বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) কী?
নির্বাচন কমিশন (EC) একটি বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Intensive Revision - SIR) চালাচ্ছে ভোটার তালিকার, যাতে “কোনও যোগ্য নাগরিক বাদ না পড়েন এবং কোনও অযোগ্য ব্যক্তি যেন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হন।”
আগে কি এমনটি কখনও হয়েছে?
২০০২ সালে একবার নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন করা হয়েছিল। তবে তখন ভোটারদের কাছ থেকে কোনও প্রমাণপত্র চাওয়া হয়নি।
বিশেষ নিবিড় সংশোধন, SIR-এ নাম অন্তর্ভুক্ত করতে কী প্রয়োজন?
যদি আপনার নাম ২০০২ সালের পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় থাকে, তবে আপনাকে একটি এনুমারেশন ফর্ম (enumeration form) পূরণ করে, নিজের দুটি রঙিন ছবি সহ BLO (Block Level Officer)-এর কাছে জমা দিতে হবে।
যদি আপনার নাম ২০০২ সালের তালিকায় না থাকে, এবং আপনার জন্ম ১৯৮৭ এর আগে হয়,তবে পূরণ করা এনুমারেশন ফর্ম ও দুটি রঙিন ছবির সঙ্গে নিচের যে কোনও একটি নথি জমা দিতে হবে:
১। ভারতীয় পাসপোর্ট
২। জন্ম সনদ
৩। ০১.০৭.১৯৮৭ এর আগে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পরিচয়পত্র
৪। কেন্দ্র/রাজ্য সরকার বা PSU কর্তৃক পরিচয়পত্র/পেনশন পেমেন্ট অর্ডার
৫। স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত মাধ্যমিক বা অন্যান্য শিক্ষাগত সনদপত্র
৬। রাজ্য সরকারের স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দা শংসাপত্র
৭। স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত জাতি শংসাপত্র
৮। NRC শংসাপত্র
৯। রাজ্য বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তুত পারিবারিক নিবন্ধন (Family Register)
১০। বন অধিকার শংসাপত্র (Forest Right Certificate)
১১। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জমি/বাড়ি বরাদ্দের শংসাপত্র
আপনার জন্ম ১৯৮৭ এর পরে হলে তার সঙ্গে আপনার বাবা বা মায়ের ভোটার তালিকায় নাম বা পরিচয় পত্রও জমা করতে হবে।
আধার কার্ড কি গ্রহণযোগ্য নথি?
নির্বাচন কমিশনের মতে, আধার কার্ড পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু SIR-এ নাম অন্তর্ভুক্তির প্রমাণ হিসেবে এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
আমরা উদ্বিগ্ন কেন?
১। পশ্চিমবঙ্গের জন্ম দেশভাগের ফলে। আমাদের মধ্যে অনেকে, বিশেষত আমাদের বাবা-মায়েরা, পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে এসেছেন। এনুমারেশন ফর্মে নিজের উৎপত্তিস্থান (place of origin) লিখতে বলা হচ্ছে। এমনকি কারও নাম যদি ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় থেকেও থাকে, তবুও তাঁকে ফর্ম পূরণ করে নিজের উৎপত্তিস্থান জানাতে হবে।
২। ১৯৮৭ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্য প্রক্রিয়াটি আরও জটিল। নিজের তথ্যের পাশাপাশি বাবা-মায়ের জন্মস্থানও জানাতে হবে। নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তনের ফলে আমাদের নাগরিকত্ব এখন বাবা-মায়ের নাগরিকত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।
৩। সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে পড়ছেন মহিলারা (সবধরনের মহিলা)। বিহারে ১০০০ পুরুষের তুলনায় ভোটার তালিকায় ৯০৭ মহিলা ছিলেন। কিন্তু SIR-এর পর সেই অনুপাত নেমে গেছে ৮৯২-এ।
মহিলারা নানা কারণে স্থান পরিবর্তন করেন, বিবাহ, কাজ (মজুর, যৌনকর্ম, গৃহকর্ম), বাস্তুচ্যুতি, যার ফলে তারা প্রায়ই জন্মতারিখ, জন্মস্থান বা শিক্ষার প্রমাণপত্র রাখতে পারেন না। বিহারে ভোটার তালিকা থেকে পুরুষের তুলনায় দু’গুণ বেশি মহিলাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
