যেদিন প্রথম এ হোটেলের তেরো তলাতে ও থাকতে এসেছিল, মাঝরাতে আধোঘুম আধোজাগরণে আলোর এই ছায়াবাজী দেখে হঠাৎ চমকে গেছিল। ভেবেছিল, চাঁদের বুঝি অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তাই তো জানালার শার্সি ভেদ করে ঠিকরে পড়ছে চাকভাঙ্গা জ্যোৎস্নার শ্যামল কুসুম ভেজা আলো ! পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছে, নিরাপত্তা এবং জৌলুসের জন্য অসংখ্য ইলেক্ট্রিক বাল্ব লাগানো হয়েছে। এ আলো সেই আলোরই রাতচরা প্রতিচ্ছবি।
চানুর দেওয়া ফিটনেস এক্সারসাইজ ওয়াচ ওপেন করে দেখলো, রাত তিনটে বেজে পঁচিশ মিনিট। মঙ্গলবারের রাতটা পেরিয়ে গেল। আজ বুধবার। অনার্স শেষবর্ষের শেষ পরীক্ষাটা আজকেই হওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিল পরীক্ষা শেষ করেই বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে বন্ধুরা চলে যাবে দিয়াবাড়ি। মেট্রোরেলের শুরুটা দেখে আসবে। সেই সঙ্গে শীতের উচ্ছন্ন কাশবনে ঘুরে ফিরে কিছু ছবিও তুলে রাখবে। ছাত্রজীবনে এরম দিন তো আর আসবে না।
কিন্তু কি হতে কি হয়ে গেল। ধাই ধাই করে করোনার গজিয়ে ওঠা তালতো ভাই অমিক্রন এসে গেল। পিছু হটে অনির্দিষ্টের ঠিকানায় চলে গেল পরীক্ষা। বিগত কুড়ি, একুশ সালের মতো আবার ওরা সেশন জটের গ্যাঁড়াকলে পড়ে বিহবল বেঘোরে অবাক হয়ে দেখতে পেল, বাজারঘাট শপিংমল জমায়েত ফমায়েত ফটাফট চলছে শুধু ইশকুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর আর কে থামায় !
কষে মাস্ক পরে স্যানিটাইজার বোতল হাতে, করোনাতে মরব, ভাতেও মরব, মরলে মরব, তবু পরীক্ষা নেওয়া হোক বলে ওরা আন্দোলনে নেমে পড়ল ভিসি অফিসের সামনে। বন্ধুদের সঙ্গে প্ল্যাকার্ড হাতে ঘন ঘন শ্লোগান দিলেও শারমিনের মন ভেঙ্গে গেছিল ভবিষ্যতের এমন নিষ্ঠুর অনির্দিষ্টতা দেখে। জমানো পুঁজি তলানিতে এসে ঠেকেছে। কোভিডের ধাক্কায় মুচড়ে পড়েছে অর্থনীতি। চাকরী পাওয়ার কোন আশা নেই। করোনা কিম্বা ক্ষুধায় মৃত্যু সুনিশ্চিত। আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে রুটি রুজির ধান্দায় ও আবার ফিরে এসেছে সমুদ্রঘেরা এই শৈল শহরের নোনাদ্বীপে।
গরীবদের পূঁজিপাটা যেমন ক্ষুদ্র তেমনি দ্রুত সেসব ফুরিয়ে যায়। শারমিনজানে। তাই আর দেরি করেনি। পূর্ব পরিচিত ট্রলার ব্যবসায়ী মাসুদ চানু এবার নরম সরম কিছু শর্ত দিয়ে এই ষ্টার হোটেলে ওকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পুরো মাসের ভাড়া বইবে মাসুদ চানু। আর মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত মাসুদ চানুকে বইবে শারমিন। বাকি দিনগুলোতে শারমিনের যত ইচ্ছা ইনকাম করার পথ ওপেন থাকবে। মাসুদ চানু ঝানু ব্যবসায়ী। ভালই বোঝে, ব্যবসা মানে ব্যবসাই। সোনারূপা, দুধ মালাই অথবা মস্তিষ্ক থেকে দেহ দান যাই হোক, কিছু কিছু কন্ট্রাক্ট ফ্লেক্সিবল রাখতে হয়। তাতে আমদানীতে লাভ বাড়ে, লোকসানের ঝুঁকি থাকে না।
