পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হিন্দুত্ববাদের পোড়া দুপুরে হিন্দুরাষ্ট্রের বৈশালীদের গল্প

  • 11 April, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 745 view(s)
  • লিখেছেন : সম্প্রীতি মুখার্জী
হিন্দু মেয়েদের ‘রক্ষা’ করতে যেমন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সদা তৎপর, তেমনি মুসলিম মেয়েদের প্রতি যৌন হিংসাকে অনেক সময় হিন্দু পুরুষের ‘কর্তব্য’ হিসেবে দেখা হয়। আরএসএসের পথপ্রদর্শক সাভারকর তাঁর লেখায় শিবাজীর সমালোচনা করেন, কারণ তিনি মোঘলদের সাথে যুদ্ধের সময় মুসলিম নারীদের ধর্ষণের নির্দেশ দেননি। তাই বিজেপি ক্ষমতায় আশার পর থেকে কেন্দ্রীয় আর ডাবল ইঞ্জিন সরকারগুলির প্রত্যক্ষ মদতে পুনর্নিমিত হচ্ছে ‘রাম’ ও ‘শিবাজী’র চরিত্র—তারা আর ভক্তি বা ন্যায়ের প্রতীক নন, বরং অস্ত্রধারী, আগ্রাসী পুরুষত্বের প্রতীক।

কিছুদিন আগে দিল্লী থেকে ফিরছি। ট্রেনটি ভীড়ে ঠাসা। কেউ কাশ্মীর বা হিমাচল থেকে বেরিয়ে ফিরছেন। কেউ ইদের ছুটিতে বাড়ি ফিরছেন। সকলেরই গন্তব্য নিজের বাড়ি। ট্রেনে এক রাত্রি যাপনের পরদিনই যাত্রীরা গল্পের আসর পেতে বসেছেন। চলছে পশ্চিমবঙ্গের রসাতলে যাওয়ার গল্প। সিঙ্গুরে টাটার কোম্পানি ব্যবসা করতে না পারায় পশ্চিমবঙ্গের এসি কামরায় চড়া মধ্যবিত্তের দুর্দশার হা-হুতাশ মিশে যাচ্ছে মোদীজীর সময় দেশ আর দশের কত উন্নতি হয়েছে তার প্রশংসায়। এসবের মধ্যে ট্রেন চলছে। আমার কোচের এক সহযাত্রী বৈশালী। সে তার তিন বছরের বাচ্চাকে সামলাতে ব্যস্ত। মানুষের গালগল্পে তার অত কান নেই। বাচ্চা কখনো কেঁদে উঠলে পিঠে দু চারটে কিল ঘুষি মেরে শান্ত করছে। তারপর চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিচ্ছে ছেলের গাল। ট্রেনের বদলানো দৃশ্যপটেই মন বেশী তার। ঝর্ণার মতন চঞ্চল মেয়ে বৈশালীর বিবাহসূত্রে কলকাতায় বাস। সে বড় হয়েছে বিহারে। ট্রেন ৫ ঘন্টা দেরীতে চলায় আলোচনার মুখ ঘুরে ততক্ষণে পৌঁছেছে রেলের বেহাল অবস্থার দিকে। উৎসবের সময় সীমিত ট্রেনের সংখ্যার দিকে। স্থায়ী চাকরির অভাবের দিকে। বেসরকারি হাসপাতালের খরচ সামলাতে হিমশিম খাওয়ার কথাও বলছেন কেউ কেউ। এই আলোচনায় সামিল বৈশালীর স্বামীও। সে জন্মেছে বড় হয়েছে কলকাতাতেই। গোটা ট্রেন যাত্রা তিনি বাচ্চার উপর চোটপাট করা আর আপার সিটে শুয়ে রিল দেখে কাটিয়ে দিয়েছেন। এতক্ষণে দেশ-দশের মনোগ্রাহী আলোচনায় অংশ নিয়ে দাদা খুব দু:খ করে বলছেন দেখুন না আমার বউ তো মোদীর পরম ভক্ত। সে মোদীর নামে কোনো কথাই শুনতে রাজী নয়। বাচ্চাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বৈশালী নিজেই বলে ওঠে আপনারা যে এত আলোচনা করছেন, মানুষ তো একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতাতেই ব্যস্ত। কার কত বড় বাড়ি, কে তার প্রতিবেশীর থেকে দামি গাড়ি কিনল এই ভেবেই তো আমরা ব্যস্ত। দেশের কথা তো ভাবছেন একমাত্র মোদিজী। নিজের ঘরকে সুরক্ষিত করতে গেলে দেশের নেতাকে হতে হবে শক্তিশালী নির্মম। মোদিজী যোগিজী সেসব করে দেখাচ্ছেন। মোদিজীর আমলে মানুষের বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহনের বেহাল অবস্থা তুলে ধরলে বৈশালী বলে আমাদের দেশ পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ধর্মের নামে বিষ ছড়ানোর কথা বলে কেউ। বৈশালীর বক্তব্য আমরা গর্বিত আমরা হিন্দু। নিজের জাতি পরিচয় তুলে ধরতে অসুবিধা কোথায়! বৈশালী একের পর এক তথ্যের যোগান দেয়। মুঘলরা নিজেদের শাসন কালে কীভাগে ধ্বংস করেছে ভারতের প্রাচীন সব স্থাপত্য, বিশ্ববিদ্যালয়! পরিবারের মুখিয়া যেমন সবার ভালোর কথা ভেবে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় তেমনই তো মোদিজী! সব পক্ষের কথা শুনলে তো দেশের জন্য তিনি কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর বিজেপি বিরোধী স্বামী কিছুতেই বৈশালীকে বাগে আনতে পারেনা। বিতর্কের পারদ কিছু থামলে আমি বৈশালীকে বলি তার সাথে আমার মতের চূড়ান্ত অমিল থাকলেও তার নিজের মত প্রকাশ করতে পারা, বিতর্ক করার আগ্রহ ভারী ভালো লেগেছে। মেয়েদের তো বেশীরভাগ সময় থামিয়েই দেওয়া হয়। কথা পরতে না পরতেই বৈশালী বলে ওঠে, “এত কথা বলি তাই তো আমি খারাপ। মেয়ে মানুষের এত মুখ কেউ সহ্য করেনা।” দীর্ঘশ্বাসের পর সে বলে, “জানো আমি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলাম। কেমিস্ট্রি আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। গ্রাডুয়েশনে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলাম আমি। সাহিত্যও আমার খুব পছন্দের। কবিতা, গল্পে কল্পনায় কত দূর অবদি পৌঁছে যেতাম।” শুধাই তারপর? পড়া ছাড়োনি তো? সে বলে “তারপর তো বিয়ে হয়ে গেল, বাবু হল। এখন সেসব অতীত।” বৈশালী বলে চলে, “আমি জানি মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো খুব জরুরী। কিন্তু পরিবার মেনে নেবেনা। আমার বাবুকে কে বড় করবে! আমার পড়শোনার পাঠ শেষ। এখন আমার বাবুকে ঘিরেই সব স্বপ্ন। আমার খুব ইচ্ছে ও সংস্কৃত শিখুক। সংস্কৃত আমাদের ঐতিহ্য।” ততক্ষণে ট্রেন গন্তব্যে ঢুকছে। বৈশালী তার ফোন নম্বর দেয়। বলে দিদি যোগাযোগ রেখ। আমি বলি বৈশালী নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা ছেড় না।

