গাটাকে। কামড়েকুমড়ে শেষ করে দেবে। তারপর একদিন দেখবি ফুৎকারে উবে গেছে সব তেল। এবার চালা তোরা ট্রেন বাস এরোপ্লেন! সব বন্ধ হয়ে যাবে। তখন গরুর গাড়ির যুগে ফিরে যেতে হবে সবাইকে। খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে অমিতদা।
কী হবে গো তখন? গোল গোল চোখ ক'রে জিজ্ঞাসা করেছিল জসিম। এত বড়ো হয়ে গেল তবু একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হলো না ওর। ভাবে শ্যাম। ছোট থেকেই দেখছে অমিতদা এভাবেই উল্টোপাল্টা বকে তাদের ভয় দেখিয়ে মজা পায়— তবু শিক্ষা হলো না ওর!
কিন্তু এটা তো হাতে আঁকা ছবি বলে মনে হচ্ছে। আর একটা লোক পৃথিবীকে কামড়াচ্ছে আর কেউ বুঝতে পারছে না! আমরা তো পৃথিবীতেই বসে আছি নাকি! প্রশ্নটা করে ফেলে শ্যাম। ক্লাসে রেজাল্টে তিন চারের মধ্যে থাকলেও, ক্যুইজে সে চ্যাম্পিয়ন। এত সহজে বোকা বানানো যাবে না তাকে।
তোর কাজই হলো সব বিষয়ে ফ্যাচফ্যাচ করা। যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস কেন! হিটলার ষাট লাখ লোককে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে যে মেরে ফেলবে, সারা পৃথিবীর লোক জানতে পেরেছিল? আমেরিকা যে হিরোশিমা নাগাসাকিতে বোম ফেলে সব ধ্বংস করে দেবে, কেউ বুঝতে পেরেছিল? বইটা জসিমের থেকে কেড়ে নিয়ে দুম করে বন্ধ করে বুকসেল্ফে তুলে রাখতে রাখতে রাগে গজগজ করতে থাকে অমিতদা। তারপর জসিমের দিকে বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলে— এখন যা তো। মহাভারত পড়ব।
এই হলো অমিতদা। হচ্ছিল তেলখেকো রাক্ষসের কথা, সেখান থেকে হিটলার, হিরোশিমা হয়ে মহাভারতে চলে গেল। আর শ্যামের সঙ্গে শুরু থেকেই ওর টম অ্যান্ড জেরির সম্পর্ক। একে অপরকে ছেড়ে থাকতেও পারে না, আবার কাছে এলেই তুলকালাম। তখন সামাল দিতে হয় ওই জসিমকেই। শ্যাম আর জসিমের ছোট থেকেই গলায় গলায় ভাব। ওদের বাবারাও বন্ধু, তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন পাশেই এক কারখানায়। রোজ একসঙ্গে সাইকেলে যাতায়াত। দুই পাড়ার মাঝে একটা খাল তার উপর কংক্রিটের একটা সেতু। খালটাকে লোকে বলে কানা। এখন আশপাশের ফ্যাক্টারির বর্জ্যপদার্থে খালটার জল কালো দুর্গন্ধময় হয়ে গেলেও শ্যামের বাবা বলেন, তাঁরা ছোটবেলায় নৌকা চলতে দেখেছে ওই জলে। ইতিহাসের স্যার আবার বলেছিলেন এটাই সেই কানা দামোদর। প্রাচীনযুগে দামোদরের মূল স্রোত বইত এই খাতে। তখন সপ্তগ্রাম বন্দর থেকে সরস্বতী নদী হয়ে এই পথে ধরে তাম্রলিপ্ত বন্দরে পৌঁছে যেত চাঁদ সওদাগরের সপ্ত ডিঙা। ভাবলেই অবাক লাগে শ্যামের। চোখের সামনে যেন দেখতে পায় বিশাল বিপুল মধুকর ডিঙা জল কেটে চলে যাচ্ছে সুদূরে।
তেলখেকো রাক্ষস নিয়ে সেদিন আর বেশি কথা হয়নি। কিন্তু জসিমের পেটে কথা থাকলে তো! ক্লাসে গিয়েই ছবিটার কথা রাষ্ট্র করে দিয়েছিল সবাইকে।