তাছাড়া শিক্ষার্থী এই সাদামাটা মেয়েটিকে চানুর ভাল লেগে গেছে। ভয়ানক মহামারীকে ভয় না পেয়ে বাবা মা ভাইবোনদের বাঁচাতে দেহবাজী রেখে লড়তে নেমেছে মেয়েটি। পুঁজি যাই হোক ; মেয়েটি আর ওর সঙ্গী মেয়েগুলো অনেকটা মাসুদ চানুদের মতো দুঃসাহসী। সাদা ব্যবসার আড়ালে ওরা যে গোটা গোটা অন্ধকার লেনদেন করে, তাতে উপকূলরক্ষী বা সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা খেলে যে কোন সময় জেল জুলুম, গুম খুন, এনকাউন্টারের নামে মৃত্যু কিম্বা নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে। অন্য রকমের ঝুঁকিও থাকে। আভ্যন্তরীণ আধিপত্য বা ভাগ বাঁটোয়ারায় না মিললে সঙ্গীসাথীরা সুযোগ পেলে ফাঁসিয়ে দেয় বা মেরে পাহাড়ের গর্তে পুঁতে রাখে অথবা গভীর সমুদ্রে হাঙ্গরের মুখে ছুঁড়ে মারে।
নিজের জীবন সে তো একটি। কিন্তু এই এক জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকে অনেকগুলো বুভুক্ষু পেট। এদের চোখেমুখে বাঁচার স্বপ্ন দোলে। চানুরা তাই দীর্ঘ উপকূল আর পাহাড়ের সৌন্দর্যের পাশে অসুন্দরের বিষফোঁড়া হয়ে গোপনে কাজকর্ম করে চলে। তাছাড়া এই শিক্ষিত সজ্জন ভদ্র ঘরের মেয়েটিকে আংশিক চুক্তিতে নিজস্ব করে রাখতে পেরেছে বলে ব্যবসা মহলের আলো আঁধারী রাজ্যপাটে চানুর প্রভাব কিছুটা বেড়ে গেছে ! আপাতত কেউ কেউ ভাই বা বস্ বলে উপহাস করলেও অনেকেই জানে সত্যিকারের বস্ হয়ে উঠতে এই পয়েন্টটি আগামী দিনে চানুকে অনেকখানি এগিয়ে রাখবে।
করোনার ফার্ষ্ট সিজনে বেকার হয়ে পড়েছিল শারমিনের বই বাঁধাইকর্মী আব্বা। পড়াশুনার ফাঁকে ও যে পার্টটাইম জবটি করত সেটিও চলে গেছিল। নিরম্বু অনাহারে না থাকলেও ভবিষ্যৎ বলে ওদের কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত গ্রামে ফিরে গেছিল। দুর্ভেদ্য লকডাউন ভেঙ্গে ভেঙ্গে গ্রামে পৌঁছে দেখে, সেখানে আরও অভাব। ঢাকায় ফিরে লকডাউন উপেক্ষা করে বাপভাই কাঁচা তরকারি বিক্রি করতে শুরু করেছিল। এদিক সেদিকের সামান্য কিছু সাহায্য পেয়ে খাওয়া জুটলেও, বাড়ীভাড়া তো দিতে হবে। বাড়ীওয়ালাও যে ওদের মতো দীনহীন। কাজ হারিয়ে তিনিও বেকার। জীর্ণ বাড়ীর ছাদের উপর যে দুটি কামরায় শারমিনরা থাকে সেই ভাড়ায় সংসার চালাতে হচ্ছে সিরাজকাকুকে। ছেলে জুবায়ের মাস্টার্স পড়তে পড়তে একটি চাইনিজ হোটেলের একাউন্টস দেখত। সেটিও এখন নেই। জুবায়েরভাই এখন স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে কাজ করে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তাই বাসায় আসে না। মাঝে মাঝে বাজারসদাই গেটের বাইরে রেখে মোবাইলে বোনদের ডেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনবোনের অই একটি মাত্র ভাই। বাজার হাতে তিনবোনই কাঁদতে থাকে। ছাদের ভাঙ্গা রেলিং জুড়ে মধুমঞ্জুরীর উল্লসিত উল্লম্ফনের আড়াল থেকে ভেজা চোখের জুবায়েরের চোখে চোখ পড়তেই সরে আসে শারমিন। জুবায়ের বোধহয় আবার তাকায়। ওর পিঠে দুটি নরম দৃষ্টির কোমল চাওয়া শিরশির করে ওঠে। রেলিং মুখো হয়ে ওঠে পা। মৃদু হাত নাড়ে। এবার বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জুবায়ের।
কাজের জন্যে জুবায়েরকেও বলেছিল শারমিন। সে সময় স্বল্প ট্রেনিং দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী নিচ্ছিল বিভিন্ন হাসপাতাল। বেতন বড্ড কম। সেবা ? সে তো প্রিটি মানবতা কিন্তু বাড়িভাড়া ?
অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত শান্তার কাছে চলে এসেছিল শারমিন। পুঁজি নিজস্ব দেহপট। ব্যবসা, সেও মনোপলি। এ সমুদ্র শহরের হোটেল থেকে হোটেলে ওদের ব্যবসার বিস্তার। শুরুতে বারোয়ারী মতো ছিল ওরা। মহামারীর ভয়ে ক্লায়েন্ট তেমন ছিলনা। আয় হত খুবই কম। খেয়ে না খেয়ে শারমিন বাড়ীভাড়ার টাকাটা পাঠাতে পারত। অবসরে ফাঁকা সমুদ্রতটে বসে থাকত সবাই। সৈকতে দাপিয়ে বেড়ানো ঘোড়াগুলোর মালিকরা বেকার হয়ে পড়েছিল। দানাপানির অভাবে নেতিয়ে পড়া মরণাপন্ন ঘোড়াগুলোকে দেখে ওরা সেদিন বুঝতে পেরেছিল, করোনায় মরে যাওয়ার ভয় আর আতঙ্কের চাইতে ক্ষুধার কষ্ট অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। ক্ষুধা নির্লজ্জ বেহায়ার মতো ছ্যাবলা এবং অনবরত ‘ও যে মানে না মানা’ র মতো হাত পাততে মানুষকে ভিখেরি করে তুলতে পারলে দেহপসারিণী হতে আর অসুবিধে কি !
মাসুদ চানুর দৌলতে বারোয়ারী লোকদের সঙ্গে ব্যবসা না করে শারমিন এবার লিমিটেড হয়ে উঠেছে। কিছুটা রেষ্ট পাচ্ছে। টাকাপয়সাও জমছে হাতে। সবচে বড় কথা নিরিবিলিতে শুয়ে বসে পড়াশুনা করতে পারছে। ওর আশা বেশি নয়, অনার্স ফাইন্যালে, স্কোর টু পয়েন্ট ফাইভ পেলেও চলবে। তারপর কোন একটি চাকরী পেয়ে গেলে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স থেকে হাল ফ্যাশানের কয়েকটি টার্কিশ বোর্কা কিনে পরতে শুরু করবে। আজকের শারমিন হারিয়ে যাবে দুষ্প্রাপ্য সমুদ্রলতার মতো। কে কবে আর অতিক্রান্ত দুঃসময়ের তসবীহ গুণে জীবন পার করে !
প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মাসুদ চানু চলে আসে বন্ধু সুব্রতকে নিয়ে। সিঙ্গল রুম। ওয়ান বেড। বাড়তি একটি সোফা এবং টি টেবিল মাত্র। আগে অস্বস্তি হত। মাসুদ চানুর সামনে---- এখন স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে শারমিন। চানুর যদি আপত্তি না থাকে তো ওর কি ! দেখুক বসে বসে। প্রেমহীন সম্পর্কে নাচতে নেমে ঘোমটা দিয়ে লাভ নেই। মাস গেলে বাড়ীভাড়াসহ তিনজন মানুষের খরচা পাঠাতে হয়। কম করে হলেও পঁচিশ হাজার টাকা। সুব্রত অবশ্য ফাউ খায় না। বেশীক্ষণ থাকেও না। এগোরাটা নাগাদ চলে গেলে টাকাগুলো ব্যাগে রেখে ফ্রেশ হয়ে আসে শারমিন। চানু ততক্ষণে গ্লাস বানায়। ও শুধু চানুর সঙ্গে পান করে। পানীয়গুলো বিশ্রী স্বাদের। এরচে দু গ্লাস শরবত বা সফট ড্রিংস অনেক টেষ্টি ।
