আকাশের অন্ধকার থেকে ছিটকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলি কেমন গাড়িটাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলতে থাকা হেডলাইটের আলো ফুঁড়ে নীচে পিচ রাস্তার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। উইন্ড স্ক্রিনের গায়ে ডানদিক-বাঁদিক করে করে ওয়াইপারটাও যেন জল ঠেলতে ঠেলতে হাঁফিয়ে পড়েছে। বাঁ হাতে লাইটার ধরিয়ে বিড়ি জ্বালাতে গিয়ে টের পেল রবিন, ভুল হয়ে গেছে, আগে জানালার কাচ উঠিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। জানালা দিয়ে ছিটকে ঢুকে পড়া জল তাড়া করা হুরমুড় বাতাস তার এই ডান হাতে স্টিয়ারিং সামলে বাঁ হাত দিয়ে বিড়ি ধরাবার প্রতিটি চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিচ্ছে। লাইটারটাকে ড্যাশবোর্ডের উপর নামিয়ে রেখে বাঁ হাত দিয়েই কোনও মতে জানালার কাচটাকে তুলে দেবে ভাবতেই মোবাইলটা বেজে উঠল। মিতার ফোন। হয়ত জিজ্ঞেস করবে, তুমি কোথায়? বা, আসার সময় বুল্টির জন্য—।
জানালার কাচ তোলার পর একবারের চেষ্টাতেই ধরে গেল বিড়িটা।
বর্ষাটা কেমন বাড়াবাড়ি করে ফেলল না? যা গরম পড়েছিল তাতে বৃষ্টিটাকে সবাই যে চাইছিল তা ঠিক। তা বলে এখনই? এত আগে? এই সময় একদিক থেকে অল্পসল্প বৃষ্টি অবশ্য কাজেই লাগে খুব। মই দেওয়া যায় সহজেই, আর তোলা ছড়িয়ে দিলে—। শ্রীকান্তের পাওয়ার টিলারের কথা সকালেই বলে এসেছে রবিন। তোলার মুখ ভালই সাদা হয়েছে। জন্মের কত ঝামেলা ভাবো। হ্যাঁ, মানুষের জন্মের মতো ধানের জন্মতেও। শুরুতে ঘন্টা দুইয়ের জন্য সেই বীজধান রোদে দেও রে, এরপর ঠাণ্ডা জলের মধ্যে একটা গোটা দিন মানে চব্বিশটা ঘন্টা, এরপর সেই ধান তোল যত্ন করে। তুলে একটা পরিষ্কার ঝুড়িতে ঢুকিয়ে খড়ের গাদার মধ্যে—। ‘এরপর তো জমির খেলা, জমি তোমাকে কী ফেরত দেবে তা জমিই শুধু জানে।’ কিন্তু রবিন কি নিজের মনেই বলেনি কথাটা? না কি ও সত্যি সত্যি মিতার পেটের কথা ভেবেই—, আর মিতা কেমন ধরল কথাটা আর কেমন আলতো করে যেন পাশের ঘরে থাকা মায়ের কানে না যায় এইভাবে ‘ন্যাকা’ কথাটাকে উচ্চারণ করল। আচ্ছা, ওই ‘ন্যাকা’ কথাটা দিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চাইল মিতা? ও কি এই পাঁচ বছরে পরপর তিন তিনটি মেয়ে জন্মানোর দায় তার উপর চাপাতে চাইল? মানে একটা অন্তত ছেলে জন্ম দেওয়ার প্রতিটি চেষ্টায়, মানে এই সাত বছরে বলতে গেলে পরপরই—, আসলে প্রতিবার মেয়ের মুখ দেখামাত্র পরের বার একটি ছেলে পাওয়ার জন্য রবিনের মরিয়া চেষ্টা--। রিমির জন্মের পর সেই যে বাড়ি ছেড়েছিল রবিন, একেবারে সাত-সাতটা দিন একটানা—, ওর এই বাড়ি না ফেরার খবর তখন ছড়িয়েছে সব জায়গাতেই। তুমি গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছ, বাড়িতে সংসার খরচের টাকা পাঠাচ্ছ ঠিক আছে, কিন্তু শনিবারের বাজার পর্যন্ত এসে বাড়ি ফিরবে না কেন? বাজারের বিকাশ ডাক্তারকে কাজের চাপের কথাই বলেছিল রবিন, বলেছিল, ‘যাই কী করে বলুন, টিপের চাপ খুব, সকালে সোনারপুর তো বিকেলে ক্যানিং।’ ডাক্তার অবশ্য ধরেছিল ঠিক, একেবারে বাজারের সবার সামনে ধরে এই মারে তো সেই মারে, ওখানে ওই দঙ্গল ভিড়ের মধ্যেই বলে ফেলল লোকটা, বলল, ছেলে বা মেয়ে হওয়ার জন্য মায়ের পেট নয় রে হারামজাদা, ওর জন্য দায়ী তোর বীজ, হ্যাঁ ওই তোর বীর্যই। এরপর ওই বিকাশ ডাক্তারই টানতে টানতে— ।
সেই গোচরণ থেকে টানা এই জামতলা পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ কিলোমিটার পথে বৃষ্টি একফোঁটা বিশ্রাম নিল না কোথাও। মিতা ওর মেয়ে বুল্টির জন্য রেইনকোটের কথাটা জানতে চাইল, অর্থাৎ রবিনের মনে আছে কিনা? মনে রেখেই বা কী হবে? বিকেলে শনিবারের বাজার থেকে গাড়ি ছাড়ার সময় ফোন এল শঙ্করদার। বলল, কিশোরীমোহনপুর থেকে সব্জি যাবে, গাড়ির অভাবে নাকি সেই দুপুর থেকে পড়ে আছে, শেয়ালদা পাঠানো যাচ্ছে না। না, শেয়ালদা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে না রবিনকে, ও অন্তত বারুইপুর পৌঁছে দিক, সোনারপুর যাচ্ছে যখন সে