আমার দাদু বলেছে ঘটোৎকচ আর কুম্ভকর্ণের থেকেও বড়ো এক রাক্ষস আছে জলের তলায়। সে নড়লে ভূমিকম্প হয় পৃথিবীতে। এ কি সেই রাক্ষস নাকি রে জসিম? রাজেশ বলে ওঠে।
ধুর্, তুই নীল তিমির সঙ্গে ভূমিকম্প গুলিয়ে ফেলছিস। নীল তিমি জানিস তো? পৃথিবীর সব থেকে বড়ো প্রাণী। চল্লিশটা হাতির সমান একটা নীল তিমি। ক্লাসের ফার্স্টবয় সুজন এই সুযোগে একটু জ্ঞান ঝেড়ে দিতে চায় সবাইকে। কিন্তু নীল তিমির ব্যাপারটা ক্লাসের অনেকেই জানে, ফলে সুজনকে অতটা গুরুত্ব দেয় না কেউ। আর ঠিক তখনই ক্লাসে ঢুকে পড়েন রক্তিম স্যার।
নীল তিমির কথা হচ্ছিল মনে হচ্ছে সুজন বাবু? হেসে বলেন স্যার। বাংলার শিক্ষক রক্তিম সেন অল্পদিনেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। পড়ানোর বাইরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, স্কুলের যাবতীয় কার্যকলাপে তাঁর উৎসাহ চোখে পড়ার মতো।
না স্যার, নীল তিমি না, রাক্ষস। জসিম কোন বইয়ে নাকি দেখেছে একটা রাক্ষস পৃথিবীকে কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
এবার জসিমের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান স্যার। মুখে মুচকি হাসি। জসিম উঠে দাঁড়িয়ে গড়গড়িয়ে বলে যায় পুরো ঘটনাটা। এবার সত্যিই যেন কৌতূহলী হয়ে ওঠেন রক্তিম স্যার। জিজ্ঞেস করেন— এই অমিতদাটা কে?
অমিতদা আর আমাদের পাশাপাশি বাড়ি স্যার। ও খুব সুন্দর ছবি আঁকে। কলকাতার কোথায় যেন আঁকা শিখতে যেত আগে। এখন অবশ্য যায় না। ঘরে বসেই ছবি আঁকে আর গাদাগাদা বই পড়ে। আচ্ছা স্যার, সত্যিই এমন রাক্ষস আছে? পেট্রোল জিজেল এসব আবার কারো খাবার হতে পারে? শ্যাম উঠে দাঁড়িয়ে বলে।
অ্যাঁ… হ্যাঁ। সেরকম কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে বলেই তো শুনেছি। কিন্তু বিরাট চেহারার তেলখেকো রাক্ষস! কে জানে তোদের অমিতদা যখন বলেছে, হতেও পারে।
অমিতদা তো রক্তিম স্যারের কথা শুনে খুব খুশি। শ্যামের মাথায় আলতো করে গাঁট্টাই মেরে বসেছিল আনন্দে।
এবার বলো চাঁদু, বিশ্বাস হলো তো! তোদের এই নতুন স্যারটাকে একটু কাল্টিভেট করতে হচ্ছে তো। মনে হয় বন্ধু লোক। সেরকম হলে আমাদের দলে টেনে নিতে হবে। এই এক দলের কথা প্রায়ই বলে অমিতদা। অথচ সে কেমন দল শ্যাম জসিম বুঝতে পারে না। মিটিং মিছিল কিছু নেই। বক্তৃতা নেই। ভোট নেই। শুধু বই পড়া আর ছবি আঁকা। এমন কোনও দল হয় নাকি! ইতিমধ্যে টেবিল থেকে একটা নতুন বই তুলে নিয়ে শ্যামের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সে।