 

জানিনা বৈশালীর সাথে আবার কখনো দেখা হবে কিনা। তবে ঘেন্নার মোড়কে ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া আমার পাড়ার রামনবমীর মিছিল থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে হিন্দু আধিপত্যবাদ ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত বৈশালীদের আমি রোজ দেখি। তাজ্জব হই।

 

আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বিজেপির নারী বিদ্বেষী পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি অজানা নয়। তার প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ্য করছি মেয়েদের নিজেদের ইচ্ছেতে বাঁচা, সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উপর অভিন্ন দেওয়ানী বিধি বা ধর্মীয় রুপান্তর বিরোধী আইনের ছলে আইনি বিধিনিষেধ আরোপের মধ্যে দিয়ে বা চাকরি থেকে উচ্চশিক্ষার মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমশ নিম্নগামী হওয়ার পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে বা প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষ ও নারীদের উপর বাড়তে থাকা আগ্রাসনে। তাহলে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর প্রজেক্টে আজকের নারীদের বৃহৎ সংখ্যায় সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে কোন প্রেক্ষাপটে: কেন আর কীভাবে? এই সময়ের বৈশালীর মত মেয়েরা যারা নিজের মত প্রকাশ শুধু নয় দেশের রাজনীতি নিয়ে মত প্রচার, মত তৈরী করা সর্বোপরি দেশের গঠনের কাজে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে যে ভূমিকাগুলিকে ক্ষমতায়নের নির্দেশক মনে করা হয়। অন্যদিকে তারা যে আদর্শ প্রচার করছে তা আমাদের নির্ভয় নি:শর্তে বাঁচার সমস্ত গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক অধিকারকে ধ্বংস করতে উদ্যত। এই বৈপরীত্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বাস্তবটা কী? তা কী সবসময়ই পিতৃতন্ত্রের চেনা ছকে আবদ্ধ নয়?