তো বারুইপুর হয়েই-–। শঙ্করদা বলল, করার নেই কিছু, দয়ালদা খুব করে বলল। দয়ালদা মানে দয়াল পাইকার। উচ্ছে-ঢেঁড়শের সিজন এটা, আজ কোনটার কত রেট গেল কে জানে। সেই দয়াল পাইকারের কথায় প্ল্যানটাই পাল্টে গেল রবিনের। জামতলা যাওয়ার রাস্তায় কোথাও হলে ঠিক ছিল, বদলে একেবারে উলটো দিকে। আগে বাঁ দিকে ঘুরে কিশোরীমোহনপুর যাও, সব্জি লোড করো, এরপর আবার যে পথে গেলে সেই পথে ফিরে শনিবারের বাজার হয়ে পেটকুলে থামো, ওখানে সোনাইদার পোলট্রি থেকে মুরগির ক্রেট। ওটাই অবশ্য আসল টিপ ছিল আজ, আজ মানে বরাবরের। সপ্তাহের সোম আর শুক্র-- একেবারে নিয়ম করে। ক্রেট প্রতি বার-তেরটা মুরগি, আর পঁচিশ থেকে চল্লিশটা ক্রেট। শঙ্করদার কথায় সায় দিয়েই মনে হয়েছিল, আরে রোজকার মতো গোটা পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ ক্রেট গেলে সব্জীর বস্তা ধরবে কোথায়? শঙ্করদা চিন্তা করতে বারণ করে বলল, মুরগি কম আছে আজ, মাত্র বার ক্রেট মাল, আর সব্জির বস্তাও গোটা তিনেক, বলল, হয়ে যাবে। পেটকুল থেকে জামতলা হয়ে সোনারপুর। ফেরার কথাটা শঙ্করদা ভাববে না? কিশোরীমোহনপুরের এই হঠাৎ পাওয়া সব্জির টিপের জন্য এখন শনিবারের বাজার থেকে পিছিয়ে বাঁ দিকে যাও অন্তত আধঘন্টা, এরপর যা হয়, লোকের জন্য দাঁড়িয়ে থাক মিনিট কুড়ি, সব্জির বস্তা তো আর রবিনের একা তোলার কাজ নয়। কিশোরীমোহনপুরের সব্জির ঝামেলা না থাকলে এতক্ষণে শনিবারের বাজার পৌঁছে যেত সে। এর মধ্যে আবার পেটকুলে নেমে সোনাইদাকে মুরগির ক্রেটের হিসেব বুঝিয়ে দিতে হবে তাকে। কিন্তু মনসা এখন কোথায়, এমনিতে ওর আলুবাজারের সেই পেচ্ছাবখানার পাশের শেষ চাতালেই থাকার কথা। পেচ্ছাবখানার পাশে হওয়ায় ওই চাতালে টিনের শেড থাকা সত্ত্বেও কোনও আলুব্যাপারি বসবে না, আর তাতেই জায়গা হয়ে গেল মনসার।অবশ্য বছর দুই আগের একা মনসা থেকে এখন দুই। দুই মানে একটা পেট থেকে আর একটা নতুন পেট। এই এখন পর্যন্ত বলা যায় পেটের মধ্যে পেট। হোক পেটের মধ্যে পেট, সংখ্যাটা আর এক নেই কিছুতেই, দুই। দু’-দুটো পেটের খিদে নিয়ে ও নিশ্চিত এখন আর ওই আলুবাজারের চাতালে বসে নেই। দুই পেট খিদে নিয়ে এত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে করে ও নিশ্চিত ধৈর্য হারিয়ে এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পিচ রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেই বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে একা দূর থেকে আসা আলো দেখতে পেলেই রবিনের কথা ভাবছে। তাই বা কেন, রবিনের নাম ও আবার জানবে কোত্থেকে, ও আসলে খিদে মেটাবার কথাই ভাবছে। দু’-দুটো পেটের খিদে। ভাত বা পরোটা।সঙ্গে মাছ সবজি। কিন্তু ও কি এখন ভিজছে? এই বৃষ্টিতে বাজারের সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে এতক্ষণে। মন্টু বেরার চায়ের দোকানের নীচে এসে দাঁড়ালে তবু একটু বাঁচতে পারবে মেয়েটা। বাঁ হাতে পকেট থেকে মোবাইলটা তুলে রবিন দেখল দশটা আঠারো। কিশোরীমোহনপুরের সব্জির ঝামেলা না থাকলে ন’টা-সাড়ে ন’টার মধ্যে ফিরে আসতে পারত সে। আর সেক্ষেত্রে জামতলা বাজার থেকেই বুল্টির জন্য রেইনকোটটা--। আজ বাজারবার ছিল তার মধ্যে। গেল মঙ্গলবার থেকেই বলে যাচ্ছে মিতা। মেয়েটা সেদিন নাকি স্কুল থেকে ভিজতে ভিজতে ফিরেছে। রবিনের মনে হয়েছিল, ছাতা দিলেই তো হতো। ছাতা? অবাক হয়ে মিতা বলে উঠেছিল, নিজে তো স্কুলে যাওনি কোনও দিন, বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে বাড়ি থেকে সব মিলিয়ে সোয়া এক ঘন্টার রাস্তা, বাতাসে ছাতা ধরে রাখতে পারবে ও ? ও মানে বড় মেয়ে বুল্টি। না, বুল্টিকে নিয়ে সমস্যা নেই রবিনের, কিন্তু তাই বলে পরপর রুবি, রিমি? মিতা অবশ্য বুল্টি ছাড়া রুবি বা রিমির জন্য কিছু বলেছিল কিনা এখন আর মনে পড়ছে না রবিনের। রিমি হওয়ার পর মা বলেছিল, পেটে সমস্যা আছে তোর বউয়ের, বংশ রক্ষা হবে না ওর দ্বারা। এই বউকে দিয়ে চেষ্টা না করে ভাব অন্য কিছু।