এই বইটা তোকে দেব বলে এনেছি। অনেক ছোটবেলায় পড়েছিলাম। বইটার সব ছবি আর ডিজাইন কার জানিস তো? স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের। দারুণ মজা পাবি পড়ে। শ্যাম হাতে নিয়ে প্রথমে বইটার নাম পড়তে পারে না। শুধু লীলা মজুমদার লেখা। আর প্রচ্ছদ জুড়ে কালো মুশকো একটা লোকের মুখ। ইয়া লম্বা সাদা গোঁফ। গোল গোল দুটো চোখ। ওমা! ও চোখদুটো তো শুধু চোখ নয়, গোল্লা দুটোর নীচে আঁকড়া দেওয়া আছে যে। অর্থাৎ অনুস্বার। নাক বলে যেটা ভাবছিল সেটা আসলে ল-এ ই, লি। কানটা ট। বইটার নাম এবার পড়তে পারে শ্যাম। টংলিং।
২
এর কিছুদিন পরে আবার একটা নতুন গল্প ফাঁদে অমিতদা। সেদিন রাস উপলক্ষ্যে স্কুল হাফ ছুটি হয়ে গেছে। শ্যাম বাড়ি ফিরে সাইকেল বার করে জসিমকে পিছনে বসিয়ে রাসের মেলা দেখতে বেরোচ্ছে পিছন থেকে গম্ভীর ডাক আসে।
এই যে মানিকজোড়। দুপুরবেলায় কোথায় বেরোচ্ছিস শুনি। শুনে যা একবার, দরকার আছে। ঘরে ঢুকে দেখে অমিতদা পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে আছে চেয়ারে, হাতে কী একটা রংচঙে ইংরেজি ম্যাগাজিন। দু'জনকে দেখে মুচকি হাসে সে।
মেলায় যাচ্ছিলি বুঝি? আমিও যাব সন্ধেয়। দলের লোকজন আসবে। শোন দুটো খবর দেব বলে ডাকলাম। প্রথমটা হলো— তোদের এই গলায় গলায় বন্ধুত্ব এবার কিন্তু খতম হতে চলেছে। জানিস তো আন্টার্কটিকার এক বিজ্ঞানী কী বানিয়েছে?
কী? শুরুতেই তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে এরকম কথায় চটে গিয়ে রুক্ষভাবে জিজ্ঞেস করে শ্যাম। যন্ত্র বানিয়েছে রে, যন্ত্র। সেই যন্ত্র ভাইরাস ভর্তি কালো মেঘ ছাড়িয়ে দেবে আকাশে বাতাসে। তারপর বৃষ্টির জলের সাথে ঝরে পড়বে অদৃশ্য ভাইরাসগুলো। আর তা একবার শরীরে ঢুকলেই সব বন্ধুত্ব খতম।
তারপর? গোল গোল চোখ করে বলে ওঠে জসিম।
খতম মানে খতম। তখন তোরা শত্রু হয়ে যাবি। দু'জনে দু'জনকে সহ্য করতে পারবি না। দেখা হলে তেড়ে আসবি একে অপরের দিকে। খুনোখুনিও হয়ে যেতে পারে। সারা পৃথিবী থেকে বন্ধুত্ব কথাটাই মুছে যাবে এবার।
এরকম আবার হয় নাকি! তুমি আজকাল শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছ আমাদের। শ্যাম বলে ওঠে এবার।
সে তুই নাও বিশ্বাস করতে পারিস কিন্তু ভাইরাস তো তৈরি। কিছুদিনের মধ্যে ট্রায়ালও শুরু হয়ে যাবে। তখন বুঝবি মজা।
সত্যিই অমিতদা, কোনওভাবে কি ওই ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় নেই? জসিম এমনভাবে কথাটা বলে যেন সে ধরেই নিয়েছে তার আর শ্যামের বন্ধুত্ব ভাইরাস এসে নষ্ট করে ফেলবে খুব শীঘ্রই।
আছে। আছেই তো। সেটাই তো দু'নম্বর খবর। কিন্তু তোর এই বেড়েপাকা বন্ধুটা শুনলে তো! না না ও কিছু বলবে না। তুমি বলো। জসিমের স্বরে বন্ধুত্ব বাঁচানোর আকুতি ধরা পড়ে এবার। কিন্তু অমিতদা ভীষণ চটে গেছে ততক্ষণে।
মুডটাই খারাপ করে দিল। এখন যা তোরা। পরে বলব একদিন। তার মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে কিছু করার নেই। সরি।