প্রথমেই মনে করে নেওয়া যাক আমরা নারীর ক্ষমতায়নকে দেখছি হিন্দু আধিপত্যপত্যবাদী জাতীয়তাবাদের মঞ্চে। যে মতাদর্শের কেন্দ্রে রয়েছে এক রাগী, আগ্রাসী, পেশীবহুল হিন্দু যোদ্ধার ছবি। এই ছবি রাজনৈতিকভাবে তৈরি, যেখানে পুরাণ ও ইতিহাসকে মিশিয়ে এক উগ্র পুরুষত্বের আদলকে আদর্শ হিসাবে তুলে ধরা হয়।  যা এক ভাষা, এক জাতি, এক ধর্মের কথা বলে—হিন্দী হিন্দু হিন্দুস্তান। এই আদর্শ শক্তি তৈরি করে ধর্মীয় ভিন্নতাকে ‘শত্রু’ রূপে চিহ্নিত করে। মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘অপর’ বানিয়ে, তাদেরকে কেন্দ্র করে ভয় বা ক্ষতির কল্পনা নির্মাণ করেই এই জাতীয়তাবাদ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। রামনবমীর মিছিলগুলো মসজিদের সামনে পৌঁছেই সবচেয়ে উত্তেজিত হয়—কারণ ‘অপর’এর উপাসনাস্থলকে অবমাননা করাটাই এদের চোখে দেশকে ভালোবাসার আর জাতীয়তাবাদকে অনুভব করার একমাত্র চেনা পথ।

এই রাজনীতির গভীর শেকড় আছে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যেও। হিন্দু জাতীয়তাবাদ পুরুষত্ব ও নারীত্বের বিসমকামী পিতৃতান্ত্রিক ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে। নারী এখানে জাতির ‘সম্মান’-এর প্রতীক—যে সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আদর্শ হিন্দু পুরুষের। এর ফলে নারী ব্যক্তি হিসেবে নয়, হয়ে ওঠে জাতীয় গর্ব ও অপমানের বাহক। এই ভাবনার ফলেই ধর্ষণ ব্যক্তিগত হিংসা নয়, বরং শত্রু জাতির সম্মান ধ্বংসের অস্ত্র হয়ে ওঠে। হিন্দু মেয়েদের ‘রক্ষা’ করতে যেমন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সদা তৎপর, তেমনি মুসলিম মেয়েদের প্রতি যৌন হিংসাকে অনেক সময় হিন্দু পুরুষের ‘কর্তব্য’ হিসেবে দেখা হয়। আরএসএসের পথপ্রদর্শক সাভারকর তাঁর লেখায় শিবাজীর সমালোচনা করেন, কারণ তিনি মোঘলদের সাথে যুদ্ধের সময় মুসলিম নারীদের ধর্ষণের নির্দেশ দেননি। তাই বিজেপি ক্ষমতায় আশার পর থেকে কেন্দ্রীয় আর ডাবল ইঞ্জিন সরকারগুলির প্রত্যক্ষ মদতে পুনর্নিমিত হচ্ছে ‘রাম’ ও ‘শিবাজী’র চরিত্র—তারা আর ভক্তি বা ন্যায়ের প্রতীক নন, বরং অস্ত্রধারী, আগ্রাসী পুরুষত্বের প্রতীক। রামনবমীর মিছিল থেকে শুরু করে ‘ছাওয়া’ সিনেমাকে ঘিরে তৈরি হওয়া উন্মাদনা—সব কিছুতেই এই উগ্র পুরুষালী জাতীয়তাবাদের ছাপ স্পষ্ট। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শত্রু কল্পিত পুরুষালী মুসলিম চরিত্র। বর্তমানে যার প্রতীক ঔরঙ্গজেব বা আলাউদ্দিন খলজি।

আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকর সংগঠনের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিন্দু পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলেন-