দু’পাশের ইউক্যালিপ্টাসগুলি একেবারে পাগলের মতো করছে না? যেন ভেঙেই পড়বে। আর পড়েও তো। আজ অবশ্য ভেঙে পড়ার মতো অত বাতাস মানে ঝড় নয়, তবু—,আর পাগলের কথায় ফের মনসার কথা মনে পড়ল। কোত্থেকে এল এই মেয়ে,ভাবো! ওর নাম যে মনসা তা-ই বা বলল কে? হতে পারে পাঁচমাথার মোড়ের মনসার মেলায় প্রথম সবার চোখে পড়ে সে। অবশ্য পাঁচমাথার মেলা না হলেও মনসার মেলার তো আর অভাব নেই এই তল্লাটে। মোট কথা মনসার মেলার সঙ্গে মেয়েটির নামের একটা যোগ আছে নিশ্চিত। ও কখনই নিজের কোনও একটা কিছু নাম বলেছে বলে তো বিশ্বাস হয় না। নামের সঙ্গে ওর এই মনসার মেলার যোগ ধরলে বছর দুয়েক আগে বর্ষার শুরুতেই এসে থাকবে মেয়েটি। আর মনসার মেলার সঙ্গে ওর নামের যোগ না ধরলে ওর ফোঁস করার অভ্যাস থেকেও হতে পারে তা। তবে আলুর গুমটির ওই টিনের শেডের নীচে ঘাপটি মারা ওই অন্ধকারে কিছু পছন্দ না হলে কবে কাকে ও ফোঁস করে বসল তা-ই বা কেউ জানবে কীভাবে? দিনের বেলায় ও যখন ঘুরে বেড়ায় নিজের মনে তখন কেউ কখনও ওকে কি ফোঁস করে উঠতে দেখেছে? এমনকি ওকে খ্যাপাবার চেষ্টা করলেও ও চুপ করে থেকেছে। তবে? কথাবার্তায় ও যে খুব পাগল তা তো নয়। সব সময় যে আজেবাজে বকবক বা গালিগালাজ তা পাবে না ওর কাছ থেকে। বরং বেশিরভাগ সময়টাতেই চুপ করে থাকবে। বড় জোর খিদে পেলে—, তা ওটা তো আর দোষের কিছু নয়। হ্যাঁ আছে, দোষের বিষয় আছে অবশ্য একটা, আর সেটা খুবই নোংরা একেবারে। এমনিতে ওকে খুব অপরিচ্ছন্ন বলতে পারবে না তুমি, কিন্তু কী যে খেয়াল ভাবো, কোমরে বেল্টের মতো করে দড়ি বাঁধবে জোর গিঁট দিয়ে, আর সেই দড়ি থেকে ঝুলিয়ে রাখবে কী নয়? সে তুমি শশা বলতে পার কি জয়দেবদার দোকানের ফেলে দেওয়া পরোটা, আবার আবর্জনায় মধ্যে পরে থাকা প্লাস্টিক পেপারে মোড়া হাবিজাবি একরাশ কাগজ বা ডাবের খোলাও। সেই প্লাস্টিক পেপারে থাকতে পারে মেয়েদের সেই নোংরা—।
পরোটার দোকানের জয়দেবদা সেদিন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে বসল, ক’মাস হতে পারে তোর মনে হয়?
‘কার?’
‘কার মানে? এখানে কি আমার বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করব তোকে? মনসার। কিছুই জানিস না যেন মনে হচ্ছে।’
‘ওহ, আমি ভাবলাম, কারেন্ট আসতে কত সময় লাগবে তার কথা বলছ।’
‘ ন্যাকা সাজছিস নাকি তুই, দুনিয়ার লোক ওর পেট দেখতে দেখতে যাচ্ছে—। বাজার কমিটির প্রদীপদা বলল, ওর বউ নাকি জানিয়েছে, অন্তত সাত মাস, ডাক্তার দেখানো উচিত।’
‘তাহলে আর আমাকে জিজ্ঞেস করলে কেন? এ সব তো মেয়েদেরই বলতে পারার কথা। বউদি আছে তো দোকানে জিজ্ঞেস করো।’
‘না রে, তোর বউদিকে জিজ্ঞেস করতে আমারই খারাপ লাগে, মনে হয়, ও তো স্ত্রীলোক ওর কাছে তো আমরাই কালপ্রিট, মানে আমাদের এই পুরুষ জাতেরই তো কেউ—। যতই স্ত্রী হোক আমার— ।’
‘তাহলে প্রদীপদা পারল কীভাবে? তুমিই তো বললে— ।’
একটা কোনও মহিলাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। ছাতা অবশ্য আছে মাথায়, কিন্তু এই বৃষ্টি কি আর ছাতায় মানে? হয়তো ভিজে ভিজে উথাল-পাথাল হওয়া ইউক্যালিপ্টাসগুলির ফাঁক গলে আচমকাই ঢুকে পড়বে পাশের গ্রামের কোনও রাস্তায়। রাস্তার নিচু জায়গাগুলিতে এর মধ্যেই জল জমে গেছে। গাড়ির দুপাশটা এই মুহূর্তে রবিন দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারছে চাকার ধাক্কায় রাস্তার নীচু জায়গায় জমে থাকা জল একেবারে তোড়ে ছিটকে দু’পাশের ইউক্যালিপ্টাস বা শিরীষ গাছগুলির গায়ে আছড়ে পড়ছে। হেডলাইটের আলো পেয়ে সেই মহিলা এবার একবার পেছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছাতার নীচে দাঁড়িয়েই রাস্তার একটু বাইরে সরে দাঁড়াল। চেনাশুনো কেউ হলে রবিন গাড়ি থামিয়ে তুলে নিত ঠিক। কিন্তু এই বৃষ্টিতে এত রাতে এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে নিজের বউকেই কি চিনতে পারত রবিন? কিন্তু মনসার কথা বাজার কমিটির প্রদীপদা ওর বউকে বলবে কেন? কোনও ধান্দা আছে নাকি লোকটার? ঠিক এই কথাটাই জিজ্ঞেস করে রীতিমতো অবাক সেদিন রবিন। প্রদীপদার নাকি বাচ্চা-কাচ্চা নেই কোনও।
‘বাচ্চা-কাচ্চা নেই মানে ছেলেমেয়ে হয়নি?’