না পরের একমাসে কোনও ভাইরাস ছড়ায়নি কোথাও। শ্যাম জসিমও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তাদের ফাইনাল টার্মের পরীক্ষায়। এবার তারা ক্লাস নাইনে উঠবে। ফলে আগের মতো খেলে বেড়ানোর দিন শেষ। শ্যামেদের বাড়িটা নিরিবিলি বলে জসিম ছুটির দিন পড়তে চলে আসে এখানে। দুজনে মিলে পড়াটাও ভালো হয়। মাঝেমধ্যে গল্পও হয়ে যায় একটু। অমিতদার সঙ্গে অবশ্য কথা হয়নি বেশ কিছুদিন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে সামনাসামনি হয়ে গেলেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায় সে।
আসলে সেদিন গুলটা একটু বেশিই হয়ে গেছিল বুঝলি, তাই এখন লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না। শ্যাম বলে। তোর কী মনে হয়, ওর কথা সত্যি হবে না?
কোনওদিন না। আমাদের বুন্ধত্বকে ও হিংসা করে। দেখিস না, দল দল করে অথচ কোনও বন্ধুই নেই ওর, কাউকে কখনও ওর বাড়ি আসতে দেখেছিস? তাই ওসব বলে। দাঁড়া, পরীক্ষা শেষ হলেই ওকে গিয়ে দু চার কথা শুনিয়ে আসব। বাচ্চা পেয়েছে নাকি আমাদের!
যেদিন সত্যি সত্যিই অমিতদার ঘরে হাজির হয় সেদিন আবার অন্য মূর্তি ওর। শ্যাম-জসিম দ্যাখে টেবিলের অপর ঝুঁকে বেশ বড়ো একটা সাদা কাগজে কী যেন দেখছে সে। ওরা ঢুকতে চমকে যায় একটু। তারপর এক গাল হেসে কাগজটা গোটাতে গোটাতে বলে—
ও তোরা… ভালো করেছিস এসেছিস। তোদের কথাই ভাবছিলুম ক'দিন ধরে।
কেন কেন? কোনও নতুন খবর আছে নাকি গো? জসিমের যেন তর সয় না।
হ্যাঁ নতুন খবরই বটে। এই যে হাতে যেটা দেখছিস এটা হলো একটা প্ল্যান। কীসের প্ল্যান বলতো? নতুন দেশের প্ল্যান। কাজ শুরু হয়ে গেছে। রেডি হয়ে গেলেই হারিয়ে যাব ওখানে। মূল প্ল্যানটা আমারই কিনা। আমাকেই আগে যেতে হবে। সাজিয়ে তুলতে হবে সবকিছু।
সেকি! তুমি অন্যদেশে চলে যাবে? কই আগে জানাওনি তো। জসিম জিজ্ঞেস করে।
এদেশ সেদেশ নয় রে বুদ্ধুরাম। এই দেশের মধ্যেই নতুন একটা দেশ বানাচ্ছে আমাদের দল। সেই ভাইরাসের কথা ভুলে গেলি তোরা! সেই যে বন্ধুকে শত্রু বানিয়ে দেয় যে। এই দেশ এমন ভাবে বানাচ্ছি আমরা যে ওই ভাইরাস ঢুকতেই পারবে না ওখানে।
কেন পারবে না? আবার প্রশ্ন করে জসিম।
পাসওয়ার্ড আছে তো। ওটা না জানলে খুলবেই না গেট। পুরো পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড দেশ।
যাহ্। একটা গোটা দেশ এমন হয় নাকি! শ্যাম বলে ওঠে এবার। দেখতেই পাবি হয় কিনা। অবশ্য আমাকে তো আর খুঁজে পাবি না তখন। তবে যদি চাস যাওয়ার আগে পাসওয়ার্ডটা দিয়ে যেতে পারি তোদের। এমন বন্ধুত্বটা চলে যাক সে কি আমি চাইতে পারি! মুচকি হেসে বলে ওঠে অমিতদা।