"একটা জাতি তখনই টিকে থাকতে পারে যখন তাদের শক্ত ভিত থাকে।…যারা এই সংগঠিত শক্তির অংশ হবে, তাদের মধ্যে কী গুণ থাকা দরকার? প্রথমত, অপরাজেয় শারীরিক শক্তি। আমাদের এমন শক্তিশালী হতে হবে যাতে দুনিয়ার কেউ আমাদের ভয় দেখাতে না পারে।………ভক্তি নয়, দুর্বলতা নয়। শক্তি চাই। মেয়েদের মতো বসে বসে কেঁদো না।……."আজ আমরা আয়নায় নিজেদের দিকে তাকালে কী দেখি? আমাদের মধ্যে পুরুষত্ব বা শক্তির কোনো চিহ্ন আছে কী?—এটা বদলাতে হবে।"

অর্থাৎ হিন্দুত্ব বা হিন্দু জাতীয়তাবাদ এমন এক পুরুষত্বের ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে আক্রমণাত্মক হওয়া, কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া, শারীরিক বল, যুদ্ধপ্রবণতা, নিজের জাতির প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ঠিক বিপরীতে, অহিংস মনোভাব, দয়া, সহমর্মিতা, শান্তি, সংহতির মত মানবিক দিকগুলির সাথে নারীত্বের তুলনা করা হয়-তাই এগুলিকে দুর্বলতার চিহ্ন মনে করা হয়। এহেন আদর্শ হিন্দু পুরুষের গুণাবলীর সাথে বৈশালীর চোখে মোদীজীর আদর্শ প্রধাণমন্ত্রী হওয়ার ছবি কেমন বেমালুল মিলে যায়!

 

কিন্তু বৈশালীর মত যে নারীরা হিন্দুরাষ্ট্র গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথকে কীভাবে প্রভাবিত করে এই পরিসর? এহেন আগ্রাসী পুরুষত্বের চৌহদ্দিতে নারীর স্থান বিতর্কিত ও অস্পষ্ট।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা অধিকারভিত্তিক আন্দোলনে নারী, বিশেষ করে আদিবাসী, দলিত ও শ্রমজীবী নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। জল-জঙ্গল-জমির অধিকার, ন্যায্য মজুরি, লিঙ্গ সমতা ও নাগরিক অধিকারের লড়াইয়ে তাঁরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা আলাদা। এখানে নারী নিজেকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন মানুষ হিসেবে দাবি করেনা, বরং হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের সহযোগী হিসেবেই তার গুরুত্ব। এমনভাবে তাঁর ভূমিকা তৈরি করা হয় যাতে সে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বাইরে না যেতে পারে।

যেমন, ১৯২৫ সালে গঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর শুরু থেকেই পুরুষদের সংগঠন ছিল। নারীদের জন্য আলাদা সংগঠন, রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি, গঠিত হয় অনেক পরে—১৯৩৬ সালে। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীবাই কেলকার আরএসএসে সদস্যপদের আবেদন করলেও তা নাকচ করা হয়। আজও আরএসএস-এ নারীরা সদস্য হতে পারেন না।

হিন্দু আধিপত্যবাদী সমাজে নারীত্বের আদর্শ ভূমিকা হল মাতৃত্বের ক্ষমতা - এক কথায় পুরুষ সন্তানকে জন্ম দিতে পারার শারীরিক ক্ষমতা, সন্তানকে হিন্দুত্ববাদী ঐতিহ্য- রীতি নীতি সসংস্কৃতির শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে  ভবিষ্যতের আদর্শ হিন্দু যোদ্ধা হিসাবে বড় করা- সর্বোপরি ঘরে ও বাইরে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে পিতৃতান্ত্রিক সীমার মধ্যে একাধিক ভূমিকা পালন করা। আরএসএস-এর পথপ্রদর্শক গোলওয়ালকার তাঁর বই Bunch of Thoughts–এ লেখেন, হিন্দু রাষ্ট্র ও পরিবার রক্ষার দায়িত্ব নারীর।

