খবরে প্রকাশ, সরকারি কাজে পুরোদস্তুর হিন্দি চালুর সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। তাদের সুপারিশ মেনে নিলে, এবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ হিন্দিতে হবে, রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের সরকারি ভাষা হিন্দি হবে, কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষদানের ভাষা হিন্দি হবে, হিন্দিভাষী রাজ্যে আদালতের কাজ হিন্দিতে হবে, সরকারি পরীক্ষায় বাধ্যতামূল ইংরিজির বদলে হিন্দি আনা হবে। না, হিন্দি, ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয়। এখনও নয়। কিন্তু অঘোষিতভাবে হিন্দিকে 'রাষ্ট্রভাষা'য় পরিণত করার চেষ্টা ছাড়া এটাকে আর কিছু মনে হচ্ছেনা। সেটা নতুন কিছু অবশ্য না। গত সত্তর বছর ধরে, বোম্বে-বলিউড, টিভি, অর্থনীতি, মাশুল সমীকরণ, কেন্দ্রীয় বরাদ্দ, সবকিছু দিয়েই হিন্দি এবং দিল্লির আধিপত্যের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে। এবং এই সত্তর বছরের চেষ্টায় হিন্দি যে একটা উচ্চমানের 'সর্বভারতীয়' ভাষা, বাকি সব 'আঞ্চলিক', সেটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। এখন কেন্দ্রীয় দলের সদস্যরা বাঙালির ছানাপোনা হয়েও কর্মকর্তা না বলে কারিয়াকর্তা বলেন। মুখ্যমন্ত্রী 'বাংলার মেয়ে' হয়েও শিক্ষা এবং চাকরিতে বাংলা বাধ্যতামূলক করার বদলে হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় খোলেন। এখন বিরোধী দল আন্দোলন করে 'ইনসাফ' বলে। স্লোগান ওঠে 'ইনসাফ চাহিয়ে'।
আমাদের ছেলেমেয়েরা নেহাৎই অখাদ্য ফ্লপ হিন্দি সিনেমা নিয়েও পাতার পর পাতা লেখে, বলিউড তাদের মোক্ষ, শাহরুক খান-টানরা টাদের হৃদয়দৌর্বল্য। আমাদের রেডিওতে মাতৃভাষায় সর্বভারতীয় খবর শোনা যায়না, কবেই উঠে গেছে। আমাদের টিভি দিল্লির চ্যানেলকে 'জাতীয়', হিন্দি সিনেমাকে সর্বভারতীয়, হিন্দুস্তানকে ভারতবর্ষ, আর নিজেকে সহি হিন্দুস্তানি ভাবতে শেখায়। আমাদের দৈনন্দিন লব্জে মিশে যায় 'কেন কী', আমাদের সারেগামায় বলিউড, আমাদের স্লোগানে অমুকসে আজাদি, তমুকসে আজাদি। আমরা খাবার দোকানে ইংরিজিতে খাবার চাই, পরিষেবা চাই বা পাই হিন্দিতে। আর নিউইয়র্ক কি লন্ডনের কোনো এক কোনে চাট্টি বাংলা সাইনবোর্ড দেখে, যা আবার আমাদের দৌলতে নয়, বাংলাদেশীদের কারণে, আশ্চর্য হয়ে ভাবি, কী কান্ড। আমাদের এফএমএ বাংলা নেই, সিনেমা হল উঠে গেছে, মাল্টিপ্লেক্সে অন্য সিনেমার রাজত্ব, কলকাতাগামী বিমানে ঘোষণা হয় হিন্দিতে। এই নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো সমস্যাও নেই। একে ইংরিজিতে বলে হেজিমনি, বাংলায় আধিপত্য, সম্মতি নির্মাণের প্রক্রিয়া। আমরা সম্মতি তৈরি হয়ে গেছে, চেতনা বন্ধক রাখা হয়ে গেছে, বলিউডি বোম্বে আর অভিজাত দক্ষিণ-দিল্লিতে।