ওর ওই হাসি দেখে গা পিত্তি জ্বলে যায় শ্যামের। আবার ওদের বন্ধুত্ব নিয়ে খোঁটা! রেগে গিয়ে বলে— তুমি না চাইলেও আমাদের বন্ধুত্ব কোনওদিন নষ্ট হবে না বুঝলে। আমরা এখন বড়ো হয়ে গেছি। তোমার কথায় ভুলব না।
হুঁ! খুব বড়ো হয়ে গেছিস। তাহলে কাল রাতে কারেন্ট চলে যেতে ম্যা ম্যা করে ডাকছিলিস কেন! ছাগলের ডাক নকল করে খুব জোরে হেসে ওঠে অমিতদা।
নিজের সিক্রেট এভাবে জসিমের সামনে এক্সপোজ হয়ে যাওয়াতে আঁতে ঘা লাগে শ্যামের। 'চল জসিম' বলে গুম গুম করে দরজার দিকে পা বাড়ায়।
যা যা। কিন্তু বন্ধুত্ব বাঁচাতে একদিন তোকে ওই দেশই খুঁজতে হবে রে ছাগল। আমি না থাকলে তোকে কে পাসওয়ার্ড দেয় তখন দেখব। শ্যামের পিছনে জসিমকেও চলে যেতে দেখে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে অমিতদা।
এরপর আর অমিতদাকে দেখেনি শ্যাম-জসিম। কোথায় যে চলে গেল সে! ক'দিন থানা পুলিশ। তারপর সব চুপচাপ। কোনও হদিস পাওয়া গেল না আর। লোকটা যেন হাওয়ায় উবে গেল হঠাৎ করে।
অমিতদার মা এখন একা থাকেন ওদের একতলা বাড়িটায়। অমিতদার ঘরটায় কতদিন যে ঢোকেনি শ্যাম-জসিম। ওর জন্য আজকাল শ্যামের খুব মন খারাপ করে। কিন্তু জসিম ছাড়া সে কথা কেউ কেউ বুঝতে পারে না। যে জানলা দিয়ে শ্যাম জসিমকে কখনও মানিকজোড়, কখনও নন্টে ফন্টে বা হাঁদা ভোঁদা বলে ঘরে ডাকত সে, সেই জানলাতেই ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন ওর মা। বাড়ি ঢুকতে ওই জানলার দিকে চোখ গেলে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে শ্যামের। তারপর ভুল ভাঙে আর খুব কান্না পায়। আচ্ছা সেদিন ওভাবে রাগ করে বেরিয়ে না গিয়ে যদি আগ্রহ দেখাত, তাহলে কি অমিতদা নতুন দেশের পাসওয়ার্ডটা দিয়ে দিত ওদের? ওটা থাকলেই অমিতদার সঙ্গে নিশ্চয় আবার দেখা হয়ে যেত। তাই না? ভাবতে থাকে শ্যাম।
৩
এরপর কেটে গেছে কয়েক মাস। বসন্তকালের হালকা শীতের আমেজ ফুরিয়ে গেছে এখন। রোদের তেজ গায়ে পড়ে চিড়বিড়ানি ধরিয়ে জানান দিচ্ছে রুদ্র গ্রীষ্মের আগমনবার্তা। এই সময় যখন পুরোদমে শ্যাম জসিমের স্কুল চলছে আর ক্লাস নাইনের ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা প্রায় এসেই গেছে, তখনই ছন্দপতন ঘটল। কোথা থেকে যেন সেই ভাইরাস ভর্তি কালো মেঘ আকাশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল চারিদিকে।
কীভাবে কী হলো জানে না শ্যাম। একদিন সকালে বাইরের হৈ হল্লায় ঘুম ভেঙে গেল ওর। বাইরের উঠোনে বাবা আর জেঠুর চাপা স্বরে উত্তেজিত আলোচনা শুনতে পেল আর দেখল জানলার সামনে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মা। কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকল ওর বাবা।