জয়দেবদা বলল, না তো। বলল, আমাদের দুটো বাড়ির পরেই, বিয়ের পর সাত বছর হয়ে গেল। ওর তিন বছর পর বিয়ে করে আমারই তো—।
‘তাই বলে পাগলির বাচ্চা?’
‘তাতে কি? বাচ্চা একবার পেট থেকে বেরিয়ে এলে পাগলি আর ভালো দেখতে যাচ্ছে কে? পেট হল পেট। সেখানে উম পেয়ে পেয়ে একটা বীজ— ।’
‘এসব নিয়ে কিছু বলেছে প্রদীপদা?’
জয়দেবদার কথায় এসব নিয়ে সরাসরি কেউ বলে নাকি কিছু? তলায় তলায় আছে নাকি অনেকেই। নইলে বাজার কমিটির পয়সায় হঠাৎ মনসার জন্য প্লাস্টিক, পরোটা তরকারি, একটা-দু’টো আপেল। থানার বড়বাবু আবার ওর জন্য কম্বল— একটা নয়, একেবারে দু-দুটো। না, শুধু প্রদীপদা বা বড়বাবু নয় আছে নাকি অনেকেই। অনেকেই মানে? সরাসরি কিছু না বলে জয়দেবদা যা বলল তা কিন্তু বলা কথার চেয়েও বেশি। বলল, মনসার চেহারা লক্ষ করলেই নাকি বুঝতে পারবে রবিন। রবিন সত্যিই তখনও বোঝেনি কিছু, আর তা বুঝতে পেরে জয়দেবদা বলল, মনসার চেহারার গ্ল্যামার দেখছিস? এই অবস্থায় কত ফুড দরকার বল তো, ফুড, ওষুধ— । ওর চেহারা তো আর এখন ফুড-ওষুধ না পাওয়া চেহারা নয় বাবা, সকাল-দুপুর-রাতের তিনবেলা খাবার না পেলে--, কেউ না কেউ তো আছে ওর পেছনে ঠিক। বা দয়া ধর্ম হয়তো করছে অনেকেই, মুখ ফুটে না বললেও অনেকেই হয়তো কাউকে না বুঝতে দিয়ে— । ‘অনেকেই’ কথাটার মানে জিজ্ঞেস করায় নামগুলি আর ভাঙতে চাইল না লোকটা।
বকুলের হাট ছাড়ানো মাত্রই সতর্ক হয় রবিন। না, বাজে চিন্তা করা যাবে না আর। রাস্তায় এখানে টার্ন আছে খুব। এই ডানদিক তো এই বাঁ দিক। বৃষ্টিতে একেবারে শুনশান হয়ে যাওয়া এই ভেজা রাস্তায় কিছু হলে সারা রাত লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না একটা, আর জয়দেবদা যা বলল সবই যে ঠিক তা তো নয়। মাঝে একদিন শহিদ বেদির পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকা প্রদীপদাকে লক্ষ করেছে রবিন। রাস্তার উল্টো দিকে তখন মনসা আখের রসের কলের পাশে উবু হয়ে বসে ফেলে দেওয়া ছিবড়ে বাছছে। প্রদীপদাকে তো মনসার দিকে তাকাতেই দেখল না সে। জয়দেবদা প্রদীপদার নামে এমন অদ্ভুত সন্দেহ কেন করল কে জানে? প্রদীপদা কি রবিনের মতো ভিখিরি নাকি যে পয়সার অভাবে নিজের বউটাকে একবার জয়নগরের কোনও ডাক্তার বা ডায়মন্ডের কোনও নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে পারবে না। ওসব ছাড়ো, মাত্র তিনশ’ টাকায় একটা মাদুলির কথা বলেছিল পাশের বাড়ির প্রতিমা, এমনকি মিতাও দু’ একবার তাগাদা দিয়েছে তাকে এটা নিয়ে, পারল রবিন? তা প্রদীপদাদের তো আর সে সমস্যা নেই, পয়সাওলা লোক, হয়তো প্রবলেম আছে ওর বউয়ের পেটে। কলকাতার বড় ডাক্তার কি আর দেখায়নি? ডাক্তার হয়তো ধৈর্য ধরতে বলেছে। হয়তো ওষুধ চলছে। তাই বলে রাস্তা-ঘাটের কোনও আবড়-জাবড় ঝোলানো নোংরা পাগলির মেয়ে? ওদের বাড়ির লোকই মেনে নেবে না। প্রদীপদার বউ এই বয়সেও রীতিমতো টিপটপ থাকা মহিলা, উনি মানবেনই না কোনও মতে, প্রদীপদার মা মানবে?