সময়ের সাথে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে কিছু নারী ভূমিকা নিতে শুরু করেন- যেমন মত প্রচারক, সামাজিক বক্তা, সংগঠক যেগুলিকে সাধারণভাবে 'পুরুষালি' হিসাবে দেখা হয়। যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মহিলা শাখা সাধ্বী শক্তি পরিষদ গঠিত হয় ১৯৯৮ সালে। এই সংগঠনের সক্রিয় সদস্যরা ব্রহ্মচারী-যারা ছোট চুল রাখেন, গয়না পরেন না এবং গেরুয়া বসন পরেন। তাদের মূল কাজের মধ্যে রয়েছে—হিন্দু জাতিকে রক্ষার প্রচার করা, তরুণীদের আত্মরক্ষা ও আদর্শ ‘নারীত্ব’ শেখানো, এবং বিভিন্ন দেবীর পূজার আয়োজন করা। অর্থাৎ হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুরুষালী যোদ্ধা হওয়ার জন্য হয় নারীদের নারীত্বের বাহ্যিক চিহ্ন ত্যাগ করতে হবে নয়ত নারীত্বের সামাজিকভাবে প্রচলিত ভূমিকা, আচার, আচরণের মধ্যেই তাকে আবদ্ধ থাকতে হবে।

এই নারীদের সামনে 'দেবী দুর্গা', 'ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই' বা 'জিজাবাই'–এর মতো চরিত্র তুলে ধরা হয়। যারা কখনও মা, কখনও যোদ্ধা—তবে উভয় চরিত্রেই এরা পুরুষ নেতৃত্বকে রক্ষা করা বা তাদের উত্থান ঘটানোর কাজে নিয়োজিত। হিন্দুত্ববাদী প্রপাগান্ডায় নারী ‘পুরুষালি’ হলেও তার পিতৃতন্ত্রের সীমা পেরোনো মানা। তাই রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি তাদের সদস্যদের কিছু পুরুষালি গুণ যেমন মার্শাল আর্ট শেখায় উৎসাহ দেয় যাতে তারা কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় নিজেদের আর জাতির সম্মান রক্ষা করতে পারে। যেমন, সাধ্বী ঋতম্বরা, সাধ্বী প্রাচী, উমা ভারতীর মতো নেত্রীরা রাম জন্মভূমি আন্দোলনে মুসলিমদের উপর হিংসা ছড়াতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা ‘পুরুষালি’ চরিত্রে কথা বলেন, বক্তৃতা দেন, সংগঠিত করেন—যাতে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রাসঙ্গিকতাকে টিকিয়ে রাখতে, হিন্দু নারীর সম্মান তথা হিন্দু জাতির সম্মান লুঠের আশঙ্কার জিগিড় টিকিয়ে রাখা যায়। যেমন সাম্প্রতিক সময় পশ্চিমবঙ্গের মোথাবাড়িতে সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরী করার অন্যতম তথ্য হিসাবে ছড়ানো হল হিন্দু নারীদের ঘিরে তৈরী করা মিথ্যা- যেমন হিন্দু নারীদের জোর করে শাখা সিঁদুর খুলতে এবং হিজাব পরতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে স্মৃতি ইরানী প্রচার করলেন হিন্দু মেয়েদের গণধর্ষণ করা হচ্ছে। তাই মেয়েরা এই পরিসরে 'পুরুষালি' ভূমিকা নিতে পারে ঠিকই—কিন্তু তা করতে হয় খুবই কৌশলে। যদি তারা অতিরিক্ত ক্ষমতা দাবি করেন বা সমাজের প্রচলিত নারী-পুরুষের বিভাজন ভেঙে ফেলেন তাহলে কী আর তাদের ঠাঁই হবে হিন্দুরাষ্ট্রে? নয়ত হিন্দুরাষ্ট্রের আগ্রাসী পুরুষ মাতব্বররা বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনি স্বীকৃতি দিতে চায় না কেন!  কেন তারা সম-লিঙ্গ বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দিতে নারাজ? কেন অভিন্ন দেওয়ানী বিধির মাধ্যমে আমাদের শেকল পরাতে চাইছ?

হিন্দু মেয়েদের সম্মান রক্ষার আর মুসলিম মেয়েদের সম্মানের লুটের হুংকারে আবর্তিত হয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। আর দুই ক্ষেত্রেই আহত হয় মেয়েদের প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের স্বতন্ত্রতা ও স্বাধীনতার অধিকার। তাই হয়ত বৈশালীদের স্বপ্ন সীমিত হয়ে যায় তার ছেলেকে সংস্কৃত শেখানোয়। কিন্তু আপনি আমি তো ততদিন মুক্ত নই যতদিন আমার বেহেনরা পরাধীনতার শেকলে রয়েছে। রামনবমীর মিছিলে, সামাজিক মাধ্যমের দেওয়ালে, রাস্তায় জীবনে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। আশা করছি সংহত লড়াইয়ের যখন সকল মুক্তির পতাকা উড়বে একসাথে।

 

0 Comments

Post Comment