খালের ওপারে নাকি অস্ত্র নিয়ে জড়ো হয়েছে ওরা। এদিকের ছেলেরাও রেডি আছে। দরকারে আমাদের যেতে হবে। দাদা তো আসগারের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে দু চার কথা শুনিয়েই দিল আমায়। উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন শ্যামের বাবা।
আসগারকাকু অর্থাৎ জসিমের বাবার সঙ্গে এই ঝামেলার কী সম্পর্ক বুঝতে পারে না শ্যাম। কিন্তু এটা বুঝে যায় জসিমের নাম এইমুহূর্তে উচ্চারণ না করাই ভালো। চুপচাপ শুনে যায় সব কিছু।
এরপর সারাদিন যা হওয়ার তাই হলো। চিৎকার চেঁচামেচি আর অনেক মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ। কখনও বলে, বাজারে ইট ছুঁড়ছে ওরা। কখনও শোনা যায় কার নাকি লাশ পড়ে আছে ব্রিজের ওপরে। দুপুর থেকে শুরু হলো পুলিশের টহলদারি। কারফিউ জারি হয়েছে এলাকায়। বাইরে বেরোলেই গুলি করে দেবে পুলিশ। ঘরে বন্দী শ্যামের চুপচাপ শুয়ে বসে কাটাতে থাকে দিনটা। বাবা জেঠুর কড়া নির্দেশ—বাইরে বেরোনো যাবে না। একবার সে বার করেছিল সুকুমার রায়ের হজবরল বইটা। কিন্তু সেটা খুলতেই জসিমের কথা মনে পড়ে যায় আবার। গলার স্বর পাল্টে সেবার শ্রুতিনাটকে কখনো বিড়াল, কখনো কাকেশ্বর, কখনো ছাগলের পার্ট করে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিল জসিম। বন্ধুর পুরস্কারপ্রাপ্তিতে শ্যামের এত ভালো লেগেছিল কেন কে জানে! বইটা সে-ই জসিমের জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল বলেই কি? আজ সারাদিন শ্যামের বারবার মনে হয়েছে জসিমের কথা। মনে হয়েছে একবার যদি কথা বলা যেত ওর সঙ্গে। কিন্তু বাবার থেকে মোবাইল চাইবার সাহসটুকু হয়নি। সাহস হয়নি জসিম নামটা একবার উচ্চারণ করারও।
রাতের অন্ধকারে সব যখন শান্ত হয়ে এসেছে আর জানলার ফাঁক দিয়ে টুকটুকে একটা চাঁদ আলো করে তুলছে শ্যামের মুখটাকে, মায়ের পাশে শুয়ে চোখ আবার জলে ভরে গেছে ওর। কী করছে এখন জসিম? তার কথা সারাদিনে কি একবারও ভেবেছে সে? তার মতোই সে এখন কি বিছানায় শুয়ে কাঁদছে?
৪
কারফিউ চলল আরো তিনদিন। কিন্তু খালের ওপার আর এপারের মধ্যে হঠাৎ তৈরি হওয়া পাঁচিলটা রয়ে গেল তার পরেও। দুই পাড়ার মাঝে কংক্রিটের ব্রিজটা যেন অদৃশ্য এক বেড়া। ওটাকে অতিক্রম করা যাবে না। স্কুল কারখানা বন্ধ এখনও। কবে খুলবে কে জানে! শ্যাম বাড়িতেই পড়াশোনা করেছে এখন। মা বলেছে স্কুল খুললেই ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তখন খেই রাখতে পারবে না। আর সত্যি বলতে করারও তো কিছু নেই। গল্প বইগুলো সব আরেকবার পড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। নতুন বই উপহার দিত যে, সেই লোকটাও যে কোথায় হারিয়ে গেল! কেউ খুঁজেই পেল না আর। জসিমকে ফোন করলে বকা খেতে হবে এটাও কীভাবে যেন বুঝে গেছে শ্যাম। ওই নাম উচ্চারণ করতেও ভয় লাগে আজকাল। কে কী বলে বসে!