দীপক মাঝির ফার্নিচারের দোকান পার হতেই প্রথম টার্নের মুখে পড়তে হল রবিনকে। প্রথম টার্ন মানে এর আগেও যে টার্ন নিতে হয়নি তা তো নয়, তবে সে সব এত অল্প জায়গার টার্ন নয়, আর প্রথম টার্নে হেডলাইটের আলো রাস্তার বাইরে বাঁদিকের জমির উপর অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তেই তাজ্জব বনে গেল রবিন। এ তো জলে থইথই একেবারে। মাঝিপাড়ার একেবারে শেষ মাথা পর্যন্ত তখন দেখা যাচ্ছে। যদিও তা কয়েক সেকেন্ডের জন্যই, আর এরপর রাস্তা আবার কয়েক মিনিটের জন্য একেবারে সোজা হওয়ায় রবিন নিজেদের মাঠটাকে মনে মনে একবার ভেবে নেওয়ার সুযোগ পায়। দরকার বড়জোর ইঞ্চি দুয়েকের জল, আর বেশি বৃষ্টি না হলে সকালের মধ্যে অতিরিক্ত জল নেমে যাবে ঠিক। দুপুরের মধ্যে মই দিয়ে নিতে পারলে ওই জমিতে তোলা ছড়িয়ে দিতে আর কতক্ষণ? এরপর শুধু পরদিন ওই ইঞ্চিদুয়েকের বেশি জমা জলটাকে বের করে দেওয়া।
আর মিতার কথা ভাবো, একেবারে ঝপ ঝপ করে বুল্টি, রুবি, রিমি। কী এমন যত্ন আত্তি করেছে রবিন? কী এমন খাদ্য-খাওয়া? এই বীজধানগুলির মতো যত্ন করলে বা একটু কোনও হিসেব, হিসেব মানে প্রতিমা বৌদির কথামতো জড়ি-বুটি বা ওষুধ ব্যবহার করলে হয়তো তিনটের মধ্যে একটা অন্তত— মানে রুবির জায়গায় কোনও ছেলে হলেই থার্ডবার আর চেষ্টা করত না সে। মানে রিমি বলে কে কেউ থাকতই না পৃথিবীতে। থাকতই না মানে আসতই না তো। কী আশ্চর্য না! একজনের ওপর আর একজনের ভাগ্য নির্ভর করে কেমন।
অত বৃষ্টির মধ্যে সোনাইদা তার জন্য রাস্তার ধারের বারান্দায় বসে থাকবে বলে আশা করেনি রবিন। আর পাঁচটা দিনে এসময় এক-দুটো কর্মচারী নিয়ে বারান্দায় বসে অপেক্ষাই করে সোনাইদা, বা সংগে থাকতে পারে আশপাশের বাড়ির কেউও। বিনি পয়সায় বিড়ি খাওয়ার লোভেই আসবে অবশ্য কেউ। এমনিতে মনটা ভালই লোকটার। রবিন তাড়াহুড়া না দেখালে চা খাওয়ার কথা বলবে। চায়ের সঙ্গে একটা বিস্কুট। আজ অবশ্য এত কিছুর প্রশ্নই উঠবে না। গাড়িটাকে সোনাইদার বারান্দার পাশ বরাবর দাঁড় করিয়ে হর্ন মারল রবিন। এমনিতে কারও সজাগ কান থাকলে ঘরের পাশে রাস্তায় কোনও চলতে-থাকা গাড়ির থেমে যাওয়া টের না পাওয়ার কথা নয়। আর রবিনের গাড়ির হর্ন বা ইঞ্জিনের শব্দও এতদিনে সোনাইদার কানে পুরনো হয়ে যাওয়ারই কথা। সে ঠিক আছে, লোকটা হয়তো তাহলে ঘুমিয়েই, ভেবে এবার হর্ন না মেরে হাঁকই মারল। বাঁদিকের মাঠে বেশ দূরেই আলো ঘুরছে কয়েকটা। টর্চ। জাল পেতেছে অনেকেই। শোল, ট্যাংরা, জাপানি পুঁটি। ভাগ্য ভাল থাকলে কারও ভেসে যাওয়া পুকুরের ছোট সাইজের ভেটকিও জুটে যেতে পারে। ব্যাঙ ডাকছে খুব। এসময় শুধু ব্যাঙ নয়, জলে মুখ ভাসিয়ে সাপও অপেক্ষা করবে। অপেক্ষা করবে, ভাসবে। অল্প জলে পায়ের তলায় গড়িয়ে যাবে শামুক। তোমার জালের পাশ দিয়ে বা তোমার গা বেয়েই একটা শামুক মুখে নিয়ে ভেসে যাবে এক শামুক-কেউটে।
গাড়ির দরজা খুলে এবার একলাফে লোকটার বারান্দায় উঠে দরজায় ধাক্কা মারা শুরু করল রবিন। আর একটা ট্রাক আসছে পেছনে। যেতে পারবে তো গাড়িটা? যা ভেবেছে তাই। জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়েই পড়ল গাড়িটা আর হর্ন মারতে শুরু করল অন্ধকার ফাটিয়ে। এই বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দের মধ্যে সে এক পাগল করা অবস্থা। লোকটার তর সইছে না যেন। এই এতক্ষণে দরজা খুলল সোনাইদা। পেছনে আসতে থাকা আর একটা গাড়ির আলো দেখে বলল, থানার বড়বাবুর গাড়ি, শিগগির গাড়ি সরা।
আবার জলে ভেজো, আবার গাড়িতে ওঠো,আবার স্টিয়ারিং-এ হাত। বড়বাবুর গাড়ি আসার আগেই ট্রাকটার রাস্তা তৈরি করে দিল রবিন। আসলে এত রাতে এই গ্রামের রাস্তায় কেউ আসবে বলেই আর ভাবতে পারেনি সে। কিন্তু বড়বাবু এত রাতে এদিকেই বা গিয়েছিল কোথায়? এই ঝড় বাতাসের রাতে লোকটার তো ঘর ছেড়ে বের হওয়ার কথা নয়। সোনাইদা বলল, জামতলার দিকে কোথাও ডাকাতি বা খুন কিছু হয়েছে হয়তো, হয়তো কলকাতা বা বারুইপুর থেকে ডাক করিয়েছে।
সবেমাত্র সোনাইদার হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে গাড়ির পেছনে উঠেছে রবিন, অমনি বলে উঠল লোকটা, বিড়ি দে তো রবিন, সেই সন্ধে থেকে মুখে দিইনি একটাও, এত বৃষ্টিতে—।
‘ড্যাশবোর্ডের উপর আছে, নিয়ে নাও।’
‘ছাতা তো তোর হাতে, এই বৃষ্টিতে আমাকে ভিজতে হবে তাহলে, তুই দেখ না একটু।’
‘আমি এখন দড়ি খুলছি, তোমারই মেশ নষ্ট হবে বলছি। দু’পা জলে ভিজলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না, যাও তো।’
বিড়ির নেশা সেই সন্ধে থেকে চেপে আছে লোকটার, যেতে ওকে হবেই, তাছাড়া এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। সারাদিন মেঘ থাকায় রাস্তার সোলারের লাইটে হয়তো এর মধ্যে রেড পরে গেছে, আর রেড পরে থাকলে শনিবারের বাজার এলাকা এখন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, খালি চোখে ওখানে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবিনের কাছে টর্চ অবশ্য আছে একটা, তবে সেটার আলো নেই তেমন,ভাল টর্চ ঘরে মিতার কাছে। বর্ষা-বাদলার দিনে ভাল টর্চ ছাড়া তুমি সত্যিকারের অন্ধকারেই।
‘এই কীরে অত খাবার কার জন্য? দিনের বেলা খাসনি তুই? ভাত নিয়েছিলি যখন তা প্যাকেটে কেন? দোকানে বসেই তো— ।’
সর্বনাশ, একেবারে খেয়াল ছিল না। সিটের উপরই তো রাখা। প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভাত, তরকারি, মাছের ঝোল। পাশে দু’ট আপেল, কলা। উত্তর না পেয়ে সোনাইদা ফের হাঁক পাড়ল, জিজ্ঞেস করল,কী রে?