এর চেয়েও বাজে ব্যাপার হল, সামনে এখন কোনো আলোকবর্তিকাও নেই। নব্বইয়ের মতো গিটার হাতে সুমন নেই, নতুন বাংলা গান নেই, কবিতায় নতুন জোয়ার নেই। গান বলতে স্রেফ সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ। ওটিটিতে বাংলা যা বিষয়বস্তু তৈরি হচ্ছে এপারে, তা চোখে দেখা যায়না। লেখালিখিতে ভূত ও রোমাঞ্চের প্রাবল্য। কেত করে নোয়াই বলুন আর উদ্ভটরসই বলুন, তা দিয়ে তো আর মাছ ঢাকা পড়েনা। ফলে, বাংলায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়ে যাবে, পরশু, এমন কোনো আশা নেই। আমরা, ওই, কে কার চটি চাটছে, এই নিয়ে পরচর্চা করেই সময় কাটাব, দিনগত গ্লানিক্ষয় করব। দোষ আলাদা করে কারো নয় গো মা, এসবই এক মরা সময়েরই অভিজ্ঞান, ঝরা সময়ে এরকমই হয়। সামনে একজন বন্দুক হাতে চে থাকলে তাও গায়ে কাঁটা লাগিয়ে চেগে ওঠা যেত। কিন্তু চে ওরকম ভাবে ম্যানুফ্যাকচার করা যায়না, ফলে এ ঠিক চেগে ওঠার পরিস্থিতি না।
পরিস্থিতি অবশ্য এরকমই হবার কথা। নিজের ভাষা, নিজের জাতীয়তাকে রক্ষা করা একটা রাজনৈতিক কাজ, সেটাকে দশকের পর দশক ধরে উপেক্ষা এবং দুচ্ছাই করে যাওয়া হয়েছে। কংগ্রেস দিল্লির ধামা ধরেছে, সিপিএম বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মনির মতো রক্ষা করতে গিয়ে ৭৭এর স্মারকলিপি গিলে ফেলেছে, অশোক মিত্র সরকার ছেড়েছেন, আর তৃণমূল ঠিক কী চায় নিজেই জানে কিনা সন্দেহ। সবার উপরে অবশ্যই বিজেপি, যাদের অ্যাজেন্ডা, বস্তুত, বাংলাভাষী ধর আর বাংলাদেশে পাঠাও। বাংলাদেশী হটাও আর গরু-পাচার বন্ধ কর। অস্যার্থ, গরুরাই এপারে থাকবে, বাংলাভাষীরা সীমানার ওপারে।
বিলাপ বেশি বাড়িয়ে লাভ নেই। কথা হচ্ছে, ব্যাপারটা আপাতত এরকমই থাকবে। অবস্থা বদলাবেনা। দীর্ঘকালীনভাবে নির্মিত সম্মতি ওভাবে একরাতে উবে যায়না। কিন্তু তার মধ্যেও বেসুরো সুর থাকে। হয়তো ছাইচাপা থাকে, হয়তো আধিপত্যের চাপে বলতে না পারা থাকে। ভিন্নমতকে জলহাওয়া দিলে, তারাও আগাছার মতো বেড়ে উঠতেই পারে, সর্বত্র। কাজেই, আপাতত, বিষমবাদী যে'কজন যেখানে মনে করছেন, যে, বিষয়টা জরুরি, তাঁদের একটাই কাজ। এটা যে একটা রাজনৈতিক বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিষয়, জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন, এই কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দিন। অর্থনীতি, চাকরি, এসবও এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা আমি আপনি এমনিই জানি। সেটা বলে চাপ দিন। বাংলা বাধ্যতামূলক করার জন্য চাপ দিন। কাজে, শিক্ষায়, মাল্টিপ্লেক্সে, এফএম এ, সর্বত্র। আর এই বলিউড নিয়ে আদিখ্যেতা, আদেখলাপনা, রিল বানানো নিয়ে খিল্লি করুন। এর সবকটাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন যেমন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ছিল। ভাষা চাপানোটা যদি রাজনৈতিক হয়, তার প্রতিরোধও রাজনৈতিক হওয়া দরকার। এইটা মূলধারার দলগুলোকে বুঝিয়ে ছাড়া হোক। বোঝাতে পারলে ভালো, নইলে আর কি, ভবিতব্য। মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকাল মাঝে, ওসব হয়েই থাকে। এমনকি চেও তো জেতেননি, আমরা কোন হরিদাস পাল।
লেখকের একটি বক্তব্য সাথে থাকলো - https://youtu.be/BhTCvUeAIKQ
লেখাটি পূর্বপ্রকাশিত