পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

'লালপার্টি'র শতবর্ষঃ ছকের বাইরের কথা

  • 28 February, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 465 view(s)
  • লিখেছেন : ডঃ আবু সঈদ আহমেদ
সহমনের সম্পাদকমন্ডলী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর : ফিরে দেখা লেখাটি নিয়ে বিতর্ক চেয়েছিল, সেই কারণেই সুশোভন মুখোপাধ্যায়ের লেখাটির একটি সমালোচনা প্রকাশ করা হয়েছিল। আজ আরও একটি লেখা প্রকাশ করা হলো। অন্য বিরুদ্ধ মত এলেও সহমন, সেই লেখা প্রকাশ করবে। আগের লেখাগুলোর সূত্র এই লেখার শেষে থাকলো।

ভারতীয় উপমহাদেশে শতবর্ষেরও প্রাচীন কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পার্টির বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক জ্ঞান আমার বিশেষ নেই, তবে অতি-বাম থেকে মধ্য-বাম আন্দোলন, রাজনীতি ও প্রশাসনের পরিসরে স্বনামধন্য হয়েছেন, এরকম অনেক মানুষের সাথেই আমার সম্পর্ক পারিবারিক আত্মীয়তার। তার বাইরেও বহু কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভারত প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক সীমানার বাইরে,তাঁদের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় এবং মূলত কমিউনিস্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্বাধীন একটি আন্দোলনের সাথে আমার নিজের সম্পৃক্ত হওয়ার অধিকারটুকুর ভিত্তিতে সহমনের সম্পাদকমন্ডলীর তরফ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর : ফিরে দেখা লেখাটি নিয়ে বিতর্ক আহবান করা হয়েছিল সেই আহবানে সাড়া দিয়ে এই লেখা। এই বিষয় নিয়ে আগেও এখানে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর বক্তব্য নিয়ে বিস্তারে যাচ্ছিনা, আমি মূলত যেকথাগুলো বলা হয়না সেটা নিয়েই বলার চেষ্টা করছি।
রাজনীতি তৈরি হয় একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কিছু মানুষের সম্মিলিত হওয়া থেকে। তাঁদের সমাজ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে আকাঙ্খা থাকে, ভাবনা থাকে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব বিচারবিশ্লেষণ থাকে। সেগুলো উপস্থিত সকল মানুষদের সব সময় একজায়গায় এসে মেলেনা। সেগুলো নিয়ে মতভেদ হয়। এরফলে একটা রাজনৈতিক দল ভেঙে যায়। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এটা বহুবার হয়েছে।
সেই মানুষগুলোর রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও একটা পরিচয় থাকে। তার সাথে থাকে একজন বা একাধিক ব্যক্তির স্বার্থ। সেই স্বার্থ একজনের ব্যক্তিগত হতে পারে। কয়েকজনের মিলিত স্বার্থ হতে পারে। আবার সার্বিকভাবে মনুষ্যপ্রজাতির অনেকগুলো সদস্যের মিলিতভাবে হতে পারে। এবার একজায়গায় কয়েকজন মিলিত হলে সবার ব্যক্তিগত স্বার্থ আর গোষ্ঠীস্বার্থ পরস্পরের সাথে সবসময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে এমনটা হয় না।
তাই যখনই,
"স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত,"
সেখানে দেখা গেছে,
"লোভে লোভে ঘটেছে সংগ্রাম--"
আর এই কোটারি/লবি/গোষ্ঠী/ব্যক্তিদের মধ্যে সংগ্রামে,
"প্রলয়মন্থনক্ষোভে ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি পঙ্কশয্যা হতে।"
আর আসল ইতিহাসটা ঠিক লুকিয়ে থাকে এখানেই। সেই ইতিহাস, তত্ত্বকথা ও নিজের রাজনৈতিক স্বার্থের প্রচারপত্রের (তা সে সরকারী পাঠক্রম বা গণমাধ্যমে প্রচার যাই হোক না কেন) বাইরের ইতিহাস। কোন ব্যক্তির সাথে কোন ব্যক্তির, কোন গোষ্ঠীর সাথে কোন গোষ্ঠীর স্বার্থে সংঘাতে 'ভদ্রবেশী বর্বরতা'য় রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি চিরকালের জন্য পালটে গেল সেই ইতিহাস। সেখানে অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলোর কি ভূমিকা ছিল সেই ইতিহাস। আর এই ইতিহাসেই