এখন এই বর্ষা-বাদলের রাতে রাস্তার দু’পাশের ইউক্যালিপ্টাসের গায়ে আছড়ে পড়া তুমুল জল আর বাতাসের দুলুনিতে অনেক শব্দ তুমি নাও শুনতে পার। আর তা যদি তুমি না শুনতে চাও তবে তুমি শুনবেও না অবশ্যই। রবিন কানেই নিল না কোনও কথা। সে বরং, মেশ-এর বস্তা ধরতে হবে বলে গাড়ি ছেড়ে নীচে নামতে বলল লোকটাকে।
‘না রে বাবা, আমাকে ঘরে ফিরতে হবে আগে, মাঠের কী অবস্থা হল কে জানে, কাল পাওয়ার টিলারের কথা বলা আছে, বীজধানের কোলা বেরিয়ে গেছে, এখন যদি আজকের এই বৃষ্টিতে—।’
পাঁচটা বিড়ি রেখে দিল লোকটা। বলল, পরে নিয়ে নিস, কাল সকালে এত বৃষ্টিতে ননী যদি দোকান না খোলে।
শনিবারের বাজারে ঢোকার লাস্ট কালভার্ট পার হওয়ার পরপরই লাইট মারলে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা দোকানঘরগুলি চোখে পড়বে। সমীর দেবনাথের মুরগির দোকান, বিকাশ ডাক্তারের চেম্বার, বাসু বৈরাগীদের মাছের কাঁটা বা মন্টু বেরা কি শ্যামল জানা থেকে শুরু করে সবার চায়ের দোকানগুলিকে এখান চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে রবিন। আর এর পরপরই পাকা রাস্তার ডানদিকে ঢুকে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে বাজারের চালা বা পাকা দালান ঘরগুলি চোখে পরবে। কিন্তু গেল কোথায় মেয়েটা। এবার শুধু আলো নয় পরপর বারকয়েক হর্ন মারল রবিন। না, রাস্তায় অবশ্য ও ছাড়া এই মুহূর্তে আর কারও থাকার কথা নয়। রাত প্রায় এই এগারোটায় মাঠে-ঘাটে টর্চ নিয়ে মাছ ধরতে নামা দু-একজন বাদে কেউই আর জেগে নেই। এরকমটা হয়নি তো কোনও দিন। টিপ না থাকলে বাজার বন্ধের আগে যে ভাবেই হোক কায়দা করে কেউ যেন দেখতে না পায় এভাবে ভাত না হলেও পরটা তরকারি বা এক-আধটা আপেল সব্জি বাজারের শেষদিকে এই টিনের শেডের তলায় ঠিকই রেখে গেছে রবিন। আর তা থেকে মেয়েটা বুঝতেও পারত ঠিক। অর্থাৎ সেদিন ওকে আর রাত করে দাঁড়াতে হবে না। কিন্তু আজ তো সে রেখে আসেনি কিছু। কোনও প্লাস্টিকের প্যাকেট, আপেল বা কলা। কেউ দেখার নেই আজ তবু আলো নিভিয়েই ছোট টর্চ হাতে গাড়ি থেকে নামল রবিন। বাঁ হাতে ভাতের প্যাকেট, ফল। তবে কি শরীর খারাপ? এসময় মেয়েদের হাজারটা প্রবলেম, দেখেছে তো মিতাকে। পাকা রাস্তা থেকে নেমে ডানদিকে বাজারের ভিতর ঢুকল রবিন। মাছের বাজারের টিনের শেড ছাড়িয়ে সব্জি বাজার। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো চাতাল। বাজারের শেষ মাথায় পেচ্ছাবখানার প্রায় গায়ে লাগোয়া আলুবাজারের শেষ চালা। দূর থেকেই টর্চ মারল রবিন। একটা অস্পষ্ট কিছু নড়ে উঠল না? না, মানুষ নয় তো। কাছে গিয়ে বোঝা গেল বৃষ্টি আর বাতাসের দাপটে ঝটপট করতে থাকা প্লাস্টিক পেপারটিই শুধুমাত্র। নীচে বাজার কমিটির প্রদীপদার দেওয়া জলের মগ, বিছানার মতো করে পাতা কম্বলের উপর এলোমেলো পড়ে থাকা গায়ে দেওয়ার কম্বল। কম্বলের মাথার দিকে না খোলা পরোটার প্যাকেট, দুটো আপেল, কলা কয়েকটা। ভিজছে সবকিছু। ভিজছে রবিনও। পুরোই ভিজে গেছে সে। ফের আলো ঝলমল করে উঠল চারপাশটা। একেবারে দিনের আলোর মতো আলোয় বোঝা গেল চারপাশের কোথাও কেউ নেই আর। মনসার নাম ধরে আজ সে ডেকেও উঠতে পারত ইচ্ছে করলে। রবিনের এই ডাক শোনার মতো চারপাশের কেউ কোথাও না থাকলেও ডাকল না সে। সঙ্গে নিয়ে আসা আপেল, কলা, ভাতের প্যাকেট, আর দুটো ছোট পলি প্যাকে মাছ আর সব্জি মনসার বিছানায় ছড়িয়ে থাকা কম্বলের মাথার দিকে রেখে গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। পরপর দুটো হর্ন দিয়ে একবার জানালার বাইরে মুখ বের করে দুপাশটা দেখে নিল ভাল করে।
দিন দশেক বাদ দিয়ে এবার বেশ বর্ষাকালের মতো করেই শুরু হল বৃষ্টিটা। আজ ছিল আমতলা। সেই বারুইপুর হয়ে। মিতা ফোন করেছিল দুপুরে। তাড়াতাড়ি ফিরতে বলে জানাল, রোয়া ভেসে গেছে একেবারে। তা ভাসুক। জল সময়মতো নামলেই হল। সোনাইদার ওখানে ক্রেট মিলিয়ে মেশের বস্তা নামাতে নামাতে প্রায় পৌনে দশ।
‘তোদের বাজারের সেই পাগলিটা নাকি বাচ্চা বিইয়েছে?’—হঠাৎ করেই জানতে চাইল সোনাইদা। এই এতদিন পর হঠাৎ। মুরগির ফাঁকা ক্রেট নামাতে নামাতেই যেন মনে পড়ল। রবিন বলল, ‘শুনেছি আমিও।’
‘ছেলে না মেয়ে?’
