৬ই মে, ২০২১। শ্রীলঙ্কার সরকার সমস্ত রকম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানী বন্ধ করে দেয় রাতারাতি। ঠিক তার এক বছরের মাথায় দেশে অরাজক অবস্থা – সাধারণ নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিস অগ্নিমূল্য। তেল, খাবার বাড়ন্ত। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী - দুই ভাইয়ের সরকার টালমাটাল। প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা। দুয়ে দুয়ে চার করে, জৈব কৃষির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত ঝাড়ছেন অনেকে। কিন্তু সত্যিই কি শ্রীলঙ্কার ৮১ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এক বছরের জৈব কৃষির ‘ধাক্কা’য় পথে বসে গেল?
শ্রীলঙ্কার ভাঁড়ারে বিদেশী অর্থ এখন ২ বিলিয়ন ডলার। এদিকে ২০১৫ সাল নাগাদ বিদেশী ঋণ শোধ করতে হবে ৭ বিলিয়ন ডলার, এই পরিস্থিতিতে পৌঁছে যায় শ্রীলঙ্কা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় সম্বন্ধে নানা ভাবে সাবধানবাণী দেওয়া স্বত্বেও কেউ খুব একটা পাত্তা দেননি। এদিকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কোন ঘাটতি নেই। ট্যাক্সে ছাড় দিলেন এমন মাত্রায় যে ৩৩.৫% করদাতা করের আওতা থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভ্যাট কমে হল ৮%। কর্পোরেট ট্যাক্স এক ধাক্কায় কমিয়ে দিলে ৪%। ২০১০ থেকে ২০২০ – বিদেশী ঋণের পরিমাণ হল দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে এই ঋণ ছিল দেশের জিডিপির ৪২% । ২০২১ এ তা দাঁড়ায় ১১৯%। সরকারের খরচ চালানোর জন্য সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে দমাদ্দম টাকা ছাপাতে থাকল সরকার – ৬ এপ্রিল একদিনে ১১৯ বিলিয়ন শ্রীলঙ্কান টাকা ছাপা হয়। ধম্মের কল বাতাসে নড়ে – ২০২২এ এসে সব হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ল। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত এল কোভিড। দেশের পর্যটন, যা কিনা জিডিপির ১০% - কোভিডে তা বন্ধ। রাশিয়ায় রপ্তানি হত শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ চা। রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে আসত অধিকাংশ পর্যটক। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে সে গুড়েও বালি।
২০০৫ থেকে ভোটে জেতার জন্য সারে ঢালাও ভর্তুকি শুরু করে সরকার। সারের ভর্তুকির পিছনে খরচ হয় ৬০ বিলিয়ন শ্রীলঙ্কান টাকা। প্রতি বছর ৩০০ মিলিয়ন ডলারের রাসায়নিক সার আমদানী করে শ্রীলঙ্কা। এই আমদানী করা সারের সবটাই ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট আর মিউরেট অফ পটাশ - তাও আবার টেন্ডার ডেকে বাজার থেকে সব থেকে কেনা সবথেকে সস্তার সার। এই সারগুলি এমনিতেই প্রাচীন প্রযুক্তির – ফলে সবটাই একসঙ্গে মাটিতে মিশে যায়, গাছ চাইলে তার সবটাই নিতে পারে – কিন্তু গাছ তার প্রয়োজন অনুযায়ী নেয় অতি অল্পই – বাকিটা জলে, প্রকৃতিতে মেশে। ফলে কাজের থেকে অকাজই হয় বেশি। আধুনিক প্রযুক্তির সার, যা ধীরে ধীরে প্রয়োজন মত মাটিতে মেশে – সেই সার আমদানী হয়েছে অনেক কম, তার উপরে তাতে ভর্তুকিও নেই। সুতরাং হাতখোলা ভর্তুকিতে শুরু হয় যথেচ্ছ সস্তার সার ব্যবহার। সেই ব্যবহার বাড়তে বাড়তে হেক্টর পিছু ৩০০ কিলোতে দাঁড়ায়। তার