লুকিয়ে থাকে সমস্যার চাবিকাঠি। সাধারণত স্বার্থের সংঘাত ঢাকতে কোন পক্ষ কি রেটোরিক নামিয়েছিল সেটা নিয়ে ব্যাপক  আলোচনা হয়। কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কে কোন অবস্থান নিয়েছিল সেসবও চুলচেরা বিশ্লেষণে উঠে আসে। কিন্তু ভেতরের কথা থেকে যায় গোপনে। আর যেটুকু আসে তাতে ব্যাপকভাবে থাকে ব্যক্তি আক্রমণ। তার অনেকগুলো কারণ থাকে। আকছারই হয়ে থাকে যে আজকের নিন্দিত রাজনীতিক হয়ে যান ভবিষ্যতের অভিনন্দিত দেশনায়ক। এককালের প্রতিদ্বন্দ্বী সুরেন্দ্রনাথ-চিত্তরঞ্জন কিম্বা প্যাটেল-নেতাজীর নাম এখন এক নিশ্বাসেই উচ্চারিত হয়। সেজন্য সব কথা প্রকাশ্যে বলা যায় না। তাই রাজনৈতিক তর্কচর্চা আর বিচার-বিশ্লেষণে মতাদর্শ ও তত্ত্বকথা নিয়ে অনেক কথাই হয়ে যায়, বাস্তব থেকে যায় অনেক দূরে। আর বাস্তবটা যাতে দূরে থাকে সেটা নিজেদের প্রয়োজনেই নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সেরকমই 'বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ', নকশালবাড়ি নিয়ে রোমান্টিসিজম চলে। রোমান্টিসিজমের কারবারে তরুণ প্রাণের সওদা চলে কিন্তু এই 'নকশাল' শব্দটি "কোন ভাষার? অর্থ কি? এই জায়গাতেই বা কেন এলো?" ইত্যাদি সমাজনৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দূরে থাকুক, "শিলিগুড়ি গ্রুপ" ও খাদ্য আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে আশাভঙ্গ হওয়া অন্যান্য গোষ্ঠির কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা হয়ই না। তাই মূলধারা আলোচনায় থাকেন কানু সান্যাল, চারু মজুমদার, ভবিষ্যতের তৃণমূল প্রার্থী 'কাকা', সত্তর দশক হয়ে যায় এনাদেরকে অনুসরণ করা মেধাবী ব্রতী-সমুদ্রদের। আর জঙ্গল সাঁওতাল থেকে যান হাঁড়িয়া মহুয়ার আঁধারে ডুবে। মাও সে তুংএর আদর্শে বিশ্বাসী জনযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া গেরিলা-নেত্রী কেন স্থানীয়দের কাছে বনপার্টির দিদি হয়ে যান, এহেন প্রশ্নের কথা মাথাতেও আসেনা। নকশালবাড়ির নিহত দারোগা সোনম (নাকি সুনাম?) ওয়াংদির শ্রেণীচরিত্র আলোচনা 'দূর অস্ত'।
এরপরেও আরও একটি বিষয় কমিউনিস্ট পরিমন্ডলে অচর্চিত থেকে যায়। কমিউনিস্ট মতবাদ যেবিষয়গুলোর বিরোধিতা করে তার মধ্যে একটা বড় ব্যাপার হলো পরিচয়ের রাজনীতি। কিন্তু কলকাতা বন্দরে যে ভিনরাজ্য থেকে আসা যে মজুর ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য আর বাংলার দুরের কোন জেলার দুরতর গ্রামের কোন প্রান্তিক চাষীর শ্রেণীস্বার্থের সংঘাতকে যতই অস্বীকার করা হোক বিশশতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকের রাজনীতিতে ফজলুল হক বনাম সোহরাওয়ার্দীর দ্বৈরথ এই বাস্তবতাকেই প্রমাণ করে। সীমিত ভোটাধিকারের যুগে কলকাতাভিত্তিক অবাঙালি মজুর অধ্যুষিত ট্রেড ইউনিয়ন দখলে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী গ্রামবাংলার অবিসংবাদিত নেতা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে নামেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে এই শহুরে অবাঙালি বনাম গ্রামের বাঙালির দ্বন্দ্বই ঘটিয়ে ছিল আদমজী মিলের গণহত্যা। তার পাশাপাশি রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের জাতপাত সমস্যা। যার তাত্ত্বিক আলোচনা অনেক হয়েছে। বাস্তব প্রয়োগ কিছু কিছু হয়েছে। কিন্তু বামপন্থী নেতৃত্বের সর্বোচ্চ অলিন্দগুলোতে এখনো এই পিছড়ে বর্গের উপস্থিতি খুবই কম। তেমনই ভারতীয় পুঁজির প্রাদেশিক চরিত্রও সেভাবে বিশ্লেষিত হয়নি কমিউনিস্ট মূলধারার চর্চাগুলোতে। কোনো রাজ্যের নিজের মাটিতে গড়ে ওঠা পুঁজি আর বাইরে থেকে এসে বিনিয়োগ করে ব্যবসা বাড়িয়ে যে পুঁজি বেড়ে ওঠে তার জন্য যে কর্মী নিয়োগ, পুনর্বিনিয়োগ ইত্যাদি জায়গায় যে ফারাকটা দেখা যায় সেই আলোচনা অস্বস্তিকর বিধায় আর হয়ে ওঠে না।