‘শুনেছি তো মরা বাচ্চা।’
‘তাতে কী, মরা বাচ্চার কি ছেলে-মেয়ে থাকবে না?’
‘এত খবর রাখব কী করে বলো? থাকি কোথায়। সারাদিনই তো তোমাদের সোনারপুর আর ক্যানিং বা আমতলা।’
সত্যি কথা বলতে রবিন এখন আর থাকে না কোথাও। বাজারের পাগলিটার বাচ্চা হওয়ার কথা সে ক’দিন আগেই শুনেছে। সেই যেবার সোনারপুর হয়ে মুরগির ক্রেট সোনাইদার পোলট্রিতে নামিয়ে সেই বৃষ্টিবাদলের রাতে--, সেই যেদিন মেয়েটিকে বাজারে নেমেও খুঁজে পায়নি রবিন। সন্ধের পরপর থানার বড়বাবুই নাকি—, সঙ্গে বাজার কমিটির প্রদীপদা আর কে কে সব, এই বাজারেরই হবে। বড়বাবুর কোন দাদার নাকি সন্তান নেই কোনও, বিয়ে হয়েছে তাও নাকি দশ বছর, সেই ভদ্রলোক নাকি একদিন কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে ঘুরে গেছে এই বাজার থেকে, ঘুরে গেছে মানে দেখে গেছে আর কি মনসাকে। অর্থাৎ রবিনের চান্স ছিল না কোনও। থানার বড়বাবুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রদীপদাই কি পারত? কিন্তু ওটা নাকি ছিল মরা বাচ্চা। পাগলিটার নাকি বাঁচার কথা ছিল না কোনও। ওই ডেলিভারির সময়ই— । ‘ছেলে না মেয়ে, বলল না কেউ?’— বাজারের জয়দেবদার কাছে একেবারে সাধারণ গলাতেই জানতে চেয়েছিল রবিন।
‘বাচ্চা যখন মায়ের পেটেই মরে পড়ে আছে তখন ছেলে না মেয়ে জেনে কার কী লাভ?’
সেদিন সকাল থেকেই নাকি অবস্থা খারাপ ছিল মনসার। বিকাশ ডাক্তার নাকি আগেই বলে দিয়েছিল উটকো ঝামেলায় পড়তে হবে, বলেছিল পেশেন্ট বা বেবি দু’য়েরই বাঁচার আশা কম। ডাক্তারের কথা শুনে মনসাকে ছুঁতে যাবে কে? কে বেকার পুলিশের ঝামেলায়--।
রবিনের তবু জানার ইচ্ছে হচ্ছিল একটা কথা, ছেলে না মেয়ে? আর সেই উত্তর জানার ক্ষীণ আশায় সে জানতে চেয়েছিল, বেঁচে আছে মনসা? জয়দেবদার কথায়, বেঁচে থাকলে হাসপাতাল থেকেই হয়তো তুলে দিয়েছে কোনও বাস বা মোটর ভ্যানে। অন্য কোনও রুটের বাস বা মোটর ভ্যানে তুলে দিলে তো হয়েই গেল। কোথায় যাবে কে জানে? নইলে এই শনিবারের বাজার ছাড়া ও যাবে কোথায়? যদিও বেঁচে আছে কিনা এখনও বলতে পারল না কেউ। ডাক্তারের মুখে ‘ বেবি অলরেডি ডেড আর মাদারের চান্স নেই কোনও’-- শুনে বড়বাবু,প্রদীপদা বা যারা গিয়েছিল তাদের কেউই কেউই নাকি আর অপেক্ষা করতে চায়নি। কিছু হলে থানায় একটা খবর পাঠাতে বলে বড়বাবু চলে এসেছিল। আর কিছু হলে বলতে তো,বড়বাবু নিশ্চিত মনসার মৃত্যুর কথাই বুঝিয়েছিল। মনসার অপারেশন অবধি ওরা কেউ অপেক্ষা করলে জানা যেত অনেক কিছু। আর সেই থেকে ওকে এই বাজারে আর কেউ এখনও দেখেনি। অবশ্য হাসপাতাল থেকে থানায় কোনও খবর এসেছিল কিনা তা একমাত্র বড়বাবুরই জানার কথা। জয়দেবদা বলল, যাও জিজ্ঞেস করে আসো বড়বাবুকে।
নকুলের মোড় ছাড়িয়ে একটা কালভার্ট আর তারপরেই শনিবারের বাজার। বাজারের বাইরে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা দোকান ঘরগুলি এবার চোখে পড়বে। এরপর ডানদিকে মূল বাজার, মাছের ঘরগুলির শেড, এরপর সব্জি। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে না। কোনও মানুষ, না কি ছায়া পড়েছে কিছুর? থামাবে গাড়িটা? একেবারে একই জায়গা। গাড়িটা একটু বাঁদিক হতেই মুহূর্তের জন্যই মনে হল, কেমন ছায়া না একটা? কিন্তু অন্ধকারে ছায়ার মধ্যে ছায়া থাকে কী করে? গতি কমালো রবিন। একেবারে প্রেতের মতো কোটরে ঢোকা চোখ, না আচড়ানো চুল, কোমর থেকে ঝুলতে থাকা— । আলোটা নিভিয়ে দিল রবিন। আকাশ থেকে নেমে আসা অল্প আলোতেও বৃষ্টিভেজা পিচ রাস্তা চকচক করছে। কেউ একজন সত্যিই দাঁড়িয়ে। কেউ একজন ভিজে যাওয়া শরীর নিয়ে রাস্তার পাশে থালা হাতে গাড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। হাসপাতাল থেকে হয়তো ছাড়া পেয়েছে আজ। না কি ছাড়া পেয়েছে আগেই, এবার এই রাস্তা ও রাস্তা ঘুরতে ঘুরতে ফের বসেই শণিবারের বাজার।
