নীলার্কও নাছোড়বান্দা। আমাকেই এই কাজটায় পাঠাবে। কোথাকার কোন বিদেশি কোম্পানি এসে কলকাতার ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট ছানবিন করে কী সমস্ত রিপোর্ট লিখবে। আমার কাজ দোভাষীর। কারখানার শ্রমিকদের কাছে পাতি বাংলায় জেনে নিতে হবে কী তাদের অভাব, অভিযোগ, প্রাপ্তি আর চাহিদা। তারপর সেসব কাহিনিমালা ইংরেজিতে সাঁটিয়ে দাও বহুজাতিকের মগজে। এই এক শুক্রবারের ভোর থেকে রাত্তির গড়ানো কাজে শ্রমিক-মালিক-বহুজাতিক কার কী উপকার হবে জানি না, তবে সারাদিনের ট্রান্সলেশন কর্মে আমার পকেটে বেশ কিছু ডলার ঢুকবে। মন্দ কি? এই বাজারে মাসমাইনেতে আর ক’বেলা নিশ্চিন্তে কাটে? এবেলা গ্যাসের দাম বাড়ল তো, ওবেলা উটকো বিয়ের নেমন্তন্নে ফস করে গলে গেল নাহ’ক শ’পাঁচেক টাকা। বাঁধা বাজেটের বাইরে প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে এক আশ্চর্য চু-কিতকিত খেলা। যতই খবরের কাগজ দেখে সঞ্চয়ী হবার আশায় সাদা খামে করে মাসের খরচ থরে থরে গুছিয়ে রাখি, ততই অনেকগুলো হাঁ-করা গহ্বর কোথা থেকে আশেপাশে এসে দাঁড়ায়।
নাঃ। আর ভাবার মানে হয় না। নীলার্ককে ছোট্ট মেসেজ-- ১৫ তারিখ তো? শুক্রবার পড়েছে। ঠিক আছে রে। পারব।
নীলার্কর বস রাজু। রাজু হুল্লার। ওকে মেল করে দিতে হবে। আমি রাজি। ওই শুক্রবার সকালেই দেখা হচ্ছে তাহলে।
মেল করতে করতেই পাশের টেবিলে তাকাই একবার। সুশীলবাবু। আমার সিনিয়র সহকর্মী। একমনে কুটি কুটি করে লিখে চলেছেন। সামনের কম্পিউটার স্ক্রিনে অবশ্য কোনও একটা সরকারি সাইট। ‘নির্মল বাংলা’ না ‘স্বচ্ছ ভারত’ কে জানে! সেখান থেকেই লিখছেন বোধহয়।
-- ‘পরের সপ্তাহে একদিন ছুটি নেব ভাবছি’।
হালকা করে কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিই। সুশীলবাবুর কানে ঢুকবেই। যত ব্যস্ততাই থাক, আমার কাজকর্ম ফোনাফুনি কি বলছি কাকে বলছি’র দিকে ওঁর একটা কান আর চোখ রাখাই থাকে। আমি নিশ্চিত, এতক্ষণ নীলার্কর বার বার ফোনে আমার এপ্রান্তের উত্তরে উনি ইতিমধ্যেই কিছু একটা আঁচ করেছেন।
-- ‘ইন্টারভিউ নাকি ভায়া? চাকরি ছাড়বে?’
গান্ডু। মনে মনেই বলি। মুখে এক চিলতে হাসি টাঙানোই থাকে।
-- ‘কি যে বলেন দাদা! এই বয়সে আবার...’
-- ‘হেঃ। বয়সের কথা তুলোনা। চারের কোঠায় দৌড়চ্ছ, এই তো বয়স’।
-- ‘চাকরি ছাড়ার ইচ্ছেটা বাড়াবাড়ি সুশীলদা’।
মুখে বলি বটে। কিন্তু গত চার বছর এই বেসরকারি মালিকানার আপিসে একটি পয়সা মাইনে বাড়েনি। ইচ্ছে তো হয় পালাই কোথাও, এই মাইনেতে হাঁ-করা সংসার গিলতে আসে। ধুস। এইভাবে কদ্দিন চলে? কিন্তু সুশীলবাবুকে এইসব প্রাণের কথা বলে ফেলাটা চাপের। মুখ ফসকে বেরোনো যে কোনও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী শব্দ চমৎকার তেল-মশলায় সাঁতলে পরিবেশন করেন সুশীলবাবু। অবশ্যই ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কানের পাশে। বেশ কয়েকবার কেস খাওয়ার পর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এই শালা চুপচাপ চুলকে এসেছে। প্রচুর গাত্রদাহ ওর। ওর পাশেই বসি, বছর দশেকের ছোট হয়েও হাজার চারেক টাকা বেশি মাইনে পাই, এইটুকুতেই ওর চিড়বিড় করে। স্বভাব।
কাজের ভান করি। আলোচনাটাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না।
কিন্তু কিছু একটা আঁচ করে সুশীলবাবু আজ-কাল-পরশুর মধ্যেই বড়কর্তার কান ভাঙাবেন। সেই পথ বন্ধ করার উপায় আমার জানা নেই। চুপচাপ কাজ গোছাই। শুক্রবার কাউকে কিছু না বলে ডুব দেব।
...........................
বৃহস্পতিবার রাত থেকেই গোছানো ছিল। ছোড়দা’র কাছ থেকে কালো জ্যাকেটটা ধার নিয়ে এসেছি। সাদা শার্ট পরাই ভাল। আর জিনস। রাজু অপেক্ষা করবে পার্ক স্ট্রিটে। ওর সঙ্গে দেখা করে প্রথমে ব্রেকফাস্ট। তারপর সোজা হায়াত রিজেন্সি। জুডিথ আর মার্ক অপেক্ষা করবে ওখানে। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে এই দুজন। তারা কলকাতার একটি ফ্যাক্টরিতে ঘুরে ঘুরে দেখতে চায় শ্রমিকদের অবস্থা।
রাজুর সঙ্গে টেলিফোনে এই অবধিই কথা হয়েছিল।
শুক্রবার সকাল আটটার একটু আগেই পার্ক স্ট্রিটের ঝাঁ চকচকে হোটেলে বসে ব্ল্যাক কফি আর স্যান্ডউইচ খেতে খেতে বাকিটা বুঝলাম। বিশ্ববিখ্যাত এক অস্ট্রেলিয়ান সংস্থা তাদের কাছে তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে আসা ফেব্রিক, চামড়ার ব্যাগের উৎপাদকের কাছে সরাসরি পৌঁছতে চায়। চীন, ভারত আর বাংলাদেশ তাদের গন্তব্য। আপাতত একদিন আগেই সুরাটে তুলোচাষীদের অবস্থা দেখে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এসেছে। এবার কলকাতার তপসিয়ায় একটি চামড়ার ব্যাগ তৈরির কারখানায় ঢুকবে। সারাদিন কাটিয়ে আজ রাতের ফ্লাইটে সোজা বাংলাদেশ।
‘কি কি জানতে চাইছে ওরা?’
রাজুকে জিগ্যেস করি।
টাকমাথা, সামান্য স্ফীত মধ্যপ্রদেশ, চশমার আড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত চোখে হেসে মুম্বই থেকে আসা রাজু বলে, ‘নাথিং সিরিয়াস। তুমি কারখানার কর্মীদের একটু সাধারণ প্রশ্নই জিগ্যেস কোরো। তারা অবশ্য কতটা ফ্রিলি জবাব দিতে পারবে, বলা মুশকিল। মালিকপক্ষের কেউ না কেউ তো পাশে থাকবেই’।
শুনতে শুনতে মাথার মধ্যে কোথাও কুটকুট করে কামড়ায়, কী জিগ্যেস করব? কী জিগ্যেস করার কাজ আমার? যদি আমার প্রশ্ন আর ওদের দেওয়া উত্তর মনপসন্দ না হয়? যদি ওরা যা বলতে চায়, তা’ বলতে না পারে, আমি কি বানিয়ে বানিয়ে উত্তর দেব?