এই সময়গুলোতে হকসাহেবের কৃষক প্রজা পার্টিকে দুর্বল করতে জমিদাররা কমিউনিস্টদের কঠোরতর রাজনীতিকে মদত দিতেন, এরকম তথ্য আবুল মনসুর আহমেদের লেখায় উঠে এসেছে। অনেক কমিউনিস্ট নেতাই এমন পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন যেগুলো তাঁদের রাজনীতি বিচারে শ্রেণীশত্রু। স্বাভাবিকভাবেই কোনও কায়েমী স্বার্থই চাইবে না আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন কোন দিকেই যাক যা সেই কায়েমী স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সেজন্য উপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ পুলিশ স্বদেশী আন্দোলনকে দুর্বল করতে অনেক ধরনের পন্থা নিয়েছিল। একইরকমভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী পুঁজি আর শাসকপক্ষও (ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধীপক্ষ) যে নিষ্ক্রীয় ছিল না বা আজও নেই সেটা বলে দিতে হয় না। নিজের যা আছে সেটা কেউই হারাতে চায় না। কখনো অতিবিপ্লবী বা কখনো আপসকামী মধ্যপন্থী সব ধরনের বয়ানবাজিকে সামনে আনা হয়েছে। কখনো কঠোর দমননীতি নেওয়া হয়েছে। এই দমননীতির সামনে মানুষের সহ্যশক্তি একসময় ভেঙে যায়, নিজের ওপর অত্যাচার সয়ে নিয়েও নিজের প্রিয়জনের ওপর অত্যাচার দেখে ভেঙে পড়েন অনেকেই। কেউ ব্ল্যাকমেলিং এর শিকার হোন, কেউ নিজের অহংবোধের। স্থিতাবস্থর সুবিধাভোগীরা এইসব দুর্বলতার বিশেষভাবে চর্চা করেন এবং সেগুলো সময়মতো চাণক্য-মেকিয়াভেলীর পন্থা মেনে প্রয়োগও করেন। বাজারে নামানো হয়েছে মানুষের কাছে সহজবোধ্য-তর প্রপাগান্ডাকে যার জবাব কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কাছে ছিল না। যেখানে আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ইতিহাসের চরিত্রকে দেবতা কিম্বা অসুর বানানো হয় সেখানে কারও করা ভিন্ন আঙ্গিকের মূল্যায়নও তীব্র বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যেরকমটা যাঁর উদ্ধৃতি লেখার শুরুতে ব্যবহার করেছিলাম তাঁকে 'বুর্জোয়া কবি' বলা নিয়ে জলঘোলা অনেক হয়, কিন্তু কে কোন পরিস্থিতিতে কোথায় এই কথা বলেছিলেন সেসব প্রায় উহ্যই থেকে যায়। এত কিছুর ফলাফল আজকে ভারতের রাজনীতিতে প্রায় প্রান্তিক বিন্দুতে কমিউনিস্টরা।
আমার এই কথাগুলোর অর্থ এই নয় যাঁরা সাংসদীয় কিম্বা সশস্ত্র বামপন্থা এই আদর্শগুলোকে সত্যি ভেবে রাজনীতি করে গেছেন তাঁদের সবাইকে একই নিক্তিতে ওজন করছি। শ্রেণী সংগ্রাম, স্বরাজ প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান আন্দোলন কিম্বা রামমন্দির বা অন্য রাজনীতি সেগুলো ঠিক হোক বা ভুল হোক, সেগুলোর আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া লোকের সংখ্যা যতই হোক এই আদর্শকে সাচ্চা ভেবে জানমাল কুরবান করে দেওয়া মানুষের সংখ্যাও তো কম নয়। কেউ কেউ ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে বসেও যেরকম সদাসিধা জীবনযাপন করেছেন তা আজকের যুগে অকল্পনীয়। সব ক্ষেত্রেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণ হীনস্বার্থ বা অন্তর্ঘাত নয়, অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি, পরিস্থিতির ভুল বিশ্লেষণ বা বিপক্ষের উন্নততর রণকৌশল থাকে। একাধিক দল বা গোষ্ঠী নিজেদের ভেদাভেদ মিটিয়ে সময়ের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এরকম উদাহরণও বিরল নয়। এরকমভাবেই হয়তো ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে একদা বামদুর্গ বাংলার মাটিতে আজকে আইনসভাগুলোতে প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে থাকা সাংসদীয় বামপন্থী দলগুলো। হয়তো আবার অঞ্চল-লিঙ্গ-ভাষা-ধর্ম-আর্থিক ব্যবধানকে সরিয়ে পথ কাঁপাবে দিনবদলের স্বপ্ন দেখা চোখগুলো।

শতবর্ষ পার হওয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কেন আজও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারল না

নোটন কর

সমালোচনায়: তথাকথিত লাল দল ও নানা 'মার্কসবাদী' লেখক

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর : ফিরে দেখা

সুশোভন মুখোপাধ্যায়

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment