২০০০ সালের নভেম্বর মাসে মধ্যপ্রদেশ থেকে খোদাই করে ছত্তিশগড়কে আলাদা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় আদিবাসীরা চাইছিলেন তাঁদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এই দীর্ঘ দাবী আদায়ের লড়াইয়ে তারা তুলে ধরেছিলেন মধ্যপ্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই পাহাড়-নদী-জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চল শিক্ষা স্বাস্থ্য সম্পদের অধিকারে কতটা পিছিয়ে। সেখানে কি তথাকথিত উন্নয়নের আশাও ছিল? তাঁরা কি আশার সঙ্গে সঙ্গে এর গোলকধাঁধারও আশঙ্কা করেছিলেন – ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ’-এর গোলকধাঁধার? নাকি তাঁদের স্বপ্নে ছিল এক ছত্তিশগড় – আদিবাসিন্দারা সেখানে দেখভাল করছেন এই সব সম্পদের? কিন্তু আর একদল স্বপ্নেও প্রকট হয়ে ছিল ভূপৃষ্ঠের সম্পদের নীচে কয়লা আর নানা খনিজ পদার্থ।
ছত্তিশগড় কয়লা, লোহা, বক্সাইট, চূণাপাথর আরও নানা খনিজ পদার্থে ভরপুর। দেশের ১৫% কয়লা তোলা হয় এই রাজ্য থেকেই আর তা দিয়ে দেশের ইস্পাত শিল্প চলে। কিন্তু এই সবই রয়েছে জঙ্গলের নীচে, আর সেই জঙ্গলে রয়েছেন আদি বাসিন্দারা – বাস্তার, দান্তেওয়াড়া আর সুকমায়। জঙ্গলের সঙ্গে যাদের জীবন, জীবিকা, খাবার, প্রতিদিনের বেঁচে থাকা ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে। এই সমাপতনের ফলে ২০০৫ সাল থেকে ১২ লক্ষ আদিবাসীকে উছেদ করা হয়েছে (CSE, 2022)। মানুষ তো আসলে শুধু ওই ভূগোলটুকু থেকে থেকে উচ্ছেদ হয় না, হয় তার ইতিহাস, জীবিকা, অভিজ্ঞতার সম্পর্ক থেকেও। পুনর্বাসন কেবল তার বাহ্যিক অবস্থানকে এক জায়গা থেকে তুলে একজায়গায় নিয়ে যায় – সঠিল অর্থে বিচ্ছেদ পরবর্তী পুনর্বাসন বলে কিছু হয় না, কম্পেন্সেশন বলে কিছু হয় না। যাই হোক, শেষ দশকে প্রায় ১০ শতাংশ জঙ্গল কমেছে এই সব খনির আওতায় এসে (Forest Survey of India Data - 2013-2023)। হাসদেও-এর জঙ্গলে আদানীর খনি নিয়ে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই! সেওনাথ, কুরকুট, শবরী, খারুন,মান্ড – এইসব নদীর অংশ বিক্রি হয়ে গেছে কোনও না কোনও কোম্পানীর কাছে এখনই। সাউথ ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেডের কয়লা খনি, জল বিদ্যুৎ প্রকল্প, ইস্পাতের জন্য কাঁচা লোহা তোলা - এই সব হয়েও উন্নয়নের থালায় সিকি পয়সাও ভিক্ষে পড়েনি। ২০২২-২৩-এ ৩২০০০ কোটি টাকার খনিজ পদার্থের ব্যবসা হলেও রাজ্যের ৪২% মানুষ এখনও দারিদ্র্যরেখার নীচে। আলাদা রাজ্য হয়েও তাহলে এইই হল শেষমেশ?