৪। ট্রান্স এবং ক্যুয়ার মানুষদের জন্য এই বিপদ আরও গভীর। অনেকেই পারিবারিক বা সামাজিক সহিংসতার কারণে নিজেদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। তাঁদের কাছে জন্ম বা শিক্ষাগত প্রমাণপত্র থাকে না, এবং তাঁরা সেই বাড়িতে ফিরে গিয়ে বাবা-মায়ের নথিও আনতে পারেন না।
অনেক সময় ক্যুয়ার ও ট্রান্সজীবনের প্রতি সমাজের বিদ্বেষের কারণে তাঁদের নথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ফলে পরিচয়, শিক্ষা বা নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও নথিই থাকে না।
৫। অনেক ট্রান্স ব্যক্তির ক্ষেত্রে পুরনো নথি (জন্ম সনদ, শিক্ষার সনদ) তাঁদের বর্তমান নাম বা লিঙ্গের সঙ্গে মেলে না।
৬। অনেক ট্রান্স ব্যক্তির ক্ষেত্রে শারীরিক চেহারার পরিবর্তনের কারণে পুরনো পরিচয়পত্র এখন ব্যবহারযোগ্য নয়।
৭। জবরদস্তি স্থানান্তর (forced migration) ট্রান্স ও ক্যুয়ার মানুষের জীবনের বাস্তবতা—সহিংসতা, বন্যা, ধ্বস, নদীভাঙন ইত্যাদির কারণে তাঁরা বারবার স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। কেবল অল্প কিছু সৌভাগ্যবান ব্যক্তি তাঁদের নথি সংরক্ষণ করতে পারেন। বেশিরভাগ ট্রান্স* মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করেন।
৮। অনেকের কাছে ট্রান্সজেন্ডার আইডি কার্ড রয়েছে, কিন্তু SIR প্রক্রিয়ায় সেটিকে বৈধ নথি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
৯। যেসব ট্রান্স বা ক্যুয়ার ব্যক্তি যৌনকর্মী বা বাস্তুচ্যুত, তাঁদের অনেকেই বাবা-মায়ের নামও মনে করতে পারেন না, বা পারিবারিক উত্তরাধিকারের কোনও প্রমাণ দিতে পারেন না। ছোট বয়সে ঘরছাড়া বা পাচার হওয়ায় তাঁদের কোনওভাবে ‘পারিবারিক বংশপরিচয়’ প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
১০। অনেক ট্রান্স- ক্যুয়ার মানুষ রাস্তার পাশে, কোনও স্থায়ী ঠিকানা ছাড়াই থাকেন। তাঁরা কীভাবে বাসস্থানের প্রমাণ দেবেন?
১১। আমরা জানতে পেরেছি অনেক ট্রান্সমানুষের পরিবার তাঁদের আগেকার নাম দিয়ে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করছেন। পরবর্তী নথিতে যেহেতু তাঁদের পরিবর্তিত নাম আছে, এই ফর্ম তাঁদের আরো বেশি অসুবিধেয় ফেলবে।
১২। গত কয়েক মাস যাবৎ রাজ্যের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার দপ্তর ট্রান্সজেন্ডার কার্ড তৈরী করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁরা চেয়েছেন ভোটার কার্ড , অতএব স্যার নিয়ে আমাদের আশঙ্কা যে সুচিন্তিত, তা বোঝাই যাচ্ছে।
আগে কি এমন ঘটনা ঘটেছে?
হ্যাঁ। ২০১৯ সালে আসামের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC)-তে ২০০০ জন ট্রান্স মহিলা তাঁদের নাগরিকত্ব হারিয়েছেন।
ট্রান্স পুরুষদের মধ্যে কতজন বাদ গিয়েছেন, তার কোনও তথ্য নেই।
বিহারের SIR প্রক্রিয়াতেও কতজন ট্রান্স মানুষ বাদ পড়েছেন তার কোনও সরকারি তথ্য নেই, তবে অনুমান করা যায় সংখ্যাটি বেশ বড়।
SIR কি NRC-র মতোই?
আমাদের আশঙ্কা, “Special Intensive Revision”-এর আড়ালে National Population Register (NPR) এবং পরবর্তীতে National Register of Citizens (NRC) চালু করার পরিকল্পনা হতে পারে পশ্চিমবঙ্গে। যদি ট্রান্স- ক্যুয়ার মানুষদের SIR থেকে বাদ দেওয়া হয়, তবে তাঁরা তাঁদের নাগরিকত্বের অধিকার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন।
ট্রান্স*- কুইয়ার মানুষের জন্য SIR একটি আশংকার পরিবেশ তৈরী করছে!
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ভারতে ট্রান্স* ও ক্যুয়ার ব্যক্তিরা কিছু আইনি স্বীকৃতি পেয়েছেন।
আমরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিকত্বের জন্য লড়াই করছি।
কিন্তু SIR আমাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে আমাদের বহু ধাপ পিছিয়ে দিচ্ছে।
এটি আমাদের কণ্ঠরোধ করছে, প্রতিনিধিকে বেছে নেওয়ার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, এবং আমাদের নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।