সেদিন পড়ার বই সামনে রেখে এসব কথা-ই ভাবছিল শ্যাম। বাইরের উঠোনে শাঁখ বাজিয়ে সন্ধে দিচ্ছে মা। দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি।
শ্যাম… এই শ্যাম…
জানলার ওপার থেকে বহুকাল পরে সেই পরিচিত কণ্ঠটা শুনে নিজের অজান্তেই চমকে ওঠে শ্যাম। পরমুহূর্তেই ভাবে জসিমকে এ পাড়ায় দেখলে নতুন কোনও সমস্যা হবে না তো! ফের ঝামেলা লেগে যায় যদি! আনন্দ আর আশঙ্কা দুটোই একসঙ্গে ঘিরে ধরে তাকে। তড়িঘড়ি জানলায় দাঁড়িয়ে ইশারায় জসিমকে পিছনের পুকুর পাড়ে যেতে বলে প্রথমে। ওই দিকটায় সন্ধেবেলায় সচরাচর কেউ যায় না। তারপর ঘরের দরজা থেকে দেখে নেয় কে কোথায় আছে। মা সন্ধে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে। বাবা বেরিয়েছে কোনও কাজে। ধীর পায়ে সদর দরজা পেরিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে এগিয়ে যায় শ্যাম। যাওয়ার রাস্তায় তালা দেওয়া অমিতদার বাড়ির দিকে একঝলক দেখে নেয় সে। অমিতদার মা-ও কারফিউ শেষ হতেই চলে গেছেন কোথাও। কোথায় গেছেন কাউকে জানিয়েও যাননি।
পুকুরপারের আবছা আলোয় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে জসিম। শ্যাম সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ফোপানোর আওয়াজ শুনতে পায়। তারও কি চোখে জল চলে আসছে অজান্তেই। কিন্তু এর আগে বহুবার জসিম কাঁদলে শ্যামই তাকে সামলেছে। জসিমকে ছিঁচকাদুনে বলে রাগিয়ে দিয়েছে।
ছিঁচকাদুনে…
হুম। তুই কাঁদছিস কেন তাহলে?
যাহ্। কোথায় কাঁদছি! হাসতে হাসতে হাতের চেটো দিয়ে দুচোখ আলগোছে মুছে নেয় শ্যাম। চাঁদের আলো ঠিক সেই সময় তাদের মুখে পড়ে রুপোলি রঙ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে।
চল শ্যাম অমিতদার মতো হারিয়ে যাই আমরাও।
আমিও এই ক'দিন ওই কথাই ভেবেছি রে। কিন্তু সেদিন তো পাসওয়ার্ডটাই নেওয়া হলো না ওর থেকে। সব আমার দোষ। নিজের ওপর খুব রাগ হয় শ্যামের।
ভালো করে খুঁজলে ওই পাসওয়ার্ড নিশ্চয় খুঁজে পাব আমরা। মন বলছে আমাদের জন্য নিশ্চয় কোনও সংকেত রেখে গেছে অমিতদা। ও আমাদের জানাবে না এ হতেই পারে না। হয়তো আমাদের বুদ্ধির টেস্ট নিচ্ছে।
তাহলে চল কাল থেকেই খোঁজা শুরু করি দু'জনে।
সেদিন থেকে শ্যাম আর জসিম নতুন দেশটায় যাওয়ার পাসওয়ার্ড খুঁজছে। যেদিন পাবে সেদিনই ওরা একসাথে পাখির মতো ডানা মেলে রওনা দেবে।
গল্পটি সাম্পান পত্রিকায় (২০২৩) প্রকাশিত হয়েছিল