রাজুর সঙ্গে হায়াত রিজেন্সিতে যাবার পথেই পারিশ্রমিকের কথা তুলব ভাবি। নীলার্ক বারবার বলে দিয়েছিল আগে থেকেই জেনে নিতে। ওরা ক্যাশ পেমেন্ট করবে, না পরে অনলাইনে দেবে। চুক্তি অনুযায়ী আজ সারাদিন ইংরেজি-বাংলা দুটি ভাষার সামান্য দক্ষতা দেখিয়ে বেশ মোটা অংকের টাকা পাব জেনে এমনিতেই গরমে আছি, বসের রাগী মুখটাও ঝাপসা। রাজুও ফুরফুরে মেজাজে। ও হয়তো আমার চেয়েও বেশি খিঁচে নেবে। জিগ্যেস করতে গিয়ে আটকাল। থাক গে। যদি আদেখলামো ভাবে।
হায়াত রিজেন্সির মতো পাঁচতারাকে আমি এতকাল বাইরে থেকেই দেখেছি। বাসের জানালা দিয়ে। এই প্রথম অস্বস্তি গোপন করে ভিতরে ঢোকা।
রেস্তোরাঁতেই জুডিথ আর মার্কের সঙ্গে আলাপ। ছিপছিপে, ছটফটে দুজনেই। রাজুর কোম্পানি ভারতবর্ষে ওদের পার্টনার। সুরাটের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রচুর কথা বলছিল ওরা। আমি চুপচাপ। খোলা রেস্তোরা। চারপাশে প্রচুর লোভনীয় খাবার। সুস্বাদু। চমৎকার গন্ধ। বড় গোল টেবিলে আমার ঠিক উলটোদিকে জুডিথ। ল্যাপটপ খুলে রেখেছে সামনে। বাঁহাতে একটা জাম্বো সাইজের বার্গার নিয়ে কামড় বসায়। মার্ক কথা বলে মূলত সুরাটের সেই কৃষকদের নিয়ে। মাঠে ঘুরেছে ওরা বহুক্ষণ। ফ্যাক্টরিতে গেছে। যে ফ্যাক্টরিতে জামা-কাপড়ের সুতো বোনা হয়, যে মিলের মধ্যে তৈরি হচ্ছে কাপড়ের থান। ফ্যাব্রিক। নানা ধরনের। সেই ড্রেস মেটিরিয়াল থেকে ব্র্যান্ডেড জামা-কাপড়। সরাসরি সেসব এক্সপোর্ট হয় অস্ট্রেলিয়া, ইয়োরোপ, আমেরিকায়। ওদের সবার সঙ্গে কথা বলে, ছবি তুলে এরা বেশ উত্তেজিত মনে হল।
জুডিথ ওর জায়গা থেকে উঠে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে। ল্যাপটপে অসংখ্য ছবি।
‘ইউ প্লিজ গো থ্রু দিজ ফোটোগ্রাফস’।
অনেক ছবি। চাষের ক্ষেতে হাসিমুখে দেহাতি মেয়ে। গাছের পাশে, আলপথে দাঁড়ানো। পিছনে নীল আকাশ। রুক্ষ জমি। ছেঁড়া কাপড়। ফাটা গাল। শুকনো চেহারায় জৌলুস নেই, অভাবের ছাপ। মন দিয়ে দেখি। গম্ভীরমুখে দেখার ভান করি। আমার দেশের মাটিকে আমি আর নতুন করে কী দেখব। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার কী করণীয় থাকতে পারে?
জুডিথ আমার চোখের প্রশ্ন বুঝতে পারে। বলে, ‘আজ আমরা একটা চামড়ার ফ্যাক্টরিতে যাব। নামী কোম্পানি। ওরা ব্যাগ বানায়। এক্সপোর্ট করে আমাদের। আমরা কথা বলব ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে। মূলত বিজনেস পলিসি নিয়ে। তুমি ওয়ার্কারদের সঙ্গে কথা বলবে। কোথা থেকে আসে ওরা? কত মজুরি পায়? যা পায়, তাতে কি ওদের চলে?’
‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন জানতে চাইছ না?’
হঠাৎই মনে হয় প্রশ্নটা। দুম করে বলে ফেলি।
জুডিথ স্মার্টলি জবাব দেয়। ‘ডেফিনিটলি। আমরা এথিকস নিয়ে ভাবছি। এগুলো তো থাকবেই। বাট বি ভেরি কেয়ারফুল, দে ওন্ট সে এনিথিং এগেন্সট দেয়ার অথরিটি’।
আমার এত খোঁজে দরকারটাই বা কি? আমি আদার ব্যাপারী। সারাদিন ঘোরাফেরা, খাওয়াদাওয়া। দিনের শেষে ক্যাশ গুনে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেওয়া। মোদ্দা যেটুকু বুঝলাম, এ এক চরম তামাশা। ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে শ্রমিকেরা একটি কথাও বলবে না। অথচ তাদের কথা জেনে আসতে হবে। তাই নিয়ে ছবি তুলে রিপোর্ট লিখে কোথায় সাঁটানো হবে, কে জানে!
জুডিথ ব্যাগ গুছিয়ে নেয় চটপট। জুডিথ আর আমি একটি গাড়িতে। মার্ক, রাজু আর একজন ফোটোগ্রাফার অন্য গাড়িতে। তপসিয়ার লেদার ফ্যাক্টরির দিকে যাওয়া।
বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ফ্যাক্টরির ভেতরে এতসব কর্মকান্ড চলছে। মালিকপক্ষ গেট থেকেই বেশ খাতির-যত্ন করে ওপরে নিয়ে যান। চমৎকার চেম্বার। থরে থরে ব্যাগ সাজানো। অপূর্ব সমস্ত ব্যাগ। আকাশছোঁয়া দাম নির্ঘাত। দাম জিগ্যেস করার মানেই হয় না। এইসব ব্যাগ এই দেশে থাকেও না। এখান থেকেই বাক্সবন্দি হয়ে সিধে বিদেশে পাড়ি। এত কাছ থেকে ব্যাগের ফ্যাক্টরিও দেখিনি আগে। প্রায় পাঁচ-ছ’তলা বাড়ি। বিরাট। ছড়ানো-ছিটোনো বিশাল কর্মযজ্ঞ। মার্ক আর রাজু কনফারেন্স রুমে মালিকের সঙ্গে মিটিঙে বসে। জুডিথ আমাকে ইশারা করে, চলো। জুডিথ, ফোটোগ্রাফার একটি অবাঙালি ছেলে, নাম জানি না তার, আর সঙ্গে আমি।
আরও দুটি ছেলে সঙ্গে আসে। কোয়ালিটি কন্ট্রোল দেখে একজন। সে সুমিত। আর একজন সেফটি ম্যানেজার। গণেশ। কর্মীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তার দায়িত্বে।
একটার পর একটা ঘর। স্তূপ করে রাখা বেল্ট, ব্যাগের হাতল। কোনও ঘরে শুধু ব্যাগের লাইনিং সেলাই হচ্ছে, কোথাও চেন, কোথাও হাতল বসছে। অজস্র মেশিন, অসংখ্য কর্মী। সবাই মাথা নিচু। মুখ গুঁজে যে যার কাজে ব্যস্ত। আগে থেকেই বলা আছে নিশ্চই। মাথা তুলবে না, কথা কম, কাজ বেশি।
জুডিথ বলে, ‘আস্ক দেম, ওরা কোথায় থাকে, কতদূর থেকে আসে...’
আমি চটপট এগিয়ে যাই। বিরাট টানা টেবিলে একের পর এক মেশিন।
‘বাঃ, দারুণ। আপনার নাম কি ভাই?’
চোখ তুলে তাকায় না অল্পবয়েসি ছেলেটি।
পাশ থেকে সুমিত উত্তর দেয়, ‘ও মইদুল’।
‘ও। আচ্ছা মইদুল, আপনি কবে থেকে কাজ করছেন এখানে?’
মইদুলের মেশিন থামে না। ঘটাং ঘট আওয়াজ করে সেলাই চলছে। মইদুল কি কানে শুনতে পায় না?