গত পঁচিশ তিরিশ বছর ধরে – মানে ছত্তিশগড়ের জন্মলগ্ন থেকেই অশান্তি ঘনিয়ে আছে। উগ্রবামপন্থীরা, মাওবাদীরা রাজ্যের জন্মের পরেও স্থানীয় আদিবাসীদের অধিকারের লড়াইয়ে মদত দিয়ে আসছেন। লড়াই বলতে – এই জীবন-জীবিকার বিনিময়ে এই সম্পদ লুঠ রোখার লড়াই। সম্পদের অধিকারের লড়াই। সরকারের তরফ থেকে পাওয়া সুযোগ সুবিধার অধিকারের লড়াই। ২০১৫ তকে ২০২৩ এর মধ্যে অন্তত ২০০ হিংসামূলক ঘটনা ঘটেছে (South Asia Terrorism Portal) যেগুলোর সবই খনি এলাকার ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। বছরে ১৫-২০ জন করে প্যারামিলিটারি ফোর্সের লোকজনো মারা যাচ্ছেন – অথচ মাঝখানে দিব্যি টিকে আছে সরকারি মদতপুষ্ট কর্পোরেট । ২০১০ সালে ৭৬জন সিআরপিএফ মারা যান দান্তেওয়াড়ায়। পুনর্বাসন, অধিকারের এই লড়াইকে অগ্রাহ্য করে সম্পদ দখলের নির্লজ্জ গাজোয়ারি চলেছে তো চলেছেই।
মাওবাদী-স্থানীয় আদিবাসীর এই লড়াইয়ে বেনোজল একদম ঢোকেনি একথা বলাও ঠিক হবে না। কিছু আত্মসমর্পণকারী এসেছেন পুলিশে, এসে তারা সরকারের হয়ে ও সরকারের বাইরেও পুলিশসুলভ শোষক ও সুবিধাভোগীর আচরণের থেকে আলাদা থাকছে না এ কথাও দান্তেওয়াড়ায় শোনা যায়। সব মিলিয়ে শাঁখের করাতের তলায় পড়ে আছে মানুষজন-গাছপালা-বনজঙ্গল।
সংবিধান মতে খনিজ পদার্থ আর জলের অধিকার নিয়ে কথা বলার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। তার মানে ছত্তিশগড় সরকার একদিকে স্থানীয় সম্পদ রক্ষার ব্যাপারে দায়বদ্ধ, অন্যদিকে রাজ্যে তথাকথিত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ’-এর ব্যাপারেও দায়বদ্ধ। কেবল মানুষ ও প্রকৃতিকে ছাপিয়ে দ্বিতীয়টির উপরেই কেন জানি না তাদের অতি উৎসাহ – তা সে যে রঙের সরকারি হোক না কেন। ‘কেন জানি না’ বলা অবশ্য ঠিক হল না – আসলে ট্যাক্স আসে, হয়ত ঘুষও আসে রাজনৈতিক দলের পকেটে। এই দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সাধনে সমস্ত প্রতিরোধকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে খুল্লম খুল্লা সরকারি হুমকি দেওয়া হয়েছে – তার একটা প্রধান লক্ষ্য যে মাওবাদীরা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কর্পোরেটরা সরকারের কাছ থেকে মাইনিং করার লিজ পায় পাব্লিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপের নামে – যেখানে চতুর্থ পি অর্থাৎ পিউপ্ল নেই। তাদের জন্য কাজ কি এল? তাদের অবস্থার কি বদল হল একটু? এসব ভাবার আগেই লিখে দেওয়া হল উচ্ছেদ, জঙ্গল হাসিল আর জৈববৈচিত্রের মৃত্যু পরোয়ানা। প্রশ্ন হল - সিদ্ধান্ত গ্রহণ কী করে হল? কেন এই সব সিদ্ধান্তের সময় মানুষের সঙ্গে কথা বলা হল না? কী করে পরিবেশের উপর প্রভাবের ছাড়পত্র পেয়ে গেল এই সব প্রকল্প? পরিবেশের ক্ষতি না করে কি তাহলে কাজ সৃষ্টি করা যায় না? একদিকে যখন কার্বনহীন সংকল্পের কথা ঢাক পিটিয়ে বলে আসছেন দেশের মাথা – তখন নতুন করে খনি, স্পঞ্জ আয়রন, নদী দূষণ হছে কেন? এ সব প্রশ্ন তলায় তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য বোবা গাছ, নদীর প্রশ্নের কেই বা উত্তর দিয়েছে? আর সশস্ত্র সওয়াল-জবাবেরই কি কোনও শেষ আছে?