পিচ রাস্তা ছেড়ে রবিনের গাড়ি এখন গ্রামের ইটের রাস্তায় ঠোক্কর খাচ্ছে। লাফাচ্ছে খুব গাড়িটা। না, হেডলাইট আর জ্বালাবে না রবিন। কেউ কি এখনও দেখে যাচ্ছে রবিনকে? কেউ কি লক্ষ করছে রবিনকে পেছন থেকে। ওই ভাতের থালা, ওই পেট,তাকিয়ে থাকা চোখ। কেউ কি আশায় থাকছে এখনও? ভাবছে একজন কেউ ঠিক প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে তার জন্য পরোটা বা একটা-দুটো ফল— । এত রাতে একটা চেনা গাড়ির ওকে পার হয়ে চলে যাওয়ার পরেও ও হয়তো আশা করছে। ভাবছে, যতই হোক ঠিক ফিরবে। তারপর ওর পেটের দিকে তাকিয়ে হাতে রাখা প্লাস্টিকের প্যাকেটে পরোটা বা কিছু ওর হাতে ধরিয়ে সেই চেনা লোকটা জানতে চাইবে, ভাল আছিস?
এত রাতে বৃষ্টি জোর বাড়াল ফের। এই বৃষ্টিটাকেই ভয় পাচ্ছে রবিন। আর একটা দিন বৃষ্টি হলেই দিন দশেক আগের কষ্টের রোয়া একেবারে বেকার হয়ে যাবে। পুরো চল্লিশ কেজি-র দামী বীজধানের অত কষ্টের তৈরি তোলা থেকে একটা দানা ধানও পাওয়া যাবে না।
গাড়ি থামিয়ে রবিন দেখল মিতা ছাতা মাথায় টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে। মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা জানতে চেয়ে উত্তর না পেয়ে, মনসা পাগলির কথা তুলল রবিন। জানতে চাইল, মিতা জানে কিনা ওর সব কথা। উঠোনে পেতে রাখা ইটের উপর পা ফেলে ফেলে মিতার দেখানো টর্চের আলোয় পথ করে করে ঘরে ঢুকল রবিন। লম্ফ জ্বেলে রবিনের জন্য ভাত বাড়তে শুরু করলে রবিন বলতে লাগল গল্পটা। একেবারে সেদিনের বিকেল মানে মনসা পাগলিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে এই আজকের রাত্রি পর্যন্ত। গল্পের শেষে আর সবার মতো মিতাও কিছু জিজ্ঞেস করবে বলে আশা করেছিল রবিন। এমনকি লম্ফের কাঁপতে থাকা আলোয় মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে সে অপেক্ষাও করল কয়েকটা মুহূর্ত। কিন্তু গল্পটি শেষ করার পরেও মিতা খুবই সহজ ভাবে, আর ভাত লাগবে কিনা জানতে চাওয়ায়, রবিন বুঝতে পারল, গল্পটি মিতার ভাল লাগেনি। বা, এটা তো ঠিক কোনও গল্পও নয়, বলা যেতে পারে ঘটনা, বলা যেতে পারে এর মুখ ওর মুখ থেকে গোটা ঘটনার অনেকটাই হয়ত মিতার জানা। বা রবিনের কথা ওর ঠিক বিশ্বাস হয়নি? ওর জানা গল্প তার মানে হয়তো অন্যরকম। না কি রবিনই বানিয়ে বলল কিছু। রবিন ফের আগাপাশতলা মনে করতে চাইল গল্পটাকে। কোথায়, মিথ্যেটা কোথায় বলল রবিন? এবার মরিয়া হয়ে বলে উঠল, বিশ্বাস হয়নি তোমার? ফিরে এসেছে, নিজের চোখে দেখলাম তো আজ। একেবারে ছায়ার ভেতরে ছায়া যেন ভূত, ওই আমার গাড়ির লাইটেই মুহূর্তের জন্যই, হাতে বাটি একটা যেন পেটই, জিরজিরে শরীর।
বাইরে আলো ঝলসে উঠল। তার মানে বাজ। ভয়ঙ্কর একটা শব্দের জন্য নিজেকে তৈরি করতে চাইল রবিন। হাত দিল দু’ কানে। কিন্তু না, খুব আলতো একটা আওয়াজ, হয়তো কোনও শব্দই নয় সেটা। সম্ভবত অনেক দূরে কোথাও উপর থেকে কিছু ধীরে মাটির দিকে— । বাইরে ব্যাঙ ডাকছে খুব। টানা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মাঠে জলের উপর মাথা তুলে এখন ব্যাঙ, শামুক, সাপ— সবাইই যেন পৃথিবীটাকে শেষবারের মতো দেখে নিতে চাইছে। মিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে রবিন ফের বলে উঠল, বিশ্বাস কর, দেখলাম তো আজ, ছেলেমেয়ে কীসের, ওই পেটে আসলে খিদে ছাড়া ছিলই না তো কিছু।