চানু কিছুটা গৃহস্থ পুরুষদের মতো স্নেহশীল চানু। ব্যথা কষ্ট সুবিধা অসুবিধাগুলো নিজের মন থেকে বুঝতে পারে। পিরিয়ডের দিনগুলোতে বরফ, লেবু স্প্রাইট আর ব্লাকসল্ট পাঞ্চ করে ডিলিশাস এক ড্রিংক্স বানিয়ে দেয়। শারমিন জাম্বুরার রস মনে করে ধীরে ধীরে পান করে আর চানুর গাওয়া রবি ঠাকুরের টপ্পা শোনে। এ শহরের দুটো ষ্টেশন ছেড়ে কোন এক পাহাড়ের উপর চানুদের বাড়ী। বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। যে কোন নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ওদের বাড়ির গুরুত্ব চরম। চার পুরুষ আগের বার্মিজ রক্ত ধুয়ে মুছে পিওর বাঙ্গালী হয়ে গেলেও সমুদ্র সম্পর্কিত ব্যবসাটা এখনও টিকিয়ে রেখেছে। চানু ট্রলার ভাড়া দেয়। সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। সুব্রত প্রতি সপ্তাহে চানুর কোন না কোন ট্রলার থেকে উধাও হয়ে যায় । ফিরে আসে দুর্ধর্ষ সাফল্য নিয়ে। তখন উত্তেজিত, অদমিত সুব্রতকে শারমিনের আশ্রয়ে দিয়ে দেয় চানু।
নাইটি পরে ফ্লোরে পা রাখতেই ছ্যাঁত করে ওঠে পা। মধ্য মাঘের ঠান্ডায় হিম হয়ে আছে সাদা টাইলসে বাঁধানো ফ্লোর। সুদৃশ্য একটি কার্পেট এনে দিয়েছিল চানু। শারমিন তুলে রেখেছে। কিছু কিছু ক্লায়েন্ট ফ্লোর পছন্দ করে। যৌনতা উদযাপনের নানা ধরণের ফিকির ফাসুর ফন্দী নিয়ে আসে অধিকাংশ পুরুষ। ও রাজি হয় না। এ ব্যবসায় আসার প্রথমপর্বে শান্তা অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে বলেছিল, মাত্র ত কটা বছর। পৃথিবীর এ অসুখ সেরে গেলে ওরা আবার ফিরে আসবে শিক্ষার্থী হয়ে। আগের মতো জুটিয়ে নিবে সাত আট হাজার টাকার কোন পার্ট টাইম জব। ওদের আব্বারাও তখন বেকার থাকবে না। কোন না কোন কাজ নিশ্চয় খুঁজে পাবে। এসব তো দায়ে ঠেকে করা । এ কাজে নিজেকে একেবারে ডুবিয়ে দিতে নেই। এ অসুখে বেসুমার মানুষ মরলেও পৃথিবী কখনও মানুষ শূন্য হবে না। স্বর্গচ্যুত আদম হাওয়া কি নিঃসন্তান ধরিত্রীকে সন্তানফুলের পূর্ণতায় ভরে দেয়নি ? তবে ? আমরাও দেব। শুধু করোনা পর্ব আর করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক দুঃসময়ে আমাদের বাঁচতে এবং বাঁচাতে হবে রে শাম্মু।
নরম কম্বলে শরীর ঢেকে সোফায় বসে থাকে শারমিন। ঘুম চটকে গেছে। একুশের শেষদিকে করোনার প্রকোপ কমে এলে অনার্স ফাইন্যাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছিল। বেতন জমে প্রায় লাখখানেক হলেও ডিসকাউন্ট দিয়েছিল কলেজ। নিজের বেতন, প্রথমবর্ষ অনার্স পড়া ভাই আর এইচএসসির ফাইন্যাল পরীক্ষার্থী বোনের বেতন, পরীক্ষার ফি কিস্তিতে পরিশোধ করবে এই শর্তে আধাআধি দিতে পেরেছে। তবে ভাইটা একা লড়তে দেয়নি শারমিনকে। ঢাকার কোন এক চালের আড়তে মাসে হাজার পাঁচেক টাকা বেতনের কাজ ধরেছে। মিন্তি যোগালেদের সঙ্গে থাকে, খায়। নিজের খরচ নিজে চালিয়ে কিছু টাকাও পাঠাচ্ছে বাড়িতে। খানিকটা হলেও শারমিনের বোঝা কমে গেছে। বাইশের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ওরা ভেবেছিল, করোনা বুঝি চিরতরে বিদায় নিয়েছে। পরীক্ষা শেষ করে শারমিন আর ফিরবে না এ ব্যবসায়।
মাসুদ চানু নাক ডাকে রাজার ভৃত্যের মত। গর্জনভীত মান্যতায় কাঁচুমাচু শব্দ বেরুচ্ছে ওর নাক থেকে। হাসি পায় শারমিনের। আজকাল পুরুষ মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছে। প্রথম দিকের কয়েকটা মাস অবশ্য যাচ্ছেতাই রকমের ছিল। ইচ্ছের বিরুদ্ধে শরীরকে মালসামানের মতো বিক্রি করার পাশাপাশি পাপ আর শাস্তির নৈতিকতাবোধের দ্বন্দ্ব ওর মনকে সে সময় কুরে কুরে খেয়েছে। নতুন ফসল উঠলে ওদের গ্রামের বাড়ীতে ওয়াজ মাহফিল হত। কত কিসিমের যে হুজুররা আসত তখন। তারা গলা কাঁপিয়ে দৈববাণীর মত ওয়াজে ফরমান শোনাত, আল্লাহর কাছে সমস্ত পাপ ও পাপীর ক্ষমা আছে কিন্তুক জেনাকারীদের কোন ক্ষমা নাই—ক্ষমা নেই- বলুন সবাই নাউজুবিল্লাহ-- -
মাহফিলে নাউজুবিল্লাহ শব্দের কোরাস উঠলে হুজুর এবার সুরে সুর লাগিয়ে বলত, তারা পচবে, পুড়বে, গলে গলে পড়বে তাদের মাংস, চোখ আর স্তনসহ সাধের গোপনাঙ্গ। বিষধর সাপ এসে তাদের সর্বাঙ্গ দংশিবে অনন্তকালের জন্যে ---
কূট প্রশ্ন করার মত বুদ্ধি তখন শারমিনের ছিল না। খুবই সাধারণ মানের ছাত্রী সে। অসংখ্য বানান ভুল হয় বলে শিক্ষকরা ওকে পাতি স্টুডেন্ট হিসেবে ‘জীবনেও কিচ্ছু হবে না’র খাতায় ফেলে রেখেছে। অনার্স থাকলে সরকারী বা বেসরকারী যাই হোক একটি চাকরী পেলে বিয়ের বাজারে ওর স্ট্যাটাস মোটামুটি থাকবে এসব ভেবেই পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু শারমিনের এখন বুদ্ধি খুলেছে। একা একাই বিবেকের কাছে যুক্তির প্রশ্ন তুলে ধরে, স্তন ? সে ত শুধু নারীদের থাকে। তাহলে হুজুর কি কেবল নারীদের কথা বলে গেল ! কেন বলল ? জেনা বা যৌনক্রিয়া তো একা করে সুখ নেই ! সঙ্গে পুরুষ লাগে। তবে কেন শুধু নারীদের কথা বলে হুজুররা ? ওয়াজে কেন পুরুষদের জন্য কোন ফরমান নেই ? পুরুষদের শরীর, চোখ নাক কি চির পূতপবিত্র পরম পূণ্যময় ? নাকি তাদের বেহেশতি দণ্ডটি অসীম ক্ষমতাধর অব্যয় অক্ষয় ?
কিম্বা হয়ত সাপেরও অরুচি ঘৃণ্য সুন্দর অই দন্ড আমিষে !