আবারও সুমিত বলে, ‘এই তো দু’তিন বছর হল’।
জুডিথ বিরক্ত হয়। ‘হোয়াই ইজ হি আনসারিং? প্লিজ লেট দেম স্পিক আউট’।
মইদুলের পাশেই আর একটি ছেলে। কিশোর বয়স। ঘাড় নামিয়ে সেলাই করছে।
‘আপনি এখানে কদ্দিন আছেন ভাই?’
‘ওই একই। দু’তিন বছর’।
আগ বাড়িয়ে প্রতিবার সুমিতের দেওয়া উত্তরে এবার খটকা লাগে। মালিকপক্ষ কি তাহলে কর্মীদের সঙ্গে একেবারেই কথা বলতে দিতে চায় না? জুডিথ স্পষ্টই বিরক্ত। ওরা তো আগে থেকে কথাবার্তা বলেই এসেছে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ব্যাগের কারখানায় সামনাসামনি দেখবে এক-একটি লোভনীয় ব্যাগের পিছনে কাদের শ্রম, কাদের দক্ষতা। তাদের কথা শুনবে। তাদের ছবি তুলবে। তারপর সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করবে এইসব ঘাম-রক্ত-শ্রম-দক্ষতার গালভরা গপ্পো। আমার কাজ শুধু ইন্টারপ্রিটারের। কিন্তু এরা যদি কেউ কোনও কথাই না বলে, আমার কাজ হবে কি করে?
মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়।
‘জুডিথ, উইল ইউ মাইন্ড টু লীভ আস অ্যালোন? আমাকে একটু একা কাজ করতে দেবে? ওরা বোধহয় তোমার সামনে কথা বলতে ঠিক স্বচ্ছন্দ বোধ করছে না’।
জুডিথ সন্দিহান। ‘ইজ ইট সো?’
‘আই থিংক সো। দেখাই যাক না, তুমি সরে গেলে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে কিনা!’
জুডিথ খুব ভরসা করতে পারল বলে মনে হল না। কিন্তু ওর পেশাদার মুখের ভাঁজেও কোথাও অবিশ্বাসের পাশে এক চিলতে আস্থা লুকিয়ে আছে, সেটুকু সামনে রেখেই জুডিথ বলল, ‘ওকে ফাইন। ইউ মে প্রসিড। তুমি কথা বলো। এদের সকলের সঙ্গে কথা বলবে, ওয়ান আফটার অ্যানাদার। দেন উই উইল টক টু ইউ। প্লিজ নোট ইট ডাউন, সবার নাম আর ডিটেল চাই আমাদের। দ্য রিপোর্ট মাস্ট বি ভেরি অথেন্টিক’।
‘ওকে। সিওর। আই উইল ডু মাই লেভেল বেস্ট’।
জুডিথ চলে যায়।
সুমিত আর গণেশ আমার দু’পাশে। ‘কি জানতে চান বলুন’।
আমার তো তেমন কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। আমার কোনও প্রশ্নও নেই। আমি তো মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা দোভাষী। জুডিথ আর মার্ক তাদের কোম্পানি থেকে উড়ে এসেছে এই তৃতীয় বিশ্বে। তাদের প্রশ্নই আমার প্রশ্ন।
এত কৈফিয়ত সুমিত বা গণেশকে আমি দেব কেন?
‘প্রত্যেকের নাম, তাঁরা কত দিন কাজ করছেন এখানে, কত টাকা মজুরি পান, কতদূরে বাড়ি, কোথা থেকে কীভাবে আসেন, এখানে কাজের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা... এই সবটাই। বুঝতেই পারছেন, এটা একটা সার্ভে’।
যথাসম্ভব গম্ভীর হয়েই বলেছিলাম। কিন্তু এই কথায় সুমিতের তো হেসে ওঠার কথা নয়। ও হেসে বলল, ‘ছাড়ুন স্যার। কী হবে? যা মনে হয় বানিয়ে বলে দিন না। এই ত অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার। দেখে নিন। নাম-ঠিকানা সব আছে। এরা কে কতক্ষণ থাকে এখানে, কি কাজ করে। সব রেকর্ড আছে তো!’
‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু এঁরা কেউ কিছু বলবেন না?’
আমার গলায় বিস্ময় না উষ্মা আমি নিজেই বুঝতে পারি না।
‘না স্যার। বলবেন না। বলতে পারবেন না’।
‘কেন’?
‘সেইভাবেই আমাদের ট্রেনিং হয় স্যার। সবার’।
‘ট্রেনিং? কীরকম?’
গণেশ চুপ করে থাকে। সুমিত একবার তাকায় তার দিকে।
‘এটা শুধু ব্যাগ তৈরির কারখানা নয় স্যার। বেসমেন্টে আরও একটা ওয়ার্কশপ আছে’।
একটু অস্বস্তি হয়। আমি এসব জেনে কী করব?
‘আমি তো এসেছি শুধু...’
‘জানি স্যার। আপনি কেন এসেছেন। ওই বিদেশি ম্যাডাম তো নিজে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না, তাই আপনাকে এনেছেন। কিন্তু আপনাকেই বা নতুন কী বলব? নতুন কিছু বলার নেই। এদের নাম-ঠিকানা-মজুরি সব তো দিয়েই দিচ্ছি’।
‘হ্যাঁ, কিন্তু...’
আমার অসহায় অবস্থার কথা শুনতে শুনতেই কখন টেবিলের মেশিন বন্ধ হয়ে গেছে। মইদুল নাম যার, সে চোখ তুলে তাকায়। চোখের মণি ধূসর। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে এবার হাতের কাপড়ের গ্লাভস দুটো খুলছে মইদুল। রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে হাত। ফুলহাতা শার্টের একটা হাতা গোটাতে থাকে। স্পষ্ট লাল পেশি। টকটকে লাল। কোনও আবরণ নেই কোথাও। দেখাদেখি পাশের ছেলেটি, তার পাশের টেবিলে, উলটোদিকে, পিছনে সামনে সমস্ত মানুষ একে একে খুলে ফেলছে তাদের ইউনিফর্মের মতো দেখতে শার্টের বোতাম। কোনও চামড়া নেই তাদের শরীরে। ছাল ছাড়ানো মুরগির মতো শক্ত লাল পেশির আবরণের ওপরেই জামা, ইউনিফর্ম, গ্লাভস। ওদের একটার পর একটা চামড়াবিহীন চেহারা দেখে মাথা ঘুরতে শুরু করে। কেন? এরকম কেন? আমার অস্ফুট প্রশ্নের উত্তরে কিনা জানিনা, সুমিত, ওই কারখানার কোয়ালিটি কন্ট্রোল দেখাশোনা করা ছেলেটি বলতে থাকে, ‘আশ্চর্য হচ্ছেন কেন স্যার? এইরকমই তো হয়। এইরকমই হবার কথা। ওদের চামড়া দিয়েই তো সব তৈরি স্যার। খাঁটি জিনিস, সেরা মাল। নিজেদের চামড়া দিয়ে বানাই বলেই তো এত যত্ন। এত চমৎকার ফিনিশিং। একটা মায়া কাজ করে না! ওরা জান লড়িয়ে কাজ করে, ওদের চামড়ায় তৈরি ব্যাগ বিদেশ চলে যাচ্ছে... ওই বেসমেন্টের ওয়ার্কশপেই প্রসেসিং হয় স্যার, ওটা দেখানো বারণ... তবে স্যার, আপনাকে দেখানোই যায়। আপনি তো আমাদেরই মতো একদম... লেবার ক্লাস... দেখলেই বোঝা যায়...’
জ্ঞান ফেরার পর অনেকক্ষণ বুঝতে পারিনি আমি কোথায়। মায়ের চোখদুটো নজরে পড়ে। বিছানার পাশেই দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ছবি দেখে বুঝতে পারি বাড়িতে আছি।
মোবাইলে সুশীলবাবুর মেসেজ। ‘শুক্র-শনি দিব্যি ডুব দিয়ে দিলে যে! বস ক্ষেপে লাল’।
ডান হাতটা তুলে আনি চোখের সামনে।
নাঃ, আমার চামড়া এখনো অক্ষত।