উপরে সরকারী সহায়ক কর্মীর অভাবে এর প্রচারক ও নিয়ন্রক হরে দাঁড়ায় সার-বিষের ডিলাররা। ভর্তুকির যোগান দিতে গিয়ে সরকারের নাভিশ্বাস। সুতরাং জৈব চাষে সরতে চাওয়া যে আদৌ কোনও মতাদর্শগত সিদ্ধান্ত নয়, অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২২ মিলিয়ন লোকের ৬৫০০০ বর্গ কিলোমিটারেরে মাথাপিছু ৪০০০ ডলার জিডিপির একটা দেশ রাতারাতি ১০০% জৈব হয়ে উঠতে পারে কি? এ প্রসঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার কথা আসছে – কিন্তু মাথায় রাখুন এত সার ব্যাবহার করেও কিন্তু ২.২ বিলিয়ন ডলারের খাবার বাইরে থেকে কিনতে হয়। ৫ বছরের নীচে ২০% শিশু ঘোরতর অপুষ্ট।
এ সব ক্ষেত্রেই আমরা কিউবার উদাহরণ দিই। কিউবার ছিল দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি। দেশের শিক্ষা, বন্টন ব্যবস্থা সব কিছু নিয়ে আটঘাট বাঁধা, এবং রাশিয়ার পতনের পর জৈব কৃষিতে সরে যাওয়া – এই সব কিছুতেই সময় লেগেছে। মস্ত সাফল্য হল শহরাঞ্চলেও সবজি উৎপাদন। এই সবজির ব্যাপারে প্রায় স্বনির্ভর হওয়ায় দেশে অপুষ্টি নেই, মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতিও নেই। কিন্তু মূলত দানাশস্য, তেল ও দুধের ব্যাপারে ৭০~৮০% এখনও আমদানী করতে হয় কিউবাকেও। পটল ফলালাম আর পটল খেলাম – দেশের খাদ্য স্বনির্ভরতার বিষয়টা এত সহজও নয় আর এখন। অর্থনীতি, রাজনৈতিক অবস্থান – এই সব কিছু না ভাবলে তাতে পটল তোলার সম্ভাবনাই বেশি। যেমন শ্রীলঙ্কা ঘাসমারা গ্লাইফোসেট নিষিদ্ধ করায় আমেরিকা শ্রীলঙ্কার চা আমদানী করা বন্ধ করে দেয় – এক ধাক্কায় শ্রীলঙ্কার আয় কমে যায়!
দীর্ঘ সময় ধরে রাসায়নিক সারে চাষ হতে থাকলে মাটির গঠন বদলে যায়, মাটিতে গাছের খাবার যোগানোর জন্য দরকারি অনুজীব আর বেঁচে থাকে না। এদিকে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ফসল আসলে কেবলমাত্র সহজলভ্য রাসায়নিক সার পেলে ভালো ফসল ফলাতে পারে। জৈবসার ধীরে ধীরে মাটিতে মেশে – মাটির দোষ শুধরায়, মাটিকে আবার জীবন্ত করে তোলে – কিন্তু যথেষ্ট সময় পেলে। সুতরাং, আর সব কিছু ঠিকঠাক রেখে, ফসল না বদলে, মাটিকে না শুধরে, দুম করে কাল থেকে ইউরিয়া দেওয়া বন্ধ করে দিলে সংকটের মুখোমুখি হতে হবেই – সে কথা বলতে তো আর পণ্ডিত হতে হয় না, নিন্দুক হলেই চলে! ঠেকায় পড়ে পরিকল্পনাহীন মান্ধাতা আমলের জৈব চাষ – যেখানে শুধুমাত্র রাসায়ানিক উপকরণের পরিবর্তে জৈব উপকরণ দেওয়া হবে – এই খন্ডচিত্রটুকুই সার্বিকভাবে ভাবা হয়েছে সেখানে সাফল্য কম হবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা ল্যাজে-গোবরে হওয়ার জন্য শুধু চাষের ক্ষেতের গোবর দায়ী তা ভাবার জন্য উর্বর মস্তিষ্ক লাগে বৈকি!
কিন্তু চিন্তার কথা একটি। এবং ভাবনার কথাও একটি। চিন্তার কথা হল – শ্রীলঙ্কার রোগগুলি ভারতের শরীরেও বাসা বেঁধেছে। সারের দাম উর্ধ্বমুখী। নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র যে সাধারণের আওতার মধ্য একথাও আর বুক ঠুকে বলা যাচ্ছে না। আর ভাবনার কথা হল – আমরা জানি আমাদের খাদ্য উৎপাদন, জীবন যাপনকে প্রকৃতি বান্ধব করে তুলতেই হবে – আর কোন রাস্তা নেই। তার জন্য সার্বিকভাবে সঠিক পরিকল্পনা করে এখুনি বদল প্রয়োজন। চোখ বন্ধ রেখে প্রাকৃতিক চাষের সমালোচনা করলে তো আর প্রলয় থেকে দূরে থাকা যাবে না!