সোফায় শুয়ে পড়ে শারমিন। জীবনে বিশাল কিছু হওয়ার মতো স্বপ্ন বা সাহস ওর নেই। গ্রামে কমন উঠানের পাশে দেড় শতাংশ জায়গায় থাকার জন্য দুটি ঘর আছে ওদের। জমিজমা না থাকায় আয় রোজগার নেই। শরীক স্বজনদের অবস্থাও একই রকমের। বাড়ীর প্রায় সব পুরুষ আত্মীয়রা বর্গা খাটে, শহরে রিকশা ভ্যান চালায়, তরিতরকারী বিক্রি করে। কিছুটা শিক্ষিতরা প্রাইভেট কার, ট্যাক্সিক্যাব চালায়, গার্মেন্টসে কাজ করে। কাজের ফাঁকে মহিলারাও ক্ষেত খামারে কাজ করে, হাঁসমুরগি গোরু ছাগল বর্গা নেয়। কিন্তু ওর আব্বা এসব পারে না বলে বই বাঁধাইয়ের কাজ করে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন থাকায় চলে এসেছে ঢাকায়। বইপাড়ার কাছে পুরনো এক বাড়ির দুটি কামরা নিয়ে ওরা থাকে। ছুটিছাটায় গ্রামে আসে। সচ্ছলতা না থাকলেও সুখ সুখ কিছু স্বপ্ন ছিল। ট্রিং করে মেসেজ আসার শব্দ হয়। ক্লাশের সবচে তুখোড় লিজা লিখেছে, দোস্তো বগুড়ার এক বড়ভাই তো একখান কাম কইরা ফেলাইছে। ‘দুইবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াইতে চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে এক্কেরে ভাইরাল হয়ে গেছে। এই যে লিঙ্ক পাঠালাম।
হাসে শারমিন। লিজা জানেনা ভাতের জন্যে শারমিন কি করছে। বন্ধুরা জানে পড়াশুনা করতে করিমগঞ্জের বাড়ীতে আছে শারমিন। শান্তাও চলে গেছে জামালপুর। শেষের দুটি সাবজেক্ট ভয়ঙ্কর কঠিন। শান্তির সঙ্গে সুখ না এসে সংঘর্ষ জুড়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। যাচ্ছেতাই রকমের ছ্যাড়াবেড়া তত্ত্ব দিয়ে মত্ত বিষয়টি। কিছুতেই মনে থাকে না। ভরসা পাশের সিটের মৌমিতা। ও খাতা খুলে রাখে বলে শারমিন টুকতে পারে। সাম্যভাইয়া যখন ওদের স্টেট এন্ড গভর্ণমেন্ট বুঝাতে গিয়ে ব্লাকবোর্ডে গভর্নমেন্টের তিনটি বাহু আর তাদের কাজ এঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, শারমিনের মনে হচ্ছিল তিনটি নয়। আদতে সরকারের অনেকগুলো মুখ আর সহস্রাধিক বাহু। তার মধ্য যৌনতা, ঘুষ, টাকা পাচার, পুরুষাঙ্গ, নারীসঙ্গসহ অতৃপ্তি আর সীমাহীন চাহিদার বাহুও রয়েছে।
গেল সপ্তাহে সরকারী অফিসের একজন মধ্যবয়েসি কম্পিউটার সহকারী এসেছিল কাস্টমার হয়ে। শারমিনের স্তন দুহাতে ছানতে ছানতে লোকটি বলেছিল, ছেলেমেয়েকে কানাডা পাঠিয়ে দিয়েছে। টাকা এখন বাতাসে উড়ে। যে কোন ফাইল টাকার পিঠে চড়িয়ে উপরের টেবিলে ওঠানো হয় আবার সেভাবে নামানো হয়। টাকাই পাখনা, টাকাই তৈলাক্ত সিঁড়ি, টাকাই খাদ্য, পরনের কাপড়, পরীক্ষার ফি, মাসের বেতন, বাড়িভাড়া, আব্বার চশমা, আম্মুর স্যান্ডেল, বন্ধুত্বের হুল্লোড় --যে ধরতে পারছে সে চড়চড় করে ধনী হয়ে যাচ্ছে।
জ্বালামুখ থেকে নির্গত ধোঁয়ার মতো সশব্দ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর বুক সেঁচে। ঘুম পাচ্ছে। কোলের ভেতর শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যায়ন বইটি আঁকড়ে ধরে শরীর ছেড়ে দেয় শারমিন। চড়চড় করে ---চড়চড় করে ধনী হয়ে যাচ্ছে, যে ধরতে পারছে চড়চড় করে ---
কলকল হাসি আর পায়ের শব্দ শোনা গেল। শান্তা ওর ক্লায়েন্টকে নিয়ে সমুদ্রের আঁতুড় থেকে মোমআলো সরাতে সরাতে সূর্যোদয় দেখবে বলে ছুটে গেল। এই স্বপ্নটা বুকের গভীরে লুকিয়ে রেখেছে শারমিন। ঘুমের ভেতর মধুমঞ্জরী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। সৈকত জুড়ে ভাঙ্গা রেলিং। বালুর গর্তে আধখানা শরীর ডুবিয়ে শুয়ে আছে ওরা। সমুদ্রের আঁতুড় ভেঙ্গে সূর্য উঠছে--- চচ্চড় করে--- চচ্চড় শব্দে - টাকা উড়ছে -- টাকা ঝরছে--